somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রিভার্স ট্রান্সকিপ্টেজ

১৫ ই জুলাই, ২০১১ বিকাল ৩:২২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


ডানা ঝাপ্টিয়ে একটা পাখি এইমাত্র উড়ে গেল মাথার ওপর দিয়ে। ওযু শেষে ঋজু হয়ে দাঁড়ানো মুন্সী আব্দুস শুক্কুর, ওরফে শুক্কুর আলী, গভীর মমতাভরা দৃষ্টি ছড়িয়ে দেয় চারপাশে। সুবহে সাদিকের নরম আলোয় পৃথিবীটা বড় সুন্দর, বড় মায়াময় মনে হয়। শীত আসছে, তার জানান দিচ্ছে শেষ অগ্রহায়নের হাল্কা ঠান্ডা বাতাসের মৃদুমন্দ ঝাপ্টা। চারিদিকের সুনসান নীরবতার মাঝে মন পাগল করা সুরে দূর দিগন্ত থেকে ভেসে আসছে আযানের সুমধুর ধ্বনি। বুক ভরে শ্বাস নেয় শুক্কুর আলী। ফিকে নীল আকাশের দিকে তাকায়। ওখানে, ওই আকাশের অন্য পাড়ে কোথাও বসে মহান আল্লাহ পাক নিশ্চয়ই মুগ্ধ চোখে চেয়ে আছেন আছেন তাঁর প্রিয় বান্দাদের পানে। তাঁর বুক ভরা ভালবাসা আপ্লুত করে যাচ্ছে তাঁর প্রিয় মুমিন বান্দাদের। রাতভর অস্থিরতার পর, এখন মনটা ক্রমশ অদ্ভুত এক ভাললাগায় ভরে উঠছে। মানুষ কি বোকা! আল্লাহ পাকের এমন অবারিত রহমত ফেলে, কিসের পেছনে তাদের এত ছোটাছুটি?

কাল সারারাত কেটেছে অস্থিরতায়, উন্মাদনায়। হাজী সাহেব, অর্থাৎ হাজী সালাউদ্দিন শিকদার সাহেবের বাড়ীর মাঠে কাল রাতে মিলাদ মাহফিল ছিল। এই গ্রামের যে কোন অনুষ্ঠানের আয়োজনে টগবগে বাইশের শুক্কুর আলী এক অপরিহার্য নাম। তার কর্মনিষ্ঠা, শৃঙ্খলা, আদব কায়দা, শিষ্টাচার – সব মিলিয়ে, সবার কাছেই, বিশেষত এই উলাইল পাড়ার মুরুব্বীদের কাছে তাকে যথেষ্ট কদরদার করে তুলেছে। তার বাবা ছিলেন উলাইল পাড়া জামে মসজিদের মুয়াজ্জিন। কি এক অজানা রোগে তাঁর অকাল মৃত্যুর পর, মসজিদের মোতওয়াল্লী নাসিরুদ্দিন সাহেব তার পুরো পরিবারের ভরণ পোষণের দায়িত্ব নেন। পরিবার বলতে শুক্কুর আলীর মা এবং ছোট ভাই মুন্সী আব্দুস সালাম। নিজে মাদ্রাসায় পড়লেও, ছোটটা, নাসিরুদ্দিন সাহেবের প্রত্যক্ষ অনুরোধ এবং পরোক্ষ চাপে, বাংলা স্কুলে পড়েছে। মেট্রিক পাশ করে, এখন সে কলেজে ভর্তির, যুগপৎ চেষ্টা এবং সিদ্ধান্তহীনতায় আছে। সবার ইচ্ছা এবং অনুরোধ ছিল, শুক্কুর আলী যেন পৈত্রিক পেশার ধারাবাহিকতা রক্ষা করে। কিন্তু শুক্কুর আলীর একান্ত ইচ্ছে, পড়াশুনা আরও কিছুদূর এগিয়ে নিয়ে, বড় কোন, যেমন, গ্রামের সদর জামে মসজিদের ইমামতি লাভ করা।

অস্থিরতার কারণ, মিলাদ মাহফিলের পর, লোকজন প্রায় সবাই বিদায় নিলে, হাজী সাহেবের বাড়ীর ভেতর একটা বৈঠক হয়। ওয়াজ করতে আসা মাওলানা সাহেব সহ গ্রামের বেশ কিছু গণ্যমান্য মুরুব্বীও এসেছিলেন, শুধু নাসিরুদ্দিন সাহেব ছাড়া। গ্রামের এই দুই শীর্ষবিন্দুর মধ্যে একটা সূক্ষ্ম রেষারেষি বেশ টের পায় শুক্কুর আলী। আমন্ত্রিতদের মধ্যে সে-ই কনিষ্ঠতম। মুরুব্বীদের এরকম বৈঠকে আমন্ত্রণ পাওয়ায়, বেশ খানিকটা পুলক মেশানো গর্বও ছিল তার মধ্যে। আলোচনা চলেছিল বেশ অনেকক্ষণ। এবং সেখানে এমন সব বিষয় উঠে আসে, এমন কিছু সে স্পষ্ট দেখতে পায়, অবাকই হয়, এসব এতদিন কেন সে দেখেও দেখতে পায়নি!

রাতভর ভেবেছে এসব নিয়ে, ভাবতে ভাবতে মাথা গরম হয়ে গেছে, অস্থিরভাবে ঘরময় নিঃশব্দে পায়চারী করেছে, রক্তকণায় জ্বলে ওঠা আগুনে পুড়েছে সারা রাত। আসলেই তো! হাজী সাহেব এমন করে চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে না দিলে, যেন একটা শিক্ষিত মূর্খই থেকে যেত শুক্কুর আলী।

শুধু এদেশেই নয়, শুধু এই যুগেই নয়, যুগ যুগ ধরে, সারা দুনিয়াটাতে কিভাবে তিল তিল করে ইসলামকে ধ্বংস করা হচ্ছে, কিভাবে ইসলামের টুটি চেপে ধরা হচ্ছে – দিনরাত দুনিয়াবী চিন্তায় মশগুল মানুষগুলো, নাম কা ওয়াস্তা মুসলমানগুলো সেটা টেরই পাচ্ছে না! তাদের ইসলামী চেতনা, তাদের ঈমানী চিন্তা – সবকিছুকে নানারকম প্রলোভনে, ভয়-ভীতি-শাসনে, নানারকম ভুল নির্দেশনা আর উদ্ভট মগজ ধোলাই দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হচ্ছে; আর ঘুমিয়ে থাকতে থাকতে একসময় সেই চিন্তাগুলো ক্ষয় হতে হতে শূন্যে মিলিয়ে যাচ্ছে।

যে ভারতবর্ষ পুরোটাই ছিল মুসলমানদের এক্তিয়ারে, সেই ভারতবর্ষকেই দুই টুকরো করে তার সিংহভাগ তুলে দেয়া হল হিন্দুদের হাতে। আরব দেশের ঠিক কলিজার ওপর তৈরী করা হল ইহুদী রাষ্ট্র ইসরায়েল। সারা দুনিয়াতে বিধর্মীরা, যে যেদিক থেকে পেরেছে, ইসলামের ওপর চড়াও হয়েছে। সারা দুনিয়াজুড়ে চলছে “ইসলাম খেদাও”! এত কিছুর পরও মালাউন মুশরিকরা শান্তি পায়নি, আজ তারা এদেশের মাটি থেকে ইসলামকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়ার জন্য উঠে পড়ে লেগেছে। পৃথিবীর আরেকটা ইসলামী রাষ্ট্রের ওপর আজ ফের ঘোর বিপদ ঘনিয়ে এসেছে। আমাদের প্রিয়, পাক পবিত্র পাকিস্তানকে দুই টুকরো করে, পূর্ব পাকিস্তানকে হিন্দুস্তান বানাবার পাঁয়তারা চলছে। এ কিছুতেই হতে দেয়া যায় না! কিছুতেই না!

কতগুলো নাম কা ওয়াস্তা মুসলমান, মালাউনদের সাথে মিশে সারা দেশে গন্ডগোল পাকাচ্ছে। তারা পাকিস্তান বরদাশত করতে পারেনা। “পাকিস্তান জিন্দাবাদ” পাক স্লোগান ছেড়ে ঘটি-মালাউনদের মত, “জয় মা কালী”, “জয় হিন্দ” এর মত “জয় বাংলা” বলে চিল্লাচিল্লি করছে। নাউজুবিল্লাহ! আস্তাগফিরুল্লাহ!

এর আগে একবার ভাষা নিয়ে গন্ডগোল হয়েছিল। তখন অনেক ছোট ছিল শুক্কুর আলী, অনেক কিছুই বুঝত না। এখন বুঝতে পারছে, ওটাও ছিল ষড়যন্ত্রের অংশ। উর্দু ভাষা কায়েম হলে সবাইকে ইসলামী সংষ্কৃতি মেনে চলতে হত, মালাউনদের মত ঢলাঢলি করা যেত না, তাই কতগুলো কাফের জবরদস্তি করে বাংলা ভাষা – ঘটিদের ভাষা কায়েম করে। এভাবে প্রথমে ইসলামের পাক জোবান বন্ধ করে দেয়া হয়। আর তারপর থেকে নতুন করে ষড়যন্ত্র পাকাতে থাকে। সেই ষড়যন্ত্রের জের ধরে আজ তারা পাকিস্তানকে হিন্দুস্তান বানাবার চেষ্টায় মত্ত। একে রুখতে হবে! যেভাবেই হোক, রুখতে হবে! ‘আমার পাক জমিনে মালাউনদের পতাকা উড়তে দেয়া যাবে না, কিছুতেই না!’

শুক্কুর আলীর দায়িত্ব হচ্ছে, গ্রামের সব ছেলেদের এইসব বিষয় বোঝানো। এইসব গন্ডগোল যে আসলে পাক জমিনে শান্তি নষ্ট করার জন্য মালাউনদের ষড়যন্ত্র, সেটা ওদের বোঝাতে হবে। বোঝাতে হবে, ওই শালার ব্যাটা মুজিব আসলে আস্ত একটা ভন্ড। সে মালাউন ভারতীয়দের কাছ থেকে পয়সা খেয়ে এখানে যত ঘোঁট পাকাচ্ছে। মুজিব নাকি কোনদিন মসজিদের বারান্দা দিয়েও হাঁটে নাই, নামায-কালাম নাই, রোযা নাই, আস্ত মুশরেক মুনাফেক একটা!


“পাকিস্তান ... জিন্দাবাদ” প্রচন্ড স্লোগানে আকাশ বাতাস কাঁপিয়ে তুলছে শুক্কুর আলী এবং তার অনুসারীরা। ইসলাম বিরোধীরা যে যেখানে আছে, শুনুক, জানুক, এই দেশ থেকে ইসলামের বাতি এখনও নিভে যায় নাই। ইসলামের ঝান্ডা উঁচিয়ে ধরার জন্য শুক্কুর আলীর মত জিহাদী যতদিন এই পাক জমিনে আছে, মালাউনদের রক্ষা নাই। কতবড় সাহস! ইংরেজদের জুতা চেটে চেটে ইন্ডিয়া পেয়েছে, এখন আবার পাকিস্তানের পাক জমিনের দিকে চোখ দেয়! সব শালা মালাউনদের চোখ খুবলে নিতে হবে। এই দেশের কয়েকটা ছোকড়ার মগজ ধোলাই দিয়ে যুদ্ধ বাধাই দিলেই হল? ইন্ডিয়া কি ভাবছে, এই দেশে একটাও মুমিন বান্দা নাই? ঐসব ঘটির বংশ ঝাড়ে-বংশে বিনাশ করতে হবে। এই দেশ ইসলামের পাক জমিন। এই দেশ মুসলমানের দেশ, এই দেশে থাকতে হলে মুসলমান হয়ে থাকতে হবে, নইলে ইন্ডিয়া ভাগো!

হাতের তলোয়ার উঁচিয়ে আবার গলা ফাটিয়ে স্লোগান দেয় শুক্কুর আলী, সাথে তার দলবল। রোদের আলোয় ঝকঝক করে ওঠে তলোয়ারগুলো। সেই আলোর ঝলকানি দেখে বড় শান্তি লাগে হাজী সালাউদ্দিন শিকদার সাহেবের। একদঙ্গল ছেলেপুলে তাঁর উঠোনে জড়ো হয়েছে। তিনি ভাষণ দেয়ার জন্য উঠে দাঁড়ান। আজ “মুক্তি” নামের মোনাফেকদের সম্পর্কে বয়ান করার ইচ্ছে আছে তাঁর। এরা ঘাপটি মেরে থাকে, রাতের অন্ধকারে মালাউন-শিখদের সাথে নিয়ে নিজের মুসলমান ভাইদের ওপর হায়েনার মত ঝাঁপিয়ে পড়ে। খুব খারাপ! খুব খারাপ!


আজকে শুক্কুর আলীর পরীক্ষা। কঠিন পরীক্ষা। অদূরে শিকদার সাহেব দাঁড়ানো। সে এক পা দু’ পা করে এগুচ্ছে। তার জেহাদী ভাইয়েরা বিপুল জোশ সহকারে ঘরের ভেতর থেকে জিনিসপত্র ছুঁড়ে ছুঁড়ে মারছে। মূল্যবান যা কিছু পাওয়া যাচ্ছে, তা আলাদা করে জমা করা হচ্ছে। এগুলো এখন থেকে গনিমতের মাল – জিহাদের খোরাকী। এলাকার সবচেয়ে বড় মালাউনদের দালাল আজ ধরা পড়েছে। উঠোনে গর্ত করে, দালালটাকে চিৎ করে শোয়ানো হয়েছে। দালালটা সাদা পাঞ্জাবী আর লুঙ্গি পড়ে আছে, মাথায় টুপিও আছে। ঘরের ভেতর থেকে কতগুলো মেয়ে কন্ঠের বিলাপও ভেসে আসছে। শুক্কুর আলী কাছে এসে দাঁড়াতেই ভেতর থেকে একটা কচি কন্ঠের কান্না মেশানো চীৎকার তীব্রতর হয়, “শুক্কুর বাই ... শুক্কুর বাই ...”! সালমার গলা। মেয়েটাকে, আর তার ছোটভাই আসলামকে প্রতিদিন আরবী পড়াতো শুক্কুর। বুক মোচড়াতে থাকে শুক্কুরের। নীচের দিকে তাকায়। চিৎ হয়ে, স্থির শুয়ে মিয়া মোহাম্মদ নাসিরুদ্দিন। চোখ দুটো ঠিক মেঘলা আকাশপানে। নির্বিকার, ভয়হীন। একটু তেজের স্ফুলিঙ্গও কি আছে? শিকদার সাহেব তলোয়ার এগিয়ে দিলেন শুক্কুরকে। শুক্কুরের মনে উথাল পাথাল। অনেক মালাউনের লাশ পড়েছে তার হাতে, তবু সেই হাতে একটু দ্বিধা। চারপাশ থেকে সবাই সম্মিলিত স্বরে কলেমা পড়ছে, তাকে উৎসাহ দিচ্ছে। নিজের বুকের ধুকপুকানি সামলাতে বেশ বেগ পেতে হচ্ছে শুক্কুরের। একদিকে ইসলাম, আরেকদিকে আজীবন ভালবাসার ঋণ। তলোয়ারটা নিয়ে নাসিরুদ্দিনের গলায় আলতো করে রাখে শুক্কুর। নাসিরুদ্দিন এবার চোখ ফেরান শুক্কুর আলীর দিকে। আশ্চর্য! এই চোখে ভয় নেই, ক্রোধ নেই, অশ্রুও নেই। ছোটবেলায় কোন ভুলচুক করে কাঁচুমাচু হয়ে বাবার সামনে দাঁড়ালে বাবা যে ক্ষমার চাউনীতে তাকে দেখতেন, এই দৃষ্টি অবিকল সেরকম। শুক্কুর আলী চোখ বুঁজে ফেলে। একবুক শ্বাস নিয়ে, শুক্কুর চীৎকার করে ওঠে, “নারায়ে তাকবীর ... আল্লাহু আকবার!” রক্তের ফোয়ারা ওপরে ছিটকে ওঠে সাথে সাথেই, সবাই সমস্বরে বজ্রকন্ঠে স্লোগান তোলে, “পাকিস্তান ... জিন্দাবাদ”, আর এই সব আওয়াজে ঢাকা পড়ে যায় “শুক্কুর বা-ই ...” – একটা রিনরিনে কন্ঠের আর্ত চীৎকার।


“ইয়া আল্লাহ! ইয়া মাবুদ! ইয়া পাক পরোয়ারদিগার! তোর দিলে কি রহম হয় না ... ...” অশ্রুবিগলিত নিঃশব্দ মোনাজাত শুক্কুরের। নিজের গোলাঘরে, ধানের স্তূপের এক কোণায় গুটিশুটি পাকিয়ে লুকিয়ে আছে সে। এভাবেই আছে প্রায় দেড়দিন ধরে। খাওয়া নেই, নাওয়া নেই, প্রাকৃতিক কাজ সারবারও উপায় নেই – তবে সবকিছু ছাপিয়ে তার দুঃখ, এমন রক্ত পানি করা জিহাদের পরও, এত মালাউনের লাশ পড়ল, এত মালাউন দেশ ছেড়ে পালাল, এত কাফের আর ইন্ডিয়ার দালালের ঘর পুড়ল, তারপরও এই পাক জমিনে ইসলামের ঝান্ডা উঁচিয়ে রাখা গেল না। পিশাব করে পানি না নেওয়া ওই মালাউনদের সাথে জোট বেঁধে মুক্তি কাফেরগুলো একে একে তাদের মুসলমান ভাইদেরকে হত্যা করেছে, ধ্বংস করেছে। পুরো গ্রাম এখন কাফের-মালাউনদের দখলে। যারা এতদিন ইসলামের খিদমতে জিহাদ করেছিল, আজ তাদের খুঁজে খুঁজে হত্যা করা হচ্ছে। ‘দেশটা তাহলে সত্যিই হিন্দুস্তান হয়ে গেল? আর কোনদিন সুবহে সাদিকে আযানের সুমধুর সুর শোনা যাবে না? আর কোনদিন কেউ এখানে সশব্দে কুরআন তেলাওয়াত করতে পারবে না? মসজিদগুলোতে এখন থেকে হিন্দুরা মূর্তি বসিয়ে, ঘন্টা বাজিয়ে, উলু দিয়ে পূজা করবে? ইসলাম দেশ থেকে এভাবে ধ্বংস হয়ে যাবে?’ দু’চোখের পানি আটকাতে পারে না শুক্কুর আলী।


সেইসব দিনের কথা ভাবলে, আজও রক্ত গরম হয়ে যায় শেখ মুহাম্মদ শুক্কুর আলীর। তবে, সময় এবং বয়স তাকে ধৈর্য্য শিখিয়েছে, কৌশলী করেছে। তাকে শিখিয়েছে, ঠিক যেভাবে একদিন ইসলাম বিরোধীরা মুসলমানের লেবাস ধরে মুসলমানকেই হত্যা করেছে, দ্বিখন্ডিত করেছে ইসলামী রাষ্ট্র, খর্ব করেছে ইসলামের ঐক্য, ঠিক সেই কায়দায়ই আজ বদলা নিতে হবে। দেশটা স্বাধীনতা হারানোর পর, কি দুঃসময়টাই না গিয়েছিল! ভাগ্যিস, মুজিব গাধাটা এসে পড়েছিল! সাধারণ ক্ষমা? ফুঃ! আরে তুই ক্ষমা করার কে? আর তোর কি মনে হয়েছিল, এইসব করে তুই আমাদের রাসূলে পাক এর সমকক্ষ হয়ে যাবি? ব্যাটা মালাউনের দালাল, ভেক ধরার আর জায়গা পাস না! তবু কিছুদিন সমঝে চলতে হয়েছিল। নিজ গ্রাম ছেড়ে, একটা সরকারী স্কুলে কিছুদিন ঝাড়ুদারের কাজ করতে হয়েছিল। কি দুঃখের দিনটাই না গেছে! কিন্তু আল্লাহপাক কখনো তাঁর প্রিয় বান্দাদের ওপর থেকে মুখ ফিরিয়ে নেন না। সেই চরম হতাশার দিনে, একদিন হঠাৎ করেই ভাগ্যের দুয়ার খুলে যায়। স্কুল কমিটির চেয়ারম্যান, স্থানীয় আওয়ামী লীগের অত্যন্ত প্রভাবশালী নেতা, বদিউজ্জামান সাহেব তাঁর মেয়ের বিয়েতে ফাই ফরমাশ খাটার জন্য শুক্কুর আলীকে নিয়ে আসেন। এসব কাজে তো সে চিরকালই সিদ্ধহস্ত, সুতরাং সাহেবের নেক নজরে পড়তে দেরী হয় নি। ক্রমেই স্কুল ঝাড়ু দেয়ার চেয়ে তাঁর ফরমায়েশ খাটার পরিমাণ বাড়তে থাকে। তখন শুক্কুর আলীর কাছে ইসলামের সেবার চেয়ে নিজেকে টিকিয়ে রাখার চিন্তাটাই ছিল বড়। চোখের সামনে নেতাকে সরকারী সাহায্যের হরিলুট করতে দেখেও তার ইসলামী চেতনা তখন সুপ্তই ছিল। কতগুলো জাসদ-বাসদ ছোকড়া নেতার মাথাব্যাথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। অভ্যস্ত হাতে তাদের দু’জনকে সরিয়ে দিতেই তার ভাগ্যের চাকা রীতিমত ঘুরে যায়। সে হয়ে ওঠে নেতার অত্যন্ত প্রিয়জন, একনিষ্ঠ যুবলীগ কর্মীর তকমাও জুটিয়ে ফেলে। মুক্তিযোদ্ধার সার্টিফিকেট হাতে পাওয়ার পর অনেকক্ষণ নিজের একলা ঘরে পাগলের মত হেসেছিল শুক্কুর।

পঁচাত্তরের পর আরেকদফা দৌড়ানী খেয়েছিল শুক্কুর আলী। শত্রু তো কম না, বিশেষত কম্যুনিষ্টদের হাতে পড়লে তো দফারফা। তখন নিজেকে বাঁচিয়েছে অভিনব উপায়ে। নিজের করা খুন- এর মামলায় আসামী হলেন ঐ বদিউজ্জামান সাহেব, শুক্কুর হল রাজসাক্ষী। জেল থেকে ছাড়া পেয়ে আবার জায়গা বদল। মাসখানেক আবার টিকে থাকার ভীষণ সংগ্রাম। এরই মাঝে আশ্রয় মেলে আরেকটি দলের স্বেচ্ছাসেবকের খাতায় – জামায়াতে ইসলামী বাংলাদেশ। এখানেই জীবনের লক্ষ্য সম্পর্কে একটা আদর্শিক ভিত্তি পায় শুক্কুর – ‘মানচিত্র আলাদা হয়েছে সত্য, দেশটাকে অনৈসলামিকতার চারণভূমি হতে দেব না। বাংলাদেশ হবে মুসলিম রাষ্ট্র, ইন্ডিয়ার ছায়া পড়তে দেব না।’ যখন শোনে সংবিধানে “বিসমিল্লাহির রাহমানীর রাহীম” আর “ধর্মনিরপেক্ষতা”র স্থানে “আল্লাহর উপর পূর্ণ আস্থা ও বিশ্বাস” – পালে হাওয়া লাগে শুক্কুরের। পাকিস্তান না হোক, “পাক বাংলাদেশ” তো, ওইটা “পাকদেশ” হতে আর কতক্ষণ?

মজ্জাগত সাংগঠনিক দক্ষতার কারণে, ছাত্র না হয়েও ‘ইসলামী ছাত্র শিবির’ নামক ছাত্র সংগঠনের বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব পায় সে। পরে অবশ্য বুঝতে পারে, যে দায়িত্ব পেয়েছে, তার জন্য ছাত্রত্বের কিছুমাত্র প্রয়োজন নেই। একাত্তরের অভিজ্ঞতা বেশ কাজ দিতে থাকে। সাথে কম্যুনিষ্টদের ধাতানী খাওয়ার ক্ষোভ ছিলই – ওরাই হয় প্রথম টার্গেট।

নব্বই পর্যন্ত, বেশ কিছু উত্থান-পতন মিলিয়ে, চলেছিল ভালই। তারপর গোটা দেশে একটা ব্যাপক পট পরিবর্তন আসে। বিচক্ষণ শুক্কুর আলী সুযোগ বুঝেই রঙ বদলায়। মুন্সী আব্দুস শুক্কুর হয়ে যায় জাতীয়তাবাদী মুন্সী মুহাম্মদ শুক্কুর আলী। যেখানে দলত্যাগের জন্য অনেককে জীবন দিয়ে খেসারত দিতে হয়েছে, সেখানে তার দলবদলে কেন হাই কমান্ড নীরব সমর্থন জানিয়েছে, তা এক রহস্য বটে। তবে সেই সমর্থনের প্রতিদান সে ভালই দিয়েছে। একটা সবল সচল দো-পেয়ে মানুষকে যদি সারাক্ষণ অনর্থকভাবে একটা পায়ের জন্য কৃত্রিম সাহায্য দেয়া হয়, তবে শারীরিকভাবে না হলেও, মানসিকভাবে সে একসময় পঙ্গু হয়ে পড়ে। সে ভাবতে এবং ক্রমশ বিশ্বাস করতে শেখে, ঐ কৃত্রিম সাহায্য ছাড়া সে চলতেই পারবে না। ভেতর থেকে লবিং এর কাজটা মুন্সী মুন্সীয়ানার সাথেই করেছে।

খুব ভাল স্রোতে থাকা শুক্কুর আলী সম্পূর্ণ অজ্ঞাত কারণে, আপাতদৃষ্টিতে একদম অনর্থকভাবে, বরং বেশ বেওকুফের মত আরেকটা ডিগবাজী দেয় ২০০৪ এর শেষভাগে। তবে তার এই দলবদলও ছিল তার দূরদৃষ্টিতার অংশ। একটা নক্ষত্র ধ্বংস হওয়ার আগে ফুলে ফেঁপে বিশাল হয় – প্রাতিষ্ঠানিকভাবে বিজ্ঞান শিক্ষা না থাকলেও, ছেলেমেয়ের কাছ থেকে এরকম একটা কথা শুনেছিল শুক্কুর আলী। ফুল হাতে নিয়ে সম্বর্ধনা সভায় যখন আনুষ্ঠানিকভাবে “শেখ মুহাম্মদ শুক্কুর আলী”র জন্ম হয়, তখন, হাততালি দিতে থাকা কর্মীগুলোর প্রায় কেউই জানতনা, তারা নিজেদের ধ্বংসের বাজনা বাজাচ্ছে।

শুক্কুর আলী কখনো এম পি ইলেকশান করেনি, বড় কোন পদের লোভও তার মাঝে নেই, ফোকাস থেকে চিরকালই দূরে সে। তার এই স্বভাবের জন্যই হাই কমান্ড তাকে ‘নির্লোভ এবং ত্যাগী’ নেতা হিসেবে দেখে।

যুদ্ধাপরাধীর বিচারের দাবীতে শুক্কুর আলী দলীয় মিটিংএ বেশ সোচ্চার।
মিছিল-মিটিংএ বুড়ো শুক্কুর আলীর “জয় বাংলা” স্লোগান সবচেয়ে উচ্চকন্ঠ।
দলের অনেক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তার উপস্থিতি অপরিহার্য।

দেশের দুই প্রধান রাজনৈতিক দলকে সরাসরি পরাস্ত করবার শক্তি, শুক্কুর আলী জানে, তাদের নেই। কিন্তু নিঃশব্দে ঘুণপোকার মত তাদের কোমর ভেঙে দেয়া যায়। গোপনে নিজেদের ছড়িয়ে দেয়া যায় সর্বত্র, তারপর, নিজেদের প্রতিরোধ করবার সব ক্ষমতা একটু একটু করে নষ্ট করে, ধ্বংস করে দেয়া যায়। শুক্কুর আলীরা যেদিন কামড় দেয়, শিকারের আত্মরক্ষা করার শক্তি কিংবা চেতনাটুকুও থাকে না।

এভাবেই বদলা নিতে হবে, এভাবেই!


শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত ড্রইংরুমে শুক্কুর আলী সস্ত্রীক আয়েশ করে বসে আছে। দু’জনের মুখেই আনন্দের হাসি। সামনে, টেলিভিশনের পর্দায়, শুক্কুর আলীর ডাক্তার মেয়ের সাক্ষাৎকার প্রচারিত হচ্ছে। মেয়ে কথা বলছে “এইডস” বিষয়ে। যদিও এই বিষয় নিয়ে যেসব কথা বলা হয়, তার অনেক কিছুই শুক্কুর আলীর বিশেষ পছন্দ না, তবুও, নিজের মেয়ে বলে কথা! মেয়ের সব কথা শুক্কুর আলী বুঝতে পারছে না, অনেক কঠিন কঠিন কথা বলছে।
“... ... এইচ আই ভি ভাইরাসের সবচেয়ে বড় সমস্যা হল, এর মধ্যে “রিভার্স ট্রান্সকিপ্টেজ” নামে একটা এনজাইম, মানে, এক ধরণের রাসায়নিক পদার্থ আছে। এর সাহায্যে এরা চট করে নিজেদের গঠন বদলে ফেলতে পারে। ফলে, আপনি যদি কোন এ্যান্টিভাইরাস ঔষধ দিয়ে এর চিকিৎসা করাতে চান, সেটা খুব বেশীদিন বা খুব বেশী পরিমাণে উপকারী হবে না, মানে, কখনো পুরোপুরি সারিয়ে তুলতে পারবেনা। ভাইরাস যখনই তার গঠন বদলে ফেলে, তখন তার ওপর আর আগের ঔষধ কাজ করে না। ... ... হ্যাঁ, এর প্রতিষেধকও নেই ঐ একই কারণে। এখন যদি কোন প্রতিষেধক তৈরীও করা হয়, রিভার্স ট্রান্সকিপ্টেজের মাধ্যমে এরা নিজেদের গঠন বদলে ফেলবে, ফলে ঐ প্রতিষেধক আর কাজ করবে না। ... হ্যাঁ, এটাই দুঃখজনক সত্য, একবার কেউ এই রোগে আক্রান্ত হলে, তাকে পুরোপুরি সুস্থ করা প্রায় অসম্ভব। ... ... সংক্রমণের সাথে সাথেই এইডসের লক্ষণ প্রকাশ পায় না। সংক্রমণের পাঁচ বছর, দশ বছর, পনর এমনকি বিশ বছর পরে গিয়ে রোগের বিভিন্ন লক্ষণ বা উপসর্গ দেখা দিতে পারে। কিন্তু যখন দেখা দেয়, ততদিনে বলতে পারেন, অনেক দেরী হয়ে গেছে ... ... ...”
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

বারবাজারে মাটির নিচ থেকে উঠে আসা মসজিদ

লিখেছেন কামরুল ইসলাম মান্না, ২৭ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৯:৪০

ঝিনাইদহ জেলার কালীগঞ্জ উপজেলার বারবাজার ইউনিয়নে মাটির নিচ থেকে মসজিদ পাওয়া গেছে। এরকম গল্প অনেকের কাছেই শুনেছিলাম। তারপর মনে হলো একদিন যেয়ে দেখি কি ঘটনা। চলে গেলাম বারবাজার। জানলাম আসল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সৎ মানুষ দেশে নেই,ব্লগে আছে তো?

লিখেছেন শূন্য সারমর্ম, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ১:৪৮








আশেপাশে সৎ মানুষ কেমন দেখা যায়? উনারা তো নাকি একা থাকে, সময় সুযোগে সৃষ্টিকর্তা নিজের কাছে তুলে নেয় যা আমাদের ডেফিনিশনে তাড়াতাড়ি চলে যাওয়া বলে। আপনি জীবনে যতগুলো বসন্ত... ...বাকিটুকু পড়ুন

পরিবর্তন অপরিহার্য গত দেড়যুগের যন্ত্রণা জাতির ঘাড়ে,ব্যবসায়ীরা কোথায় কোথায় অসহায় জানেন কি?

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ রাত ৩:৫৭


রমজানে বেশিরভাগ ব্যবসায়ীকে বেপরোয়া হতে দেখা যায়। সবাই গালমন্দ ব্যবসায়ীকেই করেন। আপনি জানেন কি তাতে কোন ব্যবসায়ীই আপনার মুখের দিকেও তাকায় না? বরং মনে মনে একটা চরম গালিই দেয়! আপনি... ...বাকিটুকু পড়ুন

গরমান্ত দুপুরের আলাপ

লিখেছেন কালো যাদুকর, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ দুপুর ১:৫৯

মাঝে মাঝে মনে হয় ব্লগে কেন আসি? সোজা উত্তর- আড্ডা দেয়ার জন্য। এই যে ২০/২৫ জন ব্লগারদের নাম দেখা যাচ্ছে, অথচ একজন আরেক জনের সাথে সরাসরি কথা বলতে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা বৃষ্টির জন্য নামাজ পড়তে চায়।

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৮ শে এপ্রিল, ২০২৪ বিকাল ৪:৩৮



ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কিছু শিক্ষার্থী গত বুধবার বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে বৃষ্টি নামানোর জন্য ইসতিসকার নামাজ পড়বে তার অনুমতি নিতে গিয়েছে। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ এটির অনুমতি দেয়নি, যার জন্য তারা সোশ্যাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

×