somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সিরাজ উদ-দৌলার চরিত্র হনন বন্ধ হবে কবে

২৫ শে জুন, ২০১১ বিকাল ৫:২৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

আ হ ম দ বা সি র

ঔপনিবেশিক শক্তির বিজয়ী হওয়া এবং টিকে থাকার অনিবার্য উপায়টি হলো দেশপ্রেমিক শক্তির, ব্যক্তির চরিত্র হনন করা। নবাব সিরাজ উদ-দৌলার ক্ষেত্রে ইংরেজরা এ উপায়টি অতীব গুরুত্বের সঙ্গে কাজে লাগিয়েছে। ১৭৫৭ সালের পয়লা মে অনুষ্ঠিত ফোর্ট উইলিয়াম সিলেক্ট কমিটির বৈঠকের ধারাবিবরণী থেকে জানা যায়, এই বৈঠকে সিরাজকে উত্খাতের জন্য পরিকল্পনা প্রণয়ন করা হয়। তারা সিরাজকে অসত্ এবং ইংরেজদের নির্যাতনকারী বলে অভিহিত করে। অথচ সিরাজ উদ-দৌলা কখনও ইংরেজদের ওপর নির্যাতন করেননি। কাশিমবাজার অবরোধ করার পরও তাদের কোনো সম্পত্তি লুণ্ঠন কিংবা বিনষ্ট করেননি। ক্লাইভ এবং ওয়ার্টসের দেয়া সাক্ষ্যও একথা প্রমাণ করে। সিরাজ উদ-দৌলা ইংরেজদের সব ক্ষতি পুষিয়ে দিয়েছেন এবং ১৭৫৭ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি সম্পাদিত চুক্তির সব শর্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে মেনে চলেছেন। তিনি সবসময় ইংরেজদের এ আশ্বাস দিয়েছেন যে, তাদের তাড়িয়ে দেয়ার কোনো ইচ্ছাই তার নেই। ইংরেজরা সিরাজের কথায় কর্ণপাত করল না। তারা নিজেদের নিরাপত্তার ভুয়া অজুহাতে বাংলায় রাজনৈতিক কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ গ্রহণ করতে সবরকম দুর্গ নির্মাণ করতে থাকল নবাবের সুস্পষ্ট নির্দেশ অগ্রাহ্য করে। এমনকি তারা অভিযুক্তদেরও সাদরে আশ্রয় দিল।
পরিকল্পনা মোতাবেক পলাশীর যুদ্ধের পর নানাভাবে ইংরেজরা সিরাজের চরিত্র হননের ধারা চালু রাখল। ইতিহাস রচনায় নিয়োগ করল অনেক ভাড়াটে লেখক। সিরাজের চরিত্র হননের নানা উপায় অবলম্বন করেছে তারা। কিন্তু কখনোই কোনো যুক্তিযুক্ত প্রমাণ হাজির করতে পারেননি। সিরাজের চরিত্র হননের ব্যাপারে তাদের অতি উত্সাহ থেকেই বেরিয়ে পড়েছে থলের বেড়াল। ‘অন্ধকূপ হত্যাকাণ্ড’সহ সিরাজের বিরুদ্ধে যত গুরুতর অভিযোগ তার সব ক’টিই মিথ্যে এবং অতিরঞ্জিত। বাঙালি ইতিহাস রচকদের মধ্যে একেবারে হাতে-কলমে এ কথাটি প্রমাণ করেছেন অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়। তার লেখা ইতিহাস গ্রন্থের আলোচনা প্রসঙ্গে রবীন্দ্রনাথ সিরাজ উদ-দৌলা সম্পর্কে লিখেছেন ‘...দ্বন্দ্বের হীনতা মিথ্যাচার প্রতারণার উপরে তাঁহার সাহস ও সরলতা, বীর্য ও ক্ষমা রাজোচিত মহত্ত্বে উজ্জ্বল হইয়া ফুটিয়াছে।’ যদিও সিরাজকে ‘উন্নতচরিত্র মহত্ ব্যক্তি’ ভাবতে রবীন্দ্রনাথের বেঁধেছে তবুও কর্নেল ম্যালিসনের বিখ্যাত উক্তিটির উল্লেখ তিনি করেছেন—‘সেই পরিণাম দারুণ মহানাটকের প্রধান অভিনেতাদের মধ্যে সিরাজ উদ-দৌলাই একমাত্র লোক যিনি প্রতারণা করিবার চেষ্টা করেন নাই।’ যিনি প্রতারণা করার চেষ্টাটিও করেননি তিনি অধম চরিত্রের অমহত্ হবেন এটা সত্যিই ভাবা যায় না।
অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র ‘সিরাজদ্দৌলা’র আলোচনা প্রসঙ্গে রামানন্দ চট্টোপাধ্যায় লিখেছেন—‘অকালে ঘটনার চক্রে তাঁহার মৃত্যু না ঘটিলে তিনি সম্ভবত রাজকর্মকুশল প্রজারঞ্জক রাজা হইতে পারিতেন।’ কাজী নজরুল ইসলাম সিরাজকে রাজনৈতিক কোলাহলের ঊর্ধ্বে তুলে ধরেছেন। তিনি বলেন, ‘হিন্দু মুসলমানের প্রিয় মাতৃভূমির জন্য নওয়াব সিরাজউদ্দৌলা সংগ্রামে অবতীর্ণ হন। সর্বোপরি বাংলার মর্যাদাকে তিনি ঊর্ধ্বে তুলিয়া ধরিয়াছিলেন এবং বিদেশী শোষণের কবল হইতে দেশকে রক্ষা করিবার জন্য আপনার জীবন-যৌবনকে কোরবানি করিয়া গিয়াছেন।’ অক্ষয় কুমার মৈত্রেয়র মতে—‘ইংরেজ বাঙ্গালি সত্যের সম্মান রক্ষার্থে সরলভাবে আত্মোপরাধ স্বীকার করিতে সম্মত হইলে, জেতৃ বিজিত সকলকেই বলিতে হইবে : Siraj-ud-doula was more unfortunate than wicked.’
এরপরও রুদ্ধ হয়নি ইতিহাস বিকৃতির ধারা। উত্কটভাবেই চলছে এটা। সম্প্রতি কলকাতার পাক্ষিক দেশ পত্রিকার সম্পাদক হর্ষ দত্ত পত্রিকাটির ১৭ এপ্রিল ২০১১ সংখ্যার শেষ পৃষ্ঠার ‘শেষ কথা’ নামের কলামে ‘কবে যে আমরা পুরোপুরি ইতিহাসমনস্ক হব!’ শিরোনামের লেখায় সিরাজ উদ-দৌলাকে ‘অত্যাচারী ও অপরিণামদর্শী’ বলে উল্লেখ করেছেন। তার বয়ানে ‘অত্যাচারী ও অপরিণামদর্শী শাসক সিরাজকে নিয়ে যে নাটক-নভেল রচিত হয়, সে সব দেখে ও পড়ে আমরা বিগলিত হই!’ অদ্ভুত এই অভিযোগ। যুগ যুগ ধরে স্বাধীনতার প্রথম শহীদ নবাব সিরাজ উদ-দৌলাকে নিয়ে নাটক নভেল লেখা হচ্ছে। মানুষ সেগুলো উপভোগ করছে। সিরাজকে নিয়ে স্বাধীন এবং স্বতঃষম্ফূর্ত নাটক, কাব্য, গান যারা রচনা করেছেন তারা সত্যিকার সিরাজকেই তুলে ধরেছেন আর যারা ইংরেজদের টাকা খেয়ে মহাকাব্য লিখেছেন তারা ইংরেজদের মতোই সিরাজের চরিত্র বিকৃত করেছেন। যারা বিকৃত করেছেন তাদের রচনা কখনোই দর্শক-পাঠকের কাছে উপভোগ্য হয়নি। গিরিশচন্দ্র ঘোষ, সচীন্দ্রনাথ সেনগুপ্ত থেকে শুরু করে সিকান্দার আবু জাফর কিংবা সাঈদ আহমদ পর্যন্ত নাট্যকাররা ইংরেজদের চোখ দিয়ে সিরাজকে দেখেননি।
হর্ষ দত্ত হঠাত্ করেই আবির্ভূত হলেন ইতিহাস নিয়ে এবং ইংরেজদের সেই বস্তাপচা অভিযোগটি তুলে ধরলেন স্বাধীন ভারতের বুকে বসে। কাজী নজরুল ইসলাম পলাশীর যুদ্ধকে ইঙ্গিত করে লিখেছেন, ‘ঐ গঙ্গায় ডুবিয়াছে হায় ভারতের দিবাকর’। সেই দিবাকর তো অনেক আগেই উদিত হয়েছে ভারতে। কিন্তু দুর্ভাগ্য এই যে, হর্ষ দত্তদের মন-মগজ এখনও উপনিবেশ শাসিত। সেখানে কোনো স্বাধীনতার চিন্তা-ক্ষমতা নেই। অথবা তারা তাদের পূর্বসূরি হেমচন্দ্র-নবীনচন্দ্রের মতো সাম্প্রদায়িক বিদ্বেষের বশবর্তী হয়ে ইংরেজদের গোলামী করেই যাচ্ছেন।
অবশ্য হর্ষ দত্ত তার এই ঔপনিবেশিক মননের পরিচয় দিয়ে রেহাই পাননি। ১৭ মে ২০১১ সংখ্যা দেশ পত্রিকায় চিঠিপত্র বিভাগে সুরজিত্ দাশগুপ্ত হর্ষ দত্তের এই উত্কট বক্তব্যের যথোচিত জবাব দিয়েছেন—‘যে অল্পবয়সী সিরাজ পলাশীর যুদ্ধের আগে সবগুলি যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন, তাঁর সমরপ্রতিভাকে অস্বীকার করা যায় কীভাবে? পলাশীর যুদ্ধে তার পরাজয় কেন হয়েছিল সে কথা আমাদের জানা আছে। যারা ষড়যন্ত্র করে তাঁকে পরাস্ত করেছিলেন, তারাই তাঁর কপালে ‘অত্যাচারী’, ‘মাতাল’, ‘লম্পট’ ইত্যাদি তকমা সেঁটে দিয়েছিলেন।’
কোনো প্রকার যুক্তি-প্রমাণ তথ্য-উপাত্ত ছাড়া সিরাজের চরিত্রকে বার বার অতি উত্সাহের সঙ্গে বিকৃত করা হয়ে থাকে বিশেষ বিশেষ উদ্দেশ্যে। আর এ থেকেই প্রমাণিত হয় সিরাজ সম্পর্কে যা যা অভিযোগ করা হয় সিরাজ ছিলেন মূলত সে সবের উল্টো। তিনি মাত্র বছরাধিক শাসনকার্য পরিচালনা করেছেন। বলা চলে এই পুরো সময়টাই ইংরেজরা তাকে নানাভাবে জ্বালাতন করেছে। দেশপ্রেমিক ঈমানদার সিরাজকে কোনোভাবেই বশে আনতে না পেরে ইংরেজরা তাকে উত্খাতের সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র করে। দুর্ভাগ্যক্রমে ইংরেজ বেনিয়াদের সঙ্গে যোগ দেয় নবাবের সুবিধাভোগী স্বদেশী বেনিয়াগোষ্ঠী। কেননা, তারাও তাদের স্বেচ্ছাচারিতার পথে নবাবকে বাধা মনে করত। রবীন্দ্রনাথ কর্তৃক উল্লিখিত কর্নেল ম্যালিসনের সেই উক্তিটি স্মরণে রেখে সে কারণেই বলতে হবে, সিরাজ উদ-দৌলা কখনোই নীতির প্রশ্নে আপস করেননি। দেশপ্রেমের প্রশ্নে কাউকে ছাড় দেননি, কারও সঙ্গে প্রতারণা করেননি এবং তিনি তার নিজের ও স্বদেশের মর্যাদাকে আমৃত্যু সমুন্নত রেখেছেন। এমন একটি মহত্তর চরিত্রকে যারা বিকৃত করতে চায় তারা নিজেরাই আসলে বিকৃত অথবা বিক্রীত। এসব বিকৃত ও বিক্রীত-মস্তিষ্কের ইতিহাস সেবকদের চিনে রাখা স্বাধীনতাপ্রিয় জনগোষ্ঠীর জন্য খুবই জরুরি।
সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৬:১৩
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

জেন্ডার ও সেক্স

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৪ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৫২

প্রথমে দুইটা সত্যি ঘটনা শেয়ার করি।

২০২২ সালে প্রাথমিক শিক্ষক নিয়োগ দিতে জেলা পর্যায়ে লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়েছিল। মৌখিক পরীক্ষার ঘটনা। দুজন নারী প্রার্থী। দুজনই দেশের নামকরা পাবলিক... ...বাকিটুকু পড়ুন

আওয়ামীলীগে শুধুমাত্র একটি পদ আছে, উহা সভাপতি পদ!

লিখেছেন নূর আলম হিরণ, ২৪ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪১


বাঙ্গালীদের সবচেয়ে বড়, পুরনো ও ঐতিহ্যবাহী দল হচ্ছে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ। এই দলটির প্রতি মানুষের ভালোবাসা আছে। মানুষ এই দলের নেতৃত্বে দেশ স্বাধীন করেছে। ৭০ এর নির্বাচনে এই দলটিকে নিরঙ্কুশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

এমপি আনারের মৃত্যু এবং মানুষের উষ্মা

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:২৯


সম্প্রতি ভারতে চিকিৎসা নিতে যাওয়ার পর আনোয়ারুল আজীম আনার নামে একজন বাংলাদেশি এমপি নিখোঁজ এবং পরবর্তীতে তাকে শ্বাসরোধে হত্যার পর তার মরদেহের হাড়-মাংস আলাদা করে হাপিত্যেশ করে দেওয়া হয়।... ...বাকিটুকু পড়ুন

দোয়া ও ক্রিকেট

লিখেছেন শাহাবুিদ্দন শুভ, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৪৪


দোয়া যদি আমরাই করি
তোমরা তাইলে করবা কি?
বোর্ডের চেয়ারম্যান, নির্বাচকের
দুইপায়েতে মাখাও ঘি।

খেলা হচ্ছে খেলার জায়গা
দোয়ায় যদি হইত কাম।
সৌদিআরব সব খেলাতে
জিতে দেখাইত তাদের নাম।

শাহাবুদ্দিন শুভ ...বাকিটুকু পড়ুন

তোমার বকুল ফুল

লিখেছেন নীল মনি, ২৪ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৪

বকুল ফুলের মিষ্টি গন্ধে ভরে থাকে আমার এই ঘর। আমি মাটির ঘরে থাকি। এই ঘরের পেছন দিকটায় মা'য়ের হাতে লাগানো বকুল ফুলের গাছ৷ কী অদ্ভুত স্নিগ্ধতা এই ফুলকে ঘিরে।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×