Published : 25 Jul 2013, 08:35 AM
ঈদে বাড়ি ফেরার অন্যতম মাধ্যম হল পানিপথ। আর পানিপথে রাজধানীতে ঢোকা বা বের হওয়ার প্রধান ফটকটি হল সদরঘাট। সারাবছর ব্যস্ত থাকলেও ঈদ মৌসুমের কথা আলাদা। বাড়ি যাওয়ার আকাঙ্ক্ষায় উপচেপড়া ভিড় সামাল দিতেই হিমশিম খায় সদরঘাট কর্তৃপক্ষ। তাই প্রতিবছরের মতো এবারও তাদের রয়েছে বাড়তি আয়োজন।
উপমহাদেশে প্রথম যন্ত্রচালিত অভ্যন্তরীণ নৌযান
নদীমাতৃক দেশ হওয়ায় বাংলাদেশে পানিপথে ভ্রমণখরচ কম। ঢাকা নদী বন্দরের প্রকাশিত ‘প্রচারপত্র’ থেকে জানা যায় প্রায় ১৭৫ বছর আগে থেকে এই উপমহাদেশের মানুষ যন্ত্রচালিত নৌযান ব্যবহার করে আসছে। ব্যক্তি হিসেবে লর্ড ইউলিয়াম বেন্টিংক ১৮৩৪ সালে প্রথম যন্ত্রচালিত স্টিমারে গঙ্গায় ভ্রমণ করেন।
এরপর প্রাতিষ্ঠানিকভাবে ১৮৪৪ সালে প্রথম অভ্যন্তরীণ স্টিমার সেবা চালু করে ‘ইন্ডিয়া জেনারেল নেভিগেশন এন্ড রেলওয়ে কোম্পানি লিমিটেড’।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল
বাহাদুর শাহ পার্ক পেরিয়ে ঢাকা কলেজিয়েট স্কুল। সামনেই একটি ফুটওভার ব্রিজ। হাতের বামে বাংলাবাজার, ডানে পাটুয়াটুলি। আর সোজা রাস্তাটাই চিত্তরঞ্জন এভিনিউ। পাঁচ মিনিট হাঁটলেই দেখা যাবে বুড়িগঙ্গার তীরে গড়ে ওঠা সদরঘাট।
দেশের প্রধান অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর। ঢাকার সঙ্গে দক্ষিণাঞ্চলের ১৫টি জেলার সঙ্গে পানিপথে যোগাযোগ করার প্রধান জায়গা এটি। তাই নাম হয়েছে সদরঘাট। যতদূর জানা যায় এই নদীপথ ফরাসি বণিকরাও ব্যবহার করতেন।
ঢাকা নদী বন্দরের প্রকাশিত ‘প্রচারপত্র’ থেকে আরও জানা যায়-- ১৯৫৮ সালের ৩১ অক্টোবর তখনকার পূর্ব পাকিস্তান সরকার অভ্যন্তরীণ নদীবন্দর প্রতিষ্ঠার অধ্যাদেশ জারি করে। যেটার নামকরণ করা হয় ‘ইস্ট পাকিস্তান ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’ বা ইপিআইডব্লিউটিএ। পরে ১৯৬০ সালে সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনাল প্রতিষ্ঠিত হয়।
স্বাধীনতার পর ইপিআইডব্লিউটিএ হয়ে যায় বিআইডব্লিউটিএ বা ‘বাংলাদেশ ইনল্যান্ড ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট অথরিটি’।
সদরঘাট লঞ্চ টার্মিনালের কাছে যেতেই চোখে পড়ে দোতলা ভবন। ভবনের বাইরের অংশ ঈদ উপলক্ষে ঘষেমেজে নতুন রংয়ে রাঙিয়ে তোলা হচ্ছে। লঞ্চ টার্মিনালে এই ভবনের নিচ দিয়েই যেতে হয়। প্রবেশ মূল্য চার টাকা।
ঢুকেই চোখে পড়ে যাত্রীদের লম্বা বিশ্রামাগার। জায়গাটা শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত না হলেও বেশ ঠান্ডা। তাই গরমেও বেশ আরাম। অনেকেই শুয়ে বসে আছেন। কেউ আবার কাঁথা-বালিশ পেতে মেঝেতে শুয়ে পড়েছেন।
যাত্রীদের সুবিধার জন্য দেয়ালের অনেক জায়গায় টাঙানো আছে লঞ্চের সময়সূচি। যাত্রী সাধারণ ও মালামালের নিরাপত্তার জন্য ডিজিটাল মনিটরিংয়ের ব্যবস্থা আছে। এছাড়াও তথ্য কেন্দ্র থেকে যে কোনো প্রয়োজনীয় তথ্য জেনে নেওয়া যেতে পারে।
বিআইডব্লিউটিএ-এর তথ্য মতে দেশের প্রধান এই নদীবন্দর থেকে ৩৯টি পথে প্রতিদিন ৬০টি লঞ্চ ছেড়ে যায়। আর ৬০টি লঞ্চ ভেড়ে। প্রতিদিন ৩০ থেকে ৪০ হাজার যাত্রী পারাপার হয়।
বাঅনৌপক-এর সদরঘাট নৌ-নিরাপত্তা ও ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা বিভাগের যুগ্ম পরিচালক মো. সাইফুল হক খান জানান, “ঈদে যখন মানুষ ঘরমুখী হয় বা ফিরে আসে তখন এর সংখ্যা প্রতিদিন গড়ে ১ লক্ষ ছাড়িয়ে যায়।”
দোতলা ভবন ছেড়ে লঞ্চ পন্টুনের দিকে গেলেই চোখে পড়ে ঈদের আমেজ। এখানেও প্রতিটি গ্যাংওয়ে বা ঘাটে যাওয়ার সিঁড়ি ও পন্টুন নতুন করে সাজানোর কাজ চলছে।
পন্টুনের পশ্চিম দিকের শেষ মাথায় আসলে দেখা যাবে অনেক ছোট ছোট নৌকা ওয়াইজঘাটে ভিড়ছে।
ষাটোর্ধ মাঝি রিপন সরকার জানালেন, “প্রতিদিন প্রায় ১ হাজার নৌকা ঢাকার আশপাশের বিভিন্ন ঘাট থেকে ওয়াইজঘাটে আসা যাওয়া করে।”
এই টার্মিনালের রয়েছে ৮টি গ্যাংওয়ে ও ১৮টি পন্টুন।
এছাড়াও সদরঘাটের কাছেই চরখেজুরবাগ এলাকায় অনেক পুরনো লঞ্চ নতুন করে রং করার কাজ চলছে। এক কথায় টার্মিনালকে ঈদময় করে তোলার চেষ্টার কমতি নেই।
বর্তমানে ২ হাজারের বেশি যাত্রী ধারণক্ষমতাসম্পন্ন বরিশালগামী কীর্তনখোলা ১, কীর্তনখোলা ২, লঞ্চ বহরে যুক্ত হয়েছে। এছাড়াও বড় লঞ্চের মধ্যে আছে সুন্দরবন ৭, পারাবত ৭, পারাবত ২, পারাবত ৯, কালাম খান ইত্যাদি।
বরিশালগামী লঞ্চ ছাড়ে রাত ৮টা ১৫মি. থেকে রাত সাড়ে ৯টা পর্যন্ত।
বরিশালগামী ভায়া চাঁদপুর লঞ্চগুলো যেমন নিউসান ৪, জলতরঙ্গ লঞ্চগুলো বিকাল সাড়ে ৫টা থেকে সন্ধ্যা সোয়া ৬টার মধ্যে ছেড়ে যায়।
ঢাকা থেকে ভোলাগামী বালিয়া ও সম্পদ ছাড়ে যথাক্রমে সন্ধ্যা ৭টা ও রাত ৮টায়।
ঢাকা থেকে পটুয়াখালি যায়-- সৈকত ১ ও সৈকত ২। ছাড়ে দুপুর ২টা ৩০ মিনিটে।
ঢাকা থেকে দৌলতখাঁগামী ফারহান ও ফ্লোটিনা ছাড়ে যথাক্রমে সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় ও সাড়ে ৭টায়।
ঢাকা থেকে মাদারিপুর যায় দ্বীপরাজ ৪। ছাড়ে সন্ধ্যা ৭টা ৪৫ মিনিটে।
সব ধরনের লঞ্চের ডেকের ভাড়া সমান। কেবিন ভাড়া লঞ্চ ও কেবিনের সুবিধাভেদে ডেকের ভাড়ার ৪ গুণ থেকে ৮ গুণ পর্যন্ত হতে পারে।
জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সাঈদ হোসেন তার অভিজ্ঞতা থেকে বলেন, “সাধারণত লঞ্চ ছাড়ার নির্দিষ্ট সময়ের আধা ঘণ্টা আগে গেলেই ডেকে জায়গা পাওয়া যায়। তবে ঈদের সময় লঞ্চ ছাড়ার ১০ ঘণ্টা আগে গেলেও ডেকে জায়গা পাওয়া মুশকিল।”
এই ঈদেও একই পরিস্থিতি হবে বলে মনে করেন তিনি।
ঈদে এবারের যাত্রীসুবিধা
২৩ জুলাই অনুষ্ঠিত বিআইডব্লিউটিএ-এর সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, এবার ৬ জুলাই থেকে ঈদের বিশেষ লঞ্চ চালু হবে। চলবে ঈদের পর ৭ দিন পর্যন্ত।
আগের রোটেশন পদ্ধতির বদলে এবার একটি পথেই একাধিক লঞ্চ চলবে। এতে করে আড়াই গুণ লঞ্চ বেশি চলবে বলে বিআইডব্লিউটিএ জানায়।
অতিরিক্ত ভাড়া নেওয়া বা কোনোরকম যাত্রী হয়রানি ঠেকাতে র্যাব, পুলিশ, স্কাউট ও স্বেচ্ছাসেবীদের নিয়ে তৈরি করা হয়েছে বিশেষ নজরদারি বাহিনী। লঞ্চঘাট থেকে বেশ কিছু দূর পর্যন্ত লঞ্চগুলোকে অনুসরণ করবে এ বাহিনী। ঢাকার বাইরে এটি পর্যবেক্ষণ করবে জেলা প্রসাশন।
ঈদ উপলক্ষে ঢাকা থেকে বরিশালের ভাড়া ২৫৮ টাকা থেকে ১৮ টাকা কমিয়ে ২৪০ টাকা করা হয়েছে।