somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কিডনি বিক্রি করেছে ওরা, তবু স্ত্রীর সম্ভ্রম বিকোয়নি : এটি কি শুধু জয়পুরহাটের চিত্র নাকি সারাদেশের মানুষ এর শিকার?

০৮ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

জয়পুরহাট জেলার কালাই উপজেলার বোড়াই ও বহুতিসহ আশপাশের গ্রামগুলো সবুজে ঘেরা। ছিমছাম পরিবেশ, মানুষগুলোও সহজ-সরল। দারিদ্র্য তাদের আষ্টে-পৃষ্ঠে ঘিরে রেখেছে। ফলে দিনের পর দিন তারা এনজিও থেকে ঋণ নিয়েছে। আবার তা পরিশোধ করতে নিতে হয়েছে অন্য এনজিও থেকে ঋণ। কখনও কখনও দাদন ব্যবসায়িদের দ্বারস্থ হয়েছে। ফলে বোঝা দিন দিন বেড়েই গেছে। ঋণের কিস্তি দিতে না পারায় এনজিওগুলোর যন্ত্রণা সহ্য করতে হয়েছে তাদের। শুধু বাড়ি ঘরের চাল নয়, নিজের স্ত্রীকেও বন্ধক নিতে চেয়েছেন অনেক এনজিও কর্মকর্তা। বাপ-দাদার ভিটেমাটি ছেড়ে পালিয়ে যেতে পারেননি তারা। আবার স্ত্রীকেও তুলে দিতে পারেননি কর্মকর্তাদের হাতে। এমন পরিস্থিতিতে বেশকিছু টাকা একসঙ্গে উপার্জনের সুযোগ তাদের সামনে হাজির হয়। আর তা হল কিডনি বিক্রি। সেই ফাঁদেই ধরা দেয় তারা। একজন থেকে দু’জন-এভাবেই ছড়িয়ে পড়ে এক গ্রাম থেকে পাশের গ্রামে। পুরো উপজেলা জুড়ে। গত ৬ বছরে এই এলাকার অর্ধশত মানুষ বিক্রি করেছেন কিডনি- শোধ করেছেন ঋণের দায়। রক্ষা করেছেন স্ত্রীর সম্ভ্রম। সন্তানের ভবিষ্যত্।

গতকাল বুধবার জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বোড়াই, বহুতি ও বৈরাগীরহাটের আশপাশের এলাকা ঘুরে মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে এসব চিত্র। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে কথা হয়েছে অন্তত এক ডজন কিডনি বিক্রেতার। এদের সবাই ঋণের দায়ে জর্জরিত। ফলে বাধ্য হয়েই বিক্রি করেছেন কিডনি। শুধু দেশে নয়, ভারত ও সিঙ্গাপুরে নিয়ে তাদের কিডনি নেয়া হয়েছে। সবচেয়ে বেশী কিডনি দেয়া হয়েছে ভারতে গিয়ে। চিকিত্সা বিজ্ঞানে কিডনি সংরক্ষণের কোন সুযোগ নেই। তাই কিডনি স্থানান্তরের জন্য সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিকে হাজির করতে হয়। আর কিডনি দেয়ার সুবাদে ভারত বা সিঙ্গাপুরও ঘুরে এসেছেন অনেকে। এখন ওই এলাকায় দেখা দিয়েছে ভয়াবহ স্বাস্থ্যহানি। যারা কিডনি বিক্রি করেছেন তাদের কেউই এখন আর সুস্থ নেই। নানাবিধ রোগব্যাধিতে আক্রান্ত। এমনকি স্ত্রীর সঙ্গে মিলনের শক্তিও হারিয়ে ফেলেছেন অনেকে।

চিকিত্সকরা বলেছেন, কিডনি স্থানান্তর করা হলে অন্তত ৬ মাস নিয়মিত চেকআপের মধ্যে থাকতে হয়। কিন্তু এ কিডনি স্থানান্তরের পর আর চেকআপ করাননি। তাদের দাবী, এমন সুযোগই হয়নি তাদের। হাতে টাকা পেয়ে এক বেলা পেটপুরে খেতেও পারেননি। পুরো টাকাটাই তুলে দিয়েছেন এনজিও কর্মকর্তাদের হাতে। তাতেও পুরো ঋণ শোধ হয়নি এই এলাকার অনেকের।

কালাই উপজেলার বোড়াই গ্রামের ভ্যানচালক আইনুল হক (৩৫)। তিন সন্তানের জনক তিনি। দেড় বছর আগে কিডনি বিক্রি করেছেন মাত্র ১ লাখ ৭০ হাজার টাকায়। কিন্তু তার এনজিওর ঋণ ছিল প্রায় ২ লাখ টাকা। পুরো টাকাটাই তুলে দিয়েছেন এনজিও কর্মকর্তাদের হাতে। তাও পুরো দায়মুক্ত হতে পারেননি। মাঝেমধ্যে হানা দিচ্ছেন এনজিও কর্মকর্তারা। কিন্তু এখন আর কাজ করার শক্তিও নেই তার। ফলে আবারও বাড়ছে ঋণের সুদ। অসহায়ের মত দিন পার করছেন তিনি। সামনে শুধু তার অন্ধকার আর অন্ধকার। এ প্রতিবেদকের সঙ্গে আলাপের সময় ফুটে উঠল তার হতাশার চিত্র। ছেড়ে দিলেন চোখের জল। আস্তে আস্তে বললেন, কিডনিও দিলাম, ঋণও শোধ হলো না, এখন ধুঁকে ধুঁকে মরছি।

কালাই’-এর বেরেন্ডি গ্রামের জাহান আলম (৫৫)। ছেলে নেহেরুল (২৮) ও তার স্ত্রী সেলিনা (২৫) এবং অপর ছেলে সাহারুল (২৫)। চারজনই কিডনি বিক্রি করেছে। এরা প্রত্যেক কিডনির দাম হিসেবে পেয়েছেন ২ লাখ ২০ হাজার টাকা করে। নেহেরুল এ প্রতিবেদককে বললেন, তিন লাখের উপর তার ঋণ ছিল। পুরো টাকাটাই তুলে দিয়েছেন একটি নামকরা এনজিওর ওই কর্মকর্তার হাতে। এখন আবার ঋণের কিস্তির জন্য হুমকি-ধামকি দিচ্ছে। কি করবেন তিনি। পুরো পরিবারের সবাই অসুস্থ হয়ে পড়েছেন। চিকিত্সা করার টাকাও নেই। শুধু এই পরিবার নয়, বহুতির মাছ ব্যবসায়ী এক সন্তানের জনক সেকেন্দার (২৮), কিডনি বিক্রি করে পেয়েছেন দুই লাখ টাকা। রাঘবপুরের আফজাল (২৮) পেয়েছেন দেড় লাখ টাকা। বগুড়ার শিবগঞ্জের কামরুল রাঘবপুরে মামা বাড়িতে থাকতেন। তিনিও কিডনি বিক্রি করেছেন। পুরো এলাকার চিত্র একই ধরনের।

সমপ্রতি পত্র-পত্রিকায় এ নিয়ে রিপোর্ট ছাপা হলে নড়ে-চড়ে বসে প্রশাসন। গ্রেফতারও করে ৫ জনকে। তবে মূল হোতা তারেক আজিম ওরফে বাবুল চৌধুরী বাবুল এখনও গ্রেফতার হয়নি। নোয়াখালির বেগমগঞ্জ উপজেলার ছোট হোসেনপুর গ্রামের তার বাড়ি। বাবার নাম আব্বাস আলী। ঢাকায় তার দু’টি গার্মেন্টস ও একটি ট্রাভেল এজেন্সি আছে। সে দীর্ঘদিন ধরে কিডনি ব্যবসা করে। ক্রেতাদের কাছ থেকে তিনি একটি কিডনি বাবদ ৫ থেকে ৭ লাখ টাকা নিলেও বিক্রেতারা পান ১ থেকে ২ লাখ টাকা। তবে বাবুলের মূল সহযোগী সাইফুল ইসলাম দাউদকে (৪২) গ্রেফতার করেছে বাগেরহাট পুলিশ। তার বাড়ি বাগেরহাটের মোল্লারহাটের মোল্লারকুল গ্রামে। ঢাকায় টঙ্গিতে থাকতেন। এখন দাউদ কোটি টাকার মালিক। অন্য যারা গ্রেফতার হয়েছে তারা হলেন— জয়পুরহাটের কালাই উপজেলার বহুতি গ্রামের আবদুস সাত্তার, গোলাম মোস্তফা, আবদুল করিম ও মোশাররফ হোসেন। এর মধ্যে মোশারফ বর্তমানে জেলে। আর দাউদকে গতকাল বাগেরহাট পুলিশ কালাই উপজেলা পুলিশের কাছে সোপর্দ করেছে। অপর তিনজনকে গতকাল দুই দিন করে রিমান্ডে নিয়েছে কালাই থানা পুলিশ। পুলিশ বলছে, এই এলাকায় একডজনেরও বেশি দালাল রয়েছে।

এলাকার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ঢাকার সরকারী ও বেসরকারী হাসপাতালে খোঁজ-খবর রাখেন কিডনি কেনা-বেচা করার দালালরা। কারো কিডনির প্রয়োজন হলে এরাই মধ্যস্থতা করে কিডনি নিয়ে দেয়। দালালরা আগেই রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা করে রাখে। যার যে গ্রুপের কিডনি প্রয়োজন তার কাছে সংশ্লিষ্ট রক্তের গ্রুপের কিডনি বিক্রেতাকে হাজির করা হয়। এই দালালদের এখন খুঁজছে পুলিশ। কিডনি বিক্রির ঘটনায় গত ২৯ আগষ্ট কালাই থানায় মামলা হয়েছে। মামলার বাদি কালাই থানার এসআই নিবেন্দ নাথ। এ পর্যন্ত ৫ জন গ্রেফতার হয়েছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা কালাই থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) ফজলুল করিম। তিনি বলেন, কিডনি বিক্রেতাদের সহযোগিতা করার জন্য স্বাস্থ্য ক্যাম্প করা হয়েছে। এখন সচেতনতা বৃদ্ধির কাজ চলছে। আর পুলিশ সুপার মোজাম্মেল হক বলেছেন, জড়িতদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে। আসামিদের গ্রেফতার করার চেষ্টা চলছে। তিনি বলেন, যারা কিডনি দিয়েছে তাদের পুনর্বাসনের কাজ চলছে।
Click This Link
১৪টি মন্তব্য ২টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

=কবিতাগুলো যেনো এক একটি মধুমঞ্জুরী ফুল=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ১৩ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:২০



©কাজী ফাতেমা ছবি
মনের মাধুরী মিশিয়ে যে কবিতা লিখি
কবিতাগুলো যেনো আমার এক একটি মঞ্জুরী লতা ফুল,
মনের ডালে ডালে রঙবাহারী রূপ নিয়ে
ঝুলে থাকে কবিতা দিবানিশি
যে কবিতার সাথে নিত্য বাস,
তাদের আমি... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে দেখা - ১৩ মে

লিখেছেন জোবাইর, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:০৩

১৩ মে ২০০৬


দমননীতির অদ্ভুত কৌশল
সরকার নির্বাচনকে সামনে রেখে বিরোধী দলের ওপর দমন নীতির আশ্রয় নেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। দ্রুত বিচার আইন ও পুলিশ প্রশাসনকে ব্যবহার করে দমন... ...বাকিটুকু পড়ুন

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

×