somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রেট্রো টু রামাদান – ৫

২১ শে জুলাই, ২০১৩ রাত ৮:১৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

ক) আব্বুর সাথে ২০০৩ সালের রমজান মাসটা সুন্দর ছিল না। ২০০২ সালের আব্বুর ডায়াবেটিস ও উচ্চরক্তচাপ জনিত কারণে ছোটখাট ব্রেইন স্ট্রোক করে বসেন – ডাক্তারী ভাষায় বলে হেমাটোমা – এটা একটু রক্ত জমাটই বটে তবে আব্বুর কথা বার্তা – স্মরণ শক্তি কমে আসছিল। আমার সাথে আমার বাবার বয়সের পার্থক্য কুড়ি বছর। আমার বয়স ছিল তখন ২৩ কি ২৪, আব্বু ৪৪ কি ৪৫। আব্বু আর আমি বন্ধুই ছিলাম। হাসপাতাল থেকে এনে আব্বুকে নিয়ে রীতিমত অনেক সাইন্টিফিক গবেষণা চালাতে হত। তাঁর রক্ত পরীক্ষা, ইউরিন পরীক্ষা, এগুলো বাসায় বসে কত কি টেস্ট সব আমার শিখতে হয়েছিল। এসব বুনসেন বার্নারে টেস্টটিউব ধরে অধঃক্ষেপ বের করা আম্মুর বুঝার ফ্রিকোয়েন্সির বাইরে ছিল বলে আমাকেই করতে হত। আমার এখনও মনে আছে – আমি সেহেরীর আগে ও ইফতারে পানি খাওয়ানোর পরে নিজ হাতে ইনসুলিন দিয়ে দিতাম। ইনসুলিন ইনজেকশানে আব্বুর হাত দাগ দাগ হয়ে যেত। আব্বু ইনজেকশান খুব ভয় পেতেন। আমার নিজ হাতে আব্বুকে এই কষ্ট দিতে মোটেই ভাল লাগত না। ইফতারে আব্বু অনেক ক্ষীরা (ছোট শশা) খেতেন, এটা ভেবে যে এই খাদ্য ডায়াবেটিস থেকে তাঁকে সুস্থ করবে। চিনি ছিল পুরা হারাম। খুব কষ্ট লাগত – যেখানে আব্বু মিষ্টি এত ভালবাসতেন। আব্বু প্রতি রমজানে হালিম খাওয়াতেন বিভিন্ন দোকানের। তিনপুলের মাথার গ্র্যান্ডের হালিম প্রিয় ছিল, বা এনায়েত বাজার মুখে বোম্বাইওয়ালার হালিম। দারুলের জিলাপী – হাইওয়ের রসমালাই – গাউসিয়ার কাবাব - আম্মুর হাতের কাটলেট – বড়মামার ভেজিটেবল আইটেম – এসব অনেক শখের ছিল তাঁর। ২০০৩ সালে তিনি এসব খেতে পারবেন না। আমি তখন সে রমজানে বুঝেছিলাম সংসারের পুরো হাল ধরার সময় এসেছে আমার। আমি তখন টিউশানি করতাম – জীবনের তাগিদে নয়, শখে। এত বেশী আমাকে মানুষজন পছন্দ করত আর ভাল ভাল কিছু কোচিং সেন্টারে পড়ানোর কারণে আমার মাসিক আয় গিয়ে দাঁড়ায় অর্ধলক্ষ। এত টাকা আমি ধরে রাখতে পারিনি – একটা টাকাও বাজে খরচ করিনি। আমরা গরীব ছিলাম না – ছিলাম পরিস্থিতির শিকার। তাই আব্বুর ব্যবসা থাকা স্বত্তেও ছিল অচল। তবুও আব্বু জীবিত থাকা অবস্থায় কখনও আমার একটা টাকাও তিনি নেন নি।
২০০৪ সালে আব্বু দ্বিতীয় ব্রেইন স্ট্রোকে ইন্তেকাল করেন, ডাক্তারী ভাষায় তাই বলে – আর আমরা জানি পানে ধুতরা মিশানো হয়েছিল। আব্বুর ইনসুলিন এখনও আছে ফ্রিজে। আব্বু শখ করে ফ্রিজটা কিনেছিল। এরপরের রমজান মাস আব্বুকে ছাড়া, এরপরের ঈদের জামাত পড়েছি একা একা। সেই শূণ্যতা আমাদের এখনও পূরণ হয়নি , হবেও না। কিছু শূণ্যতা পূরণ হয় না।

খ) আব্বুর ইন্তেকালের ক’বছর পরে মঞ্জুর বাবাও ব্রেইন স্ট্রোক করেছিলেন। আমি দেখতে গিয়েছিলাম। ডাঃ বন্ধুদের সাহচর্যের কারণে রিপোর্ট বেশ বুঝতে শিখেছিলাম। আমার মঞ্জুর বাবার দুর্বল শ্বাস উঠানামা দেখে মনে হল তিনি বোধহয় বাঁচবেন না। আমার খারাপ লাগছিল। মঞ্জুকে এককোণার ডেকে বললাম জীবনের হাল ধরার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিতে। কিন্তু মৃত্যু খুব একটা সময় দেয় নি। ঈদের দ্বিতীয় দিনে হারিয়ে ছিল মঞ্জু তার বাবাকে চট্রগ্রাম মেডিকেলে। শুনেছি কোন এক ইন্টার্নি ডিউটি ডাক্তার নাকি খুব কষ্ট দিয়েছিল, শ্বাস নেয়া অবস্থায় অক্সিজেন খুলে নিয়ে ছিল। পশুরাও ডাক্তার হয় কেন বুঝি না। যাই হোক, আমি জানি না মঞ্জু ও তার পরিবারের কেমন কষ্ট লাগে এই রমজান ঈদ যখন আসে; তবে আমি দোয়া করি আংকেল ব্যাংকার হিসেবে সৎ ছিলেন, বাবা হিসেবে আদর্শবান ছিলেন, মানুষ হিসেবে ভাল ছিলেন - আল্লাহ তাঁকে বেহেশ্তে নসীব করুণ।

গ) আরেকটা সাল হল ২০০৮। রমজান মাস শুরু হবার ক’দিন আগে আমি আমার খালা প্রিটিকে বলছিলামঃ “তোর আর আমার রক্তের গ্রুপ ‘এ’ পজেটিভ, তাহলে আমার রক্ত লাগলে তুই দিবি আর তোর রক্ত লাগলে আমি কিন্তু দিবো না। কারণ আমি রক্ত দেয়া ভয় পাই।” সে মাসে খতম তারাবী ধরে ছিলাম জীবনে প্রথমবার। সে বছর রমজানটা অনেক আশা ভরসার ছিল। কিন্তু প্রিটি আন্টির ধরা পড়ল ব্রেস্ট ক্যান্সার। তার ব্রেস্টে টিউমার হয়েছিল এবং মন্দের ভাল বিষয় এটা বড় হলেও নডিউল কিন্তু হয় নি। বাসায় সবাই অস্থির। তার একটা ব্রেস্ট কেটে ফেলে দিতে হবে। আমি ডাঃ জাহাঙ্গিরের সাথে কথা বললাম, “স্যার, ক্যান্সার কাটলে তা দ্রুত ছড়িয়ে যায়, তাহলে আপনার অপারেশানটা কি লাইফ রিস্ক হচ্ছে না।” ডাক্তার বললেন, “হচ্ছে – কিন্তু অপারেশান না করালে যে কোন মুহুর্তে টিউমার বাস্ট করার রিস্কটা তো আমি নিতে পারি না।” শেষমেষ অপারেশন হবে। রক্ত লাগবে ‘এ’ পজেটিভ। বড়মামা আর মেজখালা ৪০ উর্দ্ধ, তাই ওনাদের রক্ত নেয়া যাবে না। আমি রাজি হলাম। জীবনে প্রথম রক্ত দিলাম এক ব্যাগ। রোজা ছিলাম তবে রক্ত দেবার পর ভেঙ্গেছিলাম। দুই গ্লাস পানি আর কেক খেয়ে। কোকাকোলাও খেয়েছি বোধহয়। তখন আমার ওই কথাটাও মনে হল যে আমি একসময় বলেছিলাম খালাকে – আমি রক্ত দেবো না। আমি পশু হতে পারলাম না। খালার অপারেশন রিস্ক এমনই যে ওটাই তাকে শেষ দেখা হতে পারে। আমার পুরো পরিবারে শোকের ছায়া। খালা অবিবাহিত ছিল; এখন ক্যান্সার ধরা পড়াতে সে সুযোগও থাকলো না।
আমি অপারেশনের রাতে হাসপাতাল ছিলাম। ডাক্তারটা সাইকো কি না জানি না – অপারেশন করে একটা বাটিতে করে টিউমারটা এনে আমাদের দেখাচ্ছিলেন। এটা দেখতে সাধারণ মানুষের কেমন লাগে তা আসলে রক্তমাংশ নিয়ে যারা কাটাকাটি করে তাদের বোঝানো যাবে না। নিখুত অপয়ারেশনের কারণে আমার খালা বেঁচে যায়। আমার মনে হল আমরা মাগফেরাতের রোযায় যা চাইলাম – নাজাতের রোজায় আমার খালাকে নতুন জীবন নিয়ে বেঁচে উঠতে দেখলাম। আল্লাহর কাছে আমি ও আমার পরিবার তাই সারাজীবন কৃতজ্ঞ।

ঘ) ২০১৩ সালের রমজান মাসের এই তো শুরু হল। শুরুতে পুর্বকোণ পত্রিকার শিরোনাম হলেন নাজু চাচ্চু – “মেয়ের পছন্দের রসমালাই কিনে ফেরা হল না অধ্যাপক নাজিমের, ইফতারি হাতে ট্রাক চাপায় মৃত্যু। ” আমার বড়খালার দেবর ছিলেন নাজু চাচ্চু। ছোটবেলা থেকে এত দেখেছি যে তিনি আমাদের অনেক আপনজন হয়ে উঠেছিলেন। আজকের এই ডিজিটাল যামানায় এরকম আত্মীয়রা হলেন স্যটেলাইট আত্মীয়; কিন্তু আমাদের পরিবারের ক্ষেত্রে হল নিকট আত্মীয়। শুনেছি চাচ্চু রোজা অবস্থায় ছিলেন, শুনেছি একমাত্র মেয়ে পুস্পার জন্য রসমালাই আনতে গেলেন, পুস্পার বিয়ে দিয়েছেন তিনি – সামনের মাসেই চলে যাবে কানাডা; আদরের মেয়েকে নিয়ে ইফতারের অভিপ্রায় কতটুকু ছিল; আবেগের কতটুকু পবিত্রতা কেউ ভাবতে পারেন। কি ভালবাসা ছিল ওই দৌড়ে গিয়ে ইফতার আনায় – পিতার স্নেহ কি বুঝে ওই হারামীর বাচ্চা ট্রাক ড্রাইভার?
শুনেছি ট্রাক চাপা এমন হয়েছিল যে তাঁর শরীরের অর্ধেকটি নাকি ছিল না। এক রোজাদার পিতার অস্বাভাবিক করুণ মৃত্যু। স্নেহের এখানেই শেষ, এখন যা থাকে তাকে স্মরণ করা।

এবারের ঈদটা কেমন হবে পুস্পার? কেমন লাগছে তার এ কটা দিন রোজা রেখে? কেমন লাগছে মঞ্জুর ও তার পরিবারের? কেমন লাগে বাবা মা ছাড়া ইফতার করতে? সন্তান ছেড়ে ইফতার করতে? বন্ধু ছেড়ে ইফতার করতে? আজ যার সাথে ইফতার করছি - কাল তারা নেই? এমন কটা মুখ ভেসে ওঠে আপনার চোখের সামনে?

আমার একটা অনুরোধ রাখবেন? এ সময়ে যাদেরকেই পাবেন – উৎসবে বা শোকে তাদের ধরে রাখবেন। অংশগ্রহণ করবেন। আজকে-এখন-এই মুহুর্তে যাকে পেলেন তাকে আপনি হারিয়ে ফেলবেন, সেও আপনাকে হারিয়ে ফেলবে। তাই ধরে রাখুন মুহুর্তের দেখাদেখিতে। এটা ঠিক আপনার তাৎক্ষণিক মনিটরী কোন লাভ নেই। এটাও ঠিক আপনি হারিয়ে গেলে আপনার অস্তিত্বের মনিটরী কোন ভ্যালু নেই। একটা মানুষ সমাজে পশুর চাইতে অধম প্রমাণিত হবার আগ পর্যন্ত ঝগড়া বিবাদ মীমাংসা করুণ, সুযোগ দিন, আপনিও সুযোগ নিতে বিনয়ী হোউন। সামাজিকতা প্রতিষ্ঠিত হয় ভাল প্রতিবেশী হবার কারণে; আপনি একজন ভাল প্রতিবেশী হউন। আর নিজের আপন মানুষকে – যতক্ষণ কাছে পাবেন, কাছেই থাকবেন। মনে রাখবেন এরা সবাই হারিয়ে যাবে, এরাও আপনাকে হারাবে। ধন্যবাদ।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

**অপূরণীয় যোগাযোগ*

লিখেছেন কৃষ্ণচূড়া লাল রঙ, ২৮ শে মে, ২০২৪ ভোর ৫:১৯

তাদের সম্পর্কটা শুরু হয়েছিল ৬ বছর আগে, হঠাৎ করেই। প্রথমে ছিল শুধু বন্ধুত্ব, কিন্তু সময়ের সাথে সাথে তা গভীর হয়ে উঠেছিল। সে ডিভোর্সি ছিল, এবং তার জীবনের অনেক কষ্ট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

×