somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

অপরিচিত

২৯ শে আগস্ট, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

"এই যে,একটু সরে বসেন না ।"লোকটাকে কখন থেকে বলে চলেছি । না,সে সরবে না । গোঁ ধরে সিটি বাসের দুটো সিট দখলে নিয়ে বসে আছে । এদিকে মানুষের চাপে আমার অবস্থা কেরোসিন । শেষে লোকটাকে কোনমতে ঠেলেঠুলে তার বাঁয়ের সিটের এক চিলতে জায়গা দখল করলাম । তখন থেকেই দেখছি লোকটা জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে আছে । আবেদন অগ্রাহ্য করার কৌশল হতে পারে ! থাক,বজ্জাতটার দিকে তাকিয়ে লাভ নেই । তবু কেন যেন উত্‍সুক দৃষ্টি তার দিকেই যেতে লাগল । হঠাত্‍ ঘাড় ফেরালেন । একটু বিব্রত মনে হল তাকে । আমিও হলাম বৈকি !

"দেখেন দেখি,বেয়াক্কেলের মত সিট দখল করে বসে আছি !"বলেই ডানে চাপলেন । এবার আরাম করে বসলাম । নাঃ,লোকটা ভদ্র আছে !
"কৈ নামবেন ?"জিজ্ঞেস করল লোকটা ।
"বহদ্দারহাট।আপনি?"
"আমিও বহদ্দারহাট।"
"কী কাজে বলা যায় ?"
"কেন নয় ? বাড়ি যাব,টার্মিনাল থেকে বড় গাড়িতে উঠে সোজা সাতকানিয়া ।"একটানা বলে দম ফেললেন !
"আরে,আমিও তো সাতকানিয়া যাব।যাক ভালই হল,একসাথে কথা বলতে বলতে যাওয়া যাবে।"ফুলটাইম সঙ্গী পেয়ে ভালই লাগছে।

দুজনেই বহদ্দারহাটে নামলাম । তিনি আমার হাত ধরে টেনে শাহআমিন কাউন্টারে নিয়ে গেলেন ।
"দুইটা কেরাণীহাটের টিকেট দেন দেখি।"আমার দিকে তাকিয়ে আবার বললেন,"কেরাণীহাটেই তো নামবে,না?"আপনি থেকে তুমি ! অসুবিধা নেই,আমার থেকে বয়সে অনেক বড়,ষাট-পঁয়ষট্টি তো হবেই । হাসিমুখেই বললাম,"হ্যাঁ"।আরে,আমার টিকেটের টাকাও তিনি দিয়ে দিলেন ।
"আরে,আরে!করছেন কী ?"
"কিছুনা।তুমি আমার ছেলের মত,তোমার জন্য ৬০ টাকা খরচ করলে কিচ্ছু হবে না।"
"তা হবেনা।কিন্তু..."
"কোন কিন্তু না,টিকেট নিয়ে উঠে বস,আমি আসছি।"আমি কথা না বাড়িয়ে বাসে উঠে টিকেট দেখে সিটে বসলাম ।

একটু পর দুটি জ্যুসের বোতল আর দুটি ছোট বিস্কুটের প্যাকেট নিয়ে তিনি এলেন । আমাকে একটা বোতল আর প্যাকেট দিতে চাইলেন । আমি নিতে চাইলাম না,আর যাই হোক,তিনি এখনো একজন অপরিচিত ব্যাক্তি । তিনি বোধহয় আমার মনের ভাব বুঝতে পারলেন । তিনি আমাকে যেকোন একটি বোতল আর প্যাকেট নিতে বললেন । বুদ্ধি খারাপ না ! নিলাম । বাস চলতে শুরু করল ।

"নাম কি তোমার ?"
"সোহাগ"
"কে দিয়েছে নামটা ?"
"বাবা।মা বলেছে,বাবার নাকি প্রথম সন্তান হিসেবে ছেলের খুব শখ ছিল।প্রবাসে যাওয়ার আগেই নামটা দিয়ে গেছেন।"
"কেন?তোমার বাবাকে তুমি দেখনি?"
"না।বাবা চাকরির খোঁজে দুবাই গিয়েছিল।কিন্তু এর পর আর কোন খবর দেননি।কিছুদিন আগে বাবা ওখানে মারা যান।তারা প্লেনে লাশ পাঠিয়ে দিয়েছে।"
"তারা বলতে?"
"বাবা যেখানে চাকরি করত।"
"তারপর?"
"গতকাল চাচারা বাবার লাশ আনতে ঢাকা গেছেন।লাশ নিয়ে বাড়ি আসবেন।(ঘড়ি দেখে)এতক্ষণে চলে আসার কথা।বাবাকে প্রথম ও শেষবারের মত দেখতে যাচ্ছি।"চোখের কোণে পানি এল,এমন একজনের জন্য,যাকে আমি আজো দেখিনি !
"কি দুঃখজনক!তোমার মা আর বিয়ে করেননি?"
"না।তিনি সারাটি জীবন আমার বাবার আশায় কাটিয়ে দিয়েছেন।চাচাদের বিয়ে দিয়েছেন।বাবার সব দায়িত্ব পালন করেছেন।"
"তোমার মা এত দায়িত্বশীল!অসাধারণ!"

গাড়ি বেশ কতদূর চলে এসেছে ।আশপাশে দোকানপাট দেখছি না,নাহলে এলাকাটা চিনতাম । থাক ।
"আপনার পরিচয় জানা হল না ।"
"আমি যাচ্ছি আমার বাড়িতে।আজ আমার ছেলে আসবে।আমি ওখানে সাইকেল পার্টসের ব্যবসা করি।ব্যবসার কাজে শহরে গিয়েছিলাম।ছেলে আসবে,তাই কাজ ফেলে চলে আসছি।"
"ও"কথা বলতে ভাল লাগছে না । ভেতরে সামান্য শিহরণ অনুভব করছি । জন্মদাতাকে দেখার আনন্দ,নাকি মৃত পিতাকে দেখার শোক,বুঝতে পারছি না ।

বাস কেরাণীহাট এসে থামল । আমি আর তিনি নামলাম ।
"চলেন,আজকে দুপুরের ভাতটা আমাদের বাড়িতে খাবেন ।"তাকে নিয়ে বাড়ি যেতে চাইলাম ।
"না বাবা,আমার বাজারে একটু কাজ আছে,তোমার বাড়ির ঠিকানাটা বল।"
"হাসান চৌধুরীর বাড়ি বললেই সবাই চিনিয়ে দেবে।"
"ঠিক আছে,আমি সন্ধ্যে বেলা আসব।"বলে তিনি আমার গালে হাত বুলিয়ে দিলেন । সারা শরীর কেঁপে উঠল । আমি তাকে সালাম দিয়ে একটা রিকশা করে বাড়িতে এলাম ।


বাড়ি এসে দেখি সবাই চুপচাপ । অবশ্য হবে নাই বা কেন ? তেইশ বছর আগে সবাই যাকে হাসিমুখে বিদায় দিয়েছিল,সে যে মৃতদেহ হয়ে ফিরে আসবে সেদিন কেউ কি তা ভেবেছিল ? সবাইকে সালাম করলাম । কিন্তু লাশ কৈ ?

দাওয়ায় মা বসেছিলেন । নির্বাক । সালাম চাচা যাননি । বললেন,রাস্তায় জ্যাম । তাই বাবার লাশ বহনকারী গাড়িটার আসতে দেরী হচ্ছে । আমি গোসল করে কাপড় পাল্টালাম । ভাত খেয়ে পুকুরঘাটে বসে থাকলাম ।

সন্ধ্যা হয়ে এল । হঠাত্‍ লোকটিকে আসতে দেখলাম । আরে ধূর,উনি তো রহিম চাচা । মানে লাশ এসে গেছে ! চাচা বললেন,"ভাইপুত,গাড়িতো ব্রীজে উঠবার পারতাছে না। তাড়াতাড়ি আয়,ধরন লাগবো।"আমাদের গ্রামে একটা চিকন ব্রীজ আছে । গাড়ি ঢুকার মত যথেষ্ট চওড়া নয় । তাড়াতাড়ি গেলাম । কফিনে হাত লাগালাম । তেমন ভারী নয় । নিয়ে এসে উঠানে রাখলাম ।সবাই আমাকে আগে দেখতে বললেন । কম্পিত বুকে কফিনের ঢাকনা উঠিয়ে মুখ থেকে কাপড় সরাতেই আমার রক্ত হিম হয়ে এল ! বিকট চিত্‍কার করে ছিটকে পড়লাম । লাশ আসার পর যারা কান্নাকাটি শুরু করেছিল তারা হতভম্ব হয়ে গেল । ব্যাপার কী ? আমার মুখ দিয়ে কথা বেরুচ্ছে না,"এ- এ-এইতো সে-সেই লোক !!!"সবাই অবাক !
"কোন লোক ?"
"যার সাথে আমি সারা রাস্তা কথা বলতে বলতে এলাম!"
"কি বলিস ?"
"হ্যাঁএএ ! বাজারে উনার সাইকেল পার্টসের দোকান আছে।আমাকে খাওয়ালেন,আদর করলেন!এএইতো,এখনি উনি আসবেন !"বলেই চুপ হয়ে গেলাম ।একটু পরই শিশুর মত "বাবা" বলে চিত্‍কার করে কেঁদে উঠলাম ! বাবাকে এত কাছে পেয়ে আবার হারালাম ! তিনি শেষবারের মত সবার খোঁজ নিয়ে,তাঁর সোহাগের অপূর্ণ ইচ্ছা পূরণ করে দিয়ে গেলেন ! বাবা,তুমি আরেকবার এসো ! তোমাকে শিশুর মত জড়িয়ে ধরি,একটিবার বাবা বলে ডাকি.....
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×