যুবকের দীর্ঘশ্বাস আর চৈত্রের মাতাল পবন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে। কি অদ্ভুত মিল শব্দে আর ছন্দে! এই ধরণী দূরে থাক, যুবক নিজেই বুঝতে পারে না কোনটি তার সৃষ্ট শ্বাস।এ কেবল এই যুবকের বেলাতেই ঘটছে বোধহয়, বিকৃত জীবনের অসহায় অথচ দাম্ভিক যুবক।। শেষ কোন বসন্তে উপভোগ করেছে প্রকৃতি আর নিজের অস্তিত্বকে তা ভুলেই গেছে যুবক। তার হৃৎপিন্ড আর ফুসফুস গলে আজ বসন্ত বায়ু বয়!! কি অদ্ভুত এই জীবন, এই নিয়তি।।
আজ হঠাৎ বড্ড বেশি অভিমানী হতে ইচ্ছে করছে তার, বাসন্তি শাড়ির সেই কিশোরীর প্রতি অভিমান। কি বোকা! সে কবেকার কথা- ঝাপসা এক বসন্তের কিছুক্ষণ। তবু আজ যুবক সেই অচেনা কিশোরীর প্রতি তার সকল অভিমান ঢেলে দিতে চায়। কিন্তু শুষ্ক মনে কোন ভাবেই সেই কিশোরীর কোমল হাসিকে ঠাঁয় দিতে পারছে না। দীর্ঘশ্বাসে উড়ে যাচ্ছে কিশোরীর স্মৃতি।। সবকিছু ধোঁয়া আর বাষ্পে পরিণত হয়ে পড়ছে, ধরাছোয়ার বাইরে...কিছুতেই অভিমান করতে পারছে না যুবক।অভিমান করার ক্ষমতা সে হারিয়ে ফেলেছে, ঠিক কখন তা সে উদ্ধার করার চেষ্টা করল না। হয়ত সেদিন থেকে তিলেতিলে হারিয়ে ফেলেছে, ঠিক যেদিন থেকে নিজের হাতে ক্ষত করেছে নিজের স্বত্ত্বা।।
ভাবতে ভাবতে চোখ বুঁজে ফেলল যুবক। শূণ্যে ঘুড়ে বেড়ালো কিছুক্ষণ। এ এক অন্যরকম শূণ্যতা, এতে অমাবস্যার আঁধার নেই, আবার জোস্ন্যৎনার ঝিলিমিলি চাঁদও নেই। আজকের আধপেটা চাঁদটাও সঙ্গী হয়নি তার।।
চোখ মেলে সেই বিস্বাদ শূণ্যতাকে তাড়ানোর পায়তারা করতে থাকল সে। তার খুব দুঃখী হতে ইচ্ছে করছে, কলেজের পথে প্রতিদিন দেখা সেই অন্ধ বৃদ্ধ ভিক্ষুকের দুঃখে...প্রতিদিন তাকে পথে অতিক্রম করেও যে দুঃখের কমতি হতো না, সেই দুঃখে।। কিন্তু বধির মন দুঃখ প্রলাপ শুনতে পায় না আজ। শত শত কাতর মানুষের গোঙ্গানীও আজ স্পর্শ করে না তাকে। হয়ত সেইদিনই তার মনের বধিরতা চূড়ান্ত রূপ নিয়েছে যেদিন নির্যাতিতের পেটে লাথি মারার জোর এসেছে পায়ে...
দামি পোশাক পড়া দেহটাকে আর একটু হলেই উড়িয়ে নিত দমকা বাতাস। বেশ অপ্রস্তুত ভাবেই নিজেকে সামলে নিল যুবক, টলতে থাকা মাতালের মতন।। এবার যুবক শেষ চেষ্টা করবে অনুভূতি ফিরে পাবার... এবার একটু আনন্দিত হতে চায় সে। স্মৃতির পাতা উল্টাতে উল্টাতে খুঁজে পেল বিশ্ববিদ্যালয়ের কোন এক আড্ডার আসর। কি নির্মল আনন্দ ছিল তাতে! কত পরিচিত মুখ সেই আসরে, কত মুক্তাঝড়ানো হাসিমুখ! যুবক মনে প্রাণে চাইল সেই আনন্দে আজ ভাগিদার হতে।কিন্তু তাতেও সে অপারগ। আনন্দ, উল্লাস...কেমন হয় অনুভূতিগুলো?? সে কোনভাবেই অনুভব করতে পারল না। মনে হল জীবনের সেই আনন্দ ছিল বুঝি মুখস্থ বুলির মতন, সময়ের সাথে সাথে যার শব্দগুলো হারিয়ে যায়। তবে কবে সে তার আনন্দবুলি হারিয়ে ফেলেছিল মনে নেই যুবকের। হয়ত সেদিন, যেদিন বন্ধু অবিশ্বাসী চোখে তাকিয়ে ছিল অপলক, যুবকের বিশ্বাসঘাতকতা দেখে।।
নাহ! যুবকের এই জীবন বড্ড তেঁতো মনে হয় ইদানিং... আবেগহীন, সম্পর্কহীন জীবন। অদ্ভুত ছুটে চলার নেশায় কবে কোথায় সবাইকে, সবকিছুকে হারিয়ে ফেলেছে সে তার সঠিক হিসেব মেলানো ভার! হিসেব মেলানোর প্রয়োজনীয়তাও তেমন নেই আজ, সব হারিয়ে আজ সে নিঃস্ব। বাস্তবতা আজ বড় বেশি ভারি বোঝার মতন লাগে।।
ভাবতে ভাবতে ঝাপসা দৃষ্টিতে নিচে তাকালো যুবক...রাতের ব্যস্ত শহর।। বেশ খানিকটা উঁচুতে এক ওভারব্রিজের উপর কিনারা ঘেষে দাঁড়িয়ে আছে গন্তব্যহীন যুবক।নিজেকে তার বেশ হালকা মনে হতে লাগলো।মনে হতে লাগল পৃথিবী তাকে তার আদিম আকর্ষণে টানছে। নিমিষেই সে তলিয়ে পড়তে পারে নিচের ব্যস্ত শহরের রাস্তায়, গাড়ি ঘোড়ার ভিরে... পালকের মতন শরীরটাকে ছেড়ে দিল সে।। তবে চৈত্রের হাওয়ায় উড়ে যাক সে, উড়ে যাক তার হারিয়ে যাওয়া ভালবাসা, দুঃখ, ঘৃণা আর আনন্দের সাথে......
চোখ বুঁজে নিজেকে প্রায় ঠেলে ফেলে দিতে গিয়েও আঁকড়ে ধরে ফেলল ওভারব্রিজের রেলিং। হাঁপাতে হাঁপাতে চোখ মেলল সে।। কয়েক সেকেন্ডের জন্য যেন ঘুরে এলো মৃত্যুপুরের দরজা থেকে, কিন্তু তাতে প্রবেশের সাহস হলো না।দরদর করে ঘামতে থাকা শরীরটাকে এত সহজে হারাতে চায় না তার স্থবির মন।ঘন শ্বাস যেন এবার চৈত্রের পবনকেও হার মানাবে।। পকেট থেকে কম্পিত হস্তে রুমাল বের করল যুবক। হতচকিতের মত হঠাৎ জাগ্রত যুবক পলকে দেখতে পেল অন্য এক জীবনের চিত্র। চোখের সামনে ভেসে উঠল মাইলের পর মাইল সবুজ ধানক্ষেত, নির্মেঘ নীল আকাশ, বহতা নদী... খিলখিল করে হাসতে থাকা ছোট বোনের মুখ... যুবক কোন ঠাঁয় খুঁজে পায় না।। জীবন যেন লাস্যে বুঝিয়ে দিয়ে গেল তাকে- নিজেকে হারিয়ে ফেলা সহজ, তবে হারিয়ে যাওয়া সহজ নয়...
যুবক অপরাধী কিশোরের মতন আঝোরে কাঁদতে লাগল। আজ আকে আগলে ধরার কেউ নেই।তবুও যুবক কাঁদতে থাকে... হয়ত কোন এক আত্মীয়ের অপেক্ষায়...