somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তোতলা আসিফ ও কয়লা সুন্দরীর গল্প।

৩০ শে জুলাই, ২০১১ দুপুর ১২:৪৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

খুবই সাধারন একটা গল্প। কোনরকম চমক নেই।

নীলার গায়ের রঙ কালো। জন্ম থেকেই এটা তাকে বহুবার মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। জন্মের ৩ বছর পর তাকে দেখে তার দাদী তার বাবাকে বলেছিল ' তোর মাইয়া দেখি কালা , বিয়া দিবি কেমনে'? জন্মের পরের সব থেকে প্রাচীন স্মৃতি নীলার এটাই আছে। আগেকার দিনে মেয়ে জন্মের পরপরেই বিয়ার কথা চিন্তা করা লাগত এখনকার যুগেও দেখা যাচ্ছে খুব বেশি পাল্টায়নি।

জগতে সব সৌন্দর্য্য ফর্সারাই ধারন করে আছে কালোরা না। আমাদের আশেপাশে এরকম চিন্তাভাবনাতেই আমরা বড় হই। প্যাঁচাও যদি ফরসা হয় আমরা তাকে সৌন্দর্য্যের মাপকাঠিতে ফেলব। নীলা কাল হতে পারে, তবে নীলা দেখতে সুন্দর, অদ্ভুত রকমের এক মায়া আছে তার চেহারায়, সেই চেহারায় রয়েছে স্নিগ্ধতা। তাই আড়ালে তার একটা মজার নাম আছে- কয়লা সুন্দরী। এই নামে তাকে ডাকা হয়- তার এতে কেমন লাগে সেটা বোঝার চেষ্টা করার চেষ্টা করতে কেউ রাজীনা। দুই একজন তাকে বিরক্ত করার উদ্দেশ্যে গান গায়- মন কেন মানেনা, নিঝুম আধার কাটেনা, হায় কালা কালা কালা এ মন জুড়ে। সঠিন গানটিতে জ্বালা জ্বালা জ্বালা হওয়ার কথা ছিল।

নীলার সব থেকে বেশি কষ্ট লাগে যখন তার বাসার মানুষজন ভুল আচরনটা করে। নীলার ভাল গুনের অভাব নেই। কখনো কারো সাথে খারাপ আচরন করেনা। কিন্তু তার বিয়ের প্রস্তাব আসার সময় তার নিজের বাবাই অপর পক্ষকে বলল , শুনেন, আমার মেয়ে কিন্তু কালো!!

রেসিজম বলে একটা কথা আছে। একসময় এটা নিয়ে দুনিয়া তোলপাড় ছিল। এখনও আছে। নীলার ছোট দুনিয়াতেও দেখা যাচ্ছে এই রেসিজমে ভরা। সান্তনা খোঁজার ভাষা যতই খুঁজুক, যতই আধুনিকতার গান চারপাশে থাক কিন্তু একটা ব্যাপার সত্যি- মেয়ের গায়ের রঙ কালো মানে এক ধাপ নিচে চলে যাওয়া। আর সেটা সব থেকে বেশি পরিলক্ষিত হয় বিয়ের সময়। মেয়ে শিক্ষিত, মেয়ে ভাল, মেয়ে ভদ্র, মেয়ে সহনশীল এগুলার থেকে বড় ব্যাপার মেয়ে কালো, মেয়ে কিছুটা খাট। মানুষের জীবনে ভালবাসার আকাংক্ষা থাকে, নীলার জীবনেও থাকবে সেটাই স্বাভাবিক। সেই আকাংক্ষার সব থেকে বড় ট্র্যাজেডী হল- নীলাকে দেখতে এসে তার চাচাতো বোনকে বিয়ে করে চলে যাওয়া। একটা ব্যাপারে কেউ স্বান্তনা খুঁজতে পারে, সেই বিয়ে ধোপে টিকেনি। নীলার সেই অতি ফরসা সুন্দরী চাচাতো বোন অন্য কারো হাত ধরে দেশান্তর হয়েছে। তাতে আরও সমস্যা হয়ে গেল। নীলাদের বংশের নামে কিঞ্চিত দাগ পড়ে গেল। কেউ এটাও বুঝলনা এর সাথে নীলার কোনই সম্পর্ক নাই।

কালো মেয়ের পরে এবার এক ছেলের প্রশংগে আশা যাক। ছেলে নাম আসিফ। তার প্রধানতম সমস্যা সে তোতলা। তাই তার নাম তোতলা আসিফ। একটা কথা পুরা বলার মত সাহস বা আস্থা কোনটা তার মধ্যে নাই। তার বন্ধু তূর্যকে যখন সে ফোন করে সে তূ তূ তূ তূ তূ তূ তূ তূ তূ - এরপর আর বলতে পারেনা। ঐপাশে তূর্যের আম্মা ধরলে বলেন বাবা আর কষ্ট করতে হবেনা। এইটা লাইফের ট্র্যাজেডি কিনা কে জানে? তোতলামী একটা বড় সমস্যা। ছোটবেলায় তোতলামীর কারনে কবিতা আবৃত্তি করা হয়নি তার। ডাক্তার দেখিয়েছে। ডাক্তার অনেক চেষ্টা চরিত্র করে, মার্বেল মুখে রেখে কথা বলিয়ে দেখেছে - আস্থার অভাব। চাকুরী ক্ষেত্রেও দেখা যাচ্ছে তূর্যের আস্থার বড়ই অভাব। যে কোন কিছুতেই আস্থার বড়ই অভাব। সেই কম আস্থা নিয়েই আজ সে মেয়ে দেখতে যবে। মেয়ের নাম হল সোনিয়া। স উচ্চারনে তার সমস্যা একটু কম কিন্তু তারপরেও বলা যায়না অন্তিম মুহূর্তে কি না কি গুবলেট হয়ে যায়।

মেয়ে দেখার ক্ষেত্র নির্ধারিত হল এক চাইনীজে। এবং তোতলা আসিফের জীবনের মতই সব কিছু উলটা বালটা হল। মেয়ের গার্ডিয়ান ছেলের গার্ডিয়ান আছে তয় কথা বলছে মেয়ে আর ছেলের বাবা মা। তোতলা আসিফ কোন কারনে কথা বলার সাহস সঞ্চয় করে উঠতে পারছেনা। সে কয়েকবার সোনিয়া নামটা বলার চেষ্টা করছে কিন্তু স স স স স স স স স স এর পর আর যাওয়া যাচ্ছেনা। ব্যাপারটা আসলে কিভাবে হচ্ছে কিছুই বোঝা যাচ্ছেনা কারন ছেলের না ইন্ট্রো আগে দেওয়ার কথা। আসিফ কি মনে করে জানি উঠে টয়লেটে গেল। ছেলে আর মেয়ের টয়লেট পাশাপাশি। দরজা দুইদিকে। চাইনিজ রেষ্টুরেন্ট পুরা খালি। আসিফের ধারনা ছিল আর কেউ নাই। কিন্তু মেয়েদের বাথরুম থেকে কান্নার শব্দ আসছে। আসিফ ভুতের ভয় পাবে কিনা বুঝতে পারলনা। আসিফ বাথরুম থেকে বের হল আর সাথে সাথেই মেয়েদের টয়লেট থেকে নীলা বের হল।

এই এই আপনি ন ন ন ন ন ন নীলা না?

নীলা বেশ অবাক হল।

- তাই নাকি? আমি তো জানতাম আমি কয়লা সুন্দরী। আপনার বন্ধুরা তো আমাকে তাই ডাকত।

-ত তা ড ডাকুক। আপনার ন ন ন ন নাম তো নী নী নীলা।

-নী নী নীলা না শুধু নীলা। আপনি এত ঘামছেন কেন বলেন তো?

- আরে আমি মেয়ে দেখতে আসছি। মেয়ে খালি আমার আব্বা আম্মার সাথে কথা বলছে।

- সেটাই তো ভাল। আপনি কথা বলা শুরু করলে শেষ করতে পারবেন না। একবার আমার বান্ধবীকে প্রপোজ করতে আসছিলেন। আই আই আই করতে করতেই চলে গেলেন।

-তুমি আমাকে নিয়ে মজা করতেছ ক্যান??

-কেই বা আর কার সাথে মজা করেনা। আপনার সাথে এর আগে কথাও হয়নি কখনো। আপনাকে তোতলা আসিফ ডাকা হত শুনেছিলাম তবে এই অবস্থা জানতাম না।

আসিফের ফোন বেজে উঠল। আসিফ চলে গেল। এরপর যা হওয়ার তাই হল। আসিফ অতিরিক্ত তোতলামি কারনে সোনিয়া নামটাই ঠিকমত বলতে পারলনা।

তোতলা আসিফের সাথে কয়লা সুন্দরীর এরপরের দেখা হল কারন কাকতালীয় ভাবে তারা একই জায়গায় কাজ করা শুরু করল। তোতলা আসিফ একদিন নীলাকে গিয়ে বলল আর তোতলামির প্রধান কারন হল অনাস্থা। আশে পাশের মানুষজন যদি এতে সামান্য সাহায্য করতে পারে তাহলে হয়ত কিছুটা উন্নত করা যায়। আসলে সেবার ছিল একটা প্রজেক্টের কাজ। যেটার সেমিনারে বক্তব্য রাখতে হবে আসিফকে। অফিসের সবাই এর বিরোধী ছিল। কিন্তু ডিরেক্টর সাহেব আর যাই হোক আসিফকে পছন্দ করেন। তোতলা আসিফের কাজ হল নিয়মিত নীলার কাছে পড়াক্টিস করা। তবে অবস্থা ভয়াবহ- স্পিচ দেওয়া অনেক পড়ের ব্যাপার একটা লাইনও তার এখনও বলা হয়না। অনেক চেষ্টা চরিত্র করা হল। মোটামুটি একটা সাইজে আনা হল। সেমিনারের দিন স্পিচ বলার সময় আসিফকে ডাকা হল। আসিফ চেয়ার থেকে উঠে ভয়ে রুম থেকে বের হয়ে গেল।

কেউ কেউ হাসল কেউ কেউ বিরক্ত হল। নীলাও উঠে রুম থেকে বের হল।

- কি ব্যাপার?

- হহ হ হবেনা আমাকে দিয়ে।

- তাতো জানি আপনাকে দিয়ে কখনো কিছু হবেনা। কিন্তু আপনি আমার সময় নষ্ট করলেন কেন?

- স স্যরি।

- শুনলাম তানিয়া নামে এক মেয়ের সাথে আপনার বিয়ে ঠিক হয়েছে? আপনার কি মনে হয় এরকম ভীতু কারো সাথে তানিয়া থাকবে?

- এই কথা বলার তুমি কে?? কয়লা সুন্দরী কোথাকার!!

আসিফ আবার রুমে গেল। অনেক কিছু সহ্য করা যায় কিন্তু কয়লা সুন্দরীর খোঁচা সহ্য করা যায়না। আসিফ কয়েকজনকে বলে কয়ে আবার স্পিচ দেওয়ার ব্যবস্থা করল। অবাক করা ব্যাপার- সে মোটামুটি না থেমেই বলে ফেলল। দুয়েক জায়গায় আটকালেও দৃষ্টিকটু লাগল না। স্পিচ দিয়ে বের হয়েই সবাই অভিনন্দন জানাল। কিন্তু কোথাও নীলাকে পাওয়া গেলনা। মোবাইলে একটা মেসেজ এসেছে। নীলার মেসেজ- " আপনাকে অভিনন্দন। তোতলামী চেষ্টা করে জয় করা যায়। কিন্তু আল্লাহর দেওয়া গায়ের রঙ কেউ পাল্টাতে পারবেনা। আমি কখনই আপনার সমকক্ষ হতে পারবনা। আমাকে আজীবন কয়লাই থাকতে হবে।"

নীলার মোবাইল বন্ধ। তাকে কোনভাবেই পাওয়া যাচ্ছেনা। আসিফ তার বাবা মাকে নিয়ে নীলার বাসায় যাচ্ছে। তানিয়া টানিয়া দিয়ে হবেনা। সবার জন্য সবাই না। তার জীবনের জন্য কয়লা সুন্দরীকে দরকার। এখন নীলা মানবে কিনা কে জানে!!
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই জানুয়ারি, ২০১২ রাত ১:১৪
৩৪টি মন্তব্য ২০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

নারীবাদ, ইসলাম এবং আইয়ামে জাহেলিয়া: ঐতিহাসিক ও আধুনিক প্রেক্ষাপট

লিখেছেন মি. বিকেল, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৪



আইয়ামে জাহিলিয়াত (আরবি: ‏جَاهِلِيَّة‎) একটি ইসলামিক ধারণা যা ইসলামের নবী মুহাম্মদ (সাঃ) এর আবির্ভাবের পূর্ববর্তী আরবের যুগকে বোঝায়। ঐতিহাসিকদের মতে, এই সময়কাল ৬ষ্ঠ থেকে ৭ম শতাব্দী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

#প্রিয়তম কী লিখি তোমায়

লিখেছেন নীল মনি, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৭:৫১


আমাদের শহর ছিল।
সে শহর ঘিরে গড়ে উঠেছিল অলৌকিক সংসার।
তুমি রোজ তাঁকে যে গল্প শোনাতে সেখানে ভিড় জমাতো বেলা বোস, বনলতা কিংবা রোদ্দুর নামের সেই মেয়েটি!
সে কেবল অভিমানে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভুল শুধু ভুল নয়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৮:১৬

এক
লেখাটা একটি কৌতুক দিয়ে শুরু করি। ১৯৯৫ সালের ৩০ নভেম্বর থেকে শফিপুর আনসার একাডেমিতে বিদ্রোহ হয়। ৪ ডিসেম্বর পুলিশ একাডেমিতে অভিযান চালায়। এতে চারজন আনসার সদস্য নিহত হয়েছিল। এটি ছিল... ...বাকিটুকু পড়ুন

ময়লাপোতার কমলালেবুর কেচ্ছা!! (রম্য)

লিখেছেন শেরজা তপন, ২১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৫:১৩


বাংলাদেশের বিশেষ এক বিভাগীয় শহরে ময়লাপোতা, গোবরচাকা, লবনচোরা, মাথাভাঙ্গা, সোনাডাঙ্গার মত চমৎকার সব নামের এলাকায় দারুণ সব সম্ভ্রান্ত পরিবারের বাস।
আমার এক বন্ধুর আদিনিবাস এমনই এক সম্ভ্রান্ত এলাকায় যার... ...বাকিটুকু পড়ুন

×