somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বিবর্ণ ঈদ

০৫ ই সেপ্টেম্বর, ২০১১ দুপুর ১২:৫৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আজ ঈদ। আয়নার সামনে বসে আছে সমাপ্তি। খুব যত্ন করে চোখে কাজল দিচ্ছে। এমনিতেই ওর চোখ দুটো বড় আর টানা টানা। গাঢ় কালো কাজল দেবার পর মনে হয় ওদুটো যেন চোখ নয়, ডানামেলা দুটো প্রজাপতি! কিযে অদ্ভুত সুন্দর লাগে! সমাপ্তির অবশ্য সেরকম কিছুই মনে হয় না। বরং, এত বড় চোখের জন্য বিরক্ত লাগে! আয়নায় তাকালেই মনে হয়, একটা পেতনী তাকিয়ে আছে ওর দিকে। ছোট্ট একটা দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে টেবিলের ড্রয়ার খুলে লিপস্টিক খুঁজলো। নাহ! টকটকে লাল ছাড়া আর কোন লিপস্টিক নেই ড্রয়ারে। লাল লপস্টিক দিতে সমাপ্তির একদম ভাল লাগে না। কিন্তু রাবেয়া খালার হুকুম, লাল লিপস্টিকই দিতে হবে সবাইকে!!

ঘর ছেড়ে বের হল সমাপ্তি, এদিক ওদিক তাকিয়ে দেখল কেউ আছে কিনা। তারপর চুপি চুপি এগিয়ে গেল সিঁড়ির দিকে। মন খারাপ থাকলে এমনটাই করে সমাপ্তি। সোজা চলে যায় ছাদে। কিন্তু, রাবেয়া খালার হুকুম আছে, কেউ ছাদে উঠতে পারবে না! হুকুম অমান্য করায়, সমাপ্তি কত যে মার খেয়েছে রাবেয়া খালার! তবু, ছাদে যাওয়া ছাড়েনি…

ছাদের দক্ষিণ কোণে আম গাছের মগডালটা ঝুঁকে পরেছে। ঐ জায়গাটা সমাপ্তির খুব প্রিয়! দেয়ালের উপর বসে দিগন্তের দিকে অপলক তাকিয়ে থাকে। আজ এত কষ্ট হচ্ছে কেন ওর! বুকটা ভেঙ্গে আসছে। কতগুলো ঈদ এখানে কাটিয়েছে ও! তবু কেন আজ শুধু অতীতের কথাই মনে ভাসছে!

পাঁচ বোনের মাঝে সমাপ্তি ছিল সবার ছোট। লোকে বলত, ছেলের আশায় এতগুলো সন্তান নিয়েছিল তার বাবা-মা। টানা চার চারটি মেয়ের জন্মের পর বছর খানেক বিরতি দিয়ে আবার গর্ভবতী হয়েছিল মা। কিন্তু তবু ছেলের দেখা নেই। জন্ম হল – সমাপ্তির। তাই বাবা-মা নাকি সন্তান নেয়ার সমাপ্তি টেনেছিলেন সমাপ্তির মাধ্যমেই। সবার ছোট হওয়াতে সকলের আদর যেমন পেত ও, তেমনি ওর স্বাধীনতাও ছিল অগ্রজ বোনদের থেকে বেশি। বাবা ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন। কড়া ছিল তার অনুশাসন। বড় বোনদের লেখাপড়া তেমন এগোয়নি, অল্প বয়সেই বিয়ে দিয়ে চার মেয়েকেই পার করেছিলেন বাবা। কিন্তু, সমাপ্তির বেলায় ব্যাতিক্রম ঘটল। লেখাপড়ায় আগ্রহ আর বরাবর ভাল ফলাফল করায়, সমাপ্তির বাবা শেষ কন্যা কে নিয়ে ভিন্ন চিন্তা করলেন – মেয়েকে উচ্চ শিক্ষিত করার স্বপ্ন দেখলেন। উপর দিয়ে কড়া ভাব দেখালেও মেয়ের সকল আবদারই তিনি রাখতেন।

বাবাকে তাই ভয় পেলেও ভীষণ ভালবাসত সমাপ্তি। ভাল ফলাফল করে বাবার মুখ উজ্জ্বল করার কথা ভাবত সবসময়। কিন্তু হঠাৎ কি যে হল! নবম শ্রেনীতে উঠেই মনটা কেমন উড়ু উড়ু করতে থাকল। আর করবেই বা না কেন? গ্রামের ছুঁড়ি,বুড়ি থেকে শুরু করে সক্কলে কেবল সমাপ্তির রূপের প্রসংশা করত। আর ওপাড়ার কাসুদা সেইযে সপ্তম শ্রেনী থেকে পিছে লেগেছিল, কাঁঠালের আঠাও যেন হার মেনেছিল ওনার কাছে। প্রথম প্রথম সমাপ্তি ওনাকে দেখে ভয়ই পেত। স্কুলে যাবার পথে কেমন ভুঁই করে ঝোঁপের আঁড়াল থেকে বেরিয়ে সামনে এসে পথ আটকে দাঁড়াত কাসুদা। গায়ে পরে কথা বলতে চাইত। পাছে ওর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায়, সেই ভয়ে বাড়িতে বলতেও পারত না সমাপ্তি। লুকিয়ে লুকিয়ে খালি কাঁদত! কিন্তু, যত দিন যেতে লাগল, ওর সখীরা ওকে সাহস দিতে লাগল। সত্যি বলতে কি, কাসুদার ব্যাপারটা নিয়ে সমাপ্তি আতঙ্কিত থাকলেও ওর বান্ধবীরা খুবই উপভোগ করত। আসমা তো একবার বলেই ফেলল, আহা! আমি যদি তোর জায়গায় হতাম, কবে কাসুদা কে হ্যাঁ বলে দিতাম! ওমন ভাল ছেলে কি আর হয়?

কাসুদা দেখতে খারাপ না, উঁচা লম্বা! গায়ের রঙ উজ্জ্বল শ্যামা। মাথা ভর্তি ঝাঁকরা চুল! শহরে নাকি লেখাপড়া করত। শহরে পড়লে হবে কি, গ্রামেই পরে থাকত কাসুদা। বান্ধবীরা বলত, সমাপ্তির জন্যই নাকি গ্রামে পরে থাকে কাসুদা। আর কাসুদা বলত, শহরের পড়ালেখার ভাবই আলাদা। প্রতিদিন অত উপস্থিত থাকা লাগে না, পরীক্ষার সময় উপস্থিত থাকলেই হয়! ধীরে ধীরে এক কথা, দুকথা বলতে বলতে সমাপ্তি যেন আচ্ছন্ন হয়ে গেল… শয়নে, স্বপনে, পড়ার টেবিলে সর্বত্রই শুধু কাসুদা!

পড়ালেখা গোল্লায় গেল। জানাজানি হয়ে গেল বাড়িতেও। সমাপ্তির বাবা তো রেগে আগুন! পারলে মেয়েকে তখনি গুলি করে মারেন! যেজন্য তিনি মেয়েদের এত লেখাপড়া শেখাতে নারাজ ছিলেন, আজ পড়তে পাঠিয়ে তাই হল! মেয়ে উচ্ছন্নে গেল! সমাপ্তির স্কুলে যাওয়া বন্ধ হয়ে গেল। তড়িঘড়ি করে মেয়েকে বিয়ে দিতে চাইলেন আকবর সাহেব। কোথা থেকে পাত্রও যোগাড় হয়ে গেল। পাত্র দুই গ্রাম পরের গ্রামে থাকে, শহরে ইঞ্জিনীয়ারীং পড়ে, বাড়ির অবস্থাও ভাল। কিন্তু, ওসবে কান নেই সমাপ্তির। এক রাত্রে মায়ের জমানো টাকাগুলো নিয়ে পালিয়ে গেল কাসুদার সাথে।

সেই প্রথম ট্রেনে চেপে শহরে এসেছিল সমাপ্তি। ওরা বিয়ে করেছিল। তারপর বিকেল পর্যন্ত সারা শহর ঘুরে কাসুদা ওকে নিয়ে এল গাছ গাছালি ঘেরা গা ছমছম করা এই একতলা পাকা বাড়িতে। এটা নাকি কাসুদার কেমন খালার বাড়ি। খালার স্বামী বেঁচে নাই, তাই বাড়ির অধিকাংশ ঘরই ভাড়া দিয়েছেন। ভাড়ার টাকায় তিনি চলেন। ভাড়াটিয়ারা সকলেই মেয়ে, তাদের কেউ আশপাশের কলেজে পড়ে, কেউ কেউ নাকি চাকুরীও করে। এখানে সমাপ্তি নিরাপদেই থাকতে পারবে। সমাপ্তি এমনটাই জেনেছিল সেদিন।

কাসুদা নাকি রাবেয়া খালার ছেলের মতন। তাই রাবেয়া খালা সেদিন খুব আদর করে বরণ করেছিলেন সমাপ্তিকে। রাতের খাওয়া দাওয়া শেষে খালা ওদের একটা ঘরে পাঠিয়ে দিলেন। এখন থেকে এটাই নাকি সমাপ্তির ঘর! ওকে কোন ভাড়াও দিতে হবে না! ঘরে ঢুকে স্বস্তির একটা নিঃশ্বাস ফেলল সমাপ্তি। আহ! কি পরিপাটি করে সাজানো ঘরটি। যদিও আসবাব তেমন নেই। ক্লান্ত সমাপ্তি বিছানা দেখেই গা এলিয়ে দিল। সঙ্গে সঙ্গে কাসুদাও ঝাঁপিয়ে পরল! স্বামীর অধিকার নিয়ে নাকি ভালবাসার সাগর নিয়ে তা বোঝার মত অবস্থা তখন সমাপ্তির ছিল না। সারা রাতের তান্ডবের পর সমাপ্তি যখন গভীর ঘুমে অচেতন, কাসুদা কাজে যাচ্ছে বলে বেরিয়ে গিয়েছিল।

সারাটা দিন কাসুদার অপেক্ষায় কাটালো সমাপ্তি। রাবেয়া খালাকে জিজ্ঞেস করলেই শুধু মুখ টিপে হাসেন আর কটু মন্তব্য করেন। লজ্জায় সমাপ্তি কথা বাড়ায় না। সারাদিন রাবেয়া খালা ওর খুব যত্ন করেন। রাত বাড়লে ওকে ঘরে গিয়ে ঘুমাতে বলেন। কাসুদা এলে ঘরে পাঠিয়ে দিবেন বলে আস্বস্তও করেন। ঘরে এসে ঘুমিয়েই গিয়েছিল সমাপ্তি। হঠাৎ গায়ের উপর স্পর্শ পেয়ে ঘুম ভাঙ্গে ওর। ভাবে, কাসুদা ফিরে এসেছে। খুশি হয়ে গলা জড়িয়ে ধরে। কিন্তু একি!! এ তো কাসুদা নয়!! চমকে ওঠে সমাপ্তি!! দ্রুত আলো জ্বালায়! চোখের সামনে জন্তুর মত দাঁড়িয়ে উলঙ্গ এক পুরুষ! হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পরে সমাপ্তির উপর! ছিঁড়ে খুড়ে খায় ওর মাংস, শুষে নেয় সমস্ত রক্ত! সমাপ্তির বুকফাটা আর্তনাদ, চিৎকার কেউই শুনতে পায় না। কাসুদা আর কোনদিন আসেনি ওবাড়িতে, অথচ কাসুদার রূপ ধরে প্রতি রাতেই এসেছে নতুন নতুন জানোয়ার…

- ঐ ছেমড়ি! হারারজাদী!! ছাদে আইতে মানা করছি না! বেশি ত্যাল হইছে শইল্যে? ছাদে আইয়্যা ঢং করস?? ওদিকে কাস্টমার আইয়্যা বইয়্যা থাকে! যা! হারামী নিচে যা! ঈদের বখশিস যদি উডাইতে না পারস তয় দেহিস!

চুলের মুঠি ধরে রাবেয়া খালা সমাপ্তিকে নিয়ে যায় সিঁড়ির দিকে। অশ্রু ভরা সমাপ্তির ঝাঁপসা চোখে ভাসে ফেলে আসা জীবনের ঈদ! মায়ের হাতের সেমাই, দুলাভাইদের ঈদ সালামি, আরো কতনা মধুর স্মৃতি…
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×