somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইভ টিজিং

২৭ শে জুন, ২০১১ রাত ৮:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

সাধারণত কিশোরী বা যুব নারীরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলেও বয়সী ও শিশুরাও এর হাত থেকে রেহাই পায় না। শুধুই কি রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের সামনে নারীরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন? ঘরের ভেতরে যে নারীটি গৃহসহকারী তিনি কতখানি নিরাপদ ঘরের পুরুষদের থাবা থেকে? অফিস-আদালতে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নারী কর্মচারীরা তাঁদের ঊর্ধ্বতন, সমপর্যায় বা নিম্নপর্যায়ের পুরুষ সহকর্মী দ্বারা প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার। এখনো কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা নগণ্য। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নারী কর্মচারীরা নিতান্তই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাকরি করেন। নারী কর্মকর্তারা ক্যারিয়ার-সচেতন। ব্যক্তি-পরিবারে সচ্ছলতার প্রয়োজন ব্যতিরেকেও সুশিক্ষিত নারী আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে চান, উত্তরোত্তর উন্নতি বা অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগদানের জন্য নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমাদের এ অনগ্রসর সমাজে একটা চাকরি যেখানে সোনার হরিণ, সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা, অশোভন আচরণ বা পেশাগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে নিম্নপদস্থদের কথা তো বলাই বাহুল্য। মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সার বিনিয়োগ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরিলাভ অসম্ভব। চাকরি হারানোর ভয়ে এসব নারী নীরবে-নিভৃতে সব ধরনের হয়রানি হজম করে যান। আর না হলে বদলি আতঙ্ক।
কিছুদিন আগে ইভ টিজিং নিয়ে আলোচনার সময় আইনমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন ‘কেন ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানির ঘটনা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, এর কোনো সামাজিক গবেষণা হয়েছে কি না? সামাজিকভাবে ছেলেমেয়েরা কতটা বিনোদন বা সাংস্কৃতিক বলয় পাচ্ছে, সেটিও খেয়াল রাখা উচিত। একজন অভিযুক্তকে জেলে পাঠিয়ে দিলেই হবে না, তাকে সংশোধনীমূলক ব্যবস্থায় গড়ে তুলতে হবে।’
ইভ টিজিং নিয়ে অনেক সভা, সেমিনার, কর্মশালা, আলোচনা, লেখালেখি, শোভাযাত্রা ইত্যাদি হচ্ছে। কীভাবে এটাকে প্রতিরোধ করা যায়, এর প্রতিকার কী—এ নিয়েই আলোচনা মূলত কেন্দ্রীভূত। একদিন কোনো এক প্রাইভেট চ্যানেলে সংগীত পরিবেশনের সময় আলাপচারিতায় জনপ্রিয় শিল্পী আনুশেহ আনাদিল বলছিলেন—‘কোনো ছেলেকে ইভ টিজিংয়ে উদ্যত হতে দেখলেই টেনে এক চড় কষে দিতে হবে। অথবা স্যান্ডেল খুলে পেটাতে হবে। অপরাধীরা স্বভাবতই ভীরু হয়। সাহসের সঙ্গে ওদের মোকাবিলা করতে হবে’। কিন্তু এ রকম পারে কজন? আবার এ দেশে উল্টোটা ঘটাও অসম্ভব নয়। যে ইভ টিজিং করছে তার দলই ভারী। দল বেঁধে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে। তখন থানা পুলিশে টানাটানি। এবং শেষমেশ মেয়েটিকেই সব অপবাদ মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। ঘরে ফিরেও তাকে শুনতে হবে ‘কী দরকার ছিল এসব নাটক করার? এখন পাড়ায় মুখ দেখানো যাবে?’
আইনমন্ত্রী আসল জায়গাটি চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন—ইভ টিজিং কেন? আমাদের গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। এর কারণ আর কিছুই নয়—সেই আদি এবং অকৃত্রিম পুরুষতন্ত্র। জন্মের পর মেয়েশিশুটি শিশু থাকে খুব অল্পদিন। সমাজ ও পরিবার তার ভেতর যত দ্রুত সম্ভব নারী হয়ে ওঠার বীজ বপন করতে শুরু করে। মেয়েদের জোরে কথা বলতে নেই, মুখ নিচু করে চলতে হয়, জোরে হাসতে নেই, ঘরের কাজ করতে হয়, সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরতে হয়, লাজুক হতে হয়, পরের ঘরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়, সাত চড়ে রা না করার সদ্গুণ অর্জন করতে হয় ইত্যাদি। সিমোন দ্য বুভোয়ার তাই বড় আক্ষেপে বলে গেছেন, ‘পিতামাতারা আজও কন্যাদের তাদের বিকাশের জন্য বড় না করে বড় করে বিয়ের জন্য। তারা এর মাঝে এত বেশি সুবিধা দেখতে পায় যে তারা নিজেরাই এটা চাইতে থাকে। এর ফল হচ্ছে যে তারা সাধারণত হয় কম প্রশিক্ষিত, ভাইদের থেকে তাদের ভিত্তি হয় কম দৃঢ়, তারা তাদের পেশায় মন দেয় অনেক কম। এভাবে তারা নিজেদের নষ্ট করে, থেকে যায় নিম্ন স্তরে, হয় নিকৃষ্ট এবং গড়ে ওঠে দুষ্টচক্র: পেশাগত নিকৃষ্টতা তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে একটি স্বামী লাভের আকাঙ্ক্ষা।’
প্রকৃতপক্ষে নারী পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। নারীর সকল প্রকার অমর্যাদা, অধস্তনতা, নির্যাতন, পীড়ন, বন্দীদশা ও যাবতীয় দুরবস্থার জন্য পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবই যে দায়ী তা সুশিক্ষিত বিবেকবান মানুষের অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনো নারীকে একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে পুরুষকুল অপারগ।
সুতরাং, যত দিন না পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবার- সমাজ থেকে দূর হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক—সব ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার হতেই থাকবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল কথাই হলো নারীকে শুধু নির্বোধই ভাবা হয় না, বরং কোনো কঠিন, শ্রমসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য অনুপযোগীও মনে করা হয়।
তাই পরিবারেই জন্ম নেয় ইভ টিজিংয়ের ধারণা। নারীর প্রতি সমাজ ও সংস্কৃতি সৃষ্ট যেসব বিধিনিষেধ আরোপিত সেগুলোই প্রকারান্তরে ইভ টিজিংকে উসকে দেয়। একটা পরিবার যদি বাড়ির ছেলে ও মেয়েটির প্রতি সমান আচরণ প্রদর্শন করে তাহলে কেউ নিজেকে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন এবং কেউ নিজেকে নিম্নপর্যায়ভুক্ত ভাবার সুযোগ পাবে না। আমি পুরুষ, আমিই শ্রেষ্ঠ—এ ধারণা যখন বড়দের আচরণে ছোটদের প্রভাবিত করে তখন কোনো উপদেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কাজে লাগে না। হয়তো ছেলে ও মেয়েশিশুর প্রতি স্নেহ-মমতার পার্থক্য নিরূপণ করা যায় না কিন্তু মায়ের প্রতি বাবা বা পরিবারের অন্যদের কর্তৃত্ব ও উৎপীড়ন মেয়েশিশুটির মনে যে গভীর ছাপ ফেলে দেয় তাতে সে নিজেকে মায়েরই সমগোত্রীয় ভাবতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে ছেলেশিশুটি বাবার মতো কর্তৃত্বপরায়ণ হতে উৎসাহিত বোধ করে। মেয়েটি ভাবে এ বুঝি পৃথিবীর নিয়ম। কারণ, ছেলেদের মতো আচরণ করতে দেখলে বাড়ির সবাই হা হা করে তেড়ে আসে। জাত গেল। বলে, ‘এসব ছেলের সাজে, তোমার নয়।’ ছেলেটি দেখতে দেখতে বড় হয় যে তার বোনটি একটি নিচু স্তরের জীব। তাহলে দুনিয়ার তাবৎ মেয়েই দ্বিতীয় সারির। আবার যেসব পরিবারে কেবল ছেলে বা কেবল মেয়ে তারা কি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সদয়? না, তাদেরও আছে সব অনাচার সহ্য করা মুখ বুজে থাকা মা। তাদের আছে বন্ধু, আছে সমাজ, আছে স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কারণ, সহশিক্ষার স্কুলগুলোতেও ছেলে ও মেয়েদের প্রতি শিক্ষকদের আচরণ ভিন্ন। ছেলেরা যে ধরনের খেলা করবে মেয়েরা তা করতে পারবে না। মেয়েদের বুড়িছুটে কোনো ছেলে যোগ দিতে গেলে ‘মেয়েমানুষ’ ‘মেয়েমানুষ’ বলে তাকে নাজেহাল করবে। যেন মেয়েমানুষ হওয়া এক ধরনের পাপ। এসব ছেলেই একটু বড় হয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কারণ, মেয়েদের সম্মান করার সংস্কৃতি তারা ঘরে বা বাইরে কোথাও পায়নি। মেয়েদের দুর্বল হতে শিক্ষা দেওয়া হয়।
তো মেয়েশিশুকে রান্নাবাটি, লিপস্টিক-নেইলপলিশ, পুতুলবউ দিয়ে কোমল করে গড়ে তোলা আর ছেলেশিশুকে বন্দুক, কলকবজা আর ব্যাটবল দিয়ে মহাপরাক্রমশালী করে তোলারই প্রতিফলন ইভ টিজিং। একটা পরিবারে ছেলেশিশুটি যেদিন দেখবে তার মা, চাচি বা অন্যান্য নারী-পুরুষ সদস্য কর্তৃক প্রদেয় মর্যাদা, সম্মান আর সমানাধিকারের মধ্যে বসবাস করছেন সেদিন তার চোখে বাইরের নারীও সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আচরণে যতক্ষণ না পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করছে, ততক্ষণ সভা-সেমিনারে ইভ টিজিং প্রতিরোধে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, এমনকি আইন প্রণয়ন করেও ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র প্রবাদমুক্ত হওয়া সম্ভব হবে না।

সাধারণত কিশোরী বা যুব নারীরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হলেও বয়সী ও শিশুরাও এর হাত থেকে রেহাই পায় না। শুধুই কি রাস্তাঘাট, স্কুল-কলেজের সামনে নারীরা ইভ টিজিংয়ের শিকার হচ্ছেন? ঘরের ভেতরে যে নারীটি গৃহসহকারী তিনি কতখানি নিরাপদ ঘরের পুরুষদের থাবা থেকে? অফিস-আদালতে তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নারী কর্মচারীরা তাঁদের ঊর্ধ্বতন, সমপর্যায় বা নিম্নপর্যায়ের পুরুষ সহকর্মী দ্বারা প্রতিনিয়তই হয়রানির শিকার। এখনো কর্মক্ষেত্রে নারী কর্মকর্তার সংখ্যা নগণ্য। তৃতীয়-চতুর্থ শ্রেণীর নারী কর্মচারীরা নিতান্তই বেঁচে থাকার প্রয়োজনে চাকরি করেন। নারী কর্মকর্তারা ক্যারিয়ার-সচেতন। ব্যক্তি-পরিবারে সচ্ছলতার প্রয়োজন ব্যতিরেকেও সুশিক্ষিত নারী আত্মপরিচয়ে উদ্ভাসিত হয়ে উঠতে চান, উত্তরোত্তর উন্নতি বা অধিকতর মর্যাদাসম্পন্ন কর্মক্ষেত্রে যোগদানের জন্য নিজেকে ক্রমাগত উন্নত করার চেষ্টা করেন। কিন্তু আমাদের এ অনগ্রসর সমাজে একটা চাকরি যেখানে সোনার হরিণ, সেখানে কোনো অপ্রীতিকর ঘটনা, অশোভন আচরণ বা পেশাগত দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হলেই চাকরি ছেড়ে দেওয়ার সুযোগ নেই। সে ক্ষেত্রে নিম্নপদস্থদের কথা তো বলাই বাহুল্য। মোটা অঙ্কের টাকা-পয়সার বিনিয়োগ ছাড়া কোনো কোনো ক্ষেত্রে চাকরিলাভ অসম্ভব। চাকরি হারানোর ভয়ে এসব নারী নীরবে-নিভৃতে সব ধরনের হয়রানি হজম করে যান। আর না হলে বদলি আতঙ্ক।
কিছুদিন আগে ইভ টিজিং নিয়ে আলোচনার সময় আইনমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন ‘কেন ইভ টিজিং বা যৌন হয়রানির ঘটনা হঠাৎ বৃদ্ধি পেয়েছে, এর কোনো সামাজিক গবেষণা হয়েছে কি না? সামাজিকভাবে ছেলেমেয়েরা কতটা বিনোদন বা সাংস্কৃতিক বলয় পাচ্ছে, সেটিও খেয়াল রাখা উচিত। একজন অভিযুক্তকে জেলে পাঠিয়ে দিলেই হবে না, তাকে সংশোধনীমূলক ব্যবস্থায় গড়ে তুলতে হবে।’
ইভ টিজিং নিয়ে অনেক সভা, সেমিনার, কর্মশালা, আলোচনা, লেখালেখি, শোভাযাত্রা ইত্যাদি হচ্ছে। কীভাবে এটাকে প্রতিরোধ করা যায়, এর প্রতিকার কী—এ নিয়েই আলোচনা মূলত কেন্দ্রীভূত। একদিন কোনো এক প্রাইভেট চ্যানেলে সংগীত পরিবেশনের সময় আলাপচারিতায় জনপ্রিয় শিল্পী আনুশেহ আনাদিল বলছিলেন—‘কোনো ছেলেকে ইভ টিজিংয়ে উদ্যত হতে দেখলেই টেনে এক চড় কষে দিতে হবে। অথবা স্যান্ডেল খুলে পেটাতে হবে। অপরাধীরা স্বভাবতই ভীরু হয়। সাহসের সঙ্গে ওদের মোকাবিলা করতে হবে’। কিন্তু এ রকম পারে কজন? আবার এ দেশে উল্টোটা ঘটাও অসম্ভব নয়। যে ইভ টিজিং করছে তার দলই ভারী। দল বেঁধে মেয়েটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লে কুরুক্ষেত্র ঘটে যাবে। তখন থানা পুলিশে টানাটানি। এবং শেষমেশ মেয়েটিকেই সব অপবাদ মাথায় নিয়ে ঘরে ফিরতে হবে। ঘরে ফিরেও তাকে শুনতে হবে ‘কী দরকার ছিল এসব নাটক করার? এখন পাড়ায় মুখ দেখানো যাবে?’
আইনমন্ত্রী আসল জায়গাটি চিহ্নিত করতে সচেষ্ট হয়েছেন—ইভ টিজিং কেন? আমাদের গোড়ায় ফিরে যেতে হবে। এর কারণ আর কিছুই নয়—সেই আদি এবং অকৃত্রিম পুরুষতন্ত্র। জন্মের পর মেয়েশিশুটি শিশু থাকে খুব অল্পদিন। সমাজ ও পরিবার তার ভেতর যত দ্রুত সম্ভব নারী হয়ে ওঠার বীজ বপন করতে শুরু করে। মেয়েদের জোরে কথা বলতে নেই, মুখ নিচু করে চলতে হয়, জোরে হাসতে নেই, ঘরের কাজ করতে হয়, সন্ধ্যের আগেই ঘরে ফিরতে হয়, লাজুক হতে হয়, পরের ঘরে যাওয়ার জন্য তৈরি হতে হয়, সাত চড়ে রা না করার সদ্গুণ অর্জন করতে হয় ইত্যাদি। সিমোন দ্য বুভোয়ার তাই বড় আক্ষেপে বলে গেছেন, ‘পিতামাতারা আজও কন্যাদের তাদের বিকাশের জন্য বড় না করে বড় করে বিয়ের জন্য। তারা এর মাঝে এত বেশি সুবিধা দেখতে পায় যে তারা নিজেরাই এটা চাইতে থাকে। এর ফল হচ্ছে যে তারা সাধারণত হয় কম প্রশিক্ষিত, ভাইদের থেকে তাদের ভিত্তি হয় কম দৃঢ়, তারা তাদের পেশায় মন দেয় অনেক কম। এভাবে তারা নিজেদের নষ্ট করে, থেকে যায় নিম্ন স্তরে, হয় নিকৃষ্ট এবং গড়ে ওঠে দুষ্টচক্র: পেশাগত নিকৃষ্টতা তাদের ভেতরে বাড়িয়ে তোলে একটি স্বামী লাভের আকাঙ্ক্ষা।’
প্রকৃতপক্ষে নারী পিতৃতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গির বাইরে বেড়ে ওঠার সুযোগ পায় না। নারীর সকল প্রকার অমর্যাদা, অধস্তনতা, নির্যাতন, পীড়ন, বন্দীদশা ও যাবতীয় দুরবস্থার জন্য পিতৃতান্ত্রিক মনোভাবই যে দায়ী তা সুশিক্ষিত বিবেকবান মানুষের অস্বীকার করার উপায় নেই। এখনো নারীকে একজন মানুষ হিসেবে মর্যাদা দিতে পুরুষকুল অপারগ।
সুতরাং, যত দিন না পুরুষতান্ত্রিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবার- সমাজ থেকে দূর হচ্ছে, তত দিন পর্যন্ত রাস্তাঘাটে, কর্মক্ষেত্রে, আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক—সব ক্ষেত্রে নারী বৈষম্যের শিকার হতেই থাকবে। পুরুষতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল কথাই হলো নারীকে শুধু নির্বোধই ভাবা হয় না, বরং কোনো কঠিন, শ্রমসাধ্য, ঝুঁকিপূর্ণ কাজের জন্য অনুপযোগীও মনে করা হয়।
তাই পরিবারেই জন্ম নেয় ইভ টিজিংয়ের ধারণা। নারীর প্রতি সমাজ ও সংস্কৃতি সৃষ্ট যেসব বিধিনিষেধ আরোপিত সেগুলোই প্রকারান্তরে ইভ টিজিংকে উসকে দেয়। একটা পরিবার যদি বাড়ির ছেলে ও মেয়েটির প্রতি সমান আচরণ প্রদর্শন করে তাহলে কেউ নিজেকে উচ্চমর্যাদাসম্পন্ন এবং কেউ নিজেকে নিম্নপর্যায়ভুক্ত ভাবার সুযোগ পাবে না। আমি পুরুষ, আমিই শ্রেষ্ঠ—এ ধারণা যখন বড়দের আচরণে ছোটদের প্রভাবিত করে তখন কোনো উপদেশ, শিক্ষা, প্রশিক্ষণ কাজে লাগে না। হয়তো ছেলে ও মেয়েশিশুর প্রতি স্নেহ-মমতার পার্থক্য নিরূপণ করা যায় না কিন্তু মায়ের প্রতি বাবা বা পরিবারের অন্যদের কর্তৃত্ব ও উৎপীড়ন মেয়েশিশুটির মনে যে গভীর ছাপ ফেলে দেয় তাতে সে নিজেকে মায়েরই সমগোত্রীয় ভাবতে শুরু করে এবং একই সঙ্গে ছেলেশিশুটি বাবার মতো কর্তৃত্বপরায়ণ হতে উৎসাহিত বোধ করে। মেয়েটি ভাবে এ বুঝি পৃথিবীর নিয়ম। কারণ, ছেলেদের মতো আচরণ করতে দেখলে বাড়ির সবাই হা হা করে তেড়ে আসে। জাত গেল। বলে, ‘এসব ছেলের সাজে, তোমার নয়।’ ছেলেটি দেখতে দেখতে বড় হয় যে তার বোনটি একটি নিচু স্তরের জীব। তাহলে দুনিয়ার তাবৎ মেয়েই দ্বিতীয় সারির। আবার যেসব পরিবারে কেবল ছেলে বা কেবল মেয়ে তারা কি বিপরীত লিঙ্গের প্রতি সদয়? না, তাদেরও আছে সব অনাচার সহ্য করা মুখ বুজে থাকা মা। তাদের আছে বন্ধু, আছে সমাজ, আছে স্কুল বা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। কারণ, সহশিক্ষার স্কুলগুলোতেও ছেলে ও মেয়েদের প্রতি শিক্ষকদের আচরণ ভিন্ন। ছেলেরা যে ধরনের খেলা করবে মেয়েরা তা করতে পারবে না। মেয়েদের বুড়িছুটে কোনো ছেলে যোগ দিতে গেলে ‘মেয়েমানুষ’ ‘মেয়েমানুষ’ বলে তাকে নাজেহাল করবে। যেন মেয়েমানুষ হওয়া এক ধরনের পাপ। এসব ছেলেই একটু বড় হয়ে মেয়েদের উত্ত্যক্ত করে। কারণ, মেয়েদের সম্মান করার সংস্কৃতি তারা ঘরে বা বাইরে কোথাও পায়নি। মেয়েদের দুর্বল হতে শিক্ষা দেওয়া হয়।
তো মেয়েশিশুকে রান্নাবাটি, লিপস্টিক-নেইলপলিশ, পুতুলবউ দিয়ে কোমল করে গড়ে তোলা আর ছেলেশিশুকে বন্দুক, কলকবজা আর ব্যাটবল দিয়ে মহাপরাক্রমশালী করে তোলারই প্রতিফলন ইভ টিজিং। একটা পরিবারে ছেলেশিশুটি যেদিন দেখবে তার মা, চাচি বা অন্যান্য নারী-পুরুষ সদস্য কর্তৃক প্রদেয় মর্যাদা, সম্মান আর সমানাধিকারের মধ্যে বসবাস করছেন সেদিন তার চোখে বাইরের নারীও সমান মর্যাদায় অধিষ্ঠিত হবেন। পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্র আচরণে যতক্ষণ না পুরুষতান্ত্রিক মনোভাব পরিহার করছে, ততক্ষণ সভা-সেমিনারে ইভ টিজিং প্রতিরোধে যে পদক্ষেপই নেওয়া হোক না কেন, এমনকি আইন প্রণয়ন করেও ‘বজ্র আঁটুনি ফসকা গেরো’র প্রবাদমুক্ত হওয়া সম্ভব হবে না।
[কৈফিয়ত : ইভ টিজিং-এর উপর এই লেখাটি আমার কম্পিউটারের সংরক্ষিত ছিল, যদি কারো কাকতালীয়ভাবে কারো লেখনীর সাথে মিলে যায় তাহলে ক্ষমা সুন্দর দৃষ্টিতে দেখার অনুরোধ রইলো]
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

ব্যাঙ দমনের নেপথ্যে এবং রাষ্ট্রীয় জ্ঞান-বিজ্ঞানের সমন্বয়

লিখেছেন আরেফিন৩৩৬, ২৮ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৫৭


ব্যাঙ দমনের বাংলায় একটা ইতিহাস আছে,খুবই মর্মান্তিক। বাংলাদেশে বহুজাতিক কোম্পানির কোন সার কেনা হতো না। প্রাচীন সনাতনী কৃষি পদ্ধতিতেই ভাটি বাংলা ফসল উৎপাদন করতো। পশ্চিমবঙ্গ কালক্রমে ব্রিটিশদের তথা এ অঞ্চলের... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×