সপ্তাশ্চর্য নির্বাচন নিয়ে 'প্রতারণার' খবরে বাংলাদেশসহ বিশ্বব্যাপী প্রবাসী বাংলাদেশিদের মাঝে ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অথচ বিশ্বঐতিহ্য সুন্দরবনকে সপ্তাশ্চর্য হিসেবে সর্বাধিক ভোটে নির্বাচিত করতে দেশের জনগণ ও প্রবাসীরা এসএমএসের মাধ্যমে ভোট করে চলেছেন। শুধু দেশমাতৃকার টানে প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি সুন্দরবনকে ভালোবেসে অবলীলায় প্রবাস থেকে কষ্টার্জিত টাকায় এসএমএস করেছেন। এ জন্য প্রতি এসএমএসে অনেকেই ব্যয় করেছেন ডলার, পাউন্ড, ইউরো, দিরহাম, রুপি কেউবা রিয়াল। এখন তারা নিজেদের প্রতারিত ভাবতে শুরু করেছেন। অনেকে ক্ষুব্ধ হয়ে বলেছেন, তাহলে এত টাকা ব্যয় করে কী লাভ? এত অর্থ ব্যয় করে সুন্দরবন যদি চূড়ান্ত পর্বে উন্নীত না হতে পারে তখন কী হবে? এ ধরনের নানা প্রশ্ন এখন প্রবাসীদের মাঝে।
প্রবাসীদের সূত্রে জানা গেছে, এই অপতৎপরতায় জড়িত প্রতিষ্ঠানটি (নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশন) কৌশলে রাষ্ট্রীয় যন্ত্র, বাণিজ্যিক সংস্থা ও বিভিন্ন এনজিওকে যুক্ত করেছে। বরাদ্দ করা হয়েছে বিপুল অর্থ এবং বিভিন্ন বাণিজ্যিক সংস্থাও মাঠে নেমেছে এ কাজে। নতুন প্রজন্মের অসংখ্য ছেলেমেয়ে সুযোগ পেয়েই এসএমএস কিংবা ইন্টারনেটে ভোট দিয়েছে। এ ভোট-আন্দোলনের ঢেউ বিস্তৃত হয়েছে আটলান্টিকের ওপারেও। সভা-সিম্পোজিয়াম হয়েছে এবং হচ্ছে। সবকিছু চলছে অত্যন্ত উৎসাহ নিয়ে। এরই মধ্যে কেউ কেউ ইউনেস্কো ও সুইজারল্যান্ডে খোঁজ-খবর নিতে থাকেন। খোঁজ নিয়ে জানতে পারেন, নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের ভিত্তি হচ্ছে সুইজারল্যান্ডে। এর মালিক হচ্ছেন বারনার্ড ওয়েবার নামের এক ব্যক্তি। ২০০০ সালে এটি প্রতিষ্ঠিত হয়। অথচ সংগঠনটির আন্তর্জাতিক কোনো স্বীকৃতি নেই। জাতিসংঘের অঙ্গসংগঠন ইউনেস্কোর সঙ্গেও তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। সুন্দরবনকে সপ্তাশ্চর্য নির্বাচনে ভোট সম্পর্কে ইউনেস্কো কিছুই জানে না। অথচ এ ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার অধিকার কেবল ইউনেস্কোরই রয়েছে।
নিউইয়র্ক থেকে বার্তা সংস্থা এনা জানায়, নিউ সেভেন ওয়ান্ডার্সের উদ্যোগে ২০০৭ সালে আরেকটি জরিপ চালানো হয় এবং তারা একটি ফলাফলও ঘোষণা করে। কিন্তু সেটি ইউনেস্কো কিংবা অন্য কোনো আন্তর্জাতিক সংস্থার স্বীকৃতি পায়নি। ২০০৭ সালের ২০ জুন ইউনেস্কোর এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে সাফ জানিয়ে দেওয়া হয়, প্রাইভেট উদ্যোগের সঙ্গে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই। বারনার্ড ওয়েবারের পরিচালিত জরিপের মাধ্যমে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ তালিকার অন্তর্ভুক্ত হওয়ার কোনো সুযোগও নেই।
প্রবাসীরা অভিযোগ করেন, এত কিছুর পরও বাংলাদেশের কোনো কোনো কর্মকর্তা এবং কথিত ওই সমর্থক কমিটির পক্ষ থেকে আকারে-ইঙ্গিতে দাবি করা হচ্ছে, এ ভোট গ্রহণের নেপথ্যে জাতিসংঘ তথা ইউনেস্কোর সম্পৃক্ততা রয়েছে। নিউইয়র্কে প্রবাসী সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ার ইলিয়াস পাঠান এবং সিটি প্রশাসনে কর্মরত নিহার সরকার বলেন, মানুষের আবেগ-অনুভূতিকে পুঁজি করে কেউ যদি আর্থিক ফায়দা হাসিলের অবলম্বন হিসেবে এ বিষয়টিকে সামনে এনে থাকেন তাহলে সেটি হবে গুরুতর অপরাধ। ইন্টারনেটে ভোট প্রদানের সময় যাবতীয় ব্যক্তিগত তথ্য দিতে হচ্ছে-এগুলোকেও অনেক কোম্পানি বাজারজাত করে থাকে। এসএমএসে ভোটদানের চেয়েও অনেক বেশি ব্যয় হচ্ছে সরাসরি টেলিফোনে ভোট দেওয়ার সময়। অর্থাৎ কোটি কোটি টাকার সম্পৃক্ততা ঘটেছে ইতোমধ্যেই।
প্রবাসীদের উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা সম্পর্কে সুন্দরবন সমর্থক কমিটির রফিকুল ইসলাম খোকন বার্তা সংস্থাকে বলেন, যে কটি দেশের মধ্যে ভোটাভুটি হচ্ছে তার মধ্যে সুন্দরবন যদি বেশি ভোট পায় তাহলে দেশে পর্যটক বাড়বে, উপকৃত হবে বাংলাদেশ। এখন মোট ২৮টি দেশ রয়েছে এ প্রতিযোগিতায়। ভারত, ভিয়েতনাম, কোরিয়াসহ কয়েকটি দেশেও চলছে এ ভোট গ্রহণের প্রক্রিয়া। সরকারও প্রচার চালাচ্ছে। নভেম্বরে জানা যাবে ফলাফল। এ ফলাফলের স্বীকৃতি কে দেবে_ এমন প্রশ্নে তিনি সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের কথা বলেন। 'সেটি হচ্ছে ব্যক্তিমালিকানাধীন একটি প্রতিষ্ঠান, তার কী ক্ষমতা অথবা অধিকার রয়েছে'_ রফিকুল ইসলাম এ প্রশ্নের সঠিক জবাব দিতে পারেননি।
প্রবাসীদের মধ্যে এ ভোট নিয়ে সৃষ্ট নানা প্রশ্নের পরিপ্রেক্ষিতে প্যারিসে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত ও ইউনেস্কোয় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি মো. এনামুল কবীর বার্তা সংস্থা এনাকে টেলিফোনে বলেন, 'এই ভোটের কোনো প্রভাব ইউনেস্কোয় পড়বে কিংবা ইউনেস্কো এ ধরনের কোনো উদ্যোগ নিয়েছে বলে এখন পর্যন্ত আমার জানা নেই। তবে ফেব্রুয়ারিতে ঢাকায় বাংলাদেশের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে পাঠানো একটি সার্কুলার অনুযায়ী আরও অনেক দেশে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূতদের মতো আমিও যেখানে সুযোগ পাচ্ছি সেখানেই কম্যুনিটির লোকজনকে আহ্বান জানাচ্ছি ভোট দেওয়ার জন্য। এটি আমার ওপর অর্পিত সরকারি দায়িত্ব।
বাংলাদেশ প্রতিদিনে প্রকাশিত সংবাদ প্রসঙ্গে বন ও পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বশীল সূত্র জানিয়েছে, বিষয়টি সরকারের দৃষ্টিতে এসেছে। এই প্রক্রিয়াকে আরও ত্বরান্বিত করতে মন্ত্রণালয় মাত্র ক'মাস আগে সহযোগিতার জন্য এগিয়ে আসে। তবে বিষয়টি সম্পর্কে খোঁজ-খবর নেওয়া হচ্ছে। বিস্তারিত তথ্য-উপাত্ত নিয়েই সবাইকে অবহিত করবে মন্ত্রণালয়।
মালদ্বীপকে অবজ্ঞা ফাউন্ডেশনের!_ মোটা অঙ্কের অর্থ দাবি, নির্বাচনপ্রক্রিয়ার অস্বচ্ছতা, জাল ভোটের নির্বাচন করায় মালদ্বীপ এর আগেই ওই প্রতিযোগিতা থেকে সরে দাঁড়িয়েছে। সিদ্ধান্তটি মালদ্বীপের পক্ষ থেকে চিঠি মারফত ফাউন্ডেশনের মালিক বারনার্ড ওয়েবারকে জানিয়েও দেওয়া হয়। এর পরও মালদ্বীপ সরকারকে অবজ্ঞা করে ফাউন্ডেশন মালদ্বীপকে তাদের তথাকথিত নির্বাচনের শেষ ধাপ ২৮ চূড়ান্ত প্রতিযোগীর তালিকায় রেখে দিয়েছে। সংগঠনটি বলেছে, মালদ্বীপ এখনো প্রতিযোগিতায় রয়েছে। কোনো দেশ এই প্রতিযোগিতায় থাকবে কি থাকবে না তার একক সিদ্ধান্ত নেওয়ার কর্তৃত্ব সেভেন ওয়ান্ডার্স ফাউন্ডেশনের।