somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

বিএম বরকতউল্লাহ
পড়াশোনা করি। লেখালেখি করি। চাকরি করি। লেখালেখি করে পেয়েছি ৩টি পুরস্কার। জাতিসংঘের (ইউনিসেফ) মীনা মিডিয়া এ্যাওয়ার্ড ২০১১ ও ২০১৬ প্রথম পুরস্কার। জাদুর ঘুড়ি ও আকাশ ছোঁয়ার গল্পগ্রন্থের জন্য অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০১৬।

লেবু মিয়ার পা সমাচার

১৬ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:২৫
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

এক যে আযব দেশ। সেই দেশে সময়-সুযোগ মতো সত্য আর মিথ্যা হাত ধরাধরি করে চলে। একের সাথে অন্যের বেজায় খাতিরও হয়ে। যেখানে সত্য সেখানে মিথ্যা। আবার শক্রুতাও হয়। সত্য মাথা উচু করে দাঁড়াতে চাইলে মিথ্যা সেখানে গিয়ে লঙ্কাকাণ্ড বাধায়। সুযোগ পেলেই, সত্যকে মিথ্যার আবরণে ঢেকে ফেলতে চায়।

সত্য-মিথ্যার সাথে খাতির হয়ে গেলে রাজ্যে আর শান্তিও থাকে না; স্বস্তিও থাকে না। সত্য সত্যের মতো করে চলতে-বলতে পারে না। আবার মিথ্যাও মিথ্যার মত করে চলতে-বলতে পারে না। পদে পদে বাধা। মিথ্যা কোথাও গিয়ে যদি বেশাতি করতে চায় সেখানে সত্য গিয়ে বিরাট হাঙ্গামা শুরু করে দেয়। কী এক অদ্ভুত অবস্থা। কিন্তু এভাবেই চলছে একটা রাজ্য। রাজ্যের নামই হলো ”সত্যমিথ্যা রাজ্য”।

তো এ রাজ্যে একটা ঘটনা ঘটে গেল। এ রাজ্যে বাস করে লেবু মিয়া নামে এক গরিব লোক। হঠাৎ একদিন সে বলতে লাগল, তার নাকি একটা পা খোয়া গেছে। কয়েকজন লোক তার দেহ থেকে পা বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছে। তাকে হাসপাতালে নেয়া হলো। রক্তে নদানদী। রাজ্যময় পড়ে গেল হাহাকার। হায় হায় কয় কি? পা আবার খোয়া যায় ক্যামনে। পা নিল কে?

লোকজন এলো ছুটে। লেবু মিয়া কেঁকিয়ে বলে, দেখেন, দেখেন আমার অবস্থা। পা একটা নেই। কষ্টে আমার কলজে ফেটে যাচ্ছে। কয়েকজন চুপি দিয়ে মাথা ঘুরিয়ে ভাল করে চেয়ে দেখল, সত্যিই লেবু মিয়ার একখান পা নেই।

কষ্টের সীমা নেই লেবুর। গরিব ঘরের ছেলে লেবু মিয়া পঙ্গু হয়ে গেল চিরদিনের জন্য। তার কান্না দেখে লোকেরাও কাঁদে। তার হতদরিদ্র মা-বাবা বুক চাপড়ে কান্নাকাটি করে আর বলে আমার এ নিরীহ সন্তানের কী এমন অপরাধ ছিল, কেন কেড়ে নিল তার পা। এখন কী হবে গো আমাদের। আমার ছেলের জীবনটাই শেষ করে দিল। কীভাবে চলবে-ফিরবে সে, কীভাবে বাঁচবে এই অভাবী সংসার। কেউ তার জবাব দিতে পারে না।

কয়েকজন বলল¬, কে এভাবে তোর পা-টা নিয়ে চিরদিনের জন্য পঙ্গু করে দিল রে লেবু। লেবু সব কথা খুলে বলল। কিন্তু লোকেরা শুনলেই কি আর বিশ্বাস করলেই বা কি। রাজার লোকেদের তো শুনতে হবে, দেখতে হবে, তারপর বিশ্বাস করবে। পরেই না বিচার আচার।
লেবু মিয়া পঙ্গু হয়ে হাসপাতালে পড়ে কাৎরায়।

লেবু মিয়ার পা খোয়া যাওয়ার ঘটনাটি বাতাসের আগে চাউর হয়ে গেল রাজ্যময়। সবাই করে হায় হায়। যারা এই নিষ্ঠুর কাজ করেছে তাদের হতে হবে বিচার। খবর গেল রাজার কাছে।

সবাই আশায় বুক বেধে আছে, এ সংবাদ রাজার কানে যাওয়ামাত্র ছুটে আসবেন রাজা। সহানুভূতি জানাবেন, সুষ্ঠু চিকিৎসা করাবেন, ক্ষতিপূরণ দিবেন। দোষীদের সাজা দিবেন। লেবু মিয়ার সীমাহীন কষ্ট একটু হলেও লাঘব হবে।

রাজা বলেন, তোমরা মুখে বললেই তো হবে না। আমার লোক লস্কর দিয়া এটা তদন্ত-ফদন্ত করে দেখতে হবে আগে, তোমাদের গল্পটা আসলেই সত্য না মিথ্যা।

রাজার লোকজন এল ছুটে। তারা লেবু মিয়াকে খুটিয়ে খুটিয়ে দেখল। তারা এসব দেখেটেখে কাগজে লিখল। আশেপাশের মানুষের নাম ঠিকানা আর স্বাক্ষী নিল। সবাই বলল, লেবু মিয়ার পা খোয়া গেছে। এর সঠিক বিচার যেন হয় মশাই।

সবকিছু ঠিকঠাক। সত্য মনে মনে খুশি হয়ে বলে যাক, এবার জয় হবে সত্যের।
খালি কথা হয়; কাজের কাজ হচ্ছে না কিছুই। ব্যাপার কি?

সমস্যা হলো, তদন্তে খালি চলে আসে রাজার লোকেদের নাম। যে তদন্তে রাজার লোকেদের নাম এসে যায়, সেটা বিশ্বাস করা কি এত সোজা!

মিথ্যারাজ্যে সত্যকে সত্য বলে সোজা থাকা এত সহজ না। তদন্ত আরো করতে হবে। কঠিন তদন্ত।
বারবার তদন্ত হয়। অনেক কাগজপত্র খরচ হয়। কিন্তু লেবু মিয়ার হয় না কিছুই। দিনে দিনে বেড়ে চলেছে লেবুর কষ্ট।

তারপর এল এক পাওয়ারফুল তদন্ত কমিটি। লেবু মিয়ার দুর্গতি দেখে এক তদন্তকর্তা ঠিক থাকতে পারলেন না, ঝরঝর করে কেঁদে ফেললেন।

তদন্ত-ফদন্ত গেল রাজার কাছে। সেখানে মিথ্যা গিয়ে হাজির হলো। রাজাকে নয়ছয় বুঝায়।
রাজা বললেন, এখানে রাজার লোকেদের নাম দেখছি কেন? তদন্ত ঠিক হয়নি।

সত্য উকি মেরে বলে, কী বলেন রাজামশাই এগুলি। সবকিছু দেখেটেখে, লোকজনের সামনে সত্যটাই তো লিখে নিয়ে এলাম। এটা আবার মিথ্যা হয় কীভাবে।

রাজা ধমক মেরে বললেন, তাহলে তুমি বলতে চাচ্ছ, আমার রাজ্যে মিথ্যারাও এখন মিথ্যা বলা শিখেছে আর তোমরাও সত্য বলা শিখছ, তাই না?
মিথ্যাতো জীবনেও সত্য বলে না রাজামশাই। সে তো আমার পেছনে লেগেই আছে। তার কথা বিশ্বাস করবেন না দয়া করে।
তোমার এত বড় সাহস, মিথ্যার ওপর মিথ্যা অপবাদ দিচ্ছ? তুমি কতটা সত্য তাতে সন্দেহ থাকতে পারে কিন্তু মিথ্যার ওপর আমার ষোলোআনা ভরসা আছে। যাও। পরে দেখব এর আসল কাহিনীটা কি।

লেবুমিয়ার অবস্থা খুব খারাপ। তার ভাল চিকিৎসা নেই। পেটে খাবার নেই। গরিব পিতামাতা যোয়ান পুত্রের পঙ্গুত্ব দেখে বুক চাপড়ে কান্না করে সারাদিন।

কয়েকটা সত্য এসে লেবু মিয়াকে শান্ত্বনা দেয়। বলে, দুঃখ করিসনারে লেবু। সত্যের জয় একদিন হবেই। কিন্তু যন্ত্রণাকাতর লেবুর আর সহ্য হয় না। চারিদিকে হাহাকার। প্রচণ্ড কষ্টে কেঁকিয়ে উঠে লেবু।

এতদিনে এত এত লোক এতকিছু করেও রাজাকে বিশ্বাস করাতে পারল না যে লেবু মিয়া পঙ্গু; লেবুর পা খোয়া গেছে। বিশ্বাস করাতে পারলে তার কিছু সুবিধা হতো। যারা পা নিয়ে গেল তাদের বিচার আচার হতো। কিন্তু সত্য যে মিথ্যার সাথে পেরে উঠছে না।
এ নিয়ে নত্য আর মিথ্যার সাথে বিরাট গণ্ডগোল। সত্য মিথ্যায় টানাটানি।

এসব টানাটানিতে লেবু মিয়ার অবস্থা আরো খারাপ হয়ে যাচ্ছে। সত্যেরা নানা ভাবে, নানা কর্মসুচি দিয়ে রাজাকে বুঝাতে চাইছে যে, লেবু মিয়ার একটা পা সত্য সত্যই খোয়া গেছে।

রাজা ও তার লোকেরা এটা বিশ্বাসই করে না। বরং মনে করে লেবু মিয়া মিথ্যা পা-হারানোর গল্প বলে রাজার ও তার লোকেদের মানহানি করছে। তাই তার বিরুদ্ধে হয়ে গেল মোটা মোটা কয়েকটা মামলা। লেবু মিয়া আদৌ ভাল লোক না। সে একটা পয়মাল। সে সন্ত্রাসী, চোর, ডাকাত, ভয়ংকর প্রজা। এ মিথ্যাটাকে মিথ্যা সত্য বলে চালিয়ে দিল। লেবু মিয়ার দুঃসহ জীবনে যোগ হয়ে গেল আরো কতগুলো যন্ত্রণা, নির্মম যন্ত্রণা। হাসপাতাল থেকে আদালতে, কোর্টে, থানায় ছুটে চলেছে ক্রেচে ভর করে পঙ্গু লেবু মিয়া। মিথ্যারা লেবু মিয়ার শরীরের সমস্ত রস-কস নিংড়ে বের করে ফেলছে। আর বেঁচে থাকতে চায় না লেবু। সে সবকিছু বাদ দিয়ে এখন চায় শুধু মৃত্যুর আয়োজন।

শেষে সত্যেরা বিশাল জনসভার আয়োজন করছে লেবু মিয়ার পক্ষে। সমব্যথী মানুষের ঢল নেমেছে জনসভায়। বিশাল জনসভা। মঞ্চে দাঁড়িয়ে মাইকে গলা ফাটিয়ে বক্তারা বলছে, লেবু মিয়ার পা হারানোর দুঃসহ কষ্টের কথা। রাজার দৃষ্টি আকর্ষণের কথা। তারা এর প্রতীকার চাইছে। রাজা এর কিছু করছে না দেখে কান্নায় ভেঙ্গে পড়ল কেউ কেউ।

এমন সময় লেবু মিয়া সেখানে গিয়ে উপস্থিত হলো। দুই বগলতলায় দুটি ক্রেচে ভর করে কাঁপতে কাঁপতে সে অনেক কষ্ট করে মঞ্চে গিয়ে দাাঁল। তার যবুথবু মরমর চেহারাটা দেখেই বোজা যায় সে কত বড় দানবের সাথে লড়াই করতে করতে প্রায় শেষ হয়ে গেছে। লেবু মিয়া এগিয়ে গিয়ে বক্তার মুখ থেকে টান মেরে মাউথপিচটা হাতে নিল। তার কোটরাগত চোখ দিয়ে সামনের অসংখ্য জনতার দিকে একবার তাকাল।
এবং বলল, ভাইসব আমার জন্য আপনারা বহুত কষ্ট করছেন। আর করা লাগবে না। এতদিন আমি যা বলেছি, তার সব মিথ্যা, সব মিথ্যা বলেছি আমি।

সামনের জনতার অসংখ্য চোখ বিষ্ফারিত হয়ে গেল। তারা চিৎকার করে বলল, কি কইতাছ লেবু মিয়া। আমরাতো দুই চোখ দিয়া দেখতাছি, তোমার এক পা নাই। কি হাল হয়েছে তোমার। তুমি এখন হঠাৎ কইরে মিথ্যা কথা বলতেছ কেন?

আমি মিথ্যা বলছি না, মিথ্যা বলছেন আপনারা। আমি একদম ভাল আছি, একদম ভাল। আমার পা খোয়া যায়নি, আমার পা খোয়া যায়নি... বলে উদাস নয়নে শূণ্য আকাশের দিকে তাকাল এবং ক্ষীণকণ্ঠে বলল, মুক্তি দাও প্রভূ, মুক্তি দাও। তারপর লেবু মিয়া হাঃ হাঃ হাঃ, হুঃ হুঃ হুঃ করে হাসতে হাসতে, কাঁদতে কাঁদতে জনসমুদ্রে অবলিলায় হারিয়ে গেল!



















০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

গাজার যুদ্ধ কতদিন চলবে?

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৮ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৩

২০২৩ সালের ৭ অক্টোবর ইসরাইলে হামাসের হামলার আগে মহাবিপদে ছিলেন ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেঞ্জামিন নেতানিয়াহু৷ এক বছর ধরে ইসরায়েলিরা তার পদত্যাগের দাবিতে তীব্র বিক্ষোভে অংশ নিয়েছিলেন৷ আন্দোলনে তার সরকারের অবস্থা টালমাটাল... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্যামুয়েল ব্যাকেট এর ‘এন্ডগেম’ | Endgame By Samuel Beckett নিয়ে বাংলা ভাষায় আলোচনা

লিখেছেন জাহিদ অনিক, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৮



এন্ডগেম/ইন্ডগেইম/এন্ডগেইম- যে নামেই ডাকা হোক না কেনও, মূলত একটাই নাটক স্যামুয়েল ব্যাকেটের Endgame. একদম আক্ষরিক অনুবাদ করলে বাংলা অর্থ হয়- শেষ খেলা। এটি একটা এক অঙ্কের নাটক; অর্থাৎ... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রায় ১০ বছর পর হাতে নিলাম কলম

লিখেছেন হিমচরি, ২৮ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১

জুলাই ২০১৪ সালে লাস্ট ব্লগ লিখেছিলাম!
প্রায় ১০ বছর পর আজ আপনাদের মাঝে আবার যোগ দিলাম। খুব মিস করেছি, এই সামুকে!! ইতিমধ্যে অনেক চড়াই উৎরায় পার হয়েছে! আশা করি, সামুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

পজ থেকে প্লে : কুমিল্লা বিশ্ববিদ্যালয়

লিখেছেন বন্ধু শুভ, ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:১৫


.
একটা বালক সর্বদা স্বপ্ন দেখতো সুন্দর একটা পৃথিবীর। একজন মানুষের জন্য একটা পৃথিবী কতটুকু? উত্তর হচ্ছে পুরো পৃথিবী; কিন্তু যতটা জুড়ে তার সরব উপস্থিতি ততটা- নির্দিষ্ট করে বললে। তো, বালক... ...বাকিটুকু পড়ুন

শিরোনামে ভুল থাকলে মেজাজ ঠিক থাকে?

লিখেছেন অনিকেত বৈরাগী তূর্য্য , ২৮ শে মে, ২০২৪ রাত ১১:৫৫


বেইলি রোডে এক রেস্তোরাঁয় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা নিয়ে একজন একটা পোস্ট দিয়েছিলেন; পোস্টের শিরোনামঃ চুরান্ত অব্যবস্থাপনার কারনে সৃষ্ট অগ্নিকান্ডকে দূর্ঘটনা বলা যায় না। ভালোভাবে দেখুন চারটা বানান ভুল। যিনি পোস্ট দিয়েছেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×