somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সলিল চৌধূরীর আবৃত্তি

১৪ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:০৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ও মশাই শুনছেন............?
ও মশাই ...শুনছেন..................?
নিশুতি মাঝ রাতে চিৎকার শুনে ঘুম ভেঙে যেত। পাগলটা আবার এ পাড়ায় এসেছে। কি যে ও শুনাতে চায় তা কেউ জানে না। বড়জোর এক মিনিটের জ্যোতি, তারপর আবার সেই চিৎকার- ও মশাই শুনছেন.......। আওয়াজ টা ক্রমশ দূর থেকে দূরে মিলিয়ে যেত। কুকুর গুলো ঘেউ ঘেউ করতে করতে হাঁপিয়ে গিয়ে এক সময় থেমে যেত। কিন্তু ঐ চিৎকার টা থেমে যাওয়ার পরও বহুক্ষণ ধরে কলকাতার হর্ম্মে হর্ম্মে, দেয়ালে দেয়ালে ধাক্কা খেতে খেতে অনুরণিত হতে থাকত- ও মশাই শুনছেন শুনছেন শুনছেন.......? সারা কলকাতা এবং শহরতলীতে, কোন না কোন পাড়ায়, নিশুতি মাঝ রাতে কোন না কোন দিন চিৎকার শুনে লোকের ঘুম ভেঙে যেত ... ও মশাই শুনছেন? হঠাৎ জেগে ওঠা লোকেরা বলত, পাগলটা আবার এ পাড়ায় এসেছে। আমি তখন তরুণ। আজ থেকে প্রায় ৩৫ বছর আগের কথা। সবে দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনেক কিছু বঞ্চনার হতাশায়, প্রতারণার ক্ষোভে ক্ষমতাসীন শাসকেরা রক্তগঙ্গা বইয়ে দিচ্ছে। তখনকার কলকাতায় এবং শহরতলীতে সবাই ওকে জানে। জ্বলন্ত দু’টো চোখ, এক মুখ খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি, উস্ক-খুস্ক কাঁচা-পাকা চুল, তালি মারা লম্বা একটা আলখাল্লা, পরনে খাকি প্যান্ট, বগলে পুরোনো কাগজ আর পায়ে মিলিটারি জুতো। কেউ বলত লোকটা ছিল টেররিস্ট; পুলিশের মার খেয়ে পাগল হয়ে গেছে। কেউ বলত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে ও ছিল মেজর; মানুষ খুন দেখে দেখে মস্তিস্ক বিকল হয়ে গেছে। আবার কেউ বলত এক ভরাডুবি জাহাজের ও ছিল কাপ্তান; টর্পেডোর ঘায়ে জাহাজশুদ্ধ সবাই ডুবে মরে, ওই শুধু বেঁচে যায়। সেই দুঃখে আজও ও অনুশোচনায় জ্বলছে। বলতে চাইছে কি করে ও বেঁচেছে। আবার কেউ কেউ বলত ও মানুষ নয়; প্রেতাত্মা। অনেক চেষ্টা করেও লোকে বার করতে পারেনি লোকটা দিনের বেলায় কোথায় থাকে? রাত্তিরে ও হঠাৎ হঠাৎ এক এক পাড়ায় এক এক দিন উদয় হয়, তারপর আবার তেমনি হঠাৎ মিলিয়ে যায়। একবার নাকি শ্যাম বাজারের ছেলেরা ওকে ঘিরে ধরেছিল-বলুন আপনি কি শোনাতে চান, বলুন...বলুন....। ও নাকি বোকার মত তাকিয়ে ছিল অনেকক্ষণ। ফ্যাল ফ্যাল করে চেয়ে তারপর আবার চিৎকার করে উঠেছিল, ও মশাই শুনছেন.........। আর্তনাদের মত শুনিয়েছিল ওর কণ্ঠ সেদিন। এরও প্রায় এক দশক পরে বিধাব মা আর ছোট ছোট ভাই-বোনদের নিয়ে অকূল সমুদ্রে ভাসকে ভাসতে একদিন আমার কলকাতার বাস উঠল। ততদিনে আমার নিজের জীবনের মানেও বদলে গেছে। অন্য চেতনা অন্য মূল্যবোধ নিয়ে ভাবতে শিখেছি। দেশ ছেড়ে চলেগেছি বহুদূরে। এক দুই তিন করে তিন তিনটা দশক পেরিয়ে গেছে, কবে ভুলে গেছি “ও মশাই”এর কথা। তারপর বোধহয় সেটা ১৯৮০ সাল। আগরতলায় গিয়েছি জাতীয় সংহতি সম্মেলনে যোগ দিতে। আছি সার্কিট হাউসে, দোতলায়, একা একটি ঘরে। হঠাৎ মাঝরাত্রে আবার সেই চিৎকার- ও মশাই শুনছেন....? আমার সারা গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল, ধড়মড় করে উঠে বসলাম; এ সেই কণ্ঠস্বর! তবে যেন বড় ক্লান্ত, বড় আকুতি ভরা হতাশায় জীর্ণ। যেন কেউ শুনবে না এই চেতনার বেদনায় প্রশ্নটি বড় করুণ। তাড়াতাড়ি পোশাক বদলে টর্চ নিয়ে নিচে নামলুম; লোকটাকে আজ ধরতেই হবে। আবছা কুঁয়াশা ঘেরা রাত, সারা পাড়াটা ঘেউ ঘেউ করছে। রাস্তায় নেমে টর্চ জ্বালালুম, কিন্তু কোথায় গেল সেই লোকটা! তবে কি আমার শোনা ভুল? স্বপ্ন? অনেক্ষণ অন্যমনস্ক হয়ে পথ হাঁটলুম। ঘেউ ঘেউ শহরটা শান্ত হয়ে এল। দূরে কারা খোল-করতাল বাজিয়ে গান ধরেছে। ছোট বেলার কত স্বাদ, স্বপ্ন, স্মৃতির স্বাদ যেন ওই চিৎকারে মিশে আছে। কত কি ভাবতাম, কত কি করার ছিল, কত সোনার মত দিন বৃথা নষ্ট হল! কত জমাট দুঃখ হতাশা, কত অঙ্কুর, আধফোটা কলিদের ভাষা, না বলতে পারার পুঞ্জীভূত বেদনায় বুকটা যেন ফেটে যেতে চাইল। প্রচন্ড ইচ্ছা হল আমিও ওর মত চিৎকার করে উঠে ঘুমন্ত শহরটাকে খান খান করে জাগিয়ে দিই-ও মশাই শুনছেন ও মশাই শুনছেন? ঘরে গিয়ে আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়লুম। ভোরে উঠে চলে যেতে হবে। তন্দ্রার চাদর মুড়ি দিয়ে পাশ ফিরলুম। সত্যিই তো কত কি শোনাবার ছিল, কত গান, কত গল্প, কত কথা। ভাবতে ভাবতে ঘুমিয়ে পড়লুম। এবার আমার জালনার ঠিক নিচে আবার সেই চিৎকার- ও মশাই.......শুনছেন.....? খোলা জালনার বাইরে স্তিমিত কয়েকটা তারার দিকে তাকিয়ে চেয়ে রইলাম, আবার শুনে নিশ্চিত হব বলে। আবার শুনলাম। বিগত ৩৫ বছরে তাতে শুধূ দু’টি নতুন শব্দের সংযোজন হয়েছে-
ও মশাই শুনছেন...............
কান পাতুন...কান পাতুন.....কান পাতুন......।
অডিও এখানে
(সলিল চৌধূরী একটি স্টেজ প্রোগ্রামে এই আবৃত্তিটি করেছিলেন। ওই প্রোগ্রামের ৪৫ মিনিটের একটি এ্যালবাম আমার সংগ্রহে আছে। সেখানে আছে তাঁর কন্ঠে আবৃত্তি করা আরো কবিতা, ছড়া, গান। হেমন্ত মুখোপাধ্যায় ও লতা মুঙ্গেশকরের কন্ঠে বিখ্যাত তাঁরই লেখা কয়েকটি গান নিজের কন্ঠে গেয়েছিলেন তিনি এই প্রোগ্রামে। এছাড়া আছে অনেক আলাপচারিতা, আর তাঁর সেই বিখ্যাত গান “এই রোকো........পৃথিবীর গাড়িটা থামাও, আমি নেমে যাব” তো আছেই। সেসব না হয় আরেক দিন শোনাব :)

সর্বশেষ এডিট : ১৪ ই আগস্ট, ২০১১ রাত ১২:০৭
৮টি মন্তব্য ৭টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×