somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

তসলিমা নাসরিন,,,,নির্বাচিত কলাম আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি 'মেয়েমানুষ' তসলিমা নাসরিন

১৬ ই জুলাই, ২০১১ রাত ১০:২৯
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বয়স তখন আমার আঠারো উনিশ। ময়মনসিংহ শহরের একটি সিনেমা হলে দুপুরের শো ভেঙেছে। সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে রিক্সা। আমি একটি রিক্সায় উঠে বসলাম। ভিড়ের কারণে রিক্সা খানিক থেমে আছে, খানিক চলছে। ওই থেমে থাকবার সময় আমার ডান বাহুতে হঠাৎ তীব্র যন্ত্রণা অনুভব করলাম। দেখি, একটি আধ-খাওয়া জ্বলন্ত সিগারেট আমার বাহুতে চেপে ধরেছে বারো-তেরো বছর বয়সের একটি ছেলে। পরনে শার্ট, লুঙ্গি। ছেলেটিকে আমি চিনি না, কোনওদিন দেখিনি। আমি যন্ত্রণায় কুঁকড়ে গেলাম। ছেলেটি দিব্যি হাসতে হাসতে চলে গেল। ভাবছিলাম চিৎকার করব, কাউকে ডাকব, অথবা দৌড়ে ছেলেটিকে ধরব, লোক ডেকে তার বিচার চাইব। মেয়েদের একটি ষষ্ঠ ইন্দ্রিয় আছে, সম্ভবত সে কারণেই ছেলেটিকে শাস্তি দেবার জন্য সেদিন কোনও চেষ্টা করিনি। আমি ওই বয়সেই চোখের সামনে স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছিলাম আমি ছেলেটিকে ধরব অথবা ধরবার জন্য লোকজনের সাহায্য চাইব, সবাই আমাকে ভিড় করে দেখবে, আমার শরীরের বাঁক দেখবে, উজ্জ্বলতা দেখবে, যন্ত্রণা দেখবে, আমার আর্তস্বর, আমার ক্রোধ, আমার কান্না দেখবে। কেউ আহা উহু করবে, কেউ গায়ে পড়ে জানতে চাইবে ব্যাপারটি কী, কেউ ছেলেটিকে ধরে এনে কষে দুই থাপ্পড় মারবার কথা বলবে, কেউ আমার বাড়ি কোথায়, বাবা কে ইত্যাদির খোঁজখবর নেবে। আসলে সবাই তারা আমাকে উপভোগ করবে। আমার অসহায়ত্ব উপভোগ করবে। পোড়া বাহু দেখবার নাম করে আসলে আমার সুডোল খোলা বাহুটিই দেখবে। আমি চলে গেলে পেছনের শুভার্থীরা সমস্বরে সিটি দেবে। এসব ভেবেই আমি আমার সমস্ত যন্ত্রণা নিজের ভেতরে চেপে রেখেছিলাম।





আমার ডান বাহুতে এখনও পোড়া দাগ, আমি সেই নির্যাতনের চিহ্ন বহন করে চলেছি। আমি ওই অশিক্ষিত ছেলেটিকে দোষ দেব কী, শিক্ষিতরাই যেখানে নির্দোষ নয়। আমার চোখের সামনে বান্ধবীর উরুতে চিমটি কেটে দৌড় দিয়েছে একটি ছেলে, আমার বোনের ওড়না টেনে পালিয়েছে একটি অচেনা যুবক, ভিড়ের মধ্যে স্তন ও নিতম্ব স্পর্শ করবার জন্য ওত পেতে থাকে একশ একটা অন্ধকার হাত। সেই হাতগুলো সব অশিক্ষিতের নয়, আমি জানি, ওখানের অনেক হাতই শিক্ষিত হাত।





এসবের কোনও প্রতিবাদ আমি করি না। বরং আমি নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি, এইজন্য যে, এখনও এসিড ছুঁড়ে কেউ আমার মুখ পোড়ায়নি, আমার দু'চোখ অন্ধ করেনি। এখনও আমার সৌভাগ্য যে একপাল পুরুষ আমাকে ধর্ষণ করেনি। আমার সৌভাগ্য যে, আমি এখনও বেঁচে আছি। আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি 'মেয়েমানুষ'। আমার শিক্ষা, আমার মেধা আমাকে 'মানুষ' করতে পারেনি, 'মেয়েমানুষ' করেই রেখেছে। এই দেশে মেয়েরা কোনও যোগ্যতা বলেই 'মানুষে' উর্ত্তীর্ণ হতে পারে না। অনেকে, এই সমাজের প্রথম শ্রেণীর নাগরিক, বোধবুদ্ধি সম্পন্ন রুচিবান মানুষ, সকলেই, আমি জানি, এক বাক্যে মেনে নেবেন সিনেমা হলের কাছে সিগারেটের আগুনে বাহু পোড়ার ঘটনাটি আমার ব্যক্তিগত। 'ব্যক্তিগত' বলে তাঁরা আসলে দায়িত্ব এড়াতে চান। কিন্তু যে মেয়েরা ঘর থেকে বাইরে পা ফেলে, সেই মেয়েরা- আমি একা নই- সবাই প্রস্তুত থাকে রাস্তায় যে কোনও অশ্লীল মন্তব্য নীরবে সহ্য করার জন্য। প্রতিটি মেয়ে জানে, তার জামায় একমুখ পানের পিক ফেলে দেঁতো হাসি উপহার দিয়ে নির্বিকার চলে যাবে একটি অপরিচিত যুবক। সে প্রস্তুত থাকে এসিড, ছিনতাই, অপহরণ, ধর্ষণ, হত্যা ইত্যাদি, যে কোন দূর্ঘটনার জন্য। রাস্তায় বেরোলে গায়ে দু'তিনটে ঢিল এসে পড়া বিরল কোনও ঘটনা নয়। ছুঁড়ে ফেলা সিগারেট থেকে রিক্সায় বসা কিশোরীর কাপড়ে আগুন ধরে যায়, এবং অর্ধ উলঙ্গ অবস্থায় বাড়ি ফেরা- মাত্র দু'মাস আগে এই শহরের অনেকেই বেশ উপভোগ করেছে। মানুষ একদা গুহায় বাস করত, কন্যা সন্তান জন্মালে জ্যান্ত কবর দিত। সেই থেকে সময় অনেক এগিয়েছে কিন্তু মানসিকতা খুব একটা এগোয়নি।



ময়মনসিংহ শহরের বিভিন্ন স্থানে, বিশেষ করে মেয়েদের স্কুল, কলেজ, সিনেমা হলের পাশে কাঠের থামের উপর এক ধরনের সাইনবোর্ড ঝুলত, ওতে লেখা ছিল 'বখাটেদের উৎপাতে টহল পুলিশের সাহায্য নিন'। এই ব্যবস্থাটি দীর্ঘদিন স্থায়ী হয়নি। সম্ভবত বখাটেরা ওর গুঁড়িসুদ্ধ উঠিয়ে নিয়ে গেছে। যতদিন সাইনবোর্ড ছিল, মেয়েদের স্কুলে যাওয়া-আসার সময় বখাটে ছেলেরা ওই থামে হেলান দিয়েই শিস দিত। আর সবচেয়ে মজার ব্যাপার হচ্ছে, টহল পুলিশের উৎপাতে একবার স্কুলের মেয়েরা বখাটেদের সাহায্য নিতে বাধ্য হয়েছিল।



তসলিমা নাসরিন

নির্বাচিত কলাম
আমার যে অপরাধের জন্য আমি এতসব অত্যাচারের আশঙ্কা করছি, তা হচ্ছে, আমি 'মেয়েমানুষ'
তসলিমা নাসরিন
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯




মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা... ...বাকিটুকু পড়ুন

রাজীব নূর কোথায়?

লিখেছেন অধীতি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৩:২৪

আমি ব্লগে আসার পর প্রথম যাদের মন্তব্য পাই এবং যাদেরকে ব্লগে নিয়মিত দেখি তাদের মধ্যে রাজীব নূর অন্যতম। ব্যস্ততার মধ্যে ব্লগে কম আসা হয় তাই খোঁজ-খবর জানিনা। হঠাৎ দু'একদিন ধরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

=তুমি সুলতান সুলেমান-আমি হুররাম=

লিখেছেন কাজী ফাতেমা ছবি, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৮:৩৬



©কাজী ফাতেমা ছবি

মন প্রাসাদের রাজা তুমি, রাণী তোমার আমি
সোনার প্রাসাদ নাই বা গড়লে, প্রেমের প্রাসাদ দামী।

হও সুলেমান তুমি আমার , হুররাম আমি হবো
মন হেরেমে সংগোপনে, তুমি আমি রবো।

ছোট্ট প্রাসাদ দেবে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×