somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আসুন, মাদকমুক্ত বাংলাদেশ গড়ি। মাদককে ঘৃণা করুন মাদকাসক্তকে নয়।

২১ শে জুন, ২০১১ রাত ১০:২৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

পুরান ঢাকার লক্ষ্মীবাজার এলাকায় একটা বুটিক শপ উদ্বোধন করতে গিয়েছি। আমার ছেলেবেলা থেকে শুরু করে জীবনের অনেকখানি সময় কেটেছে গেণ্ডারিয়ায়। প্রথমে গেণ্ডারিয়া হাইস্কুল, তারপর জগন্নাথ কলেজ, লেখালেখি শুরু করার পর বাংলাবাজারের বইপাড়াথএই ছিল জীবন। ফলে প্রচুর বন্ধু-বান্ধব, প্রচুর চেনা মানুষ ওই সব এলাকায়। আমি গিয়েছি শুনে আমার পুরনো দিনের বন্ধুরা, পরিচিতজন অনেকে এসেছে। আড্ডায়-স্মৃতিচারণায় ভালোই কাটছে সময়। এ সময় একজন ভাঙাচুরা যুবক এসে দাঁড়াল আমার সামনে। ময়লা লুঙ্গি, ছিঁড়ে ঝুলে পড়া টি-শার্ট পরা। টি-শার্টের রং ময়লার চাপে বোঝাই যায় না। কত দিন ধরে পরে আছে, কে জানে। মাথার চুল মাকড়সার জালের মতো, মুখে দেড়-দুই মাসের দাড়িগোঁফ। রোদে পোড়া শরীর থেকে, মুখ থেকে দুর্গন্ধ আসছিল। আমার দিকে হাত বাড়িয়ে বলল, ‘১০টা ট্যাকা দেন ভাই।’ সঙ্গে সঙ্গে আমার বন্ধুরা তেড়ে উঠল। এই, গেলি? গেলি এখান থেকে? ধমক খেয়েও সে যেতে চায় না। অনেকণ ঘ্যান ঘ্যান করল। বুটিক শপে আসা মহিলাদের কাছে হাত পাতল। কিন্তু কেউ তাকে একটি পয়সাও দিল না। এমন বিরক্ত হলো সবাই, শেষ পর্যন্ত মার্কেটের সিকিউরিটির লোকজন এসে তাকে সরিয়ে দিল। আমি ল করলাম, সিকিউরিটির লোকগুলো পর্যন্ত হাত দিয়ে ধরল না তাকে, হাতের ডাণ্ডা দিয়ে ঠেলে বাইরের দিকে নিয়ে গেল। আমি কিছুই বুঝতে পারছি নাথকেন ছেলেটির সঙ্গে সবাই এ রকম অমানবিক আচরণ করছে। এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম, ব্যাপারটা কী রে! বন্ধু বলল, তুই বুঝস নাই? আরে এইটা তো ‘হিরনচি’। ‘হিরনচি’ মানে হেরোইনসেবী। ড্রাগ অ্যাডিক্টেড। কথায় কথায় জানা গেল, ভালো ঘরের ছেলে। কখন কোন ফাঁকে নেশার জগতে ঢুকে গেছে, মাদকাসক্ত হয়ে উঠেছে, পরিবারের কেউ টের পায়নি। যখন অবিরাম টাকা-পয়সা চাইতে শুরু করেছে বাড়িতে, পরিবারের লোকজন যত দিন পেরেছে দিয়েছে। যখন দিতে পারেনি, তখন বাড়ির জিনিসপত্র বিক্রি করতে শুরু করেছে। পরিবারের লোকজন বাধা দেওয়ার পর চুরি করতে শুরু করেছে নিজেদের বাড়ির টুকটাক জিনিসপত্র। সেটা যখন বন্ধ হয়েছে, তখন চুরি শুরু করেছে এদিক-ওদিক। তারপর সরাসরি মানুষের কাছে হাত পাতা। মানুষ তাকে নেশাখোর হিসেবে জেনে গেছে। তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য, অবহেলা, মারধরথসবই চলছে তার ওপর। এ শুধু ওই এক যুবকের জীবনের ঘটনা নয়, এ রকম ঘটনা এখন দেশের লাখ লাখ যুবকের জীবনে ঘটছে। মাদক ধ্বংস করে দিচ্ছে তাদের। যে পরিবারের একটি ছেলে মাদকে আসক্ত হয়েছে, ভেতরে ভেতরে সম্পূর্ণ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে সেই পরিবারটি। অনেক পরিবারের অভিভাবক লজ্জায় কারো কাছে বলতেও পারছে না, তার ছেলেটি মাদকাসক্ত। ছেলের জীবন তো ধ্বংস হচ্ছেই, পরিবারের প্রতিটি মানুষই ধ্বংস হতে বসেছে। নানা কাজে আমার কাছে ছেলেমেয়েরা অনেকে আসে। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতে পড়া একটি মেয়ে এসেছিল নাটকে অভিনয়ের জন্য। কথায় কথায় জানলাম, তারা বেশ অবস্থাপন্ন ছিল। বাবা ভালো ব্যবসায়ী, কিন্তু একমাত্র ভাইটি মাদকাসক্ত। তিলে তিলে পরিবারটি শেষ করে দিচ্ছে সে। নানা রকমভাবে চেষ্টা করা হয়েছে তাকে ওই ভয়ংকর জগৎ থেকে ফিরিয়ে আনার। মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্রে দেওয়া হয়েছে অনেকবার। কিছুদিন থেকে ফিরে আসে। সবাই মনে করে, ভালো হয়ে গেছে। দুদিন পর দেখা গেল, সেই আগের চেহারা।
এখন যুবকটির অবস্থা এমন, যখন-তখন মারা যাবে সে। কিছুদিন আগে এক ভয়ংকর কাণ্ড ঘটে গেল ঢাকায়। মা খুন করালেন মাদকাসক্ত ছেলেকে। এ কাজে মাকে সাহায্য করল ডাক্তারি পড়া মেয়ে। সমগ্র জাতি শিউরে উঠেছে এ ঘটনা জেনে। মাদকাসক্ত ছেলেকে পুলিশের হাতে তুলে দেওয়ার ঘটনা প্রায়ই শুনি আমরা। কিন্তু মা খুন করালেন ছেলেকে, বোন খুন করাল ভাইকেথএ রকম ঘটনা এর আগে কখনো ঘটেনি। ঘটনার বিবরণ পড়ে আমি আঁতকে উঠেছি। কেন খুনের পথ বেছে নিলেন মা? মেয়ে কেন তাঁকে সাহায্য করল? এ পথে না গিয়ে তাঁরা কি উল্টো পথটা ধরতে পারতেন না? স্নেহ-মমতা, আদর-ভালোবাসা, মানসিক প্রশান্তি, চিকিৎসা এবং যত রকমের সহায়তা একজন মাদকাসক্তকে দিলে ওই আত্মবিধ্বংসী জগৎ থেকে সে ধীরে ধীরে ফিরতে পারে, তার ফিরে আসার পথটা তৈরি করে দিলে, ক্রমাগত চেষ্টা করে গেলে কি সে স্বাভাবিক জীবনে কোনো না কোনোদিন ফিরে আসত না? নিশ্চয়ই আসত। চেষ্টা করলে হবে না কেন? ধৈর্য, একাগ্রতা, মায়া-মমতা-ভালোবাসা নিয়ে একজন মাদকাসক্তর পাশে দাঁড়ালে কোনো না কোনোভাবে তাকে শোধরানো যাবেই। সুস্থ-স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনা যাবেই। পৃথিবীর বহু দেশ বহুবার আক্রান্ত হয়েছে মাদকে। পরিবারের সহযোগিতায়, দেশের মানুষের সহযোগিতায়, সরকারের সহযোগিতায়, প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সহযোগিতায় ওই ভয়ংকর ছোবল থেকে অনেকখানি মুক্ত হয়েছে সেই সব দেশ। সত্তরের দশকের শেষ দিকে জার্মানিতে ভয়ংকর থাবা বসিয়েছিল ড্রাগ। বার্লিনের ‘জু’ স্টেশনের আশপাশটা ছিল ড্রাগ অ্যাডিক্টেডদের স্বর্গ। জার্মানির একজন চলচ্চিত্র পরিচালক একটি ছবি তৈরি করলেন এ বিষয় নিয়ে। ছবিটির ইংরেজি নাম ‘উই চিলড্রেন ফ্রম জু স্টেশন’। জার্মানি তো বটেই, সারা পৃথিবী আঁতকে উঠল সেই ছবি দেখে। জার্মান জনগণ এবং সরকার সচেতন হলো। একটার পর একটা মাদকাসক্ত নিরাময় কেন্দ্র খুলে যত দ্রুত সম্ভব পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে নিয়ে এল তারা। আসলে পজিটিভ মনোভাব সবচেয়ে জরুরি। আমরা মাদককে ঘৃণা করব, মাদকাসক্তকে না। মাদকের কাছে অসহায় হয়ে যাওয়া মানুষটিকে নয়। আসুন, আমরা মাদককে যত রকমভাবে সম্ভব, তত রকমভাবে প্রতিহত করি। সরকার এবং জনগণ এক হয়ে এই ভয়াবহ দৈত্যের হাত থেকে দেশটিকে, দেশের মানুষকে, বিশেষ করে যুবসমাজকে রা করি। আমাদের আর একটি সন্তানও যেন মাদকে আসক্ত না হতে পারে। যারা এরই মধ্যে আসক্ত হয়ে গেছে, তাদের প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ না করে, তাদের যত রকমভাবে সম্ভব সহায়তা দিই। তাদের পাশে দাঁড়াই। তাদের ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করি সুন্দর-সুষ্ঠু জীবনে।
সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১১ রাত ১০:৩০
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

মৃত্যু ডেকে নিয়ে যায়; অদৃষ্টের ইশারায়

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৭ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৩৯

১৯৩৩ সালে প্রখ্যাত সাহিত্যিক উইলিয়াম সমারসেট মম বাগদাদের একটা গল্প লিখেছিলেন৷ গল্পের নাম দ্য অ্যাপয়েন্টমেন্ট ইন সামারা বা সামারায় সাক্ষাৎ৷

চলুন গল্পটা শুনে আসি৷

বাগদাদে এক ব্যবসায়ী ছিলেন৷ তিনি তার... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিরে এসো রাফসান দি ছোট ভাই

লিখেছেন আবদুর রব শরীফ, ১৭ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৩৮

রাফসানের বাবার ঋণ খেলাপির পোস্ট আমিও শেয়ার করেছি । কথা হলো এমন শত ঋণ খেলাপির কথা আমরা জানি না । ভাইরাল হয় না । হয়েছে মূলতো রাফসানের কারণে । কারণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুমীরের কাছে শিয়ালের আলু ও ধান চাষের গল্প।

লিখেছেন সোনাগাজী, ১৭ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৪০



ইহা নিউইয়র্কের ১জন মোটামুটি বড় বাংগালী ব্যবসায়ীর নিজমুখে বলা কাহিনী। আমি উনাকে ঘনিষ্টভাবে জানতাম; উনি ইমোশানেল হয়ে মাঝেমাঝে নিজকে নিয়ে ও নিজের পরিবারকে নিয়ে রূপকথা বলে... ...বাকিটুকু পড়ুন

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×