চুড়িহাট্টা মসজিদ: বাংলাদেশের অন্যতম একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
Tweet
চুড়িহাট্টা মসজিদ, ভালো করে বললে প্রাচীন চুড়িহাট্টা মসজিদ বাংলাদেশের অন্যতম একটি পুরাতাত্ত্বিক নিদর্শন, যা ঢাকা মহানগরের পুরোন ঢাকার উমেশ চন্দ্র দত্ত লেন ও হায়দার বকশ লেনের তেমাথায় অবস্থিত। স্থানীয়ভাবে মসজিদটি চুড়িহাট্টা শাহী মসজিদ নামে পরিচিত ছিল। মসজিদটির প্রকৃত অবস্থান ছিল চকবাজারের সামান্য পশ্চিম দিকে ২৬-২৭ শেখ হায়দার বকশ লেন। ঐতিহাসিক তথ্যমতে মসজিদটি ৩৬০ বছর পুরোন (২০০৮ খ্রিস্টাব্দ)। তবে প্রাচীন মসজিদ স্থাপত্যটি বর্তমানে বিলুপ্ত, সে জায়গায় গড়ে তোলা হয়েছে আধুনিক স্থাপত্য।
চুড়িহাট্টা মসজিদটির দৈর্ঘ্য ৩০ ফুট এবং প্রস্থ ১৩ ফুট। মসজিদটির কোনো গম্বুজ ছিল না, এবং সমতল ছাদ ছিল। এই হিসাবে মসজিদটি সাধারণ বাঙালি স্থাপত্যের খড়ের ছাদওয়ালা দো চায়া ঘরের মতন ছিল। ড. দানী'র মতে, মসজিদটি আয়তাকৃতির এবং এর চার কোণে চারটা টাওয়ারসদৃশ মিনার ছিল। পূর্বদিকে ৩টি দরজাপথ রয়েছে, যার প্রতিটি দুটো পরিপূর্ণ আর্চ বা কীলকে গিয়ে খুলতো। সামনের দিকটা বিভিন্ন আয়তাকৃতি আর কার্ণিশ দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। সামনের দেয়াল প্যানেল দ্বারা অলঙ্কৃত ছিল। এছাড়া উত্তর ও দক্ষিণ দেয়ালে আলো-বাতাস চলাচলের সুবিধার জন্য ১টি করে দরজা ছিল। অভ্যন্তরভাগ ঢাকা ছিলো সংস্পর্শী দুটো ভোল্টেড ছাদ দ্বারা, সংযোগস্থলটা আর মধ্যখানটা ছিল বাঁকানো। তবে এজাতীয় ভোল্টেড ছাদকে তিনি উত্তর ভারতীয় পিরামিডাকৃতির স্থাপত্বের সাথে তুলনা করে, বাংলাদেশের স্থানীয় স্থাপত্য থেকে পৃথক বলেছেন।
মসজিদটির একটি শিলালিপি পাওয়া যায়; আরবি ও ফারসি ভাষায় লেখা ঐ শিলালিপিতে মুসলমানদের পবিত্র ধর্মগ্রন্থ কোরআনের সূরা তওবার ১৭ ও ১৮ নম্বর আয়াতের সারমর্ম উপস্থাপিত হয়েছে। সেখানে লেখা বক্তব্যের বাংলা অনুবাদ হলো:
আল্লাহ তা'আলা বলেন, একমাত্র তাঁরাই আল্লাহর মসজিদসমূহের রক্ষণাবেক্ষণ করবেন, যাঁরা আল্লাহ ও পরকালের উপর বিশ্বাস রাখেন। নামায প্রতিষ্ঠা করেন, যাকাত দেন এবং আল্লাহ ছাড়া অন্য কাউকে ভয় করেন না।
শিলালিপিতে মসজিদটির নির্মাতা হিসেবে মোহাম্মদী বেগ কিংবা মোহাম্মদ বেগ নামের এক ব্যক্তির কথা বলা হয়েছে। তখন ছিল শাহ সুজার রাজত্বকাল। শিলালিপিটি বর্তমানে (২০১০) মসজিদের ইমামের কাছে রক্ষিত আছে।
বিভিন্ন ঐতিহাসিক তথ্য-উৎস থেকে জানা যায়, মসজিদটি মুঘল আমলের স্থাপত্য নিদর্শন। সুবাদার শাহ সুজার সময়ে ১৬৪৯ খ্রিস্টাব্দে মসজিদটি নির্মিত হয়। জেমস ওয়াইযের ১৮৮৪ খ্রিস্টাব্দের লেখানুযায়ী, মুঘল আমল থেকেই মুসলমান কারিগরেরা কাচের চুড়ি তৈরি করে পুরোন ঢাকার চকবাজারে বেচাকেনা করতেন, তাই এই পুরো এলাকাটি স্থানীয়ভাবে চুড়িহাট্টা নামে পরিচিত। জানা যায়, চুড়ির এইসব কারিগরেরা নামায পড়ার জন্যই গড়ে তোলেন মসজিদটি।
মসজিদটির নির্মাণ বিষয়ে আলাদা আলাদা বক্তব্য পাওয়া যায়। জানা যায়: ঐতিহাসিক ড. মুনতাসির মামুনের মতে, সুবাদার শাহ সুজার নির্দেশে মোহাম্মদী বেগ নামের এক মুঘল কর্মকর্তা মসজিদটি নির্মাণ করেন। "তাওয়ারিখে ঢাকা" গ্রন্থের প্রণেতা মুনশী রহমান আলী তায়েশ উল্লেখ করেন, আগে এই জায়গায় একটি মন্দির ছিল; সম্রাট শাহজাহানের আমলে কোনো এক হিন্দু কর্মকর্তা মন্দিরটি নির্মাণ করেন। পরে সুবাদার শাহ সুজা মন্দিরের দেবমূর্তি ফেলে দিয়ে মন্দিরটিকে মসজিদে রূপান্তর করেন। "ঢাকার ইতিহাস" গ্রন্থের প্রণেতা যতীন্দ্রমোহন রায়ের বিবরণ থেকে জানা যায়; ঢাকার নবাব তার কয়েকজন কর্মচারীকে একটি ধর্মমন্দির নির্মাণের জন্য অর্থ দান করেছিলেন। সেই অর্থ ব্যয় করে একটি বাসুদেব মন্দির নির্মাণ করা হয়। কিন্তু নবাব, তাঁর কর্মচারীদের এই আচরণে ক্ষুব্ধ হয়ে বাসুদেব মন্দিরকে মসজিদে পরিণত করেন। এই কথার সমর্থন পাওয়া যায়, যখন ইংরেজ আমলে ঢাকার তৎকালীন ম্যাজিস্ট্রেট জে টি র্যাং কিন্স মসজিদের মাটি খনন করে একটি বাসুদেব মূর্তি উদ্ধার করেছিলেন। বাঙলাদেশের প্রত্নসম্পদ গ্রন্থে আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া উল্লেখ করেছেন, ১৯০৬ খ্রিস্টাব্দে মসজিদ প্রাঙ্গনে মাটির নিচে পাথরের একটি বাসুদেব মূর্তি পাওয়া গিয়েছিল। ব্র্যাডলে বার্টের মতে, মাটি খুঁড়ে বাসুদেবের চিত্র অঙ্কিত পাথরখণ্ড পাওয়া গিয়েছিল। "কিংবদন্তির ঢাকা" গ্রন্থে গ্রন্থকার নাজির হোসেন উল্লেখ করেছেন, শাহ সুজার সময়ে জনৈক হিন্দু কর্মকর্তাকে একটি মসজিদ নির্মাণ করতে বললে তিনি মন্দির নির্মাণ করেন। পরবর্তিতে শাহ সুজা তা জানতে পেরে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণ করেন। Glimpses of Old Dhaka গ্রন্থে এস. এম. তাইফুর লিখেছেন, মসজিদের শিলালিপিতে মন্দির ভেঙে মসজিদ নির্মাণের কথা উল্লেখ ছিল; যদিও বর্তমান শিলালিপিতে তেমন কিছুর উল্লেখ নেই। মন্দিরটি পুরোপুরি ভেঙে সেটিকে মসজিদ বানানো হয়েছিল, নাকি মন্দির থেকে বিগ্রহ বিতাড়িত করে স্থাপত্য নকশায় সামান্য পরিবর্তন করে সেটিকে মসজিদে রূপান্তর করা হয়েছিল, সে বিষয়ে ঐতিহাসিক তথ্যে মতপার্থক্য আছে; জনাব আবুল কালাম মোহাম্মদ যাকারিয়া'র মতে, মন্দির ভেঙেই মসজিদ নির্মিত হয়েছিল।তবে এভাবেই ঐতিহাসিকভেদে চুড়িহাট্টা মসজিদের ইতিহাসও ছিল বিভিন্ন। তাই মসজিদটির যথেষ্ট ঐতিহাসিক মর্যাদাও ছিল।
চুড়িহাট্টার ঐতিহাসিক মসজিদটি প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের তালিকায় অন্তর্ভুক্ত ছিল না। মসজিদটির ঐতিহাসিক গুরুত্ব না জেনেই মসজিদ কমিটির লোকজন অপেক্ষাকৃত বৃহদাকৃতির বহুতল মসজিদ নির্মাণের লক্ষ্যে পুরোন মসজিদটি ভেঙে ফেলার উদ্যোগ নেন। জানা যায় ২০০৮ খ্রিস্টাব্দের প্রথম দিকেই মসজিদটি ভাঙার কাজ শুরু হয়, এবং জুলাই মাস নাগাদ পুরো মসজিদটি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ভেঙে ফেলার পরও সেখানে যে নতুন ভবন নির্মাণ করা হচ্ছে, শিলালিপিটি সেই মসজিদের গায়ে লাগানো হবে বলে জানা যায়। অবশ্য প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এব্যাপারে নিশ্চুপ থাকলেও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর শিলালিপিটি উদ্ধার করবে বলে জানা যায়।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর
আলোচিত ব্লগ
যুক্তরাষ্ট্রে ইসরাইল বিরোধী প্রতিবাদ বিক্ষোভ
গাজায় হামাস উচ্ছেদ অতি সন্নিকটে হওয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে নিউইয়র্ক ও লসএঞ্জেলসে কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোতে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পরেছিল। আস্তে আস্তে নিউ ইয়র্ক ও অন্যান্ন ইউনিভার্সিটিতে বিক্ষোভকারীরা রীতিমত তাঁবু টানিয়ে সেখানে অবস্থান নিয়েছিল।
... ...বাকিটুকু পড়ুন
৫০১–এর মুক্তিতে অনেকেই আলহামদুলিল্লাহ বলছে…
১. মামুনুল হক কোন সময় ৫০১-এ ধরা পড়েছিলেন? যে সময় অনেক মাদ্রাসা ছাত্র রাজনৈতিক হত্যাকান্ডের শিকার হয়েছিল। দেশ তখন উত্তাল। ঐ সময় তার মত পরিচিত একজন লোকের কীভাবে মাথায় আসলো... ...বাকিটুকু পড়ুন
মেহেদীর পরিবার সংক্রান্ত আপডেট
মার্চ মাস থেকেই বিষয়টি নিয়ে ভাবছিলাম। ক'দিন আগেও খুলনায় যাওয়ার ইচ্ছের কথা জানিয়েও আমার বিগত লিখায় কিছু তথ্য চেয়েছিলাম। অনেক ইচ্ছে থাকা সত্ত্বেও মেহেদীর পরিবারকে দেখতে আমার খুলনা যাওয়া হয়ে... ...বাকিটুকু পড়ুন
'চুরি তো চুরি, আবার সিনাজুরি'
নীলসাধুকে চকলেট বিতরণের দায়িত্ব দিয়ে প্রবাসী ব্লগার সোহানীর যে তিক্ত অভিজ্ঞতা হয়েছিল তা বিলম্বে হলেও আমরা জেনেছি। যাদেরকে চকলেট দেওয়ার কথা ছিল তাদের একজনকেও তিনি চকলেট দেননি। এমতাবস্থায় প্রায়... ...বাকিটুকু পড়ুন
বরাবর ব্লগ কর্তৃপক্ষ
আমি ব্লগে নিয়মিত নই।
মাঝে মাঝে আসি। নিজের লেখা পোষ্ট করি আবার চলে যাই।
মাঝেমাঝে সহ ব্লগারদের পোষ্টে মন্তব্য করি
তাদের লেখা পড়ি।
এই ব্লগের কয়েকজন ব্লগার নিজ নিক ও ফেইক... ...বাকিটুকু পড়ুন