দৃশ্য: ১
অনেকক্ষন ডুব দিয়ে আছি পুকুরে। পানির উপর বৃষ্টি পরার রিমঝিম শব্দ। এর চেয়ে মধুর কোন শব্দ কি পৃথিবীতে আর আছে? আমার ঠিক জানা নেই। আমি এখনও মাঝে মাঝে শাওয়ার ছেড়ে চোখ বন্ধ করে দাঁড়িয়ে থাকি। মনে হয় ছোট্টবেলার মত পুকুরে ডুব দিয়ে আছি। বর্ষাকালটা ছোটবেলা থেকেই আমার খুব পছন্দের। বাসার পাশে পুকুরে বৃষ্টি ফোটা পরার দৃশ্য দেখে কত সময় যে কাটিয়েছি । পুকুর পাড়ে ছিল প্রকান্ড এক অশ্বথ। বৃষ্টিতে ভিজে অশ্বথের পাতা গুলো ফিকে সবুজ হয়ে যেত। আর সেই ফিকে সবুজ রঙে গোধূলির লাল আলো পড়লে মনে হত কেউ যেন আগুন ধরিয়ে দিয়েছে। তখন আমার বয়স বড়জোর আট কি নয়। সেই গাছটা এখন আর নেই। পুকুরের শান বাধানো ঘাটও নেই। কিন্তু এখনও চোখ বন্ধ করলে আমি দেখতে পাই পুকুর পারে কলমি গাছে ফুল ফুঁটে আছে। অশ্বথের এক মস্ত বড় শিঁকড়ের একপ্রান্ত ডুবে আছে পুকুরের পানিতে আর সেই শিঁকড়ে পা ঝুলিয়ে বসে আছে এক কিশোরি, কাঁধের উপর লাল ফিতে বাঁধা দুই বেণী, পরনে নীল ফ্রক।
দৃশ্য: ২
তখন কলেজে পড়ি। আমরা সবাই প্রাইভেট পড়তে যেতাম গৌড়দার কাছে। উনি তখন রাজশাহী ইউনিভার্সিটির আ্যাপলাইড ম্যাথ এর ফার্স্ট ক্লাস ফার্স্ট । ছুটিতে বাড়ি এলেই আমরা সব বন্ধুরা মিলে সারাদিন একটার পর একটা সাবজেক্ট ব্যাচ করে পড়তাম উনার কাছে। উনার বাড়ি ছিল নদীর পাড়ে। একদিন বিকেলে পড়া শেষ করে ফিরছি এমন সময় দেখি দূর থেকে বৃষ্টি এগিয়ে আসছে আমাদের দিকে। সবাই কাছাকাছি একটা দোকানের ছাউনির নীচে চলে গেল। আমি বৃষ্টিতে ভেজার এমন সুযোগ হাতছাড়া করতে চাইলাম না তাই বই খাতা সব বন্ধুদের কাছে জমা রেখে হাটা শুরু করলাম । ততক্ষনে কালোমেঘ আর বৃষ্টি আমাকে ঘিরে ফেলেছে। পাশেই নদীর পানিতে বৃস্টি পরার অপরূপ সৌন্দর্য্য। মনের মধ্যে গুন গুনিয়ে উঠছে
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে .....
মাথার উপর ঘন কালো মেঘপুন্জ গর্জে উঠছে একটু থেমে থেমে , পাশে নদীর জলে বৃষ্টি ফোঁটার আঁকা চিত্রকর্ম আর এর সাথে তৃতীয় মাত্রা যোগ করল ইস্পাতের ব্রীজের উপর বৃষ্টি পরার ঝমঝম শব্দ। সব মিলিয়ে আমার স্মৃতিপটে চিরতরে আঁকা হয়ে গেল সেদিনের জলছবি।
দৃশ্য: ৩
জীবনের দীর্ঘ কয়েকটা বছর কাটিয়েছি রোকেয়া হলে। সবুজ গাছপালায় ঘেরা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস বর্ষায় এক অপূর্ব রূপ ধারন করে। সারি সারি জারুল আর কদম গাছে রঙিন হয়ে ওঠে প্রকৃতি। ছুটির দিনে বৃষ্টি এলেই নেমে পরতাম হলের মাঠে। একবার প্রচন্ড শিলাবৃষ্টিতে ভিজতে নেমেছি। মাথার উপর বরফ পরছে। হিম ঠান্ডা বৃষ্টির ফোঁটাগুলো গায়ে কাপুনি ধরিয়ে দিচ্ছিল । হঠাৎ দেখি সেলিনা চৌধুরি ম্যাডাম, আমাদের হাউস টিউটর । তখন চারদিকে সবার খুব জ্বর হচ্ছে। ম্যাডাম কে আমরা এমনিতেই খুব ভয় পেতাম। উনি আমাদের পাঁচ মিনিটের মধ্যে রুমে চলে যেতে বলে আবার অফিসের দিকে রওনা হলেন।
এর পর ঠিক কতক্ষন ভিজেছি মনে নেই তবে ম্যাডামের ভয়ে একটু তাড়াতাড়িই রুমে চলে গিয়েছিলাম। এখন বকা দেয়ার কেউ নেই তবু কেন জানি দৌড়ে মাঠে বা বাসার ছাদে চলে যাওয়া আর হয়না। আর হয়ত তাই বৃষ্টি হলেই খুব মিস করি আমার রোকেয়া হল জীবন।
দৃশ্য:৪
আষাঢ়ের প্রথম দিন। আকাশ ঢেকে গিয়েছে ঘন কালো মেঘে। পাহাড়ি মেঘগুলো মানুষের সান্নিধ্য খুব ভালোবাসে। তাই মাঝে মাঝেই কাছে এসে ভিজিয়ে দিয়ে যায়।
অনেকদিন থেকে আসবো আসবো করে অবশেষে বান্দরবন বেড়াতে আসা। উঠেছি মিলনছড়িতে গাইড ট্যুরসের রিসোর্টে। গত দুদিন আকাশ ভালোই ছিল। আজ সকাল থেকেই হালকা মেঘের দেখা মিলল । সকালে যখন নীলগিরির উদ্দেশ্যে রওয়া দিলাম সবাই, তখন প্রায় ৭টা বাজে। তখনও আকাশে ছিল ঝলমলে রোদ্দুর। নীলগিরি থেকে ফিরবার পথে হঠাৎ রাস্তায় মেঘের মধ্যে দিয়ে পার হয়ে এলাম। চারপাশে মেঘ ভেসে বেরাচ্ছে আর এর মাঝখান দিয়েই ছুটে চলছে আমাদের চাঁদের গাড়ি। একবার পার হলাম বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে। বৃষ্টির ফোঁটাগুলো যেন তীরের ফলার মতো গায়ে বিঁধছিল রিসোর্টে ফিরতে ফিরতে আকাশ কালো হয়ে গিয়েছে। দূরের পাহাড়গুলো সব কালো মেঘে ঢাকা । বড় বড় ফোঁটায় বৃষ্টি পড়া শুরু হয়েছে। কোনো রকমে দৌড়ে ডাইনিং হলে পৌছালাম । দুপুরে যে খাওয়া হয়নি ভুলেই গিয়েছিলাম। খাবারের গন্ধে এখন টের পাচ্ছি ক্ষুধার তীব্রতা।
আজ রাতেই রওনা দিতে হবে। একেবারেই ইচ্ছা করছেনা যদিও, তার পরও যেতে হবে। একটা জিপ গাড়িতে রওনা দিয়েছি আমরা। চারপাশে অন্ধকার আর মুষলধারে বৃষ্টির শব্দ। আর কখনও কোনো ট্যুরিস্ট স্পট থেকে ফিরতে এত খারাপ লাগেনি। পাহাড়ী বৃষ্টি যেন ভালোবাসার সুতোয় বেঁধে ফেলেছিল আমাদের।
দৃশ্য:৫
ঝুম বৃষ্টিতে রেল সিগনালে দাঁড়িয়ে আছে গাড়ি । জানালার কাচে বৃষ্টির ফোঁটা পরে অনুপম চিত্রকলা তৈরি করেছে। জানালার কাঁচটা একটু নামিয়ে দিয়েছি বৃষ্টির ছোঁয়া পাবার আশায়। রাস্তার পাশের গাছগুলো ঘন সবুজ হয়ে গেছে বৃষ্টি স্নান করে । সারি সারি সবুজ গাছের মাঝ দিয়ে উঁকি দিচ্ছে ট্রেনের ইন্জিন। আমি ফেসবুক আ্যকাউন্ট খোলার পর কখনোই স্ট্যাটাস আপডেট দেইনি। আজই প্রথম ইচ্ছে হল। মোবাইল থেকেই জীবনের প্রথম ফেসবুক স্ট্যাটাস আপডেট দিলাম
" Jhum bristite rail signale boshe aaci"
দৃশ্য:৬
অফিস থেকে সহকর্মীরা কয়েকজন মিলে বেড়াতে গিয়েছিলাম কক্সবাজার। তখন বর্ষাকাল শেষ হয়ে গিয়েছে। তার পরও প্রকৃতির সাথে মেঘ বৃষ্টির কানাকানি। সকাল সকাল চান্দের গাড়ী নিয়ে রওনা হয়েছি , গন্তব্য টেকনাফ । মনের ভেতর অনেক পুরোনো একটা ইচ্ছা ............
"চলোনা ঘুরে আসি অজানাতে
যেখানে নদী এসে থেমে গেছে। ।"
আমি কখনও মোহনা দেখিনি। জীবনে এই প্রথম মোহনার উদ্যেশ্যে যাত্রা। গাড়িতে যখন উঠেছি তখনও আকাশে ঝলমলে রোদ। কিছুদুর যাবার পরপরই শুরু হল মুষলধারে বৃষ্টি। আমি বসেছিলাম ড্রাইভারের ঠিক পিছনের সিটে আর তাই সবার আগে আমার নজরেই পড়ল বিষয়টা আর তা হল গাড়িতে কোনো গ্লাস ওয়াইপার নাই। প্রচন্ড বৃষ্টির কারনে ড্রাইভার সামনে কিছুই দেখতে পাচ্ছেনা। একটু পরপর জানালা দিয়ে বাইরে তাকিয়ে দেখছে অপজিট সাইট থেকে কোনো গাড়ি আসছে কিনা। গাড়িতে যারা পিছনের দিকে মুখ করে বসে আছে তারা কেউই টের পাচ্ছিলনা কি ভয়াবহ একটা জার্নি করছি আমরা। একটার পর একাট বাস আসছে টেকনাফ থেকে। ভয়ে আমার সারা গা হিম হয়ে গিয়েছিল। আমরা দু'তিন জন যারা ঘটনাটা টের পেয়েছিলাম তারা চিন্তায় পুরো শক্ত হয়ে বসে পার করেছিলাম প্রায় এক ঘন্টা সময় । তার পর আবার রোদেলা দুপুর , মনে হল এ যাত্রায় বেঁচে গেলাম এমন একটা অনুভূতি।
দৃশ্য:৭
এক শ্রাবন সন্ধ্যায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছি। হঠাৎ অনেক পুরোনো একটা কবিতা মনে পড়ে গেল।
"ইচ্ছে ছিল
তোমার বৃষ্টি ভেজা অধরে
চুমু আঁকব সারাবেলা।"
কবিতাটি আমার লিখা নয়। বৈবাহিক সুত্রে কবি ও আমি একই ছাদের নীচে বসবাস করি।
সর্বশেষ এডিট : ১৮ ই জুলাই, ২০১১ দুপুর ২:১৮