somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সুশীল মানুষের গল্পঃ সাগর সাহেবের একদিন ও কোন এক রোকসানা।......পর্ব ১

০৯ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৪:১৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

(গল্পের সমস্ত চরিত্র ও ঘটনা কাল্পনিক, বাস্তবের মেলাতে চাইলে নিজ দ্বায়িত্বে মেলাবেন)

শেষ বিকেলের রোদটা কলেজের মাঠের উপরে যেন একটা অদ্ভুত আভা ছড়িয়ে দিয়েছে। তুমুল করতালিতে “জসীমপুর স্কুল এন্ড কলেজে”র পক্ষ থেকে সাগর সাহেবকে সংবর্ধনা দেয়া হচ্ছে। কলেজের সব শিক্ষক, এলাকার সংসদ সদস্য সহ এলাকার গণ্যমান্য ব্যাক্তিরা হাজির হয়েছেন। বিভিন্ন টিভি চ্যানেলের ক্যামেরাও এদিক সেদিক ঘোরা ফেরা করতে দেখা গেল। একসপ্তাহ ধরে এই আয়োজন করা হচ্ছে। জসীমপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান আক্কাস উদ্দিন সাহেবের ঘুম হারাম হয়ে গেছে, উনি যেন নাওয়া খাওয়া ভুলে গেছেন, যেভাবেই হোক সংবর্ধনা অনুষ্ঠান সফল করতেই হবে। কেননা, ওখানে এম.পি সাহেব থাকবেন, উনি যদি তুষ্ট না হন তাহলে সামনের ইউপি নির্বাচনে তার খবরই আছে।

সাগর সাহেবের পরিচয় একটু দিয়ে নেয়া যাক। সবাই সাগর সাহেবকে বুদ্ধিজীবি হিসেবেই চেনে, তাকে যেকোন অনুষ্ঠানে পরিচয় করিয়ে দেবার সময় তার নামের আগে “বিশিষ্ট বুদ্ধিজীবি” বলা হয়। ইউনিয়নের মানুষদের উতসাহের কারন হচ্ছে সাগর সাহেবের মিডিয়াতে তার সরব উপস্থিতি। যেকোন টকশোতে তার কথা বলার স্টাইল, বাচনভঙ্গি দর্শকদেরকে বেশ আকর্ষন করে। বিশেষ করে তার ইসলামি জঙ্গিবাদ এবং গোঁড়ামির বিরুদ্ধে কথাবার্তা দর্শকদেরকে বেশ প্রভাবিত করে।তার বক্তব্যে তিনি জঙ্গিবাদ, তালেবান, বোরকা,হিজাব ইত্যাদির বিরুদ্ধে বেশ কৌশলে তীব্র বিদ্রুপ ছুঁড়ে দেন। তাঁর মতে বর্তমানে মুসলমানদের দুর্দশার জন্য ইসলামের সমাজ ব্যাবস্থাকেই দায়ি করেন। তিনি অন্যান্য পাবলিকদের মত আমেরিকা ইসরাইলের যুদ্ধনীতির তীব্র সমালোচনা করেননা, তার বক্তব্য “এত সমালোচনা করলে দেশিও জঙ্গিরা মাথাচাড়া দিয়ে উঠবে।“


তবে তাকে কেউ তীব্র ইসলাম বিদ্বেষি বলে মনে করে না। কেননা তিনি বিভিন্ন ইসলাম ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও বিশেষ অতিথি হিসেবে গিয়েছেন। তার বক্তব্য হচ্ছে ইসলামের ভাল ভাল দিকই গ্রহন করা উচিত, সেজন্য সবাইকে খোলা মন নিয়ে চলার আহবান জানান। একবার ভারত সফরে গিয়ে আজমির শরীফ মাজার জিয়ারত করে “উদার মুসলিম” হিসেবে তার ভুমিকা নিয়ে বুদ্ধিজীবি মহলে বেশ প্রশংসাও পান। ভারতের একটি টিভি চ্যানেল “A New Horizon ” শিরোনামে ৩০ মিনিটের একটি ডকুমেন্টরী প্রচার করে। সেখানে তাকে “মডারেট মুসলিম” উপাধি দিয়ে তার ভূয়াসী প্রশংসা করা হয়।

দেশে বিদেশে তার অনেক শুভাকাঙ্খি আছেন। তাঁদের ভয় যেকোন সময় উগ্র জঙ্গীরা তার উপর হামলা চালাতে পারে! ইতোমধ্যে তাকে ই-মেইলে হুমকি দেয়া হয়েছে এবং সেটা বেশ ফলাও করে প্রচারিত হয়েছে। এই নিয়ে টিভি টকশোতে বেশ হৈ চৈ হয়েছে। বিদেশি মিডিয়াতেও খবরটি প্রচারিত হয়েছিল। তিনি সরকারের সেক্যুলার রাষ্ট্রনীতির পক্ষে শক্তিশালী অবস্থান নেন। তিনি সেক্যুলার নীতির সাথে হুদাইবিয়া সন্ধির তুলনা করে বেশ সুন্দর একটা কলামও লেখেন। মোট কথা তিনি এদেশের সুশীল সমাজের মধ্যে এক অন্যাতম ব্যাক্তি। বাঘা বাঘা মন্ত্রীরাও তাকে নাকি সমীহ করে চলে।


চেয়ারম্যান, এম.পি, প্রিন্সিপাল সহ একে একে সবার বক্তৃতা শুনতে শুনতে শ্রোতারা বিরক্তির চুড়ান্ত পর্যায়ে চলে গেল। এমন সময় ঘোষনা করা হলো সাগর সাহেবের নাম। চেয়ারম্যান আক্কাস উদ্দিন ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক উপমা লাগিয়ে সাগর সাহেবের নাম ঘোষণা করেন। সাগর সাহেব মুচকি হেসে একটা হাত তুলে সবাইকে অভিনন্দন জানালেন। চারিদিক বিপুল করতালিতে ফেটে পড়ল। শেষ বিকেলের আলো তার শুভ্র পোষাকের উপর এসে পড়েছে। এই শুভ্র পোষাকে তাকে যেন অনেক পবিত্র মনে হচ্ছে। সবাই একটু নড়েচড়ে বসল, কারন সাগর সাহেব খুবই আকর্ষনিয় ভাবে বক্তব্য রাখতে পারেন। তিনি সংক্ষেপে তার বক্তব্য শেষ করলেন। বক্তব্যে নারীদের উন্নয়ন ও দারিদ্র থেকে মুক্তি নিয়ে বেশ কয়েকটি ধারনা তুলে ধরেন। তুমুল করতালিতে সেসব কথার জবাব দেয়া হয়।

সাগর সাহেব চেয়েছিলেন বিকালেই চলে যেতে, কিন্তু চেইয়ারম্যান সাহেব কিছুতেই হতে দেবেন না। চেয়ারম্যানের বাড়িতেই রাতের খাবারের ব্যবস্থা করা হলো। বেশ খিদে পেয়েছিল তার, রান্নাও বেশ চমৎকার হয়েছে। খাসির রেজালাটা এক কথায় চমৎকার। খাওয়াদাওয়া শেষে জীপে ওঠার সময় “হিঁ হিঁ হিঁ হিঁ” করে একটা করুন স্বরে কান্নার আওয়াজ পাওয়া গেল। সাগর সাহেব দেখলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা জীপের সামনে দাঁড়িয়ে রয়েছে, সাথে এক কিশোর, দুজনের চোখই ছলছলে। চেয়ারম্যান আক্কাস হাঁ হাঁ করে উঠলো তাকে বলল “অ্যাই রাকিবের মা, এইখানে ঝামেলা কইরো না, আমি দেখবো কি করা যায়।“ সাগর সাহেব এগিয়ে গেলেন, তখন মহিলাটি কান্না জড়ানো কন্ঠে বলল, “স্যার, ৭ দিন ধইরা রোকসানার কোন খোঁজ খবর পাইতাসিনা, ৭ দিন আগে ফোন করসিল, এর আগে প্রত্যেকদিন ফোন করত, এখন কোন খবর নাই, ফোনও বন্ধ”।

চেয়ারম্যান আক্কাস উদ্দিন তখন পুরো বিষয়টি বুঝিয়ে দিলেন। তিনি ইনিয়ে বিনিয়ে অনেক ভনিতা করে ঘটনা যা বলা হলো তার সারমর্ম হলো, মহিলার বড় মেয়ে রোকসানা ঢাকার একটা এন.জি.ও তে চাকরী করে, মহিলার স্বামী ৫ বছর আগেই মারা গেছে, এখন সব কিছু রোকসানাই সামলায়। স্বামীর নিজস্ব বাড়ি ছিল বলে রক্ষা, রোকসানার পাঠানো টাকায় মোটামুটি চলে যায়। রোকসানা ঢাকায় ৫ জন মেয়ের সাথে একসাথে থাকে। তাদেরকেও ফোন করা হয়েছিল, তারাও কিছু বলতে পারেনা। শুধু জানায় যে ৭ দিন আগে এক সকাল বেলা অফিসের জন্য সে বের হয়ে যায়, এর পরে ফিরে আসেনি। তারা মনে করেছে রোকসানা বাড়ি গিয়েছে, কারন রোকসানা মাঝে মাঝেই না বলে হুট বাড়ি চলে যেত, তাই তারা খোজ নেবার প্রয়োজন মনে করেনি।

সাগর সাহেব চেয়ারম্যানের দিকে তাকালেন, “এই ব্যাপারে কি করলেন?” চেয়ারম্যান বললেন কালকেই লোক পাঠাবো ঢাকায়, থানায় একটা.........”কালকে কেন? এই কয়টাদিন কি করেছেন??” সাগর সাহেবের ধমক শুনে চেয়ারম্যান চুপশে গেলেন। মিন মিন করে বললেন “আসলে সংবর্ধনা অনুষ্ঠানের জন্য এত ব্যাস্ত ছিলাম..........."আপনি থামুন!!"

সাগর সাহেব মহিলার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “আপা, কোন চিন্তা করবেন না, পুলিশের ডি.জি আমার খুব ভালো বন্ধু, সে খুব দ্রুত খোঁজ নিতে পারবে, আর হয়ত কোন অফিসিয়াল ট্যুরে গিয়েছে, হতে পারে শুধু শুধু চিন্তা করা হচ্ছে, আমার মন বলছে রোকসানা ভাল আছে, তারপর বললেন, “কি যে হয়েছে এই দেশটার, মেয়েরা যে কেন নিরাপদে চলতে পারেনা”। "আচ্ছা আমি ব্যাপারটা দেখব চিন্তা করার দরকার নাই।“ বলেই জীপে উঠে পড়লেন। কেউ একজন মহিলাকে বলল, "কোন চিন্তা কইরেন না চাচি, সাগর সাহেব অনেক বড় মানুষ, উনি ঠিকই কিছি একটা করবো"

জীপের এসি চলছে, কিন্তু এর মধ্যেও তার মাথা ঝিমঝিম করতে লাগল। তিনি ঠিক বুঝতে পারলেন না কেন এমন হচ্ছে। তার খুব ঘুম পেতে লাগল। ততক্ষনে জীপটি জসীমপুর পেরিয়ে তীব্র গতিতে ঢাকার দিকে ছুটে যাচ্ছে।


রাত প্রায় ১ টা বাজে। জসীমপুর থেকে ফিরেছেন প্রায় দুই ঘন্টা আগে। তিনি স্টাডি রুমে বসে আছেন। হাতে এক পেগ হুইস্কি। তিনি মনে মনে ভাবতে লাগলেন একেই কি কাকতালীয় ব্যাপার বলে??.......সাত দিন আগের একটা কথা মনে করে তার মাথা আবারো ঝিম ঝিম করে উঠলো।

সাত দিন আগের কথা..........তার গুলশানের বিশাল ডুপ্লেক্স বাসায় কয়েকটি এন.জি.ও থেকে এক্সিকিউটিভরা এসেছে। সামনের মাসে তারা “ক্ষুধামুক্ত বাংলাদেশ” সেমিনারের আয়োজন করেছে, সাগর সাহেব এর মূল উদ্যোক্তা। ২৫-২৬ জন তার লনে বারান্দায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসে রয়েছে। হঠাৎ বারান্দার এক কোণায় এক তরুনীকে দেখে চমকে উঠলেন। যারা এখানে আছে তাদের সবাইকেই মোটামুটি চেনেন, কিন্তু একে আগে দেখিনি। মিসেস ফারহানা এগিয়ে আসলেন। সাগর সাহেবের জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে নিজেই মেয়েটিকে সাগর সাহেবের সাথে পরিচয় করিয়ে উদ্যত হলেন, “আসলে ওর এখানেই প্রথম আসা, সে জন্যই চিনতে পাড়ছেন না, আফসার ভাইয়ের সাথে কাজ করে।” মেয়েটি মিষ্টি হেসে দাঁড়িয়ে গেল, “স্লামালিকুম স্যার, আমি রোকসানা”।.........(চলবে)

সর্বশেষ এডিট : ১০ ই আগস্ট, ২০১১ দুপুর ১২:৪৫
৫টি মন্তব্য ৪টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

---অভিনন্দন চট্টগ্রামের বাবর আলী পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে এভারেস্ট জয়ী---

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৯ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫৫





পঞ্চম বাংলাদেশি হিসেবে বিশ্বের সর্বোচ্চ শৃঙ্গ মাউন্ট এভারেস্ট জয় করেছেন বাবর আলী। আজ বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৮টায় এভারেস্টের চূড়ায় ওঠেন তিনি।

রোববার বেসক্যাম্প টিমের বরাতে এ তথ্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

সকাতরে ঐ কাঁদিছে সকলে

লিখেছেন হাসান মাহবুব, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৯

সকাতরে ওই কাঁদিছে সকলে, শোনো শোনো পিতা।

কহো কানে কানে, শুনাও প্রাণে প্রাণে মঙ্গলবারতা।।

ক্ষুদ্র আশা নিয়ে রয়েছে বাঁচিয়ে, সদাই ভাবনা।

যা-কিছু পায় হারায়ে যায়,... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×