somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

"বন্ধনের জন্য ভালবাসা"

০৭ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৩:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আমি অবাক হয়ে ছেলেটার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম, ও কি অনেক গরীব নাকি!! শীতে ঠোঁট ফেটে গিয়ে রক্ত জমে আছে, অথচ ভেসলিন দেয় না। পরে ওর বাসায় গিয়ে অবাক। ওরে বাপস! সেই রকম বড়লোক। বুঝলাম পুরা আউলা। আরও অবাক হলাম যখন দেখলাম অজস্র কমিক্স ওর বাসায়। কিন্তু নেয়ার কোন উপায় ছিল না। সব ইংলিশ। ৬ বছর বয়সে যে কেউ ইংলিশে কমিক্স পরতে পারে আমার ধারনা ছিল না। ওর হাতের ইংলিশ লেখা ছিল বাইব্রন ইতালিক!! এই অসম্ভব মেধাবী আর তার চাইতেও বেশি অগোছালো ছেলেটাকে বলা যেতে পারে আমার সবচাইতে প্রাচীন বন্ধু। এখন আছে টেক্সাস এ।
ক্লাস এর সবচাইতে সুন্দর ছেলেটাকে দেখে খুবই অবাক লাগত। সবাই ওকে বেশ পাত্তা দিত, বিশেষ করে মেয়েরা। আর ও খুবই পাটে থাকত সেইটা নিয়ে। আমি বেশ নিরীহ টাইপের ছেলে ছিলাম। সাভাবিক ভাবেই আমার সাথে এদের বন্ধুত্ব হত না। আমার ওকে ভালো লাগত। বলা যায় আমি ওর মুগ্ধ ভক্ত ছিলাম। মুগ্ধতা বন্ধুত্ব তৈরি করতে পারে না। অন্ধত্ত তৈরি করতে পারে হয়ত। নটরডেমে এ এসে সেই ছেলেটার সাথে ২ বছর কাটল। কোথায় গেল মুগ্ধতা !! দুইজন মিলে দুইজনের ক্লাস এর দফা রফা করে দিলাম। ক্লাস ফাকি দিয়ে পুল এ বসে থাকা। শহর ছেড়ে বেরিয়ে আসা দূরে, আরও দূরে... ফলস্বরূপ দুই জনের গার্ডিয়ান কে ডাকা হল। দুইজনকে জেল ক্লাস ও করতে হল একসাথে। সে আছে ইউনিলিভার এ। মজার বাপার হচ্ছে। যে ভেসলিন দিয়ে গল্পের শুরু, এর দায়িত্ব সেই ভেসলিনের !!
আমি নিরীহ ছিলাম দেখেই আমার বন্ধু প্রায় ছিল না। ক্লাস এইটে এক ভালো ছাত্র এসে আমার পাশে বসল। অন্যদের থেকে এই ভালো ছাত্রের আলাদা বৈশিষ্ট্য হচ্ছে, তার বন্ধু বান্ধব সবই পেছনের দিকের। কেউ ফেল করা। কেউ কোনমতে পাস। রাস্তার বখে যাওয়া ছেলেদের সাথেও তার খাতির। সব কিছু নিয়ে নিজের অনিশ্চিত মত সুনিশ্চিত ভাবে প্রকাশ করা সেই ছেলেটার সাথেও বন্ধুত্ত হয়ে গেল। এটা সত্যি আমার জীবনের একটা টার্ন ছিল। আমি ওর হাত ধরে গণ্ডির বাইরে আসলাম। আড্ডা দেয়া শিখলাম। বন্ধুদের সাথে ঘোরা শিখলাম। চীৎকার করে গান গাওয়া শিখলাম। বুঝলাম জীবনটা নিয়ে ভাবাটা মন্দ না। তুচ্ছ তুচ্ছ বিষয় নিয়ে সিরিয়াসলি চিন্তা করতে শিখলাম যেমন “নারী” যেটা ওই সময় সত্যি দরকার ছিল। বুঝলাম মতিঝিল থেকে মিরপুর হেটে আসা, বা অচেনা গ্রামে গিয়ে দুপুরে খাবার চেয়ে খাওয়ার মত পাগলামি করাটা মাঝে মাঝে ভালো। এতে মন ভালো থাকে। এটাও বুঝলাম, মানুষের জীবনের ইচ্ছেটা খুব খুব খুব বেশি মূল্যবান। সেই মূল্যটা দিতে শিখলাম। আমরা খুব তাড়াতাড়ি কিছু বন্ধু জোগাড় করে ফেললাম। একটা দল হল। সেই দল একটা কফি হাউস খুজে বের করল প্রথমে আড্ডা দেয়ার জন্য। এখন দরকার আড্ডার বিষয়। নারী খুব আকর্ষণীও একটা টপিক। তাই, একই সাথে, একই দিনে আড্ডার তিন ছেলে একই ব্যাচের তিন মেয়ের প্রেমে পরে গেলাম, আর একই সাথে রিফিউস হলাম!! ব্যাপার না। আড্ডার টপিক তো পাওয়া গেল। একদিক দিয়ে ভালই হল। সফল প্রেমের গল্প শোনার চাইতে বার্থ প্রেমের গল্প শোনা হাজারগুন ভালো। রোবট টাইপের যে বন্ধুটা আমাদের যৌথপ্রেমে পড়ল না, দুই দিন পরে সে একটা প্রেম করে ফেলল। আমি প্রায়ই তাদের মাঝে কাবাব মে হাড্ডি হয়ে চাইনিজ এ টিভি দেখতাম, অথবা নৌকায় বসে আকাশ দেখতাম। এটাও আমার জন্য দরকার ছিল। প্রিয় মানুষের খুব প্রিয় মানুষের সাথে কিভাবে মিশতে সেটা শিখলাম। রোবট টাইপের বন্ধু এখন ফিজিক্সে এ। ও রোবটিক্স নিয়ে পরলে নিশ্চিত ভালো করত। কিন্তু এই কথা বলার সাহস আমার নাই। রাগ করলে সে সাইলেন্ট রোবট হয়ে যায় আর আড্ডার পুরো বারোটা বাজায়। কে চায় এত কষ্ট করে সময় বের করা আড্ডার বারোটা বাজাতে। আর প্রথমজন ডাক্তার। সাভাবিক ভাবেই সব রোগীর সাথেই তার খাতির। আমার ধারনা রোগীদের সাথে সে অসুখের চাইতে অন্য বিষয় গল্প বেশি করে!!
আমাদের দল বড় হতে থাকল। যে ছেলেটা স্কুলে কাপ্তান ছিল, আমি নিরীহ হওয়ার কারনে খুব বেশি যোগাযোগ ছিল না, সেই ছেলেটাকে নতুন করে চিনলাম। খুব ভালো ছাত্র, খুব গম্ভির ভাবে থাকা ছেলেটা যে আসলে অসম্ভব রকমের ফাজিল একটা ছেলে বুঝলাম। পৃথিবীর সবকিছু নিয়ে মজা নেয়াটা তার দায়িত্ব। হসপিটালে রোগী দেখতে এসে করিডোরে হা হা করে হাসতে আমাদের কখনও খারাপ লাগত না। গান শুনতে ইচ্ছে করলে গায়ক বন্ধুকে মাঝরাতে ঘুম থেকে টেনে হিঁচড়ে উঠিয়ে জোর করে গান গাওয়াতে মায়া লাগত না। সেই গায়ক বন্ধু ছিল আরেক চিজ। ফেব্রুয়ারী থেকে এপ্রিল মাস হিশাব করতে গিয়ে সে অক্টোবর-নভেম্বর ঘুরে এসে বলত, “ওরে বাপরে, এখনো তো অনেক দেরি!!” অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে আমার জীবনের প্রিয় গানগুলির অনেক গুলিই আমি প্রথম তার গলাতে শুনি। ইউনিভার্সিটি তে ও আমার ক্লাস এসে গান গেলে ক্লাস এর সবচাইতে লাজুক মেয়েটা তাকে খুশি হয়ে চকলেট দিয়েছিল। এখন লন্ডনে ও কাকে গান শোনায় কে জানে। কাপ্তান এখন কাপ্তান থেকে শিক্ষকের ভুমিকায়। তার ছাত্রগুলো তার চাইতে বয়সে বড়। বেশি ব্রিলিয়ান্ত হলে যেটা হয়। স্কুলে রাস্তার পাশে কিছু ছেলে আড্ডা দিত। এলাকার বখে যাওয়া বড় ভাইদের সাথে তাদের খাতির ছিল। তাই ওদেরকেও ভাবতাম বখে যাওয়া, অভদ্র। তাদের দলের এক ছেলের সাথে বন্ধু হওয়ার পরে অবাক হয়ে দেখলাম আমার বন্ধু মহলে সে সবচাইতে বেশি ভদ্র, সভ্য, সামাজিক। তার কাছ থেকে শিখলাম ফর্মালিটি কি। ফর্মালিটি হচ্ছে বন্ধু বান্ধবের বাসায় গিয়ে বাবা মার সাথে গল্প করা। এর সাথে আশ্চর্য রকমের কাজুয়াল বন্ধুও ছিল। যে আমাদের নেতৃত্ব দিয়ে জোর করে ইফতারির দাওয়াত খেত বন্ধুদের বাসা থেকে। বন্ধুদের বাবা মাকে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে, বাসার বুয়ার পিচ্ছির সাথে বল খেলত!! আমি নিশ্চিত ওর রোগীরা ওর কাজ কারবার দেখলে হাসতে হাসতেই অর্ধেক ভালো হয়ে যাবে। যে ছেলেটা সব চাইতে চুপচাপ সেই নাটকের মঞ্চে হাজার মানুষের সামনে অবলীলায় অভিনয় করতে লাগল। ওর ভিতরে আবেগ বলে কিছু আছে নাকি এটা নিয়ে আমি সন্দেহে ছিলাম। আর এখন সে পৃথিবীর সবচাইতে মন খারাপ করে দেয়া ভায়োলিন এ আঙ্গুল বোলায়! আরেক বন্ধু ছিল, আমাকে যদি তালিকা করতে বলা হয় কাদেরকে আমি সারাজীবনে সব চাইতে বেশি শ্রদ্ধা করি। ওর নাম প্রথম তিনজনের মধ্যে আসবে। একটা বিশ্বাস নিয়ে নিজের পুরো জীবনকে ঘুরিয়ে দেয়ার মত সাহস আমার নেই, ওর আছে।
এর পরের জীবন ইউনিভার্সিটি। এখানকার বন্ধুদের কথা বলতে গেলে উপন্যাস লিখতে হবে। সেটা নিয়ে আরেকদিন লিখব। আজ ভোর হয়ে গেছে। যে বন্ধুদের কথা বললাম তারা ছিল আমার স্কুল জীবনের। নটরডেম এও আমরা এক সাথে ছিলাম। আমরা একটা গ্রুপ ছিলাম। আমাদের মধ্যে অনেক কিছু কমন ছিল। যেমন আমরা প্রায়ই একে অন্যকে জন্মদিনে উইশ করতে ভুলে যাই। ফেসবুক এ আমাদের যোগাযোগ হয় না। আমার লেখাটা ওরা না পরার সম্ভাবনা ৯৯.৯৯%।
কিন্তু এই বন্ধু গুলোর সাথে একশো বছর পরেও যোগাযোগ হলেও সম্পর্ক একচুল বদলাবে না। দশ বছর পরে হুট করে দরকার পরলে এদের দরজায় কড়া নাড়তে দ্বিধা হবে না, আর আবার দশ বছরের জন্য হাওয়া হয়ে যেতেও গ্লানি হবে না। যে বন্ধনে আমরা বাধা পরেছিলাম অনেক অনেক আগে, দূরত্ব, সময়, বাস্তবতা, বাস্ততা কোন কিছুই সেই বন্ধনকে অতিক্রম করতে পারবে না। একটা নিশ্চিত বিশ্বাস নিয়ে আমরা যে যার জায়গায় আছি। সেই বিশ্বাস বন্ধুত্তের, সেই বিশ্বাস বন্ধনের।


৯টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্বর্গের নন্দনকাননের শ্বেতশুভ্র ফুল কুর্চি

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৭


কুর্চি
অন্যান্য ও আঞ্চলিক নাম : কুরচি, কুড়চী, কূটজ, কোটী, ইন্দ্রযব, ইন্দ্রজৌ, বৎসক, বৃক্ষক, কলিঙ্গ, প্রাবৃষ্য, শক্রিভুরুহ, শত্রুপাদপ, সংগ্রাহী, পান্ডুরদ্রুম, মহাগন্ধ, মল্লিকাপুষ্প, গিরিমল্লিকা।
Common Name : Bitter Oleander, Easter Tree, Connessi Bark,... ...বাকিটুকু পড়ুন

সচলের (সচলায়তন ব্লগ ) অচল হয়ে যাওয়াটই স্বাভাবিক

লিখেছেন সোনাগাজী, ২২ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬



যেকোন ব্লগ বন্ধ হয়ে যাওয়ার খবর, একটি ভয়ংকর খারাপ খবর; ইহা দেশের লেখকদের অদক্ষতা, অপ্রয়োজনীয় ও নীচু মানের লেখার সরাসরি প্রমাণ।

সচল নাকি অচল হয়ে গেছে; এতে সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

হরিপ্রভা তাকেদা! প্রায় ভুলে যাওয়া এক অভিযাত্রীর নাম।

লিখেছেন মনিরা সুলতানা, ২২ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৩৩


১৯৪৩ সাল, চলছে মানব সভ্যতার ইতিহাসের ভয়াবহ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। টোকিও শহর নিস্তব্ধ। যে কোন সময়ে বিমান আক্রমনের সাইরেন, বোমা হামলা। তার মাঝে মাথায় হেলমেট সহ এক বাঙালী... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনারই মেরেছে এমপি আনারকে।

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২২ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:৪৮


ঝিনাইদহ-৪ আসনের সরকারদলীয় এমপি আনোয়ারুল আজিম আনার হত্যাকাণ্ডের মূল পরিকল্পনাকারী ছিল তারই ছোটবেলার বন্ধু ও ব্যবসায়িক পার্টনার আক্তারুজ্জামান শাহীন!

এই হত্যার পরিকল্পনা করে তা বাস্তবায়নের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল আরেক... ...বাকিটুকু পড়ুন

টাকা ভাংতি করার মেশিন দরকার

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৩ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

চলুন আজকে একটা সমস্যার কথা বলি৷ একটা সময় মানুষের মধ্যে আন্তরিকতা ছিল৷ চাইলেই টাকা ভাংতি পাওয়া যেতো৷ এখন কেউ টাকা ভাংতি দিতে চায়না৷ কারো হাতে অনেক খুচরা টাকা দেখছেন৷ তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×