এমনি রোযার সময় যে কত কি হত সে না হয় পরে বলবো। আমার বাবা ছিলেন আমার চোখে আদর্শ বাবা । সততায় কর্মে কথায়। তিনি একাকী থাকতে পারতেন না এক্কেবারেই না। তার জীবনে একটি সময় আমি ছিলাম তার সফরসঙ্গী তিনি মেঘালয়, শিলং, কলকাতা গিয়েছেন আমি তার সাথে গেছি । তাই বিধাতা এই পৃথিবীতেও তাকে একাকী থাকতে দেননি । তার আগেই তাকে তুলে নিয়ে গেছেন ।
ছোট বেলায় ঈদ আসলেই খুব আনন্দের ছিল আমরা অনেক ভাই বোন বাবা মায়ের আদরে যত্নে লালিত হয়েছি । কখনো বাইরের জগত এ একাকী মেশার বা যাবার সুযোগ হয়নি তাই এখন হোঁচট খাচ্ছি প্রতি পদক্ষেপে। তবুও বলবো তখনকার দিন গুলো ছিল খুব সুন্দর ।
রোযার শেষের দিকেই শুরু হত নতুন জামা-জুতো কেনার ধুম । আমরা সবাই একসাথে কাপড় কিনতে যেতাম বড়রা যেত না তাদেরটা বাবা মাই পছন্দ করে কিনতেন। যা এখন সম্ভব না।
কি যে খুশি বাবার হাঁক ডাকে মুখরিত চারধার। সেই সকালে গিয়ে বিকেলে ফিরতাম। কাপড় কিনেই, বোনের পেছন লাইন কবে আমারটার সেলাই হবে । আমি একটু শান্ত ছিলাম বলে আমার বড়দের শেষ হলেই পেতাম। আর দুষ্ট ছিলাম আমার বড়টা কে বলতাম, দেখো ছোটআপু আমার কাপড় সুন্দর তোমারটা না আরো কতকি । ও ছিল খুব সহজ সরল । অমনি বাবার কাছে নালিশ আর বাবা ধমক দিতেন হাসি মুখে ।
বড়াপু খুব আদর করত তাই এটা ওটা করে দিতাম। আর আমার ঠিক বড়টা যত ঝামেলা করত। ওকে নিয়ে একরাতে কয়েকবার জামার সেলাই করে আবার খুলে বানাতে হয়েছে। আপু বিরক্ত হবে কি ওর টা না হওয়া পর্যন্ত টেনসন থাকত ওর। কারণ অনেক গুলো বাকি যে। দেখা যেত অনেক রাত এ আপু ঘুম ভাঙিয়ে বলত যা তো পরে আয় তো দেখি ঠিক হয়েছে কিনা। আমি কখনো বায়না করিনি যা দিয়েছে নিয়েছি। তারপর ও আনন্দ শিহরন মিশানো এক একটি দিন রাত । অনেক রাত পর্যন্ত জামা সেলাই করত আপু। আমিও ওর পাশে জেগে থাকতাম এমন কি অনেক রাত এ আপুকে চা বানাতে সাহায্য করেছি।
দেখা গলো ঈদের আগের রাতে ছিঁচ কাঁদুনে বোনটির ভ্যা। কেন জুতো ঠিক হচ্ছে না বা আর সাইজ বড় ছোট। এমনটা লেগেই থাকত। তাই তো ওকে প্রায় বলতাম তোমার বিয়ের রাতেই ভ্যা শুনতে হবে সবার বর পছন্দ হয়নি বলে। এসব বলতাম আস্তে কারণ মা শুনলে রক্ষা নেই এসব বড়দের কথা না ?
ঈদের আগের দিন বাবার হৈ চৈ এ ঘুম ভাঙত, আজ ঘর ধুতে হবে i লম্বা পাইপ নিয়ে জিনিস সরিয়ে সরিয়ে বাবা সব রুম ধুতেন। আর তো আমরা ছিলাম পেছন পেছন । বাবা গান ও করতেন আমরাও গলা মেলাতাম। আর মায়ের অনবরত বকা তো ছিলই ঠান্ডা লাগবে জ্বর হবে। আমরা তো বাবার পেছনে । বাবা ছিলেন রক্ষাকর্তা । সদা হাসি মুখ বাবা কখনো বকেননি। আমাদের ঘর পরিষ্কার অভিযানে, আমি আর আমার ভাই দুষ্টমিও কম করতাম না। যত না কাজ করতাম অকাজ করতাম বেশি । আর ভাইয়াটা অকারনে বকা খেত বাবার ।
টুল নিয়ে ঝুল ঝাড়া। এসব অনেক অপকর্মই করতাম আমরা । আব্বু হাসতেন। মা বকলে বলতেন, বছরের একটা দিন ওদের করতে দাও। লোক ছিল এসব করার। কিন্তূ বাবা হৈ চৈ য়ে মাতিয়ে রাখতেন সারা দিনমান। আমরা খুশি কারণ পড়াশোনা আপাতত মুলতবি।
আস্তে আস্তে দিন গড়িয়ে বিকেল । অপেক্ষা কাল ঈদ হয় কিনা । ইফতার করেই ছুট । বাবাও আমাদের সাথে চাঁদ দেখতে তখন চাঁদ উঠলেই সাইরেন বাজাত,। সে কি আনন্দ চাঁদ দেখা গেলে। বাবা এসেই টিভি ছেড়ে দিতেন নজরুল এর একটা গান আজও দেয় তখনো দিত " ও মন রমজানের ওই রোযার শেষে এলো খুশির ঈদ" । আজও সে গানটা শুনেলে আমি কান্নায় ভেঙ্গে পড়ি। ঈদের আগের দিন রাত এ বাবা টিভি ছেড়ে সবাই কে ডাকতেন এক সাথে টিভি দেখতাম সেদিন পুরনো অনুষ্ঠান দেখাত নাটক ,হানিফ সংকেতের একটা অনুষ্ঠান। অনেক রাত পর্যন্ত বাবা আমরা টিভি দেখতাম। যা এখন বিরল চিত্র । যা আজ কাল দেখা যায় না।
ঈদের আগের দিন হৈ চৈ পরে যেত বাড়িতে কি রান্না হবে, সবার জামা কাপড় ইস্তিরি করতে হবে কিনা। আমরা তো অনেক আগেই ঠিক করে রাখতাম। কাউকে দেখতে দিতাম না জামা ঈদের আগে। কখনো নয় কিন্তূ নিজে রোজ লুকিয়ে একবার দেখতাম যেন ঝিনুকে রাখা মুক্ত!
এত আনন্দের ছিল ঈদের দিন গুলো আজ কোথায় গেল সে সব দিন !
বাড়িতে কাজের লোকের অভাব ছিল না। রান্না, ঘর পরিষ্কার সব কিছুর লোক ছিল। কিন্তূ বাবা চাইতেন মা করুক। মায়ের তদারকি তে কত কি রান্না হত অনেক রাত পর্যন্ত । ঈদের সকালেই বাবার সব অফিস কলিগরা আসতেন ছোট বড় সব আমাদের বন্ধু বান্ধব। আর ঈদের দিন আব্বু চিৎকার করে খুব ভরে ঘুম থেকে তুলে দিতেন য়ার এক এক করে স্নান করতে ঢুকাতেন। আমি ছিলাম শীত কাতুরে আব্বু উঠিয়ে দিতেন। আমি গিয়ে অন্য ঘরে বড় ভাইয়ার পাশে শুয়ে পরতাম । সেই হিম হিম সকালে কে স্নান করে? কিন্তু কেউ রক্ষা পেত না একে একে সব্বাইকে স্নান করে নতুন কাপড় পরে রেডি থাকতে হোত।
মা ও সকাল থেকে সেজে গুজে রেডি। সেদিন সবাই হাসি খুশি আর আমরা বসে থাকতাম বাবা কখন ঈদের নামাজ পরে আসবেন। না কোনো দিন ও তিনি পা ছুঁয়ে সালাম নেননি এবং সালামি কখনই দিতেন না। তবুও তিনি যে বুকে জরিয়ে নিতেন সেটাই ছিল আনন্দের।
আমরা মায়ের কাছ থেকেই নিতাম। কোথাও যাওয়া নিষেধ তাই বাগানে খেলতাম বাবা মা নিয়ে যেতেন কোথাও গেলে। আর ঈদের দিন সন্ধায় টিভি অনষ্ঠান দেখতে বসে যেতাম বাবার সাথে । মনে পরে রাত খাবার এর জন্য ডেকে ডেকে সারা হলে কোনো রকমে নাকে মুখে গুঁজে আবার টিভি দেখতে বসে জেতাম।
আজ বুঝি বাবা সে সব দিন গুলোতে একটু ও চোখের আড়াল করতে চাইতেন না। তবুও যেতে হত। সবাই একসাথে যেতাম দু একটা বাসায় মায়ের সাথে। ঈদের সে কয়টা দিন বড় মধুর ছিল। আজ কেবল স্মৃতি সে সব দিন !
কালের আবর্তে সময়ের পরিবর্তনে আমরা রোবট হয়ে গেছি। অন্যান্য দিন এত ব্যস্ত থাকি যে, ঈদের দিন রেস্ট নিতে চাই। চাই কাছের লোকজনদের নিয়ে দুরে কোথাও যেখানে কোলহল নেই। সেই জায়গা থেকে ঘুরে আসতে। তাই দেখা যায় আজ যারা অর্থবান সারা বছর ব্যস্ত থাকেন। তারা ছুটছেন সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া বা অন্য কোথাও আবার কেউ দেশেরই কক্সবাজর, কুয়াকাটা বা সুন্দরবন। এমন কোনো জায়গায় নিরিবিলি একান্ত আপন মানুষদের সান্নিধ্যে একান্ত নিজের মতন সময় কাটিয়ে আসেন ।
আজ সেই সব শিউলি কুড়ানো দিন গুলোকে আবার ফিরে পেতে ইচ্ছে করে ।
তবু ঈদ মানে আনন্দ ঈদ মানে খুশির । ঈদ বোনের হাতের মেহেদির রং আর ভাইয়ের রঙিন পাঞ্জাবি ! বড় ছোট বড় কোনো ভেদাভেদ নেই । ঈদে মজার মজার রান্না করা আর খাওয়া আর খাওয়ানো । আসুন সব ভুলে যাই আসছে ঈদে সব মলিনতা সব সংকীর্ণতা সবটুকু ধুয়ে ফেলি ।
সব্বাইকে আসছে ঈদের শুভেচ্ছা ।
[