একদিন এক কালো ছ্যাংগা (caterpillar) হেলেদুলে হাঁটতে হাঁটতে আমাদের বারান্দায় এসে হাজির। হঠাৎ কী মনে হল! ছ্যাংগা থেকেই তো প্রজাপতি হয়। এই ছ্যাংগা পুষতে হবে। যেই ভাবা সেই কাজ। বিস্কুটের ট্রান্সপ্যারেন্ট বক্সে বাতাস চলাচলের জন্য ফুটো করলাম। কাঠি দিয়ে ছ্যাংগাটাকে ঐ বাক্সে স্থাপন করলাম।পাতা দিলাম খেতে। এই ছ্যাংগাটা কম খেত। নড়াচড়াও কম করত।আসলে ওর দশা পরিবর্ত্নের সময় এসে গেছে। এবার একটু অস্থির মনে হল ওকে। বক্সের মধ্যে ভাল একটা কোনা খুঁজে নিল। এর মধ্যে ছ্যাংগার গায়ের কাঁটা খসে পড়তে শুরু করেছে। ছ্যাংগাটা ওর মুখের লালা আর কাঁটা গুলো দিয়ে একটা আবরণ সৃষ্টি করল, ওর চারপাশে। একটু আধটু বিজ্ঞান জানি। তাই বুঝলাম এটা কোকুন বা গুটি, আর এটা হল মূককীট দশা। এবার অপেক্ষা পূর্ণাংগ মথের। খুব খেইয়াল করে পর্যবেক্ষণ করি বক্সটা। কয়েকদিন যাবার পরে দেখি কোকুন যেন নড়ছে। বেশ কয়েক ঘণ্টায় কোকুন থেকে মিষ্টি (চমচমের ভেতরের গোলাপী রঙ) আর কালো রঙ্গের ফুটি ফুটি দেওয়া এক বিশ্রী পোকা বের হচ্ছে। ইয়াক!!! ঘণ্টা খানেক পরে বুঝি ওটা ছিল পোকাটর পেটের দিক।ধীরে ধীরে মথটার যে পরিবরতন ঘটল সেটা বর্ণনা করার জন্য নয়। শুধু চেয়ে চেয়ে দেখার। মথ তখনো উড়ে যাবার শক্তি অর্জন করেনি। তবুও আমার আম্মা ওটাকে বক্স খুলে খোঁচা দিয়ে উড়িয়ে দিল।আমার সব কাজেই আম্মা অনেক বাগড়া বাঁধায়। সন্ধ্যার অন্ধকারের মাঝে পোকাটা চিরদিনের জন্য হারিয়ে গেল।
এর প্রায় বছর খানেক পরের কথা। সামনে মাস্টার্স ফাইনাল। একটু পড়ালেখায় মনোযোগী হবার চেষ্টা করছি। একদিন বাজার থেকে শাক কিনে আনার পরে আম্মা একটা ফেলে দিচ্ছিল। বা হয়ত বাজারের ব্যাগ থেকে পড়ে গিয়েচিল ঘরে। কীভাবে ঠিক মনে নেই, তবে যেভাবেই হোক পাতাটা আমার হাতে এল। পাতার উপরে এক গুচ্ছ সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ডিম। ডিম তো নয় যেন এক ছড়া মূক্তো। কী যে সুন্দর করে বিন্যস্ত পাতার উপর! কোণ বিচ্ছিরী পোকার ডিম এগুলো ভাবতেই ইচ্ছে করে না। আমি আমার গবেষণা চালানোর জন্য পাতাটা রেখে দিলাম, আগের ছ্যাংগা পোষার বাক্সে।
একদিন, দুই দিন। দিম আর ফোটে না। পাতাটাও শুকিয়ে যাচ্ছে। প্রায় ভুলতে বসেছিলা। এমন সময়, থিক ১৫ দিন পরে বক্সটা হাতে নিয়ে দেখি অনেকগুলো সূক্ষ্ণ সূক্ষ্ণ ছ্যাংগা (শূককীট) হেঁটে বেড়াচ্ছে। ওরা এত স্বচ্ছ যে প্রায় দেখাই যায় না। পিঁপড়ার চেয়েও ছোট। জলদি রাতুলকে (আমার এই সব কাজের সংগী, ছোট্ট কাজিন)নিয়ে এক ছুটে চলে গেলাম ছাদে। সেখান থেকে গাছের কচি পাতা নিয়ে এলাম। ছ্যাংগাগুলো পাতা খেতে শুরু করল।ওদের জন্য পাতাটা শক্ত ছিল।ওরা লালা দিয়ে ভিজিয়ে নরম করে কেটে কেটে খাচ্ছিল। আর সব কটা একটা একটা পাতায় আক্রমণ করছিল। একটা পাতা খাওয়া শেষ হলে সবাই মিলে অন্য পাতায় আক্রমণ। খুন দ্রুত ওরা পাতা খেয়ে শেশ করছিল।
খেয়াল করলাম, ছ্যাংগাগুলো ১দিন প্রচুর খায়। আর ১দিন ঘুমায়। এই ঘুমে ওরা বেশ বড় হয়ে যায়। তারপর ঘুম খেকে উঠে আবার প্রচণ্ড হারে খেতে থাকে। এবার ওদের গায়ের রঙ হল পাতার রসের মত। ওদের স্বচ্ছ শরীরের ভেতরে শুধুই পাতার রস। আর সবাই মিলে যখন একসাথে পাতা খায় তখন কুট কুট কুট কুট শব্দ হয়। এক ছন্দে। একটা পারায় এক গাদা ছ্যাংগা এত বিশ্রী লাগে দেখতে! গা ঘিন ঘিনে। আম্মাকে বললাম, ‘’ফেলে দিই। ভাল্লাগে না।‘’ আম্মা বল্ল,’’আরো কয়টা দিন দেখ। কেমন প্রজাপতি হয় দেখবি না?’’
১৫ দিনে ছ্যাংগাগুলো আরো বড় হল। গায়ের রঙ কালো হল। গায়ের কাঁটাও আরো বড় হল। আমি গুণে দেখলাম সর্ব মোট ৩২টা ছ্যাংগা। ওরা এত বড় হয়ে গেল যে, এবার ওরা আর এক সাথে থাকতে চায় না। পরস্পরেরথেকে দূরত্ব বজায় রকাহতে চায়। একজনের কাঁটায় আরেকজনের খোঁচা লাগে। ওরা বিচ্ছিন্ন হতে চায় এবার। ওদের ছোট্টবেলার একতা যেন আর টিকে না। আমি একটা শিক্ষা পেলাম এই বিশ্রী ছ্যাংগাগুলো থেকে। দূর্বলেরা সব সময় একত্রে থাকতে চায়। আর এভাবে ওরা অনেক বড় কিছু করে। কিন্তু যখন শক্তিশালী হতে থাকে ওরা বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। একাই রাজার মত চলতে চায়। কাছে গেলেই রেষারেষি।
যাই হোক, ৩২টা ছ্যাংগাকে এক বাক্সে জায়াগা দিতে আমার এখন হিমশিম অবস্থা। একটা PET বোতলে বাতাস চলাচলের জন্য ফুটো করে কয়েক্টাকে সেখানে স্থানান্ত্র করলাম। এবার আম্মা গাইগুই শুরু করলেন, ‘’ফালা এগুলা, ফালা।‘’ কিন্তু আমার তো এত দিনে মায়া পড়ে গেছে। ‘’দেখি না, কেমন প্রজাপতি হয়!’’ আমার মাস্টার্স পরীক্ষা শুরু হয়ে গেছে। ওদের প্রতি আগের মত মনোযোগ দিতে পারছি না। আমার ছোট মামা ওদের তদারকির ভার নিলেন।
ছ্যাংগা পোষা তেমন কথিন কিছু না। শুধু পাতা খেতে দিতে হয়। ওরা খাবার পরে যখন ঘুমায় তখন আমি লম্বা কাঠি দিয়ে ওদেরকে বাক্স থেকে নামিয়ে বাক্সটা পরিষ্কার করে ফেলি। তারপর আবার ওদের বাক্সে রেখে দেই।ছোট মামা আমাকে এই ব্যাপারে সাহায্য করত।
ছ্যাংগাগুলো আরো বড় হল। এবার ওরা খাওয়া কমিয়ে দিল। চলত হেলেদুলে। হঠাৎ ওরা একটু অস্থির হয়ে গেল। আসলে তখন ওদের দশা পরিবর্তনের সময় এসেছে। কোকুন তৈরির জন্য ভাল জায়গা এ সময় ওরা খোঁজে। কিন্তু ওদের তো বাক্সের বাইরে যাবার অনুমতি নেই। ওদের গায়ের কাঁটা খসে পড়তে শুরু করছে। গাও আঠালো হয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যে বাক্সটাও পরিস্কার কারা হয়নি। আমি ব্যস্ত পড়া নিয়ে। খেয়াল করি নি ব্যপারটা। ছোট মামাও কাজে ফাঁকি দিল।
পরীক্ষা দিয়ে বাসায় এসে দেখি অনেকগুলো ছ্যাংগা একসাথে আঠালো হয়ে জট পাকিয়ে গেছে। কয়েকটা কোকুন তৈরি করতে পেরেছে। এ অবস্থায় বাক্স খুলে পরিষ্কার করতে গেলে ওরা আরো ক্ষতিগ্রস্ত হয়। শেষ পর্যন্ত মাত্র তিনটা পূর্ণাংগ মথ হিসেবে পূণতা লাভ করতে পারে। বাকিদের মৃত্যুর জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হল। এবার নোংরা বাক্সটা ফেলে দিলাম।
পর্ব১।http://www.somewhereinblog.net/blog/eijeduniya/29435621
পর্ব ২।http://www.somewhereinblog.net/blog/eijeduniya/29435623
পর্ব৩।http://www.somewhereinblog.net/blog/eijeduniya/29436110