আদিবাসী বিতর্ক
আদিবাসী বিতর্ক
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে মূল তর্ক শুরু হলেও পাশাপাশি আলোচনায় উঠে এসেছে দেশের ক্ষুদ্র জাতিসত্তার মানুষদের পরিচয়ের প্রশ্ন। ক্ষুদ্র জাতিসত্তার এই মানুষরা বাঙালি নয়, ভূতাত্তি্বক জাতীয়তাবাদে তারা বাংলাদেশি হলেও নৃতাত্তি্বক জাতি পরিচয়ে তারা সম্মিলিতভাবে কী নামে অভিহিত হবে, সেটা নিয়ে নতুন করে আলোচনা শুরু হয়েছে। তাদের মূল দাবি, নিজেদের আদিবাসী হিসেবে পরিচিত করা। কিন্তু এই 'আদিবাসী' শব্দে আপত্তি আছে সরকারের। তর্কটা শুধু সরকার আর সংখ্যালঘু জনগোষ্ঠীর মধ্যেই সীমাবদ্ধ নেই, রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে দীর্ঘদিন ধরে আত্মপরিচয় প্রশ্নে একটি বড় জনগোষ্ঠী যখন কথা বলে উঠে, তখন সেই আলোচনা সাধারণেও ছড়িয়ে যায়। ক্ষুদ্র নৃতাত্তি্বক এই জনগোষ্ঠী কি 'উপজাতি', 'আদিবাসী', নাকি শুধুই বাংলাদেশি হিসেবে পরিচিত হবে? সম্প্রতি জোরেশোরে শুরু হওয়া এই প্রশ্নেই আলোকপাত করেছেন অনিক শাহরিয়ার--
সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে একটি রাজনৈতিক ধারণা ছিল যে বর্তমান মহাজোট সরকার ১৯৭২ সালের সংবিধান পুনঃস্থাপন করবে। কিন্তু পরিবর্তিত বাস্তবতায় সেটি সম্ভব হয়নি, যদিও আওয়ামী লীগ তার রাজনৈতিক প্রতিশ্রুতির জায়গায় অনেক পরিবর্তন এনেছে।
'৭২ সালের সংবিধানে ফিরে যাওয়ার ক্ষেত্রে নীতিগত জটিলতা তৈরি হয় এ দেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের মাঝে। '৭২ সালের সংবিধানে বাংলাদেশের জনগোষ্ঠী হিসেবে বাঙালি ভিন্ন অন্য কোনো জাতিসত্তার উপস্থিতি বাংলাদেশের ভূখণ্ডে অস্বীকার করা হয়েছে।
কিন্তু বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বসবাস করে আসা অনেক পাহাড়ি ও সমতলী জাতিসত্তা নিজেদের স্বতন্ত্র পরিচয়ের দাবিতে এই প্রশ্নটিকে সামনে নিয়ে আসে। আর এই নিয়ে আসার কারণেই রাজনীতিতে আলোচিত বিষয় হয়ে দাঁড়ায় আদিবাসী বিতর্ক। মূল জনস্রোত বাঙালির বাইরে বাংলাদেশে চাকমা, গারো, সাঁওতাল, মুরং, হাজং, কোচসহ অনেক জাতিসত্তার মানুষ বসবাস করে থাকে। নাগরিকত্ব এবং জাতিগত পরিচয় দুটো ভিন্ন বিষয় হওয়ায় নাগরিক হিসেবে এরা প্রত্যেকে বাংলাদেশি হলেও বাঙালির বাইরের জনগোষ্ঠী নিজেদের জাতিগত পরিচয়ে রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পেতে উদগ্রীব। এ নিয়ে দীর্ঘদিন ধরেই আলোচনা চলছিল বিভিন্ন পর্যায়ে।
কিন্তু পঞ্চদশ সংশোধনী এই আলোচনাকে গতি দেয়। আর আলোচনাটিকে বড় করে তুলেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি। গত ২৬ জুলাই তিনি বিদেশি কূটনীতিক ও উন্নয়ন সহযোগী গোষ্ঠী এবং সাংবাদিকদের আলাদা আলাদা ব্রিফিং করে দেশের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র জাতিগুলোকে 'আদিবাসী' হিসেবে অভিহিত করতে বারণ করেছেন এবং পক্ষান্তরে তাদের 'জাতিগত সংখ্যালঘু' বা 'উপজাতি' (ট্রাইবাল) হিসেবে আখ্যায়িত করার পরামর্শ দিয়েছেন।
ডা. দীপু মনির এই বক্তব্যে সরকারের অবস্থান পরিষ্কার হয়ে গেছে। সম্প্রতি বিভিন্ন তৎপরতা থেকেও এটি পরিষ্কার যে সরকার পার্বত্য অঞ্চলের অবাঙালি জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে রাজি নয়।
আদিবাসী বলতে কী বোঝায়
বাংলাদেশের আদিবাসী কারা
ইংরেজি রহফরমবহড়ঁং শব্দটির বাংলা হচ্ছে 'আদিবাসী'। আদিবাসী বলতে জাতিসংঘের স্পেশাল ড্যাপেটিয়ার হোসে মার্টিনেজ কোবোর যে সংজ্ঞা জাতিসংঘ 'ওয়ার্কিং ডেফিনেশন' হিসেবে ১৯৮৪ সালে গ্রহণ করেছে, তা বিশেষভাবে প্রণিধানযোগ্য। এতে বলা হয়েছে, 'আদিবাসী সম্প্রদায়, জনগোষ্ঠী ও জাতি বলতে তাদের বোঝায়, যাদের ভূখণ্ডে প্রাক-আগ্রাসন এবং প্রাক-উপনিবেশকাল থেকে বিকশিত সামাজিক ধারাসহ ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতা রয়েছে, যারা নিজেদের ওই ভূখণ্ডে বা ভূখণ্ডের কিয়দংশে বিদ্যমান অন্যান্য সামাজিক জনগোষ্ঠী থেকে স্বতন্ত্র মনে করে। বর্তমানে তারা সমাজে প্রান্তিক জনগোষ্ঠীভুক্ত এবং নিজস্ব সাংস্কৃতিক বৈশিষ্ট্য, সামাজিক প্রতিষ্ঠান ও আইনব্যবস্থার ভিত্তিতে জাতি হিসেবে তাদের ধারাবাহিক বিদ্যমানতার আলোকে তারা তাদের পূর্বপুরুষদের ভূখণ্ড ও নৃতাত্তি্বক পরিচয় ভবিষ্যৎ বংশধরদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য দৃঢ়প্রতিজ্ঞ।' অন্যদিকে ১৯৮৯ সালে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) ১৬৯নং কনভেনশনে আদিবাসী বলতে বলা হয়েছে, 'স্বাধীন দেশগুলোর জাতিসমূহ, যারা এই মর্মে আদিবাসী হিসেবে পরিগণিত যে তারা ওই দেশটিতে কিংবা দেশটি যে ভৌগোলিক ভূখণ্ডে অবস্থিত সেখানে রাজ্য বিজয়, কিংবা উপনিবেশ স্থাপন, কিংবা বর্তমান রাষ্ট্রীয় সীমানা নির্ধারণকাল থেকে বসবাসকারী জনগোষ্ঠীর বংশধর, যারা তাদের আইনসংগত মর্যাদা নির্বিশেষে নিজেদের সামাজিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক কাঠামোর অংশবিশেষ বা সম্পূর্ণ লালন করে চলেছে।'
দেখা যাচ্ছে, জাতিসংঘ যাদের আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দেয়, তাদের ক্ষেত্রে কয়েকটি সংজ্ঞা নির্দিষ্ট করে দিয়েছে। সহজ ভাষায় তারাই আদিবাসী, যারা ১. কোনো উপনিবেশ স্থাপনের আগে থেকেই ওই ভূখণ্ডে বাস করছিল এবং ২. যারা ভূখণ্ডে নিজস্ব জাতিসত্তার সংস্কৃতিকে ধরে রেখেছে।
এই সংজ্ঞানুসারে আদিবাসীর উদাহরণ হতে পারে অস্ট্রেলিয়া, আমেরিকা কিংবা নিউজিল্যান্ডের আদিবাসীরা। এই দেশগুলোর আদিবাসীরা প্রথম থেকেই সেখানে ছিল, কিন্তু পরবর্তী সময়ে শ্বেতাঙ্গ ঔপনিবেশিক দেশগুলো ভূখণ্ড অধিকার করে নিয়ে নিজেদের সংখ্যাগুরু করে ফেলে। নিজেদের ভূখণ্ডে নিজেরাই সংখ্যালঘু হয়ে পড়া এই মানুষরাই পরবর্তী সময়ে ওইসব দেশের আদিবাসী হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে।
কিন্তু এই একই যুক্তি কি বাংলাদেশের সংখ্যালঘু জাতিসত্তার মানুষদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে? ৫৫ হাজার বর্গমাইলের এই বাংলাদেশে বাঙালিরা বাইরে থেকে এসে দখল করে নেয়নি। বরং উন্মুক্ত এই ভূখণ্ডে বিভিন্ন জাতির আগমনে ধীরে ধীরে বাঙালি একটি স্বতন্ত্র জাতি হিসেবে সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমার খুব ক্ষুদ্র কিছু অংশে বিশেষ করে পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়ি জাতিগোষ্ঠীর মানুষের উপস্থিতি থাকলেও বাংলাদেশের প্রায় গোটা ভূখণ্ডের ওপর কখনোই তাদের দখল ছিল না এবং বাঙালিরা কখনোই এই ভূখণ্ড কোনো চাকমা, ত্রিপুরা, হাজং, সাঁওতালদের কাছ থেকে দখল করে রাজত্ব কায়েম করেনি। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট জনসংখ্যার মাত্র ১.২ শতাংশ মানুষ কখনোই এই ভূখণ্ডের মূল মালিক হিসেবে দাবি করতে পারছে না।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী তাঁর বক্তব্যে দাবি করেছেন, মোগল শাসনামলে প্রতিবেশী বিভিন্ন দেশ ও মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠী থেকে রাজনৈতিক ও সামাজিক আশ্রয়ের জন্য অভিবাসী হিসেবে পার্বত্য চট্টগ্রামে বিভিন্ন উপজাতি গোষ্ঠী আশ্রয় নেয়। এই হিসেবে পার্বত্য অঞ্চলে অবাঙালি এই জনগোষ্ঠীর অবস্থান মাত্র কয়েক শতকের। অন্যদিকে পররাষ্ট্রমন্ত্রী ব্রিফিংকালে জানান, এই অঞ্চলে অন্তত চার হাজার বছর ধরে বাঙালিরা বাস করে আসছে।
বাংলাদেশের রাষ্ট্রসীমাকে বিবেচনায় নিলে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর এই বক্তব্যে সত্যতা আছে। কিন্তু একই সঙ্গে এই বিষয়টিও সত্য যে পাহাড়ি অঞ্চলে মোঙ্গলীয় জাতিগোষ্ঠীর আগমনের আগে পাহাড়ি অঞ্চলে বড় কোনো বাঙালি জনগোষ্ঠীর অস্তিত্বের প্রমাণ পাওয়া যায় না।
পাহাড়ের আদিবাসী নাকি রাষ্ট্রের আদিবাসী
পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যের পরে আদিবাসী বিতর্ক আরেকটু জোরালো হয়ে ওঠে। বিভিন্ন পক্ষ নিজেদের মতামত বিভিন্নভাবে ব্যক্ত করেছে। মুক্তমনা ব্লগে মঙ্গল কুমার চাকমা পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যকে অজ্ঞতাপ্রসূত বলে অভিহিত করে বলেন, 'বস্তুত প্রাক-ঔপনিবেশিক আমলে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রাম তথা তৎকালীন চাকমা রাজ্য বাংলারই কোনো অংশ ছিল না। সে সময় বর্তমান চট্টগ্রামের অধিকাংশ অঞ্চলসহ পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চল ছিল একটি স্বাধীন সামন্ত রাজ্য। ১৫৫০ খ্রিস্টাব্দে ঔড়ধ ফব ইধৎৎড়ং নামের এক পর্তুগিজ মানচিত্রকরের আঁকা একটি মানচিত্র থেকে তৎকালীন 'চাকোমাস' বা চাকমা রাজ্যের সুস্পষ্ট অবস্থান সম্পর্কে প্রমাণ মেলে। এ মানচিত্রে চাকমা রাজ্যের সীমানা সুস্পষ্টভাবে দেখানো হয়েছে, উত্তরে ফেনী নদী, দক্ষিণে নার্মে বা নাফ নদী, পূর্বে লুসাই হিলস এবং পশ্চিমে সমুদ্র।
১৭৬৩ সালে ইস্ট ইন্ডিয়া কম্পানি দ্বারা নিযুক্ত চট্টগ্রাম কাউন্সিলের প্রথম প্রধান কর্মকর্তা ঐবহৎু ঠবৎবষংঃ সরকারিভাবে ঘোষণার মাধ্যমে স্বীকার করেন যে চাকমা রাজা শেরমুস্ত খাঁর আমলে চাকমা রাজ্যের সীমানা ছিল ফেনী থেকে সাঙ্গু নদী এবং নিজামপুর রোড থেকে কুকি রাজ্য পর্যন্ত। মোগল ও নবাবি আমলে বর্তমান পার্বত্য চট্টগ্রামসহ রাঙ্গুনিয়া, রাউজান ও ফটিকছড়িসহ বিস্তীর্ণ অঞ্চল কার্পাস বা কাপাস বা তুলা মহল হিসেবে পরিচিত ছিল। পার্শ্ববর্তী চট্টগ্রাম জেলার ব্যবসায়ীদের সঙ্গে পার্বত্য এলাকার আদিবাসী জুম্মদের পণ্য বিনিময় ও ব্যবসা-বাণিজ্য করার সুবিধা প্রদানের বিনিময়ে চাকমা রাজারা সুনির্দিষ্ট পরিমাণ কার্পাস বা তুলা চট্টগ্রামের মোগল রাজপ্রতিনিধিকে প্রদান করতেন। এ 'কার্পাস শুল্ক' কোনো করদ রাজ্যের মতো কর ছিল না। ভারত বিভক্তির সময় বাঙালিদের জনসংখ্যা ছিল মাত্র ১.৫ শতাংশ, যারা মূলত চাকরি ও ব্যবসায়িক উদ্দেশ্যে সেখানে সাময়িকভাবে বসবাস করত। এসব তথ্যই প্রমাণ করে যে পার্বত্য চট্টগ্রামে জুম্ম জনগোষ্ঠীর তুলনায় বাঙালিদের বসতি অতি সাম্প্রতিককালের।'
সাম্প্রতিক ইতিহাস পর্যালোচনা করলেই এটি বোঝা যায় যে পাহাড়ে বাঙালিদের ইতিহাসের তুলনায় চাকমা এবং অন্যান্য নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর ইতিহাস অনেক বেশি প্রাচীন। সে ক্ষেত্রে পাহাড়ে এসব পাহাড়িই আদিবাসী, এ বিষয়ে হয়তো বিতর্ক তোলার অবকাশ খুব কম।
কিন্তু এই পাহাড়িরা কি পাহাড়ের আদিবাসী হিসেবে নিজেদের দাবি করছে? না। পাহাড়িরা দাবি করছে, বাংলাদেশের সংবিধানে আদিবাসী হিসেবে নিজেদের পরিচয় লিপিবদ্ধ করতে। আদিবাসী কোনো একটি অঞ্চলের হয় না, আধুনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানের আলোচনায় আদিবাসী বলতে বোঝায় কোনো রাষ্ট্রের প্রথম জনগোষ্ঠীর কথা। এখন যদি সংবিধান ও রাষ্ট্র পাহাড়ি ও সমতলের কিছু অবাঙালি নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বীকার করে নেয়, তাহলে রাষ্ট্রের ইতিহাস অনাবশ্যক জটিলতার মুখে পড়বে। আর যদি আঞ্চলিক আদিবাসী হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হয়, তাহলে এ রকম আরো নতুন নতুন আদিবাসীর দাবি তৈরি হবে। পুরান ঢাকা বলে অভিহিত অঞ্চলের লোকজন, যাদের 'ঢাকাইয়া' বলা হয়, তারাও নিজেদের আদিবাসী হিসেবে দাবি করতে পারবে।
সে ক্ষেত্রে এই সংখ্যালঘু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ কি আলাদাভাবে স্বীকৃতি পাবে না? তাদের নিজস্ব সংস্কৃতি কি উপেক্ষিত থাকবে রাষ্ট্রের কাছে? সেটা সম্ভব নয়। আর সম্ভব নয় বলেই সরকার এদের ট্রাইব বা উপজাতি হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে।
জুম্মজাতি থেকে আদিবাসী
স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান গৃহীত হয় ১৯৭২ সালের যে সংসদে, তার একজন সদস্য ছিলেন মানবেন্দ্র লারমা। '৭০-এর গণজোয়ারেও তিনি পাহাড় থেকে স্বতন্ত্র সদস্য হিসেবে নির্বাচিত হয়েছিলেন। '৭২ সালের অক্টোবরে যখন সংসদে দেশের প্রথম সংবিধান গৃহীত হয়, তখন সেখানে ৩নং ধারায় জাতীয়তা নির্ধারণ করে দিয়ে বলা হয়, 'বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে, বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালি বলিয়া পরিচিত হইবেন।' সংবিধানের এই জাতীয়তাবাদ নির্ধারণের প্রতিবাদ করে ওয়াক আউট করেছিলেন মানবেন্দ্র লারমা। বলেছিলেন, 'সংবিধান হচ্ছে এমন এক ব্যবস্থা, যা অনগ্রসর জাতিকে পিছিয়ে পড়া ও নির্যাতিত নীতিতে অগ্রসর জাতির সঙ্গে সমান তালে এগিয়ে নিয়ে আসার পথ নির্দেশ করবে। কিন্তু বস্তুত এই পেশকৃত সংবিধানে সেই রাস্তার সন্ধান পাচ্ছি না।'
অবিস্মরণীয় এই নেতা '৭৩ সালের সংসদেও স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবেই জয়লাভ করেছিলেন। সর্বক্ষণ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর অধিকার নিয়ে উচ্চকিত থেকেছেন তিনি। এর মধ্যেই জনসংহতি সমিতি গঠন করেন, পাহাড়ের ১১টি জাতিগোষ্ঠীকে ঐক্যবদ্ধ করে জুম্ম জাতির রূপরেখা প্রণয়ন করেন এবং জুম্ম জাতির স্বীকৃতি আদায় করার জন্যই নিয়মতান্ত্রিক আন্দোলন পরিচালনা করেন।
এমনকি সামরিক সরকারের আগ্রাসনে যখন পার্বত্য অঞ্চলে পাহাড়িদের সংখ্যালঘু করে তোলার জন্য সামরিক জান্তারা চক্রান্ত করছে এবং জনসংহতি সমিতি সামরিক শাখা গঠন করছে, তখনো কোনো অংশ থেকেই 'আদিবাসী' হিসেবে কোনো দাবি উঠে আসেনি। পাহাড়িদের বিভিন্ন সংগঠন সেই সময় পাহাড়ি সংগঠন হিসেবেই পরিচালিত হয়েছে, আদিবাসী হিসেবে নয়।
কিন্তু বিশেষ করে গত কয়েক বছর ধরে 'আদিবাসী' হিসেবে স্বীকৃতির দিকে ঝুঁকে পড়েছেন সংখ্যালঘু নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর নেতারা। তাঁরা সরে এসেছেন সেই আগের জুম্ম জাতির দাবি থেকে। এই সরে আসাটা কি নিছকই রাজনৈতিক বিবর্তন, নাকি এর পেছনে কোনো দূরদর্শী রাজনৈতিক চাল আছে, সেটি বিবেচনার দাবি রাখে।
আদিবাসী স্বীকৃতি ও আইএলও কনভেনশন ১৬৯
শব্দ ও ব্যাকরণগত আলোচনায় পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর এক অংশ এবং বাংলাদেশের সুশীল সমাজের কিছু সদস্য ও এনজিওরা আদিবাসী নিয়ে ব্যবচ্ছেদ করলেও, আইএলও কনভেনশন ১৬৯-এর জটিলতার কথা কোথাও তেমন করে আলোচনা হচ্ছে না। কিন্তু আদিবাসী হিসেবে কোনো নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে স্বীকৃতি দেওয়াটা শুধু একটি শব্দগত স্বীকৃতির বিষয় নয়, এর সুদূরপ্রসারী ও দীর্ঘমেয়াদি প্রতিক্রিয়া আছে।
রাষ্ট্রের মধ্যে কোনো একটি নির্দিষ্ট জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী হিসেবে স্বতন্ত্র স্বীকৃতি দেওয়া হলে, আইএলও কনভেনশন ১৬৯ মানার নৈতিক দায়িত্ব এসে বর্তাবে বাংলাদেশের ওপর। যৌক্তিক কারণেই বাংলাদেশসহ অনেক দেশ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি এখনো।
আসুন কনভেনশন ১৬৯-এর কয়েকটি ধারায় চোখ বোলানো যাক।
ধারা-৪ এ বলা হয়েছে, 'সুস্পষ্টভাবেই আদিবাসী অধ্যুষিত অঞ্চলটিকে এক ধরনের স্বায়ত্তশাসনের অধীনে নিয়ে আসতে হবে।'
আসুন, কনভেনশনের ১৫.১ ধারাটিতে একটু চোখ বোলানো যাক। বলা হচ্ছে,
'আদিবাসীরা বাস করে এমন কোনো এলাকায় কোনো খনিজ সম্পদের সন্ধান পাওয়া গেলে সেগুলোর ওপর আদিবাসী জনগোষ্ঠীর আলাদা অধিকার জন্মাবে।'
৩২ ধারায় বলা হচ্ছে,
'আশপাশের দেশগুলোর মধ্যের একই জনগোষ্ঠীগুলোর লোকজনের অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, আধ্যা@ি@@@ক ও পরিবেশগত যোগাযোগ ও সহযোগিতা নিশ্চিত করতে সরকারকে উদ্যোগ নিতে হবে এবং প্রয়োজনে আন্তর্জাতিক চুক্তি করতে হবে।'
এর মানে কি ভারতের ত্রিপুরা রাজ্য কিংবা মিয়ানমারের কোনো অঞ্চলের সঙ্গে আমাদের দেশের বিশেষ জনগোষ্ঠীর অবাধ যোগাযোগের পদ্ধতি বাংলাদেশ আবিষ্কার করে দেবে?
জাতিসংঘ সম্প্রতি আদিবাসী নিয়ে বিশেষ হৈচৈ করছে। মজার বিষয় হচ্ছে, এসব আদিবাসী ইস্যু জাতিসংঘের যেসব সদস্য দেশে বিরাজমান, তারাই এই ব্যাপারে কম আগ্রহী। অন্যদিকে বাদামি ও কালো চামড়ার দেশগুলোর ওপরই নৈতিকতার দোহাই দিয়ে জাতিসংঘ নিজেদের এই আদিবাসী এজেন্ডা বেশি চাপিয়ে দিচ্ছে। এক শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীও এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশকে এই সনদে স্বাক্ষর করার চাপ দিচ্ছেন।
যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, ভারত, ইউরোপের ২৬টি দেশ, চীন, জাপান, রাশিয়া কেউ এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করেনি। জাতিসংঘের ১৯৩টি দেশের মধ্যে ১৭০টি দেশ এই চুক্তি স্বাক্ষর করেনি। কানাডার মতো বিশাল দেশও বলেছে, আদিবাসী হিসেবে কাউকে অভিহিত করে আলাদা ভূমি বরাদ্দ করা তাদের পক্ষে সম্ভব নয়।
আদিবাসী সনদে যে ২৩টি দেশ স্বাক্ষর করেছে তার একটি হচ্ছে চিলি। সেই স্বাক্ষরের কারণে দেশটির একটি গুরুত্বপূর্ণ সুপেয় পানির উৎস থেকে নিয়ন্ত্রণ প্রত্যাহার করতে হয়েছে সম্প্রতি।
পাহাড়ি যে ঝরনা থেকে বোতলজাত পানি উৎপন্ন হতো, সেটির নিয়ন্ত্রণ ওই এলাকার আদিবাসীদের কাছে ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য সম্প্রতি আদেশ দিয়েছেন চিলির সর্বোচ্চ আদালত। আদালত রায়ে উল্লেখ করেছেন, আইএলও সনদ ১৬৯ স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে ওই অঞ্চলের খনিজ সম্পদের ওপর আদিবাসীদের অধিকারকে স্বীকার করে নিতে হবে চিলির সরকারের। তাই ঝরনার পানি, যা খনিজ সম্পদ হিসেবে বিবেচ্য, সেটি বোতলজাত করার কোনো অধিকার সরকার নিযুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের নেই।
আওয়ামী লীগের দ্বিচারিতা
আওয়ামী লীগ পাহাড়ি জনগোষ্ঠীকে 'আদিবাসী' বলে এসেছে, সেই দলই এখন বাস্তবতা অনুধাবন করে আগের অবস্থান থেকে সরে এসেছে বলে মনে হচ্ছে। এই সরে আসার ব্যাপারে দলটি আলাদাভাবে কোনো ব্যাখ্যা দেয়নি।
গত ২৬ জুলাই পররাষ্ট্রমন্ত্রীর বক্তব্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে বেশি অবাক হয়েছেন পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর নেতারা। আজকের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিই বিভিন্ন সময়ে পাহাড়ি জনগোষ্ঠীদের সভা-সমাবেশে গিয়ে জোর গলায় 'আদিবাসী' স্বীকৃতির ব্যাপারে একসময় উচ্চকিত হয়েছেন।
২০০৮ সালে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস উপলক্ষে আয়োজিত শোভাযাত্রায় তিনি যে আবেগাপ্লুত বক্তব্য দিয়েছিলেন এবং শোভাযাত্রায় সন্তু লারমার পাশাপাশি হেঁটেছিলেন, সেই দীপু মনিই যখন এখন সবাইকে ডেকে 'আদিবাসী' ডাকা যাবে না বলে ঘোষণা দেন, তখন সেদিনকার শোভাযাত্রা ও সমাবেশে অংশগ্রহণকারীরা বিস্ময়ে বিমূঢ় হবেন, এটাই স্বাভাবিক।
তবে শুধু পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনিই নন, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিভিন্ন সময়ে এই জনগোষ্ঠীকে আদিবাসী উল্লেখ করেছেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও আদিবাসী শব্দের উল্লেখ আছে।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, আওয়ামী লীগ 'আদিবাসী' শব্দের অর্থ আগে জানত না, এখন নতুন করে হৃদয়ঙ্গম করছে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই বোধোদয় পাহাড়ি জনগণকে আওয়ামী লীগের ব্যাপারে কিছুটা হতাশই করেছে নিঃসন্দেহে।
আন্তর্জাতিক রীতিনীতি এবং আদিবাসী শব্দের ব্যুৎপত্তি নির্ধারণ এত জোরালো হয়ে উঠত না, যদি আওয়ামী লীগ ২০০৭ সালে জনসংহতি সমিতির সঙ্গে যে শান্তিচুক্তি করেছিল, তার পূর্ণাঙ্গ বাস্তবায়ন ঘটাতে পারত।
এই চুক্তি বাস্তবায়নে আওয়ামী লীগের নৈতিক বাধ্যবাধকতা আছে, কারণ এই চুক্তিকে শেখ হাসিনার রাজনৈতিক জীবনের অন্যতম সাফল্য হিসেবে উপস্থাপন করা হয়। এই চুক্তির কারণে শেখ হাসিনার নোবেল পুরস্কার পাওয়া উচিত বলেও অসংখ্যবার হাসিনাভক্তরা মন্তব্য করেছেন।
কিন্তু চুক্তি থেকে শেখ হাসিনার যেমন নোবেল পুরস্কার জোটেনি, তেমনই পাহাড়ি জনগোষ্ঠীর কপালেও বড় কিছু জোটেনি। পার্বত্য অঞ্চলের বড় সমস্যা হচ্ছে ভূমি বিরোধ, এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে সরকারের সদিচ্ছা নিয়ে যথেষ্ট প্রশ্ন আছে। মূলত পার্বত্য অঞ্চলের ভূমি বিরোধ নিষ্পত্তি করা গেলেই এই অঞ্চলের সংকট অনেকাংশে কেটে যাবে। সাংস্কৃতিক অন্যান্য সংকটের সমাধান করা তখন অনেক সহজ হয়ে আসবে।
আইএলও ১৬৯ কনভেনশন বিবেচনায় নিয়ে সরকার এখন যেভাবে আদিবাসী শব্দটির ব্যবহার থেকে পিছিয়ে আসতে চাইছে, সেই সনদের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অনেক কিছুই কিন্তু ২০০৭ সালের শান্তিচুক্তিতে রয়েছে। সরকার সেগুলো বাস্তবায়ন করেনি বলেই পাহাড়িরা অভিযোগ করে থাকে।
আদিবাসী বিতর্ক নয়, চাই সম-অধিকার
সংখ্যালঘুদের অধিকার নিশ্চিত করা একটি সভ্য রাষ্ট্রের দায়িত্ব। বাংলাদেশ তার অবাঙালি সংখ্যালঘু নৃতাত্তি্বক জনগোষ্ঠীর অধিকার কতটুকু নিশ্চিত করতে পারছে, সেটাই এখন প্রশ্ন। আদিবাসী বলা হবে নাকি উপজাতি বলা হবে, এই বিতর্কের আগে যদি আমরা নিশ্চিত করতে পারি যে সংখ্যালঘু এই মানুষরা নিজেদের বাংলাদেশের অংশ হিসেবেই ভাবছে, রাষ্ট্র তাদের যথাযথ সম্মান ও অধিকার নিশ্চিত করেছে, তাহলে এই বিতর্ক অনেকটাই প্রশমিত হয়ে যাবে।
সমস্যাসংকুল এই দেশে এমনিতেই অনেক ধরনের বিভাজন আর অনৈক্য আমাদের প্রতিনিয়ত পিছিয়ে দিচ্ছে। রাষ্ট্রের সব মানুষের সমান অধিকার নিশ্চিত করতে পারলেই আমরা অনৈক্য ও দ্বিমত রোধ করতে পারব।
সূত্র: Click This Link
পুরনো ধর্মের সমালোচনা বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করেই নতুন ধর্মের জন্ম
ইসলামের নবী মুহাম্মদকে নিয়ে কটূক্তির অভিযোগে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী তিথি সরকারকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দিয়েছেন আদালত। একইসঙ্গে তাকে এক বছরের জন্য সমাজসেবা অধিদপ্তরের অধীনে প্রবেশনে পাঠানোর... ...বাকিটুকু পড়ুন
ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট
আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন
ল অব অ্যাট্রাকশন
জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন
চরফ্যাশন
নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।
প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন
নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?
১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন