বোতলের গায়ে সাঁটানো লেবেলে লেখা_ 'পাওয়ার ফিলিংস। মিক্সড ফ্রুট এনার্জি ড্রিঙ্কস। প্রস্তুতকারক সাথী ফুড প্রোডাক্টস, ফেনী।' খুচরা মূল্য ৫০ টাকা। লেবেলের নিচেই লেখা_ 'পানীয়টি শুধু প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য।' রাজধানীসহ সারাদেশে ফুটপাতের দোকান থেকে শুরু করে অনেক নামিদামি ডিপার্টমেন্ট স্টোরে পাওয়া যাচ্ছে নানা ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকস। বাহারি সব নাম_ পাওয়ার ফিলিংস, হর্স ফিলিংস। এর মধ্যে কিছু এনার্জি ড্রিঙ্কস তৈরি হচ্ছে ফেনসিডিলের উপাদান দিয়ে। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, এনার্জি ড্রিংকসের আড়ালে 'দেশীয় ফেনসিডিল' বাজারজাত করে একটি অসাধু চক্র কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে। গতকাল মঙ্গলবার
রাজধানীতে দুটি এনার্জি ড্রিংকসের গুদাম সিলগালা করেছেন ভ্রাম্যমাণ আদালত। এ সময় উপস্থিত ছিলেন মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের কর্মকর্তারা। 'পাওয়ার ফিলিংস ও ম্যান পাওয়ার' নামে ওই দুটি ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকসে ফেনসিডিল তৈরির অন্যতম প্রধান উপাদান 'অপিয়েটসের' অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। রাজধানীর খিলগাঁওয়ে ওই দুই ব্র্যান্ডের গুদাম থেকে অন্তত ৬ হাজার বোতল এনার্জি ড্রিংকস জব্দ করে ৮ জনকে গ্রেফতার করেছেন র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত। তাদের বিরুদ্ধে মাদক আইনে মামলা করা হয়েছে। ফেনসিডিলের দাম বেশি হওয়ায় বর্তমানে তরুণ-তরুণীরা নতুন ধরনের এ নেশায় ঝুঁকছে। এ কারণে উদ্বিগ্ন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও সচেতন অভিভাবকরা।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের খাদ্য ও পুষ্টিবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. খুরশীদ জাহান সমকালকে বলেন, এনার্জি ড্রিংকসের প্রতি তরুণ-তরুণীদের আসক্তি সবচেয়ে বেশি। মাদকের উপাদানযুক্ত পানীয় গ্রহণের ফলে লিভার ও কিডনি আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। এসব ড্রিংকস পান করতে করতে এক সময় তরুণ-তরুণীরা আসক্ত হয়ে পড়ে। যারা অসৎ উপায়ে এ ধরনের ড্রিংকস বাজারজাত করে আসছে তাদের গ্রেফতার করে আইনের আওতায় নেওয়া জরুরি।
'পাওয়ার ফিলিংসের' গুদাম জব্দ : ফিরোজা মঞ্জিল, ৪৭২/সি, প্লট ৪৩, খিলগাঁওয়ের ওই ভবনের নিচতলায় চারটি রুম ভাড়া নেন সাদেক ফার্মাসিউটিক্যালস কোম্পানি ইউনানি লিমিটেড। গতকাল সকালে র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এইচএম আনোয়ার পাশার নেতৃত্বে একটি টিম ওই ভবনে অভিযান চালায়। সেখানে নানা ধরনের ইউনানি ওষুধ ছাড়াও 'পাওয়ার ফিলিংস' নামে একটি এনার্জি ড্রিংকসের ভরা ও খালি বোতল পাওয়া যায়। জব্দ করা হয় কয়েক হাজার বোতল এনার্জি ড্রিংকস। গ্রেফতার করা হয় প্রতিষ্ঠানের পরিচালক আনোয়ার ও তার ভাই শহীদুল আলম ভূঁইয়া ওরফে সারোয়ারকে। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালত তাদের দু'জনকে দুই বছর করে কারাদণ্ড ও দুই লাখ টাকা করে জরিমানা, অনাদায়ে আরও তিন মাস করে কারাদণ্ড দেন।
যেভাবে বাজারে 'পাওয়ার ফিলিংস' :সাদেক ফার্মাসিউটিক্যালসের পরিচালক আনোয়ার ও সারোয়ারের সঙ্গে ঘটনাস্থলে এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তাদের ভাষ্য, ২০০৫ সাল থেকে তারা ফেনীতে ইউনানি ওষুধের কারখানা তৈরি করেন। মাস ছয়েক আগে তারা নরসিংদীর ইউসুফ চৌধুরীর কাছ থেকে সাথী ফুড প্রোডাক্টস নামে একটি কোম্পানির লাইসেন্স কেনেন। ফেনসিডিলের উপাদানে তৈরি একটি পানীয় কোম্পানির লাইসেন্স কেন কিনেছেন_ এ প্রশ্নের জবাবে তারা বলেন, লোভে পড়েই সাথী ফুড প্রোডাক্টসের লাইসেন্স কিনেছি। এদিকে পাওয়ার ফিলিংসের গুদামে অভিযানের আগে খিলগাঁও জোড়পুকুর এলাকায় 'ম্যান পাওয়ার' নামে আরেকটি এনার্জি ড্রিংকসের কারখানায় অভিযান চালান ভ্রাম্যমাণ আদালত।
তরুণ-তরুণীদের আসক্তি বাড়ছে : নকল এনার্জি ড্রিংকসের প্রতি রাজধানীসহ সারাদেশের তরুণ-তরুণীদের আসক্তি দিন দিন বাড়ছে। এক বোতল ফেনসিডিলের দাম এক হাজার থেকে দেড় হাজার টাকা হওয়ায় অনেক তরুণ-তরুণী নতুন স্বাদের এ ধরনের পানীয়র দিকে ঝুঁকছে।
যেভাবে তৈরি হয় 'বিশেষ পানীয়' :সাদেক ফুড প্রোডাক্টসের পরিচালক আনোয়ার ও সারোয়ার প্রথমে বলেন, সাথী ফুড প্রোডাক্টস থেকে তারা লাইসেন্স কিনলেও এখনও পাওয়ার ফিলিংস বাজারজাত করেননি। তবে মেশিন কেনার জন্য তারা ভারত ও চীনে যোগাযোগ করেছেন। মেশিন কেনার জন্য এলসি (লেটার অব ক্রেডিট) খোলার প্রক্রিয়া চলছিল। কিছু সময় পরই তারা ভিন্ন কথা বলেন। আনোয়ার জানান, জব্বার নামে এক ব্যক্তি তাদের কোম্পানির রসায়নবিদ। তিনিই পাওয়ার ফিলিংস তৈরি করে তাদের জোগান দিচ্ছেন। নিজেদের উদ্যোগে লেবেল ও প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয়। 'ইমেজ' নামে একটি কোম্পানির কাছ থেকে প্লাস্টিকের বোতল কেনা হয়। র্যাবের ভ্রাম্যমাণ আদালতের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট এইচএম আনোয়ার পাশা সমকালকে জানান, বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের এনার্জি ড্রিংকসের মধ্যে ৫-৬টি কোম্পানি ফেনসিডিলের উপাদান 'অপিয়েটস' দিয়ে ড্রিংকস তৈরি করছে। অপিয়েটস আফিমের একটি উপাদান। ভেজাল এনার্জি ড্রিংকস ব্যবসার সঙ্গে জড়িত থাকার থাকার অভিযোগে র্যাব গ্রেফতার করে নওয়াব আলী, আমির হোসেন, শাহনেওয়াজ, মোনায়েম হাওলাদার, আবুল হোসেন ও রফিকুলকে।
কর্তৃপক্ষের বক্তব্য : মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের ঢাকা মেট্রো অঞ্চলের উপ-পরিচালক মজিবর রহমান সমকালকে বলেন, মাদক নিয়ন্ত্রণ অধিদফতরের পরীক্ষাগারে 'পাওয়ার ফিলিংস' ও 'ম্যান পাওয়ার' নামে দুটি কোম্পানির এনার্জি ড্রিংকস পরীক্ষা করে তার ভেতর ফেনসিডিল তৈরির একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদানের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ার জন্য কয়েক দফায় পরীক্ষার পরও একই রিপোর্ট এসেছে।