somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

বারাক ওবামার পিছনের কথা

২৪ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:০৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর মায়ের বিদেশ জীবন নিয়ে লেখা বই আ সিঙ্গুলার উমেন প্রেসিডেন্ট ওবামা ও তাঁর মায়ের বিদেশ জীবন নিয়ে লেখা বই আ সিঙ্গুলার উমেন


১৯৬৭ সালে, ছয় বছর বয়সী বারাক ওবামাকে নিয়ে তাঁর মা চলে আসেন ইন্দোনেশিয়ায়। কিন্তু মায়ের সেদিনের সেই সিদ্ধান্ত সুদূরপ্রসারী প্রভাব ফেলে বর্তমান মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামার জীবনে।

সন্তানের মধ্যে তার মা-বাবার ছায়া থাকে। সে ছায়ায় কখনো থাকে বাবার প্রভাব, কখনো বা মায়ের। আবার কখনো সে ছায়ায় বাবা-মা দুজনই সমান। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক হুসেন ওবামা তাঁর বাবার সান্নিধ্য তো নয়ই, মায়ের সাহচর্যও খুব বেশি দিন পাননি। তাহলে তাঁর মধ্যে কার ছায়া বেশি?
এ ক্ষেত্রে খুব সহজেই এ কথা বলে দেওয়া যায়, রাজনীতি ও রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য যে তীক্ষধী প্রয়োজন, তা তিনি বাবা-মা দুজনের কাছ থেকেই পেয়েছেন। ওবামার বাবা বারাক হুসেন ওবামা সিনিয়র ছিলেন তাঁর দেশ কেনিয়ার একজন প্রথিতযশা অর্থনীতিবিদ। ১৯৫৯ সালে বৃত্তি নিয়ে উচ্চশিক্ষার্থে যুক্তরাষ্ট্রের হনলুলুর হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়তে যান তিনি। ওই বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনিই প্রথম বিদেশি আফ্রিকান ছাত্র। পরবর্তী সময়ে হার্ভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে উচ্চতর শিক্ষা শেষে দেশে ফিরে যান। গড়ে তোলেন উজ্জ্বল পেশাগত জীবন।
শিক্ষাদীক্ষায় ওবামার মা স্ট্যানলি অ্যান ডানহামের পাল্লাটা আরও ভারী। নৃবিজ্ঞানে পিএইচডি করেন তিনি।

ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার: আ স্টোরি অব রেস অ্যান্ড ইনহেরিট্যান্স শীর্ষক যে বইটি ওবামার রাজনৈতিক উত্থানে বিশেষ ভূমিকা রেখেছে, এতে তিনি মা সম্পর্কে লিখেছেন, ‘তিনি ছিলেন লাজুক প্রকৃতির ছোটখাটো এক শহুরে মেয়ে, যিনি মুগ্ধ হয়েছিলেন আফ্রিকান এক যুবকের মেধা ও মহিমায়।’
এরপর বইয়ের বিভিন্ন অধ্যায়ে ওবামা তাঁর মায়ের যে বর্ণনা দিয়েছেন, এতে ফুটে উঠেছে অচিন কোনো দূরদেশে ছলাকলাহীন এক ভাববাদী তরুণী মায়ের ছবি, যাঁর ছিল অচেনা মানুষ ও অজানা পরিবেশকে আপন করে নেওয়ার অনন্য গুণ।
হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সূত্রেই ওবামা সিনিয়রের সঙ্গে অ্যান ডানহামের পরিচয় ও প্রেম। ওবামা সিনিয়র তাঁর চেয়ে বছর ছয়েকের বড়। প্রেমের পরিণতিতে ১৯৬০ সালে অন্তঃসত্ত্বা হয়ে পড়েন তিনি। গর্ভে ধারণ করেন আজকের প্রেসিডেন্ট ওবামাকে। অ্যানের বয়স তখন মাত্র ১৭ বছর। সন্তানসম্ভবা হওয়ায় পড়াশোনার পাট শিকেয় উঠল তাঁর। ১৯৬১ সালের ২ ফেব্রুয়ারি হাওয়াই দ্বীপের মাউইতে বিয়ে করেন তাঁরা। উভয় পরিবারের অভিভাবকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে বিয়েটা হয়। তখনো যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় ২৪টি অঙ্গরাজ্যে শ্বেতাঙ্গের সঙ্গে কৃষ্ণাঙ্গের বিয়ের ব্যাপারে আইনি বাধা ছিল। একই বছরের ৪ আগস্ট ওবামা জুনিয়রের জন্ম হয়। কিন্তু তাঁদের সংসার টেকেনি বেশি দিন। কেনিয়ায় সন্তানসহ স্ত্রী রেখে এসেছিলেন ওবামা সিনিয়র। প্রেম করার সময় অ্যানকে তিনি জানাননি সে কথা। বিয়ের পর এ কথা ফাঁস করলে তা মেনে নেওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায় অ্যানের জন্য। ১৯৬৪ সালের জানুয়ারিতে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায় তাঁদের। এর আগেই অবশ্য কয়েক বছর ধরে আলাদা ছিলেন তাঁরা। ওবামা জুনিয়রের দায়িত্ব বাবা-মাকে দিয়ে অ্যান ফিরে গিয়েছিলেন পড়াশোনায়।
১৯৬৪ সালে ইন্দোনেশিয়ার জাভাবাসী লোলো সোয়েতোরোকে বিয়ে করেন অ্যান। এটিও অবশ্য প্রেমের বিয়ে। হাওয়াই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভূগোলে উচ্চশিক্ষা নিতে গিয়েছিলেন লোলো। পরের বছর তিনি জাভায় ফিরে যান। এদিকে অ্যান একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে নৃবিজ্ঞানে স্নাতক শেষ করে ছয় বছরের ছেলে ওবামাকে নিয়ে ১৯৬৭ সালে জাভায় যান।
পরবর্তী চারটি বছর মায়ের উষ্ণ সাহচর্যে ছিলেন ওবামা। ওই সময় তাঁকে ‘ব্যারি’ বলে ডাকা হতো। শিশু ওবামার পৃথিবীকে ধীরে ধীরে বুঝে ওঠার বিষয়টা মায়ের মাধ্যমেই শুরু হয়। সচেতন বা অজ্ঞাতসারে মায়ের মূল্যবোধ তাঁকে দারুণভাবে মুগ্ধ করে। ইন্দোনেশিয়ায় প্রবাসজীবনের চারটি বছর শিশু ওবামাকে একদিকে যেমন দুনিয়ার হালচাল, আচার-আচরণ ও সংস্কৃতির বিষয়ে শিক্ষা দিয়েছেন, তেমনি তাঁকে দিয়েছেন বৈরিতা মোকাবিলার তালিম।
ছেলেকে নিয়ে প্রায়ই বিভিন্ন স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন অ্যান। দেখা যেত, সুশ্রী এক শ্বেতাঙ্গ তরুণী-মায়ের হাত ধরে যাচ্ছে তাঁর আধা মার্কিন কৃষ্ণাঙ্গ ছেলে। ওই সময় ইয়োগাকার্তা শহরে এলিজাবেথ ব্রায়ান্ট নামের এক মার্কিন নারী ছিলেন। তাঁর সঙ্গে বেশ ঘনিষ্ঠতা ছিল অ্যানের। এক দিনের ঘটনার স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে এলিজাবেথ বলেন, সেদিন আরেক প্রবাসীর বাড়িতে দুপুরের খাওয়ার দাওয়াত ছিল তাঁদের। অ্যান সেখানে লম্বা স্কার্ট পরে ছেলেকে নিয়ে হাজির হন। স্কার্টটি ছিল ইন্দোনেশীয় কাপড়ে তৈরি। ছেলে ব্যারির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ছেলেটি সপ্রতিভভাবে তাঁর সঙ্গে হাত মেলায়। আসার সময় একটি ইংরেজি ওয়ার্ক-বুক এনেছিলেন অ্যান। সোফায় বসে বইটি পড়তে থাকে ব্যারি। তার মধ্যে কোনো চপলতা ছিল না।
চার দশক আগের স্মৃতি হাতড়ে এলিজাবেথ বলেন, ‘তত দিনে ইন্দোনেশিয়ায় প্রায় চার বছর হয়ে গেছে অ্যানের। একপর্যায়ে তিনি আমার কাছে জানতে চান, আর কত দিন আছি ইন্দোনেশিয়ায়। জবাবে বলি, টেনেটুনে বড়জোর আর বছর দুয়েক থাকতে পারব। তারপর ফিরে যাব দেশে। অ্যান এর কারণ জানতে চাইলে বলি, এখানে বাস করা কঠিন। ভালো চিকিৎসক নেই। নেই স্বাস্থ্যকর পরিবেশ। কিন্তু অ্যান এ ব্যাপারে আমার সঙ্গে একমত হননি। অর্থাৎ, ইন্দোনেশিয়ার তখনকার পরিবেশ তুলনামূলকভাবে আয়েশি জীবনযাপনে অভ্যস্ত মার্কিন নাগরিকদের জন্য আশানুরূপ না হলেও অ্যান এতে খাপ খাইয়ে নিয়েছিলেন।
‘খাওয়া শেষে নয় বছরের ব্যারি নিচে খেলতে যাওয়ার বায়না ধরল। মা বললেন, “যিনি আমাদের দাওয়াত করেছেন, তাঁর অনুমতি নিয়ে যাও।” ব্যারি তা-ই করল। ফেরার সময় অ্যান ও এলিজাবেথ পাশাপাশি গল্প করতে করতে এগোচ্ছিলেন। তাঁদের সামনে ছুটতে ছুটতে যাচ্ছিল ব্যারি। একপর্যায়ে স্থানীয় কিছু ছেলে দেয়ালের আড়াল থেকে তার দিকে ঢিল ছুড়তে থাকে। একই সঙ্গে তারা “কালো” বলে টিটকিরি করছিল ব্যারিকে। কিন্তু ব্যারি এতে কান দেয়নি মোটেও। আপন খেয়ালে বিভোর থেকেছে। আপন মনে খেলেছে। অ্যান তখন বলেন, এসবে অভ্যস্ত হয়ে গেছে তাঁর ছেলে।’
এভাবে ১০ বছর বয়স পর্যন্ত সরাসরি মায়ের সান্নিধ্যে থেকে পারিপার্শ্বিক জগৎ চিনেছেন ওবামা। শিখেছেন কোন পরিবেশে কোন পরিস্থিতিতে কোন পদক্ষেপ নিতে হবে। মায়ের কাছে থেকেই মূলত ওবামা শিখেছেন সাফল্যের শিখরে যাওয়ার কৌশল।
১৯৭০ সালের ১৫ আগস্ট অ্যান ও সোয়েতোরোর ঘরে একটি মেয়ের জন্ম হয়। তাঁর নাম মায়া সোয়েতোরো। ওবামার এই বোনটি মায়ের স্মৃতিচারণা করতে গিয়ে বলেন, তিনি ছিলেন সন্তান-অন্তঃপ্রাণ। ‘তুই আমার জানের জান’—এ ধরনের আদুরে কথা দিনে অন্তত শ খানেক বার বলতেন তিনি। ছেলেমেয়ের ছোটখাটো কৃতিত্বে আবেগপ্রবণ হয়ে পড়তেন। এ সময় চোখে পানি এসে যেত তাঁর। সুচিকর্মসহ হাতের বিভিন্ন কাজও ভালো জানতেন তিনি। মায়া বলেন, ‘তাঁর সান্নিধ্যে থেকে আমরা জীবনে অনেক কিছুই পেয়েছি।’
প্রথম সংস্করণের পর ২০০৪ সালে ওবামার ড্রিমস ফ্রম মাই ফাদার বইটির পরবর্তী সংস্করণ প্রকাশিত হয়। মায়ের মৃত্যুর নয় বছর পর প্রকাশিত বইটির নতুন সংস্করণের মুখবন্ধে ওবামা অকপটে বলেন, অসুস্থ হয়ে মা এভাবে চলে যাবেন, আগে টের পেলে হয়তো আরেকটি বই লিখতেন তিনি। এতে তাঁর জীবনে মায়ের অনুপস্থিতির চেয়ে সান্নিধ্যলাভের বিষয়টিই ঘটা করে বর্ণনা করা হতো। লেখা হতো এমন একজনের কথা, যিনি সারাক্ষণ তাঁর সঙ্গে ছায়ার মতো আছেন।
সূত্র: দি নিউইর্য়ক টাইমস ম্যাগাজিন। শরিফুল ইসলাম ভূঁ্ইয়া | তারিখ: ১৯-০৮-২০১১
View this link
সর্বশেষ এডিট : ২৪ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১০:১৫
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×