somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আমরা-'মেডিকেল জীব'

২৩ শে আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

তুর্য আমার বন্ধু।ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পদার্থবিজ্ঞানের ছাত্র।একদিন ওর সাথে কার্জন হলে ঘুরতে গিয়েছি।তখনো আমার ক্লাস শুরু হয় নি, সিলেট এম এ জি ওসমানী মেডিকেল কলেজ এ ভর্তি হয়েছি মাত্র।আমরা হাঁটছি আর কথা বলছি।হঠাৎ শিউলি ফুল দেখে আমি দাঁড়িয়ে যাই,তুর্য কথা বলতে বলতে শিউলি ফুল পায়ে মাড়িয়েই চলে গেল।আমার চিৎকারে ও পিছন ফিরে তাকায়।আমি ওকে ঝাঁঝাল কন্ঠে জিজ্ঞেস করলাম,'তুই এটা কি করলি?'ও জ়ানে,শিউলি ফুল আমার ভীষণ প্রিয়।তাই বুঝতে পেরে বলল,'আমি তো শিউলি ফুল পায়ে মাড়িয়ে চলে গেছি;কয়েকদিন পর তুই কি করবি জানিস,পড়ার চাপে আর টেনশনে শিউলি গাছের মাথায় উঠে বসে থাকবি!'
আজ ২বছর হতে চলল,মেডিকেলের ঘানি টানছি।এখনো আমার হোস্টেলের রুমের বারান্দায় দাঁড়ালে যখন শিউলি গাছটার দিকে চোখ যায় তখন তুর্য কে মনে পড়ে আর নিজেকে কল্পনা করি 'শিউলি গাছের মাথায় জবুথবু হয়ে বসে থাকা অবস্থায়'!সেদিন ওকে অনেক বকে ছিলাম,অনেক বড় বড় কথাও শুনিয়েছিলাম।কিন্তু আজ সত্যিই মাঝে মাঝে এমন অনুভূতি কাজ করে, শিউলি গাছ হোক আর কদম গাছ হো্ক,একটা হলেই হয়.।তাতে আমার কি!
'স্বপ্নে আমি ভেবেছিলাম অনেক কিছুই।এটা করব,সেটা করব;বাড়ি করব পাহাড়চূড়োয় স্বপ্ন এবং সুখের কুটো দিয়ে'।স্বপ্ন দেখায় কার্পণ্য করি নি কখনো।অনেক কিছু হতে চেয়েছিলাম জীবনে,অনেক কিছুই।শুধুমাত্র 'চিকিৎসক' হওয়া ছাড়া!হঠাৎ করেই বাবা-মা'র ইচ্ছা সক্রামিত হল আমার মধ্যেও।বাহ্‌,মন্দ হয় না!স্বপ্নবিলাসী মন আমার শুরু করলো নতুন করে স্বপ্ন দেখা-মেডিকেল নিয়ে!সিওমেক-আমার স্বপ্নের কারখানা।
অবশেষে ক্লাস শুরু হল।হোস্টেলে থাকি,ক্লাস করি।ক্লাসে কিছুই বুঝি না।রাতে রুটিন করে কাঁদি-মা'র জন্য,বাবা'র জন্য,আপু'র জন্য-বাসার জন্য।আর সারাদিণ অঞ্জন দত্তের গান গাই,'বুঝিনি তো আমি আগে,বড় হওয়া বড়ই শক্ত'!ফোনে বাবা সাহস দেন,আপু স্বান্তনা দেয়।কিন্তু মা একটু ভয় পান।যদি নানার মত ডাক্তার হবার বাসনা কে থোড়াই কেয়ার করে আমি ফিরে যাই!বন্ধুরা বলে,'আগেই বলেছিলাম,মেডিকেল ফালতু জায়গা।শুনিস নি।যাই হোক,লেগে থাক-তুই পারবি'।
আস্তে আস্তে পড়াশোনা নিয়ে কষ্টটা কমে আসে।রেগুলার আইটেম দেই,কার্ড দেই।কিন্তু সকাল ৮টায় উঠে ক্লাসে যাওয়া-অসম্ভব!ক্লাসে আমি কেন যাব?ক্লাসে যা পড়ায় তা আমি কিছুই বুঝি না!স্যার-ম্যাডাম রা নিজেরা বুঝে কিনা সন্দেহ!চলতে থাকে দিন,আমিও আমার মতই চলতে থাকি।প্রথম প্রথম সকালে ঘুম থেকে উঠে সবাই যখন এনাটমী বই নিয়ে বসে আমি তখন সত্যিই শিউলি ফুল কুড়াতাম।আর এখন.।।???!!!
মেডিকেলে যারা পড়ে তাদের সবার জীবনটাই একটু অন্যরকম।আমাদেরকে ঠিক পারিবারিক বা সামাজিক জীব বলা যায় না,তাই আমরা-মেডিকেল জীব!একটা সার্ভে তে পড়েছিলাম সবচেয়ে হতাশাগ্রস্থ হয় মেডিকেল শিক্ষার্থীরা!আসলেই তাই।
এর মধ্যেও অনেক ব্যাপার আছে,মেডিকেলে সত্যিকার অর্থেই কেউ 'নিঃস্বার্থ' বন্ধু হয় না!বিশেষ করে মেয়েদের মধ্যে।অনেকেই হয়ত এর ঘোর বিরোধিতা করবেন।কিন্তু এটাই সত্যি।সবার মনেই একটা অলিখিত কম্পিটিশন!এক সিনিয়র আপুর ভাষায়,'মেডিকেল হচ্ছে সেই জায়গা যেখানে একটা ছেলে সাপ্লি খেলে সব ছেলে উঠেপড়ে লাগে ওকে পাশ করানোর জন্য আর একটা মেয়ে সাপ্লি খেলে তাকে মোটামুটি একঘরে করে রাখা হয়'।অবশ্য ছেলেদের মধ্যেও আছে নোংরা রাজনীতি!
৮ অক্টোবর,২০১০।আমরা দো'তলায় ক্লাস করছি। তখন কলেজে ১ম বর্ষের শিক্ষার্থীদের ভর্তি প্রক্রিয়া চলছে।হঠাৎ বাইরে চিৎকার চেঁচামেচি।বাইরে বেরিয়ে হতবাক হয়ে গেলাম,নিচে শিবির-ছাত্রলীগ মারামারি হচ্ছে!ক্লাসের যে ছেলেটা কে নিরীহ বলেই জানতাম,তার হাতেও দেখি অস্ত্র!
এপ্রন কোমরে বেঁধে একজন আরেকজন কে পিটাচ্ছে!অদ্ভুত,এরাই কিছুদিন পর হবে ডাক্তার!হঠাৎ দেখি আমার আশে-পাশে সবাই দৌড়াচ্ছে,পিছনে তাকিয়ে দেখি একজন হকি স্টীক নিয়ে আমাদের ধাওয়া করছে!সিওমেক এ অবশ্য প্রকাশ্য রাজনীতি বন্ধ।তারপর সব ঠাণ্ডা,ছুটির পর আবার পুরোদমে ক্লাস শুরু।
এভাবে চলতে চলতেই চলে এলো ১ম পেশাগত পরীক্ষা।আবার নতুন করে বুঝলাম,মেডিকেল কী জিনিস!শুরু হল অমানষিক কষ্ট।সবাই যখন পড়তে পড়তে অজ্ঞান।আমার তখন উলটো অবস্থা!ইচ্ছে হলে পড়ি ইচ্ছে হলে ঘুমাই, লিস্ট করি-পরীক্ষার পর কী কী করব,সাইকেল কিনব নাকি গীটার!আর ভাবি,কতোদিন খালি পায়ে ঘাসের উপর হাঁটি না!নিজেকে স্বান্তনা দেই গান গেয়ে-'যদি ছেড়ে যেতে বলে শিকড়েবাঁধা মাটি,জেনো ছাড়তে দিব না'!
খুব কষ্ট হয়েছিল সেদিন,যেদিন একমাত্র বোনের বিয়ের দিন সকালে আমাকে সিলেট চলে আসতে হয়েছিল হঠাৎ তারিখ দিয়ে দেয়া পরীক্ষায় বসার জন্য।আমার শিক্ষক মা সেদিন তার এতদিনের গাম্ভীর্য কে অবলীলায় ভুলে গিয়ে শিশুর মত কেঁদে ফেলেছিলেন!
তারপরও আমি স্বপ্ন দেখি।একের পর এক স্বপ্ন গুলো চোখের সামনেই দুঃস্বপ্ন হয়ে যাচ্ছে,তাতে কি!স্বপ্ন দেখা আমার ফুরোয় না।আমার সিওমেক,আমার স্বপ্নের কারখানা।এত কষ্ট,এত ত্যাগ স্বীকারের পরেও আমরা বলতে ভালবাসি, আমরা মেডিকেল জীব!
৬টি মন্তব্য ৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। VF 3 Mini: মাত্র 60 মিনিটে 27 হাজার বুকিং!

লিখেছেন শাহ আজিজ, ২১ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:০৪



আমার ব্যাক্তিগত গাড়ি নেই কিন্তু কর্মসূত্রে বেঞ্জ , ক্যাডিলাক ইত্যাদি ব্যাবহার করার সুযোগ পেয়েছি । তাতেই আমার সুখ । আজ এই গাড়িটির ছবি দেখেই ভাল লাগলো তাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

সাময়িক পোস্ট: বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন

লিখেছেন করুণাধারা, ২১ শে মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


বন্ধ হয়ে গেল সচলায়তন! view this link

সামহোয়্যারইনব্লগ থেকে কয়েকজন ব্লগার আলাদা হয়ে শুরু করেছিলেন সচলায়তন বা সংক্ষেপে সচল ব্লগ। এটি বন্ধ হবার মূল কারণ উল্লেখ করা হয়েছে দুটি:

১)... ...বাকিটুকু পড়ুন

×