somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

জিলাপি

১৪ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:৫৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি কাল বাসা থেকে পালাচ্ছি। আর বারো ঘণ্টার মধ্যেই আমি নাই হয়ে যাবো। এখন নিশ্চয়ই আমার খুব ভয় লাগার কথা, কোথায় যাবো, কিভাবে পালাবো, পালানোটা ঠিক হচ্ছে কিনা। কিন্তু আমার মধ্যে কোন ভয় ডর কাজ করছেনা। উল্টো আমার কেমন যেন আনন্দ আনন্দ লাগছে। এই পালানোর প্ল্যানটা আমার মাথা থেকেই বের হয়েছে। তৌসিফ তো একটা ছাগল। এইরকম বিশাল একটা সিদ্ধান্ত নেয়ার মত কলিজা ওর ছোটখাটো শরীরে আটঁবেনা। উল্টো মিন মিন করে আমাকে বাড়ি পালানোর কুফল বুঝানো শুরু করেছিলো। পরে আমার এক ঝাড়িতেই রাজি হয়ে গিয়েছে। ওর মত একটা ছেলে কিভাবে আমার প্রেমে পড়ে গেলো, আমি এটাই ভেবে পাইনা। যাই হোক বেচারার কপালে যা লিখা ছিল তাই হয়েছে।

এমনিতে হয়তো পালানোটা খুব একটা দরকারী ছিলোনা। তৌসিফের কলিজার সাইজ যেমনই হোক, একেবারে উটকো ছেলে সে মোটেই নয়। এখন হয়তো ছোটখাটো একটা চাকরি করে, কিন্তু ওর মত তেলতেলে আঁতেলদের তড়তড়িয়ে উপরে উঠতে দেরি হয়না। বাবা হয়তো তৌসিফকে দেখলে একটু কপাল কুঁচকাবেন, একটু নাক সিঁটকাবেন, তারপর একসময় ঠিকই রাজি হয়ে যাবেন। ঝামেলা বাঁধাবেন মা। এ পরিবারে কেউই তার ইচ্ছের বাহিরে যাওয়ার অধিকার রাখেনা, বাবাও নয়। আমার মায়ের জীবনের লক্ষ্যই হচ্ছে আমার জীবনটাকে তেজপাতা বানিয়ে দেয়া। সৎমা হিসেবে তার অবশ্য আরো খারাপ হওয়ার কথা ছিলো, কিন্তু হতে পারেনি। এর কারণটাও আমার বাবা।

আমার বাবা মানুষটা কি পরিমান ভালো, সেটা বুঝানোর জন্য পৃথিবীর কোন ভাষায়ই যথেষ্ট পরিমানে শব্দ নেই। বাবার ভেতরটা পুরোপুরি দুইভাগে ভাগ করা। একটা ভাগ হলো রহস্যময়, নানা অজানা কারনে বাবা আমার সৎমাকে খুব ভয় পান। আর আরেকটা ভাগ হোল ভালবাসাময়, বাবা আমাকে অদ্ভুত রকমের ভালোবাসেন। খুব ছোটবেলায়ই আমি মাকে হারিয়েছিলাম, মায়ের ছবিগুলো দেখে বুঝেছি আমার চেহারাটা অনেকটা মার মতোই হয়েছে। এই কারনেই হয়তো বাবা আমাকে প্রয়োজনের তুলনায় একটু বেশীই ভালোবাসেন। কিন্তু কখনই আমার সৎমার সামনে প্রকাশ করতে পারেন না। এই দুইভাগে বিভক্ত বাবার জন্য বেঁচে থাকাটা নিশ্চয়ই অনেক কষ্টের। কিন্তু বাবার জন্য আমার কখনো কষ্ট লাগেনা। আমার প্রচণ্ড রাগ হয়। খুব ইচ্ছে করে বাবার উপর একটা প্রতিশোধ নিতে। এই যে আমি পালিয়ে যাচ্ছি, এতে কারো কিছু আসে যায়না। আমার সৎমা উল্টো খুশী হবেন, যাকে বলে দানবীয় খুশী। শুধু কষ্ট পাবেন আমার বাবা, ভেতরে ভেতরে ভেঙ্গে যাবেন কিন্তু কাউকে কিছু বলবেন না। আমাকেও নয়। তৌসিফও অনেকটা বাবার মতো, তাদের কলিজায় ভালবাসার মতো বিশাল একটা জিনিসের জায়গা হয়ে যায়, অথচ ওটা প্রকাশ করার জন্য সামান্য সাহসের জায়গা হয়না। আমার রাগ হচ্ছে, প্রচণ্ড রাগ। মার সাথে সাথে আমিও মরে জাইনি,এটাই কি আমার অপরাধ? কেন ঘরের শান্তি রক্ষার জন্য এতোটা নিরীহ হতে হবে বাবাকে? টের পাচ্ছি মাথা গরম হয়ে আসছে আমার। খুব দ্রুত নিঃশ্বাস ফেলছি। লক্ষণ ভালো না ।নিজের উপর নিয়ন্ত্রন হারিয়ে ফেলছি । কিছু একটা ভাঙতে হবে। রাগে আমি মোবাইলটাকে আছাড় মারি। কিন্তু মাটিতে নয়, খাটের উপরই আছাড় মারি। আমি কাল পালাচ্ছি, এখন বিশাল একটা সাসপেন্সের সময়, আমি রাগী ঠিক আছে কিন্তু এতটাও বোকা না যে এখন মোবাইল ভেঙে ফেলবো। তাইতো খাটের উপর নরম জায়গায় আছাড় মারা। রাগটাও কমলো, মোবাইলটাও জানে বেঁচে গেলো। উভয়পক্ষ রক্ষা।

রাত নয়টার দিকে বাবা আমার ঘরের দরজায় উঁকি দিলেন। আমি তখন পড়ছিলাম। শব্দ পেয়েই বইটা ছুড়ে ফেলে, একটা গল্পের বই হাতে নিলাম, উদ্দেশ্য বাবাকে রাগানো। কিন্তু সবসময়ের মতোই বাবা একটুও রাগলেন না। কিসের একটা প্যাকেট এনে টেবিলের উপর রাখলেন। বোঝাই যাচ্ছে আমার সৎমার চোখে জিনিসটা অবশ্যই বৈধ নয়। আমি দেখেও দেখলাম না। বাবা ফিসফিসিয়ে বললেন, “মা তোর জন্য জিলাপি নিয়ে এলাম, তুই সেদিন বলছিলি না, এই কয়দিন অনেক খুঁজেছিলাম, ধারে কাছে কোথাও পাইনি, অনেক দূর থেকে আনতে হোল, তাড়াতাড়ি খেয়ে নিস মা, কেউ যাতে না দেখে”। বলেই বাবা এক রকম দৌড়ে পালালেন, বাবার সেই কেউ নামক আমার সৎমার ভয়ে। আমার আবছাভাবে মনে পড়ল কোন একদিন আমাদের কাজের মেয়েটাকে বলছিলাম আমার জিলাপি খেতে ইচ্ছে হচ্ছে। আমি এত দিনে ভুলেও গিয়েছি, কিন্তু বাবা ভুলেন নি, তিনি মনে রেখেছেন, খুঁজে খুঁজে এত দিনে জিলাপি নিয়ে এসেছেন, লুকিয়ে লুকিয়ে আমার ঘরে এসে দিয়েও গেছেন। আমি জিলাপির প্যাকেটটা হাতে নিয়ে বসে রইলাম। একটা মানুষ এতটা ভালবাসা বুকে চেপে রেখে কিভাবে বাঁচতে পারে?

আমার অনেকগুলা প্ল্যানের মতো এই পালানোর প্ল্যানটাও ক্যান্সেল। এই মুহুর্তে এই কথা শুনে তৌসিফের চেয়ে বেশি খুশী আর কেউ হবেনা। বেচারা তো আগে থেকেই পালানোর টেনশনে আধমরা হয়ে ছিলো।

আমার বাবা মানুষটা খুব অদ্ভুত; অদ্ভুত এবং ভালো। এমন ভালো মানুষকে কষ্ট দিতে পৃথিবীর সবচেয়ে বড় কলিজা লাগে। আমার এত বড় কলিজা নেই। আর নেপথ্যের কারণটা হচ্ছে, আমিও আমার বাবাকে অনেক ভালবাসি, কিন্তু ভুলেও কখনো প্রকাশ করিনি।
----------------------------------------------------------------------------------

আমি কখনো কোন মা দিবসে আমার মাকে জড়িয়ে ধরে উইশ করিনি। কখনো বলিনি, মা তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কোন বাবা দিবসেও বাবাকে গিয়ে বলিনি, আব্বু তোমাকে অনেক ভালোবাসি। কিন্তু তারপরও এই পৃথিবীতে এই দুইজন মানুষকেই আমি সবচেয়ে বেশি ভালোবাসি।


(প্রথম আলো ঈদ অনুগল্প সংখ্যায় প্রকাশিত)
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই অক্টোবর, ২০১১ রাত ৮:১৪
৩২টি মন্তব্য ৩০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×