নজরুল বাংলা সাহত্যির মুকুটহীন সম্রাট
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
কবির ৩৫তম মৃত্যুবার্ষিকীতে শ্রদ্ধার সাথে স্বরণ করছি ।
কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের প্রিয় কবি। তিনি ১৮৯৯ খ্রীষ্টাব্দে ২৪মে বাংলা ১৩০৬ সালের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমাধীন জামুরিয়া থানার চুরুলিয়া গ্রামে জন্ম গ্রহণ করেন। কবির পিতার নাম কাজী ফকির আহমদ ও মাতার নাম জাহেদা খাতুন। কবির পিতৃ পুরুষগণ পাটনার অধিবাসী ছিলেন। সম্রাট শাহ আলম যখন দিল্লীর বাদশা, সে সময় সম্রাটের নির্দেশে পাটনার হাজীপুর থেকে তাঁরা চুরুলিয়া চলে আসেন।
ছোটবেলায় কবির নাম ছিল ‘দুখু মিয়া’। জন্মের পূর্বে চার সন্তান শিশু অবস্থায় মৃত্যুবরণ করায় পিতামাতা তাঁর নাম রেখেছিলেন ‘দুখু মিয়া’। এ নাম ছাড়াও ছেলে বেলায় তাঁকে ‘ক্ষ্যাপা’ এবং ‘নজর আলী’ নামে ডাকতো। কবির জন্মের সময় প্রকৃতিতে ছিল ঝড়ের তাণ্ডব। ঝড় ঝঞ্ঝার মধ্যে চির বিদ্রোহী মহাবীর জন্ম নিলেন। নজরুল তাঁর এক কবিতায় জন্মমুহূর্তটিকে বর্ণনা করেছেন,
‘শোনো সবে জন্ম কাহিনী মোর
আমার জন্ম ক্ষণে উঠেছিল
ঝঞ্ঝা তুফান ঘোর।
উড়ে গিয়েছিল ঘরের ছাদ ও
ভেঙে ছিল গৃহদ্বার
ইস্রাফিলের বজ্র বিষাণ
বেজেছিল অনিবার।’
ডানপিটে এক কিশোর। গ্রামের মক্তবে পড়ে। কিন্তু মক্তবের বাধাধরা নিয়ম মানতে তার ভালো লাগে না। সুযোগ পেলেই সে ক্লাস ফাঁকি দেয়। মেতে উঠে দস্যিপনায়। অন্যের লিচুগাছে চড়ে পাকা লিচু পেড়ে আনে, হানা দেয় কোন গাছ বা পোড়ো দালানের কার্নিশের পাখির বাসায়। তাই বলে বছর শেষে মক্তবের পরীক্ষায় ফেল করে না, বরং প্রথম হয়। কারণ ক্লাস ফাঁকি দিলেও পড়ায় ফাঁকি দেয় না সে। তাই দূরন্তপনার মাঝেই নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করে গ্রামের মক্তব থেকেই।
কয়লা অঞ্চল বলে খ্যাত আসানসোলের ঐতিহ্যবাহী গ্রাম চুরুলিয়া। চুরুলিয়া গ্রামের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে অজেয় নদ। গ্রামের পূর্ব পার্শ্বে রাজা নরোত্তম সিংহের গড় এবং দক্ষিণ পার্শ্বে রয়েছে ‘পীর পুকুর’। হাজী পাহলোয়ান নামে একজন ‘পীর’ এই পুকুর খনন করেছিলেন। পীর পুকুরের পূর্বপাড়ে হাজী পাহলোয়ানের মাজার শরীফ। পশ্চিম পাড়ে একটি মসজিদ আর মাজার। কবি নজরুলের পিতা, পিতামহ আজীবন এ মসজিদ ও মাজার দেখাশোনার দায়িত্ব পালন করেন।
নজরুল চুরুলিয়ার যে মক্তবে পড়ালেখা এবং নিম্ন প্রাইমারি পরীক্ষায় পাস করার পর কৈশোরেই শিক্ষকতা করেন সেই মক্তবেরই শিক্ষক ছিলেন তার চাচা মৌলবী কাজী ফজলে আহাম্মদ। আরবী ও ফারসী ভাষায় পারদর্শী এই চাচার কাছেই নজরুল এই দুই ভাষা শেখেন। তার লেখায় আরবী, ফারসী, উর্দু ও হিন্দী শব্দ দক্ষমতার সাথে যথাযথভাবে ব্যবহার করতে পারার গোড়াপত্তন ঘটে তখনই।
নজরুলের বয়স যখন আট সে সময় আকস্মিক তাঁর জীবনে এক আঁধার অধ্যায় নেমে আসে। এ সময় পিতা ফকির আহমদ মারা যান। পিতার মৃত্যুর পর সংসারের অভাব-অনটন বেড়ে যায়। মা জাহেদা খাতুন ছেলের লেখাপড়া কিভাবে করাবেন তা নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েন। কিন্তু তিনি দমে যাননি। অতি কষ্টে ছেলের লেখাপড়া চালিয়ে যান। ১৩১৬ খৃষ্টাব্দে গ্রামের মক্তব হতে নজরুল নিম্নিমাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।
নজরুলের বয়স মাত্র দশ তখন। তাঁর মা সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। অভাব-অনটনের কারণে নজরুলের লেখাপড়া বন্ধ হয়ে গেল। সংসারে আর্থিক দৈন্য দূর করতে নজরুল মক্তবে চাকরি গ্রহণ করেন। এই অল্প বয়সে নজরুল মক্তবের শিক্ষক হিসেবে যোগ দেন। মক্তবের শিক্ষার্থীদের কাছে তিনি অল্প সময়েই প্রিয় হয়ে ওঠেন। শিক্ষার্থীরা তাকে ছোট ওস্তাদজী বলে সম্মান দিত। এ সময় নজরুল মাজারের খাদিমগিরি ও মসজিদের মুয়াজ্জিনেরও দায়িত্ব পালন করেন। নজরুলের এক চাচা কাজী বজলে করিম ভাল ফার্সি জানতেন। কবিতাও লিখতেন। নজরুলের এই চাচা লেটো দলের সাথে জড়িত ছিলেন। লেটো দলের জন্য বজলে করিম কবিতা ও গান লিখতেন। নজরুল তাঁর চাচার উৎসাহে কবিতা লিখা শুরু করেন। চাচার মতো নজরুল এ সময়েই কবিতায় আরবী, ফার্সি শব্দ ব্যবহার করে সুন্দর সুন্দর কবিতা লিখতেন।
তখনকার দিনে গ্রামে গ্রামে যাত্রা, পালাগানের আসর বসতো। বসতো লেটো গানের আসর। লেটো গানের কথা ও সুর নজরুলকে আকৃষ্ট করে। সে সময় চুরুলিয়ার আশেপাশে লেটো গানের কয়েকটি দল ছিল। নজরুল মক্তব ছেড়ে লোটো দলে যোগ দিলেন। অল্প বয়সেই চমৎকার চমৎকার পালা গান লিখে নজরুল সুনাম কুড়ান। চুরুলিয়া, রাখপুরা, নিমসা প্রভৃতি গ্রামে নজরুল কবি হিসেবে পরিচিত লাভ করেন। নজরুলের লেখা ‘চাষার সঙ;, ‘মেঘনাদ বধ’, ‘শকুনি বধ’, ‘দাতা কর্ণ’, ‘রাজপুত্র,’ ‘আকবর বাদশা’, ‘কবি কালি দাস’ প্রভৃতি পালা গান উচ্ছ্বসিত প্রশংসিত হয়। সে সময়কার লেটো দলের বিখ্যাত কবিয়াল শেখ চাকার নজরুলকে ব্যাঙাচি বলে ডাকতেন।
নজরুলের শৈশর-কৈশোরের অনেক ঘটনা আর কাজের প্রভাব লক্ষ্য করা যায় তার লেখায়। কৈশোরের তার দুরন্তপনার চিত্রই যেন ফুটে উঠেছে তার বিখ্যাত ‘লিচুচোর’ কবিতায়-
পুকুরের ঐ কাছে না
লিচুর এক গাছ আছে না
হোথা না আস্তে গিয়ে
য়্যাব্বড় কাস্তে নিয়ে
গাছে গেৎ যেই চড়েছি
ছোট এক ডাল ধরেছি,
ও বাবা, মড়াৎ করে
পড়েছি সড়াৎ জোরে!
কবির শিশু মানসের পরিচয় পাওয়া যায় তার ‘খুকী ও কাঠবেড়ালি’ কবিতায়। শিশু-কিশোরদের অতিপ্রিয় ও বহু পঠিত এই কিশোর কবিতাটি কবি রচনা করেন তার একবারের কুমিল্লা সফরের সময়। এটি রচনার ইতিহাস সম্পর্কে মুজফফর আহমদ তার ‘কাজী নজরুল ইসলামঃ স্মৃতিকথা’ বইতে লিখেছেন, ‘এর রচনার পেছনে যে ঘটনা ঘটেছিল নজরুল তা’ আমাদের বলেছিল। সে একদিন দেখতে পেল যে শ্রী ইন্দ্রকুমার সেনগুপ্তের শিশুকন্যা জটু (ভালো নাম শ্রীমতী অঞ্জলী সেন) একটা একা কাঠবেড়ালির সঙ্গে কথা বলছে। তা দেখেই সে কবিতাটি লিখে ফেলে।’
কাজী নজরুল ইসলাম কৈশোরে এক জায়গায় আটকে থাকতে পছন্দ করতেন না। জ্ঞানার্জন আর দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়ানোর প্রতি ছিল তাঁর অদম্য আগ্রহ। তাইতো ‘সঙ্কল্প’ কবিতায় লিখেছেন-
থাকব না’ক বদ্ধ ঘরে
দেখব এবার জগৎটাকে
কেমন করে ঘুরছে মানুষ
যুগান্তরের ঘূর্ণিপাকে।
দেশ হতে দেশ দেশান্তরে
ছুটছে তারা কেমন করে,
কিসের নেশায় কেমন করে
মরছে যে বীর লাখে লাখে।
তার সবচেয়ে বড় পরিচয় ছিল বিদ্রোহী। তিনি জীবনের সর্বক্ষেত্রে অন্যায়ের বিরুদ্ধে ছিলেন বিদ্রোহী। ১৯৭৬ সালের ২৭ আগস্ট আমাদের চিরবিদ্রোহী কবি ধূলিবালির ধরা থেকে বিদায় নেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যাল মসজিদের পাশে চিরঘুমে শায়িত আছেন।
৫টি মন্তব্য ৩টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট
আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন
ল অব অ্যাট্রাকশন
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
চরফ্যাশন
নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।
প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
কর কাজ নাহি লাজ
রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।
হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?
নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন
নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন