বহুদিন হলো ঝড় দেখিনা।বৃষ্টির সাথে পাগলা হাওয়ার মিতালী আর চোখে পড়েনা।দুরন্ত বাতাসের মাঝে এলোমেলো উড়ে চলা কাকদেরও দেখা হয়না।এতটাই গুটিয়ে গেছি আমি।অথচ একটা সময় ছিল,যখন বৃষ্টি হলেই বারান্দায় ছুটে যেতাম।গ্রীলের ফাঁক দিয়ে হাত বাড়িয়ে জলধারা স্পর্শ করতাম।মাঝে মাঝ মায়ের চোখ ফাঁকি দিয়ে উঠে যেতাম ছাদে।মনের সুখে বৃষ্টিবিলাস করতাম।টের পেয়ে মা-ও চলে আসতেন আর গালাগালি করতেন।ঠাণ্ডার ধাত ছিল আমার।সামান্য কিছুতেই হুলস্থুল অসুখ বাধিয়ে বসতাম।তাই মায়ের আকুতি,”আর ভিজিস না বাবা,ঠাণ্ডা লেগে যাবে”।কিন্তু কে শুনে কার কথা।আমিও শুনিনি।মা রাগ করে চলে যেতেন।কিছুক্ষণ পর কাকভেজা হয়ে বাসায় ফিরতাম।ঘরে ঢুকতেই মা’র অগ্নিদৃষ্টি।আমি সেই দৃষ্টির তোয়াক্কা না করে চটজলদি বাথরুমে ঢুকে গোসল সেরে আবার বারান্দায় ছুটতাম।বৃষ্টি আমার এতো ভাল লাগতো!
সেই আমি আজ খোলসবন্দী।বাইরের পৃথিবী আমাকে আর টানেনা।গৎবাঁধা নিয়মে জীবন চলে যাচ্ছে।বলতে গেলে আমার অখন্ড অবসর।আসলেই কি?বেঁচে থাকার মত অসহনীয় কাজটা যে আমাকে দিনের পর দিন করে যেতে হচ্ছে!এর থেকে মুক্তি কি নেই?
আমাদের সম্পর্ক ছিলো ২ বছরের।এই সময়ের প্রতিটা মুহূর্ত আমরা নিজেদের মত করে সাজিয়ে নিয়েছিলাম।রবি ঠাকুরের একটা কথা সেই সময় আমার মনে খুব দাগ কেটেছিলো।“দাম্পত্য হলো আর্টের মত,একে প্রতিদিন নতুনভাবে সৃষ্টি করা চাই।“কথাটা প্রথম যেদিন তাকেবলেছিলাম,শুনে তার সে কি হাসি!হাসিটা তার সুন্দর ছিলো।ছিলো?সুন্দর কিছু কি সময়ের গহবরে হারিয়ে যেতে পারে?কি জানি,পারে হয়ত?তা না হলে তার তো এই অসময়ে চলে জাবার কথা ছিলোনা।
সেদিন ঘুম থেকে উঠেই ফোন দিলাম বিথিকে।রিসিভ করলোনা।ভাবলাম,হয়ত ব্যাস্ত ছিলো তাই দ্বিতীয়বার আর দিলাম না।ক্যাম্পাস এ গিয়ে দেখি ও তখনো আসেনি।আবার ফোন দিলাম।এবার ফোন বন্ধ।বুঝতে পারলাম না হঠাৎ কি হলো।তবে ব্যাপারটা নিয়ে তেমন একটা মাথা ঘামালাম না।কিন্তু রাতেও যখন ফোনে পেলাম না,তখন বুকে ছোট্ট একটা ধাক্কার মত লাগলো।এমন তো কখনো হয়নি!সে রাতে আমার আর ঘুম হলনা।বিছানায় শুয়ে শুয়ে শুধু ওর কথাই ভেবেছি।ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পরলাম মনে নেই।ঘুম ভাঙলো ফোনের রিংটোন শুনে।রিসিভ করতেই ওপাশ থেকে ওর গলা শুনলাম।আমি হ্যালো বলার আগেই ও বলা শুরু করলো।“শোনো,তুমি এক্ষুনি লেকের পাড়ে চলে আসো,খুব জরুরি।রাখছি এখন।”খুব অস্পষ্ট হলেও বুঝতে পারলাম ওর গলা কাঁপছিলো।কাঁদছিলো নাকি?যাই হোক,এতসব চিন্তা বাদ দিয়ে দ্রুতই চলে গেলাম সেখানে।একটু পর সেও আসলো।কিন্তু একি!এ আমি কাকে দেখছি?দ্বিধান্বিত চোখ,চোখের নিচে কালি,মনে হচ্ছে একদিনে ওর বয়স দ্বিগুন হয়ে গেছে।হাঁটার মাঝে অনভ্যস্ত জড়তা।আমার একদম সামনে এসে দাঁড়ালো,কিন্তু মনে হচ্ছেনা সে আমাকে দেখছে।দু’হাত দিয়ে ওর মুখটা তুলে ধরতেই ঝরঝর করে কেঁদে দিলো।আমি শুধু বোকার মত ওর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।কান্নার ফাঁকে ফাঁকে ওর কথা থেকে যেটুকু বুঝলাম তার সারমর্ম হচ্ছে,ওর অন্য জায়গায় বিয়ে ঠিক হয়ে গেছে।এখন আমাদের পালিয়ে গিয়ে বিয়ে করতে হবে।এই মুহূর্তে কি এটা সম্ভব?আমি তাকে বুঝাতে চাইলাম,আমাদের পড়ালেখা শেষ হতে আরো ২ বছর বাকি।তারপরও বিয়ের জন্য প্রস্তুত হতে কমপক্ষে ১ বছর লাগেই।তুমি তোমার ফ্যামিলিকে বুঝাও।
কিন্তু সে কিছুতেই মানতে চাইছিলোনা।ওর বাবা নাকি আমাদের সম্পর্ক কখনোই মেনে নেবেনা।যা করার এখনি করতে হবে।আর তা না হলে সে আত্মহত্যা করবে।আমি এটাকে তেমন পাত্তা দিলাম না।এমন তো হয়ই।আমি ওকে আমাদের ব্যাপারটা বাসায় জানাতে বললাম।যদি কিছু করা যায়।ও বলল সম্ভব না।কিন্তু পালিয়ে যাওয়াটাও কি তখন সম্ভব ছিলো?আমি আসলেই বুঝতে পারিনি তখন আমার ঠিক কোন কাজটা করা উচিত ছিলো।যা করেছিলাম তা হয়ত ভুল করেছি।কিন্তু সেই পরিস্থিতিতে এর চেয়ে ভালো কিছু চিন্তা করাও আমার পক্ষে সম্ভব ছিলোনা।বিথিকে ওই মূহুর্তে বাড়ি পাঠিয়ে দেয়াটা অনেকের কাছে আমার কাপুরুষতা হিসেবে চিহ্নিত হতে পারে।হয়ত আমি কাপুরুষই ছিলাম।চলে যাবার সময় ওর চোখে আমি আর্তনাদ দেখেছি।কিন্তু হৃদয়টাকে কিছু সময়ের জন্য পাষাণ করে রাখতে হয়েছিলো।তখন ঘুর্ণাক্ষরেও বুঝতে পারিনি ওই চোখ আমি শেষবারের মত দেখছি।
পরদিন ভোরে যখন পুলিশ এসে আমাকে ধরে নিয়ে গেলো তখনো আমি জানিনা আমি কি হারিয়ে ফেলেছি।৩০টি ঘুমের ওষুধ বিথিকে আমার কাছ থেকে সময়ের আগেই কেড়ে নিলো।আত্মহত্যার প্ররোচনার অভিযোগে আমাকে ছ’মাস জেল খাটতে হলো,এতে আমার বিন্দুমাত্র কষ্ট নেই।ওর জন্যে আমি সারাজীবন হাসিমুখে বন্দীশালায় কাটিয়ে দিতে পারতাম।কিন্তু এভাবে ও নিজেকে শেষ করে দিলো!আমার মৃত্যুর আগ পর্যন্ত আমার ভালোবাসাকে হত্যার জন্য আমি তাকে অভিযুক্ত করে যাবো।।
আকাশে কি মেঘ করেছে?বৃষ্টি হলে ভাল হত।প্রচণ্ড বৃষ্টির মাঝে প্রথম যেদিন ও আমার হাত ধরেছিলো,তখন থেকে আমার প্রিয় বৃষ্টির দিনগুলো আরো বেশি মধুর হতে লাগলো।আমি জানি,সেই অনুভূতি আর কখনোই ফিরে আসবেনা।তবুও আজ বহুদিন পর আমি বৃষ্টি চাই।মানুষটা আমার পাশে নেই,কিন্তু তার সঙ্গে কাটানো মূহুর্তের স্মৃতিগুলো আছে।স্বার্থপরের মত সে নিজেকে ধবংস করেছে,স্মৃতিগুলোকে পারেনি।বেঁচে থাকার জন্য অবলম্বন হিসেবে এটুকুই আছে আমার।এখন অপেক্ষা শুধুই কয়েক ফোঁটা বৃষ্টি্র।।
=O=
******অনেকদিন পর গল্প লিখলাম।ভালো হয়নি বুঝতে পারছি।গঠনমুলক সমালোচনা আশা করছি।*******
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১২:৫০