আকাশ আর আমার সর্ম্পকটা যেন ছিল পুরোই ছেলেমানুষী মাখা।সূর্য অস্ত যাবার সময় আকাশ ওকে বিদায় জানাত, তার কপাল জুড়ে থাকত অনেক বড় সোনালী লাল টিপ।বৃষ্টির দিনে আকাশটা নীলচে সাদা শাড়িতে সেজে সলাজ চোখে আমার সামনে এসে দাঁড়াত।আকাশ যে রূপেই নিজেকে সাজাত আমি তাতেই ছিলাম গুণমুগ্ধ।জানলাবন্দী সেই আকাশটা ছিল একান্তই আমার নিজস্ব।
আমি বিছানায় বসে জানলায় মাথা রেখে অবাক হয়ে আকাশ দেখতাম,বর্ষপুরাতন আকাশটাকে আমার চোখ যেন প্রিয় কাউকে দেখার আবেগ নিয়ে আবিষ্কার করত।প্রথম দেখার অনুভূতি যেমন কখনই পুরনো হয় না তেমনি আমার আর আকাশের মাঝে যে সর্ম্পক তাও কখনও পুরনো হত না।প্রতিটা দেখায় আমরা যেন নিজেদেরকে আরো গভীরভাবে আবিষ্কার করতাম।আরো গভীর হত আমাদের আত্ত্বিক যোগাযোগ।
সেই আকাশের মেঘগুলো হঠাৎ হঠাৎ আকাশের সাথে অভিমান করত,তাইতো আকাশ থেকে মাঝে মাঝে অঝোর ধারায় অশ্রু হয়ে মেঘের অভিমান ঝরে পড়ত।মান-অভিমান এক সময় শেষ হত কখনো অল্প সময় লাগত কখনও বা একটু বেশি।আমার আকাশ আবার শিশুর সারল্যে হেসে উঠত!
কখনও খুব ভোরে আকাশ জেগে উঠার আগেই ঘুম ভাঙত আমার।আমি বাইরে তাকিয়ে দেখতাম কাল আকাশ ধীরে ধীরে কিভাবে ধূসর,ধূসর থেকে নীল হয়ে আড়ঁমোড়া ভেঙে জেগে উঠত।অবাক আমি দেখতাম এক আকাশের এত রং!!যেন আকাশটা পাগলাটে কোন অস্থির শিল্পীর ক্যানভাস।
আমি যেমন সাক্ষী ছিলাম আকাশের মান-অভিমানের আকাশও তেমনি সাক্ষী ছিল আমার একাকীত্বের।কারণছাড়া মন খারাপের বিকেলগুলোতে খুব অস্থির লাগত,তখন আকাশ দেখতাম উদাস হয়ে।আকাশের মেঘগুলো কেমন করে জানি বুঝে যেত আমার মন বিষন্ন।ওরা আমাকে হাসানোর জন্য উঠে পড়ে লাগত।ওরা লুকোচুরি খেলত আমি দেখতাম।ছোট ছোট দুষ্ট মেঘগুলো মায়ের আচঁলের নিচে লুকিয়ে যেত,আমার চোখ ইতিউতি ওদেরকে খুঁজে বেড়াত।খুঁজে খুঁজে যখন হাল ছেড়ে দিতাম ছোট্ট মেঘ তখন মায়ের আচঁল থেকে বের হয়ে এসে হেসে বলত,পাগল মেয়ে এই তো আমি এখানে।দুষ্ট মেঘের স্বর্ণালী হাসি দেখে হাসি ফুটত আমার মুখেও।এমনটাই ছিল আমাদের সর্ম্পকের সরলতা।সুখে-দুঃখে ছিলাম হৃদয়ের খুব কাছে।
নিঃসঙ্গ রাতে শহরের নিয়ন আলো আর আমি জেগে থাকতাম নির্ঘুম।আকাশের চোখ জুড়ে তখন রাজ্যের ক্লান্তি,ঘুমের ছড়াছড়ি।আকাশ ঘুমাত কিন্তু আমার সঙ্গী করে রেখে যেত এক দঙ্গল তারাকে।আকাশের বুকে মাথা রেখে তারারা একবার জ্বলত একবার নিভত।বুঝে নিতাম নির্ঘুম নগরীতে একা আমি নই জেগে আছে অসংখ্য তারাও।সব তারার মাঝে একটি তারা ছিল আমার অন্যরকম কাছের,অন্ধকার রাতে সে ছিল আমার সার্বক্ষণিক সঙ্গী।প্রতিদিন ওকে খুঁজে পেতাম ঠিক আমার জানলা সোজা আকাশের বুকে।তারাটি আমার সঙ্গী ছিল সুর্দীঘ নয়টি বছর!
সময়ের বির্বতন কিংবা সভ্যতার অগ্রগতি এই শব্দগুলোকে কেন যেন আমার অনেক বেশি নির্দয় মনে হয়।এরা আমাদের যতটা উদার হয়ে দেয় তার চেয়েও বেশি কেড়ে নেয় যেন।সময়ের আগ্রাসন আমার আকাশটাকেও শেষ পর্যন্ত ছাড় দেয় না।সভ্যতার প্রয়োজনের দোহাই দিয়ে আমার আকাশ ছুঁয়ে জম্ম নেয় বহুতল অট্টালিকা।অট্টালিকাগুলো নিজেদের মধ্যেই প্রতিযোগীতা করে কে কত উপরে উঠে আমার আকাশটাকে দখল করবে।পনের-বিশ-পচিঁশ তলা অট্টালিকাগুলো খুব সহজেই অবরুদ্ধ করে দেয় আমার খুব কাছের সঙ্গী জানলাবন্দী আকাশটাকে!
কেন জানি মনে হয় বাঙালীর এত এত উৎসবের সাথে অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আরো একটি নতুন উৎসব যুক্ত হবে ‘আকাশ দেখা উৎসব’।আবেগ নিংড়ে নেওয়া সমাজে যে নতুন প্রজম্ম বেড়ে উঠছে তারা হয়ত ৩৬৫ দিনের যে কোন একটি দিন বিশাল খোলা প্রান্তরে উপস্থিত হবে,বাবা তার শিশুটিকে আকাশ দেখাবেন,মেঘ চিনাবেন।কিশোরী মেয়ে দুহাত মেলে আকাশের নিচে দাঁড়িয়ে বৃষ্টি ছুঁবে।হয়ত তারা তখন উপলব্ধি করতে পারবে বড় বড় অট্টালিকা বাস করে আকাশের যত কাছেই থাকা যাক না কেন,কিছু কিছু জিনিসের আসল সৌন্দর্য ফুটে উঠে দূর থেকে,কাছ থেকে নয়!
অখন্ড অবসরে বসে বসে যে আকাশে উড়ে যাওয়া পাখি গুনতাম আমি একটা-দুটা-তিনটা….সেই আকাশ জুড়ে আজ শুধু বেদনার হাহাকার।আমার জানলা থেকে আজও আকাশ দেখা যায়-এক ফালি বির্বণ আবেগহীন আকাশ!আর তাই প্রিয় সঙ্গী হারানোর কষ্ট নিয়েই আমার জানলাবন্দী আকাশের স্মৃতি তোলা থাকে সময়ের খাতায় অতীত হয়ে খুব যত্নে,খুব আবেগ নিয়ে।
সর্বশেষ এডিট : ১৭ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:০১