সময়: ১৯৭১
তন্ময়ের বাঁ পায়ে গুলিটা লেগেছে। গাছের এক কোণায় ও গা এলিয়ে চোখ বন্ধ করে আছে। আমি পিছন ফেরে এক নজর দেখেই আবার আমার রাইফেলটা সামনের দিকে তাক করলাম। আমার ডানদিকে রিফাত,নয়ন,রফিক আর রাজিব বিরামহীন গুলি চালাচ্ছ। বামপাশে রাসেল, মুরাদ আর পলাশ গ্রেনেড হাতে নিয়ে আছে। কয়েকমিনিট পর পরই ওরা গ্রেনেড ছুড়ছে। আর আমাদের সবার ব্যাক আপে আছে অনন্ত,ফুয়াদ আর তুর্য। পাকিস্তানিরা আর বোধহয় সংখ্যায় বেশি নেই ।
হঠাৎ শাঁ করে একটা গুলি আমার মাথার উপর দিয়ে চলে গেল। আরেকটু হলেই.................আজ হঠাৎ কি হল। আজ একদমই মন বসাতে পারছি না অপারেশনে । তন্ময়ের জন্য খারাপ লাগছে। আমাকে বাচাতেই ও গুলিটা খেলো। গতকাল ১৫ ডিসেম্বরের মিশনটা ওর জন্যই সার্থক হয়েছিলো। ও যদি রমজান চাচাকে সময় মত গুলি না করতো তবেতো আমরা সবাই মারা পরতাম। রমজান চাচা যে শান্তি কমিটির রাজাকার সেটা আমি জানতামই না। অনন্ত অবশ্য একবার আমায় বলেছিলো রমজান চাচার মতিগতি আজকাল ঠিক ভালো মনে হচ্ছে না, তিনি নাকি গত পরশু অনন্তদরে বাসায় গেয়ে হৈ চৈ করে এসেছে , ওদরে নাকি এ গ্রাম ছেড়ে বর্ডাররে ওপার যেতে হবে। মুসলমানদের দেশে বিধর্মীদের কোন জায়গা নেই । অথচ এই রমজান চাচার বড় দুঃসময়ে অনন্তের বাবা যদি সাহায্য না করত তবে হয়তো বা আজ রমজান চাচাকে পথে বসত হতো। এসব কথা তিনি বেমালুম ভুলে গেলেন, মানুষ কত তাড়াতাড়ি পরবির্তন হয়।
আজ কেমন জানি লাগছে। আসলে তন্ময়টা পাশে না থাকলে আমার কেমন একা একা লাগে। এইতো ক’মাস হলো আমরা তন্ময়ের দেখা পেলাম । আমরা একই গ্রামের, তবে তন্ময় খুব ছোটবলোয় ঢাকা চলে গিয়েছিলো পড়াশুনার জন্য। আমরা গ্রামইে পড়ে রইলাম। পরে গত বছর ওর আব্বা মারা যাওয়ার পর তন্ময় গ্রামে চলে আসল। পরে আর ঢাকা ফিরে যায়নি। ও ঢাকায় কোন কলেজে নাকি অনার্সে ভর্তি হয়েছিলো। এখন আপাতত পড়াশুনা বন্ধ। আর এর মাঝেই দেশে গন্ডগোল শুরু হল। শহর থেকে এসে প্রথম প্রথম ও আমাদের সাথে ঠিকভাবে মিশতে পারত না, পরে এমনভাবে মিশে গেলে আমাদের সাথে ,বিশেষ করে আমার সাথে। যুদ্ধের ট্রেনিংয়েও ও সব সময় আমার আর অনন্তের সাথে ছিল। প্রতিদিন যুদ্ধও করলাম একসাথে পাশাপাশি, আর আজ.........
আমাদের গ্রামের সব কটা পাকিস্তানি ক্যাম্প আমরা দখল করে ফেলেছি ধীরে ধীরে। শুধু এই পশ্চিম দিকেরটা বাকি ছিল। তাও বাকি থাকত না যদি না রমজান চাচা আমাদরে সাথে বিশ্বাসঘাতকতা না করত। সেদিন অনন্ত আর ফুয়াদ মধ্যরাতরে অপারেশনে এসে দেখে ক্যাম্প
ঊধাও। তারা আগইে খবর পেয়ে গেছে। আর সেটা যে রমজান রাজাকারই জানিয়েছে তা বুঝতে এখন আর বাকি নেই।
ধুম্ করে একটা শব্দ হলো গাছের পাশে। হানাদাররা বোধহয় শেল ফাটালো। আরকেটু হলেই তন্ময়রে গায়ে এসে লাগতো। না! তন্ময়কে গাছরে পাশে রাখাটা নিরাপদ মনে হচ্ছে না।
‘তন্ময় তুই ঠিক আছিস তো’
‘উহ্!... আছি, আমি ঠিক আছি তুই চালিয়ে যা।’
তন্ময়রে জড়ানো গলা শুনে আমার ভেতরটা কেপে উঠলো। ওর বোধহয় খুব কষ্ট হচ্ছে। সেদিন তন্ময় বলছিল,‘দেশ স্বাধীন হলে, আমরা আমাদের অনার্সটা শেষ করব। পড়াশুনা শেষ করে আমাদের গ্রামের হাইস্কুলে আমি ,অনন্ত আর তুই একসাথে চাকরি করব। তিন বন্ধু মিলে গ্রামে একটা সংগঠন দাড় করাবো। গ্রামের মানুষের সব রকম সমস্যা দূর করব। আবার বলছেলি, ‘তুই,রূপা,ইরা,রফিক আর নাহিদা মিলে একটা গানের দল করবো। আমরা সবাই মিলে সারা গ্রাম গান গেয়ে বেড়াবো। রফিক,নাহিদা আর ইরা মিলে গান বাধবে ,তুই আর রূপা গাইবি। তোদের দ্বৈত কন্ঠে গান খুব মানায়। তন্ময় রূপাকে যে আমার জন্যই গানের দলে নিবে সেটা আমি জানি। রূপাকে যে আমি খুব পছন্দ করি তন্ময় সেটা জানে। আসলে তন্ময় খুব বড় মনের তাই ওর ইচ্ছাগুলোও খুব বড় বড়। ইস্ কবে যে যুদ্ধ শেষ হবে দেশ স্বাধীন হবে। এই হারামির বাচ্চারা কবে যে আমাদের দেশ ছেড়ে যাবে ।
শাঁ করে আরকেটা গুলি গেলো আমার পাশ দিয়ে। এবার মেজাজটা খারাপ হয়ে গলেো। রাইফেলের ট্রিগারটা চেপে ধরে রাখলাম যতক্ষণ গুলি বের হতে পারে বের হোক। সব হারামিরা মরে যাক। দেশের শান্তি প্রিয় মানুষগুলো আবার শান্তি ফিরে পাক।
হঠাৎ আলতো র্স্পশে আমি পিছন ঘুরে দেখি তন্ময় আমার পাশে, ও আবার রাইফেল হাতে তুলে নিল।
‘তন্ময় তুই! এই শরীরে........’
‘রাখ্ তোর শরীর ,একটা পা গেছে বলে কি আমি যুদ্ধ করতে পারব না। ঐ হারামির বাচ্চাদের শেষ না করে আমার স্বস্তি নেই।’
কিছুক্ষণের মধ্যে অনন্তও আমার পাশে আসলো। ওদরেকে পাশে পেয়ে আমি আবার অফুরন্ত সাহস ফিরে পেলাম। যেন অতল সমুদ্রে আমি তলিয়ে যাচ্ছলিাম ওরা যেন ভেলা হয়ে এলো। ওদের অমিত তেজ আমার মধ্যে প্রবাহতি হলো। চারদিকে তাকিয়ে দেখি সবাই একমনে গুলি ছুড়ছে ,লক্ষ্যবস্তু একটাই ‘হানাদার’। মনে হল আজকেই দেশ স্বাধীন করে ফেলব।
হঠাৎ একটা গুলি আমার বুকের ঠিক বামপাশে আঘাত করলো। আমার অফুরন্ত সাহস তখন গুমোট এক ব্যথায় আটকে গেল। সকল চঞ্চলতা স্থবির হয়ে এলো। বুকের ভিতর তীব্র কষ্ট হচ্ছে। তন্ময় চিৎকার করে আমায় জড়িয়ে ধরলো। ওর বুকের সাথে আমার বুক স্পর্শ করতেই আমার সব ব্যথা যেন অনুভুতিহীন হয়ে যাচ্ছে। আমার আর ব্যথা লাগছে না। চারদিক হঠাৎ নিরব হয়ে গেল। সব গুলির আওয়াজ বন্ধ, আর কোন বোমার শব্দ নেই। সবাই কেমন যেন বোবা হয়ে গেছে। কী শান্ত চারদিক! কত দিন পর এত শান্ত এক পরিবেশ দেখছি। অনন্ত কি যেন বলছে আমি ভাসা ভাসা শুনতে পাচ্ছি বোধহয় আমার নাম ধরে চিৎকার করে ডাকছে। অনন্ত আমার এতো কাছে তবুও চিৎকার করছে কেন? মাঝে মাঝে একটা সুরের মতো রোল উঠছে আবার নামছে, নিরবতা ভেঙ্গে আমার কানে ভেসে আসছে,
‘‘ জয় বাংলা
জয় বাংলা ’’
আমি তন্ময়ের কোলে মাথা দিয়ে শুয়ে আছি। এদিকে অনন্ত ছোটাছুটি করছে, কি করবে, না করবে ও বোধহয় বুঝে উঠতে পারছে না। ফুয়াদ আমার হাত ধরে নিস্পলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। আমাদের ঘিরে আছে রিফাত,রাজিব,রফিক,নয়ন,পলাশ,মুরাদ। সবার চোখ ছলছল। শুধু আমার চোখে জয়ের চিহ্ন। আমরা অবশেষে জিতেছি। দেশ স্বাধীন হলো। আমার খুব চিৎকার করে ওদের মত বলতে ইচ্ছে করছে,
‘‘জয় বাংলা
জয় বাংলা’’
থেকে থেকে তন্ময়ের গলা শুনতে পাচ্ছি,‘তোর কিছুই হবে নারে, তোর কিছুই হবে না.........তোকে বাচতে হবে, স্বাধীন দেশে তোকে বাচতেই হবে, স্বাধীন দেশে কেউ মরবে না।’
আমি একটু হেসে আকাশের দিকে থাকালাম। আজকের আকাশটা এত সুন্দর কেন? স্বাধীন দেশের আকাশ বলে কি এত নীল! পরাধীনতার সব কালো মেঘ উড়ে গেছে। অনেকদিন আগে নদীর পাড়ে এরকম নীল আকাশ দেখে রূপা খুশিতে আত্বহারা হয়ে বলেছিল,‘দেখো দেখো শান্ত, কী সুন্দর আকাশ, নীলের মধ্যে শুভ্র মেঘগুলো যেন শিমুল তুলো, আকাশে পরী হয়ে উড়ছে।’ বিকেলের সেই সোনালী আলোয় রূপাকে কী সুন্দরই না লাগছিল। রূপা সেদিন আমার দেয়া লাল পাড়ের সবুজ শাড়ি পরেছিল, কপালে ছিল ডুবন্ত সূর্যের মত লাল টিপ, সব যেন এখনও আমার চোখে ভাসছে। রূপা কী সুন্দর রিনিঝিনি করে হাসছিল যেন এখনও আমার কানে ভাসছে। রূপা! আজও তোমায় বলা হল না ‘ভালোবাসি’। এসব ভাবতে ভাবতে আমি বিজয় উল্লাসে আকাশপানে ভেসে যাচ্ছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৭ ই আগস্ট, ২০১১ বিকাল ৫:৪০