somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

একদিন, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর

২১ শে জুন, ২০১১ সকাল ১০:৪৮
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দামোদর নদের পাড়ে একখানি গৃহস্থবাড়ি। গৃহস্বামীর নাম বনমালী । গৃহিণীর নাম আরতি । বৈশাখের আকাশ মেঘাচ্ছন্ন হয়ে উঠছে দেখে উঠানে কাপড় তুলতে এল আরতি । হঠাৎ একবার নদীর ধারে চোখ গেল আরতির। নদীর পাড়ে কে একজন দাঁড়িয়ে রয়েছে। পোশাক-আশাকে শহুরে বাবু বলেই মনে হল।
আরতি দৌড়ে স্বামীর কাছে চলে এল।
উঠানের গাছপালায় পাগলা হাওয়ার শনশন শব্দ উঠেছে। ‘হট,’ ‘হট’ শব্দ করে গরু-বাছুর তাড়িয়ে গোয়ালে তুলছিল মধ্যবয়েসি বনমালী।
আরতি স্বামীর কাছে এসে বলল, এখুনি একবার লদীর পাড়ে যাও।
কেন গা? কি হয়েছে?
হাওয়া দামাল হয়ে উঠেছে বলে আরতি চিৎকার করে বলল, লদীর পাড়ে কে যেন দাঁড়িয়ে রয়েছ। শহুরে বাবু বলে পেরেততয় (প্রত্যয়) হয়। ওদিকে ঝড় উঠিছে। যাও, বাবুকে ঘরে ডেইকে নিয়ে এস গে যাও।
বনমালী গরু-বাছুর ফেলে নদীর পাড়ে ছুটল।
দামোদর নদের তীরে পৌঁছে ঈশ্বরচন্দ্রের কপালে ভাঁজ পড়েছিল। শূন্য ঘাট। ঘাটে পারাপারের জন্য একটিও খেয়া নৌকা নেই। বৈশাখ মাস অতিক্রান্ত হতে চলেছে । বৈশাখের আকাশে কালো মেঘের স্তর দ্রুত ছড়িয়ে পড়েছে। সেই সঙ্গে এলোমেলো ঝড়ো হাওয়া বইতে শুরু করেছে। ঝড় ওঠার সমূহ সম্ভাবনা। কলিকাতা থেকে গতকাল রাত্তিরে যাত্রা করেছেন ঈশ্বরচন্দ্র । রেলপথে বিলম্ব হল। তখন কে জানত যে এমন ঘোর দুর্যোগে পড়তে হবে। নদীর ঘাটে পৌঁছতে-পৌঁছতে দুপুর গড়াল। এখন ঝড় উঠলেই সর্বনাশ। ঈশ্বরচন্দ্র জানেন বৈশাখি ঝড়ের সময়ে দামোদর নদ অত্যন্ত বিক্ষুব্দ এবং উত্তাল হয়ে ওঠে।
যে করেই হোক, আমাকে নদী পেরোতেই হবে। ঈশ্বরচন্দ্র অস্ফুটস্বরে বললেন।
বনমালী দৌড়ে এসে ঈশ্বরচন্দ্রের কাছে দাঁড়াল। রীতিমতো হাঁপাচ্ছে লোকটা। বলি, ও কর্তা, ঝড় উঠিছে যে। ঝড় না-থামা অব্দি এই গরীব-দুঃখীর বাড়ি পায়ের ধুলো দিন না কেন?
নদী পাড়ের আলো-আঁধারিতে মধ্যবয়েসি লোকটিকে দেখলেন ঈশ্বরচন্দ্র । স্থানীয় লোক বলেই মনে হল। অতি সাধারণ কালো রঙের শীর্ণ চেহারা । খালি গা, ধূতি পরে আছে। ভাঙা গালে খোঁচা খোঁচা দাঁড়ি।
ঈশ্বরচন্দ্র মাথা নেড়ে বললেন, নাঃ। আমাকে যে করেই হোক নদী পেরুতেই হবে।
কিন্তু, আপনি কেমন করি এ পাগলা লদী পাড়ি দেবেন কর্ত? বনমালী আর্তনাদ করে উঠল।
সে রকম হলে নদী সাঁতরে পাড় হব। ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের কন্ঠস্বরে দৃঢ় প্রত্যয়।
বনমালীর চোখ দুটি যেন কোটর থেকে বেরিয়ে এসে কপালে ঠেকল। বলছেন কি কর্তা! এ যে বড় রাক্ষুসী লদ! তুফান উঠলি এ লদ সাঁতরে পাড় হবেন কি করে গো কর্তা!
ঈশ্বরচন্দ্র চিন্তিতভাবে মাথা নাড়লেন । তিনি জানেন জোর তুফান এলে নদের ঢেউ জল পাহাড় সমান হয়ে উঠবে। তখন ক্ষরস্রোতা নদে সাঁতার কাটা মানেই যমে মানুষে টানাটানি। তাঁর মুখেচোখে দুশ্চিন্তার প্রগাঢ় ছাপ পড়ল। ক্ষণিকের জন্য মায়ের মুখখানিও ভেসে উঠল। ঈশ্বরচন্দ্রের মা অতি সত্ত্বর দেখা করার জন্য পুত্রকে সংবাদ পাঠিয়েছেন। মায়ের মুখখানি স্মরণ হওয়ায় নির্ভয় বোধ করেন ঈশ্বরচন্দ্র । কয়েক পা এগিয়ে নদীর পাড় ঘেঁষে দাঁড়ালেন। বনমালীর বুক কেঁপে উঠল। এখানে পাড়টি বেশ উঁচু । জল অনেক নীচে। ঈশ্বরচন্দ্র শ্বাস টানলেন।
আরতি উঠান থেকে কাপড় তুলে ঘরে রেখে আবার উঠানে এসে দাঁড়িয়েছিল। স্বামীর দেরি দেখে বুক কাঁপছে। নারীর মন। দৌড়ে নদীর পাড়ে যেতে থাকে আরতি । তখন অন্ধকারে ছেয়ে যাচ্ছিল নদীর দু-পাড়ের চরাচর আর দূরের আবছা দিগন্ত । নীলাভ কালো আকাশে ঘন ঘন ঝলসে উঠছিল বিদ্যুতের রূপালি রেখা। অস্থির হয়ে উঠছিল ঝড়ো হাওয়া। ঘরমুখো ভয়ার্ত গরু তুলছিল ‘হাম্বা’ রব ।
ঈশ্বরচন্দ্রের সামনে এসে দাঁড়াল আরতি। তারপর লম্বা ঘোমটা টেনে করুণ স্বরে বলল, মিনতি করি, বাবু। আপনি এ বেলাটি গরীবের ঘরে আশ্রয় নিন। সর্বনাশা ঝড় উঠল বলে।
ঈশ্বরচন্দ্র উদ্বিগ্ন নারীকে এক পলক দেখলেন। তারপর দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, উপায় নেই মা। আমার মা আমাকে স্মরণ করেছেন। পথে এমনিতেই অহেতুক বিলম্ব হয়েছে। যে করেই হোক আমায় এ বেলা নদী পেরুতেই হবে।
আরতি আর্তনাদ করে উঠল, কিন্তু ... কিন্তু আপনি কি ভাবে এই সর্বনাশা লদ পাড়ি দিবেন বাবু?
আরতি এবং বনমালীর বিস্মিত চোখের সামনে ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগরের শ্যামল দেহখানি শূন্যে উঠে যায়। তারপর সে দেহখানি শূন্যেই দু’বার পাক খায়। কৃষ্ণবর্ণের আকাশের পটভূমিতে সে এক আশ্চর্য দৃশ্যের অবতারনা হল বটে। তারপর সে মাতৃভক্ত পুত্রের দেহখানি দ্রুত কালো হয়ে ওঠা দামোদর নদীর উত্তাল জল নির্ভয়ে স্পর্শ করে ...
সর্বশেষ এডিট : ২৭ শে জুন, ২০১১ সকাল ৭:৩৬
১৩টি মন্তব্য ১৩টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

তাঁর বোতলে আটকে আছে বিরোধী দল

লিখেছেন মহাজাগতিক চিন্তা, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:০৭



সেই ২০০৯ সালে তিনি যে ক্ষমতার মসনদে বসলেন তারপর থেকে কেউ তাঁকে মসনদ থেকে ঠেলে ফেলতে পারেনি। যারা তাঁকে ঠেলে ফেলবে তাদের বড়টাকে তিনি বোতল বন্দ্বি করেছেন।... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?

লিখেছেন জিএম হারুন -অর -রশিদ, ১৬ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৪



কেউ কি আমার বন্ধু শাহেদের ঠিকানা জানেন?
আমার খুবই জরুরি তার ঠিকানাটা জানা,
আমি অনেক চেষ্টা করেও ওর ঠিকানা জোগাড় করতে পারছিনা।

আমি অনেক দিন যাবত ওকে খুঁজে বেড়াচ্ছি,
এই ধরুণ, বিশ-একুশ বছর।
আশ্চর্য্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা:কথায় কথায় বয়কট এর ডাক দেয়া পিনাকীদের আইডি/পেইজ/চ্যানেল বাংলাদেশে হাইড করা উচিত কি? ব্লগাররা কি ভাবছেন?

লিখেছেন লেখার খাতা, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১২:১৩



অপূর্ব একজন চমৎকার অভিনেতা। ছোট পর্দার এই জনপ্রিয় মুখকে চেনেনা এমন কেউ নেই। সাধারণত অভিনেতা অভিনেত্রীদের রুজিরোজগার এর একটি মাধ্যম হইল বিজ্ঞাপনে মডেল হওয়া। বাংলাদেশের কোন তারকা যদি বিদেশী... ...বাকিটুকু পড়ুন

×