somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

উপমহাদেশের রসায়ন চর্চার পথিকৃত আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রায় এর ১৫১ তম জন্মবার্ষিকী

০২ রা আগস্ট, ২০১১ রাত ৯:৫৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাঙালী বিজ্ঞানীদের মধ্যে অন্যতম প্রফুল্লচন্দ্র রায় বিশ্ব দরবারে বাঙালীদের রসায়ন চর্চা ও গবেষণার এক নতুন পথ উন্মোচন করেছেন এটা বলাটা মোটেই অত্যুক্তি হবে না। তাঁরই শিক্ষাদীক্ষায় ও তত্ত্বাবধানে যে নব্য রাসায়নিক গোষ্টী তৈরি হয়, পরবর্তীকালে বাঙালীর বিজ্ঞান চর্চায় তাদের ভূমিকাও ছিল লক্ষনীয়। মূলতঃ চিরকুমার এই মানুষটির যথার্থ উত্তরাধিকারী ছিল তাঁরই অনেক অনেক শিক্ষার্থী। আজ ২রা আগস্ট এই মনীষীর ১৫১ তম জন্মবার্ষিকী।

তৎকালীন যশোর জেলার (পরবর্তী খুলনা জেলা) পাইকগাছা উপজেলার রাডুলি কাঠিপাড়া গ্রামের জমিদার হরিশচন্দ্র রায়ের তৃতীয় পুত্র প্রফুল্লচন্দ্র। তাঁর জন্ম ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দের ২রা আগস্ট। পিতা হরিশচন্দ্র ছিলেন পান্ডিত্যে, শিক্ষাবিস্তারে, ন্যায়পরায়ণতায় সমাদৃত। এই সকল গুণই পুত্র প্রফুল্লচন্দ্রের জীবনে প্রতিফলিত হয়েছে।

চার বছর বয়সে গ্রাম্য পাঠশালায় প্রফুল্লচন্দ্রের হাতেখড়ি। পাঠশালার শিক্ষা সমাপ্ত করে দশ বছর বয়সে কলকাতার হেয়ার স্কুলে ভর্তি হন। যদিও কিছুদিনের মধ্যে অসুস্থ হয়ে পড়ায় পড়াশুনা বন্ধ রাখতে বাধ্য হন। ১৮৭৪ খ্রিষ্টাব্দে অ্যালবার্ট স্কুলে পড়তে থাকেন এবং ১৮৭৯ খ্রিষ্টাব্দে প্রথম বিভাগে প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাস করেন। এফ এ পড়ার জন্য মেট্রোপলিটর ইনস্টিটিউশন কলেজে (বর্তমান বিদ্যাসাগর কলেজ) আসেন। সেই আমলে এফ এ পরীক্ষায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে রসায়ন ও পদার্থবিদ্যা বিষয় দুটিও আবশ্যিক ছিল। কিন্তু মেট্রোপলিটনে এই বিষয়ে পড়াবার ব্যবস্থা ছিল না।

সেই সময় প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগের অধ্যাপক ছিলেন অলেকজান্ডার পেডলার। প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজে গিয়ে পেডলার সাহেবের বক্তৃতা শুনতেন এবং রসায়ন পাঠ নিতেন। খ্যাতিমান এই অধ্যাপকের সান্নিধ্যে এসে রসায়নের প্রতি আগ্রহ বাড়ে তাঁর। কলেজের পাঠ্য বই ছাড়াও বিভিন্ন পাঠাগার থেকে রসায়নের বই সংগ্রহ করে পড়তেন। নিজের চেষ্টায় বাড়িতে পরীক্ষাগার স্থাপন করে রসায়ন সম্পর্কে নানারকম পরীক্ষাও চালাতেন।

১৮৮১ সালে এফ এ তে ২য বিজ্ঞানে পাস করে বিএ ভর্তি হলেন প্রেসিডেন্সি কলেজ্ সেখান থেকে 'গিলক্রিস্ট' বৃত্তি নিয়ে স্কটল্যান্ডের এডিনবার্গ বিশ্ববিদ্যালয় থেকে কৃতিত্বের সাথে বিএসসি পাস করেন এবং এখান থেকেই ডিএসসি ডিগ্রী লাভের জন্য গবেষণা আরম্ভ করেন। তাঁর গবেষণার বিষয় ছিল 'Conjugated Sulphates of Copper Magnesium Group: A Study of Isomorphous Mixtures and Molecular Combination' । প্রায় দু'বছর কঠোর পরিশ্রমের পর পিএইচডি ও ডিএসসি ডিগ্রী লাভ করলেন এবং তাঁর গবেষণাপত্রটি শ্রেষ্ঠ হওয়ায় তাকে 'হোপ' পুরষ্কারে ভূষিত করা হয়।

১৮৮৮ খ্রিষ্টাব্দের আগস্ট মাসে ইংল্যান্ড থেকে ভারতে ফিরে আসেন প্রফুল্লচন্দ্র। ১৮৮৯ খ্রিষ্টাব্দে তিনি প্রেসিডেন্সি কলেজে রসায়ন বিভাগে সহকারি অধ্যাপক হিসেবে যোগদান করেন। একই সঙ্গে তাঁর গবেষণার কাজও চালিয়ে যান। ১৮৯৫ খ্রিষ্টাব্দে পারদ সংক্রান্ত বিখ্যাত গবেষণাটি সম্পন্ন করেন, আবিষ্কার করেন পারদঘটিত নতুন যৌগ মারকিউরাস নাইট্রাইট। শীতল অবস্থার অতিরিক্ত মারকারির লঘু নাইট্রিক এসিডের বিক্রিয়া ঘটিয়ে তিনি এই যৌগ গঠন করেন। এই আবিষ্কারের মধ্য দিয়েই রসায়নবিদ হিসেবে তাঁর খ্যাতি বিস্তৃত হয়। পরবর্তীকালে তিনি পারদের নাইট্রোজেন ঘটিত বিভিন্ন যৌগ তৈরি করেন এবং তাদের ভৌত ও রাসায়নিক ধর্ম বের করেন। এদের মধ্যে মারকিউরিক ও মারকিউরাস হাইপো নাইট্রাইট ও ডাই সালফোনিয়াম প্রভৃতি উল্লেখযোগ্য। এছাড়া তিনি ধাতব ও অধাতব নাইট্রাইট যৌগসমূহের প্রস্তুতপ্রণালী ও ধর্ম নিয়ে গবেষণা করেন। প্ল্যাটিনাম যৌগের সংশ্লেষণ ও তাদের কয়েকটির সম্ভাব্য গঠন ও আকৃতি ১৯১১ খ্রিষ্টাব্দে প্রফুল্লচন্দ্র প্রেসিডেন্সি কলেজের প্রধান অধ্যাপকের পদে নিযুক্ত হন। একই বছর ব্রিটিশ সরকার তাকে সিআইই ও ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে 'নাইট' উপাধিতে ভূষিত করে। এছাড়া ডারহ্যাম, কলকাতা, ঢাকা ও বেনারস বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তিনি ডি.এস.সি উপাধি লাভ করেন। ১৯২০ খ্রিষ্টাব্দে ভারতীয় বিজ্ঞান সভা তাকে প্রধান সভাপতি পদে বরণ করে। ১৯২৪ খ্রিষ্টাব্দে তাঁর ঐকান্তিক চেষ্টা ও অর্থ সাহায্যে প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান কেমিক্যাল সোসাইটি। এই প্রতিষ্ঠানে তিনি প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি রূপে প্রতম চার বছরের জন্য নির্বাচিত হন।

প্রফুল্লচন্দ্র এর অমর কীর্তি 'বেঙ্গল কেমিক্যাল এন্ড ফার্মাসিউটিক্যাল ওয়ার্কস লিমিটেড' ১৯০১ খ্রিষ্টাব্দে স্থাপিত হয়। এটিই ভারতবর্ষের রাসায়নিক দ্রব্য ও ওষুধ প্রস্তুতের প্রথম কারখানা এবং আজও সারা ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠ রসায়ন শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর অন্যতম।


রসায়নশাস্ত্র প্রফুল্লচন্দ্রের দীক্ষামন্ত্র ছিল। কিন্তু এর পাশাপাশি তিনি মানুষের দুঃখ দুর্দশায়, দুর্ভিক্ষে, বন্যায় সম্বলহীন মানুষের পাশে এসে দাড়িয়েছেন। সমাজ সংস্কারের ক্ষেত্রেও তাঁর মূখ্য ভূমিকা ছিল। বাল্যবিবাহ, জাতিভেদ প্রভৃতি হিন্দু সমাজের বহু কুসংস্কারের বিরুদ্ধে তিনি আন্দোলন করে গেছেন। বিজ্ঞান চর্চা বা মানব সেবা যে কারণেই হোক না কেন নিবেদিত প্রাণ এই মানুষটি ছিলেন নিঃসন্তান। নিঃসন্তান হলেও শিক্ষার্থীরাই ছিল তাঁর সন্তানস্বরূপ।

গান্ধীজির সাথে প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে অংশ নেন তিনি। এজন্য ব্রিটিশ গোয়েন্দা ভাষ্য ছিল - তিনি ' বিজ্ঞানী বেশে বিপ্লবী'। ১৯১৯ খ্রিষ্টাব্দের ১৮ জানুয়ারি রাওলাট আইনের বিরুদ্ধে টাউন হলে দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাসের সভাপতিত্বে এক অনুষ্ঠানে আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র বলেন, "আমি বিজ্ঞানী, গবেষণাগারেই আমার কাজ। কিন্তু এমন সময় আসে যখন বিজ্ঞানীকেও সাড়া দিতে হয় দেশের কাজে"।

কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে প্রতিষ্ঠিত বিজ্ঞান কলেজে অধ্যাপনা ও গবেষণার কাজে নিয়োজিত থেকে ১৯৩৬ খ্রিষ্টাব্দে ৭৫ বছর বয়সে অবসর গ্রহণ করেন। যদিও তিনি আমৃত্যু এই কলেজের এমেরিটাস অধ্যাপক হিসাবে নিযুক্ত ছিলেন। শেষ জীবনে তাঁর স্মৃতি শক্তি লোপ পায়। নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে ১৯৪৪ খ্রিষ্টাব্দের ১৬ জুন বিজ্ঞান কলেজেই তাঁর জীবনাবসান হয়।

নিঃস্বার্থ এই বিজ্ঞান সাধকের জীবনাদর্শ কতোটুকু উদ্বুদ্ধ করতে পেরেছে বাঙালী ও বাংলার বিজ্ঞান চর্চায়, সেটি যদিও স্বভাবতই প্রশ্নবিদ্ধ। কারণ, আমরা মহতী মানুষদের জীবনাদর্শে যেমন অনুপ্রাণিত হই না তেমনি তাদেঁর প্রতি যথাযথ কৃতজ্ঞতা প্রকাশ ও শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করবার কষ্টটুকুও করি না। তারপরেও এঁরা চির জাগরুক হয়ে থাকবেন তাদেঁর কর্মের মাঝে।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শৈল্পিক চুরি

লিখেছেন শেরজা তপন, ০১ লা জুন, ২০২৪ সকাল ১১:৫৭


হুদিন ধরে ভেবেও বিষয়টা নিয়ে লিখব লিখব করে লিখা হচ্ছে না ভয়ে কিংবা সঙ্কোচে!
কিসের ভয়? নারীবাদী ব্লগারদের ভয়।
আর কিসের সঙ্কোচ? পাছে আমার এই রচনাটা গৃহিনী রমনীদের খাটো... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। কোথায় বেনজির ????????

লিখেছেন শাহ আজিজ, ০১ লা জুন, ২০২৪ দুপুর ১২:০৫




গত ৪ মে সপরিবারে সিঙ্গাপুরের উদ্দেশে পাড়ি দিয়েছেন সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ। সঙ্গে আছেন তার স্ত্রী ও তিন মেয়ে। গত ২৬ মে তার পরিবারের সকল স্থাবর সম্পদ... ...বাকিটুকু পড়ুন

‘নির্ঝর ও একটি হলুদ গোলাপ’ এর রিভিউ বা পাঠ প্রতিক্রিয়া

লিখেছেন নীল আকাশ, ০১ লা জুন, ২০২৪ দুপুর ১:৫৭



বেশ কিছুদিন ধরে একটানা থ্রিলার, হরর এবং নন ফিকশন জনরার বেশ কিছু বই পড়ার পরে হুট করেই এই বইটা পড়তে বসলাম। আব্দুস সাত্তার সজীব ভাইয়ের 'BOOKAHOLICS TIMES' থেকে এই বইটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে বিতর্ক করার চেয়ে আড্ডা দেয়া উত্তম

লিখেছেন সাড়ে চুয়াত্তর, ০১ লা জুন, ২০২৪ রাত ১১:২৬

আসলে ব্লগে রাজনৈতিক, ধর্মীয় ইত্যাদি বিতর্কের চেয়ে স্রেফ আড্ডা দেয়া উত্তম। আড্ডার কারণে ব্লগারদের সাথে ব্লগারদের সৌহার্দ তৈরি হয়। সম্পর্ক সহজ না হলে আপনি আপনার মতবাদ কাউকে গেলাতে পারবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্লগে প্রাণ ফিরে এসেছে!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০১ লা জুন, ২০২৪ রাত ১১:৩৪



ভেবেছিলাম রাজিবের অনুপস্হিতিতে সামু রক্তহীনতায় ভুগবে; যাক, ব্লগে অনেকের লেখা আসছে, ভালো ও ইন্টারেষ্টিং বিষয়ের উপর লেখা আসছে; পড়ে আনন্দ পাচ্ছি!

সবার আগে ব্লগার নীল আকাশকে ধন্যবাদ... ...বাকিটুকু পড়ুন

×