somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

যমুনা এক্সপ্রেস

২৫ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

বাংলাদেশে রেলওয়ে রুটের কোন ট্রেন আমার সবথেকে প্রিয় যদি কেউ জিজ্ঞেস করে, তাহলে বিনা দ্বিধায় আমি যমুনা এক্সপ্রেসের নাম বলবো। এটা কি খুব অত্যাধুনিক কোন ট্রেন? না, বাংলাদেশের আর দশটা সাধারণ ট্রেনের মতোই। দুই হাজার সালে নামানো নীল বাদামী রঙের বগি, শোভন বগিতে মুখোমুখি সিট, যাত্রীদের-হকারদের হাউকাউ, দরজার পাশে ভীড়ের জটলা, বাথরুমের কাছাকাছি জায়গায় বিকট দুর্গন্ধ। সবকিছু মিলিয়ে আর সব সাধারণ ট্রেনের মতোই।

কিন্তু এরপরেও এই ট্রেন কেন আমার কাছে ভালো লাগবে? ঘটনা ক্লাস ফাইভে পড়ার সময়। ফাইনাল এক্সাম ও বৃত্তি পরীক্ষা দিয়ে ঘরে অযথা সময় কাটাই। জানি না অন্য কারোর সঙ্গে মিলবে কি না, আমাদের সে সময়কার ছেলেমেয়েদের একটা ধারণা ছিল শীতের সময়ই সবাই পরীক্ষা শেষ করে ঘুরে বেড়ায় আত্মীয়দের বাসায়। বাবা-মায়েরাও নিজ দায়িত্বে হাসিমুখে সন্তানদের নিয়ে গাট্টি-বোঁচকা বেঁধে ঘুরতে যেত আত্মীয়দের বাড়িতে। পুরো দেশ জুড়েই বলতে গেলে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের ছড়াছড়ি। কিন্তু এরপরেও সবারই শেকড় জামালপুর এবং ময়মনসিংহে। বাবা চাকরী ও ব্যবসার কাজে একদমই সময় দিতে পারতেন না কোথাও নিয়ে ঘুরে বেড়াতে। মা-ও সংসারের ব্যস্ততার কারণে আমাদের নিয়ে ঘুরে বেড়াতে পারতেন না, আমিই যে পরিবারের একমাত্র সন্তান না, আমার আরো বোন আছে। সবার দিক ভেবেই মা-ও সময় বের করতে পারতেন না, এখনো পারেন না।

সেবারে কিসের যেন কাজে আমার বড় ফুফুর ছেলে শুভ ভাইয়া এসেছিলেন শীতের মাঝে। আমি বাসায় বসে আছি দেখে আমাকে নিয়েও যেতে চাইলেন জামালপুরে তাঁদের বাসায়। এমনিতেই নাচুনে বুড়ি, তার উপর ঢোলের বাড়ি। বাসা থেকে রাজী হলো। হুট করেই ভাইয়া এসে বলেছিলো, আবার বাসা থেকেও হুট করেই রাজী হলো, সঙ্গে কি কি নিব ভাবতে ভাবতেই বেশ সময় চলে গেল। পুরোপুরি মনে নেই, যতটুকু মনে আছে কাপড়-শীতের কাপড়, গান শোনার জন্য এক বন্ধুর কাছ থেকে ওয়্যাকম্যান ধার করেছিলাম; সেটাও নিলাম, আর হুমায়ূন স্যারের বোতল ভূত বইটা নিয়েছিলাম। ছোট বাচ্চা আর সব বয়সের মেয়েদের নিয়ে বাসা থেকে চিন্তা করে। আমার বেলাতেও তাই হতো ছোটবেলায়। তাই শুভ ভাইয়াকে বারবার বলে দিচ্ছিলো হাত ধরে রাখার জন্য, একটুও যেন না বলে কোথাও যাই, বাথরুমে গেলেও যেনো উনাকে নিয়ে যাই।

ট্রেনে যাতায়াত সেবারই আমার প্রথম ছিলো না, তবে প্রথম ছিলো বাবা-মা ছাড়া একা একা যাওয়ার। অন্যরকমের একটা রোমাঞ্চ কাজ করছিল। আমাদের ট্রেনের নাম ছিল যমুনা এক্সপ্রেস। সেই সময়ও ট্রেনটি বিকাল ৫টা ৪০এই জয়দেবপুর থেকে ছাড়তো এখনো ছাড়ে। শেষ বিকেলের গোধুলী বেলা। আমি আর শুভ ভাইয়া ট্রেনের জন্য অপেক্ষা করছি পাঁচটা থেকেই। শুভ ভাইয়ার একটা বদঅভ্যাস ছিলো। স্মোকিং করা। পরবর্তীতে সেটি আমার মাঝেও এসেছে, তবে কাউকে দেখে অনুপ্রাণিত হয়ে না। স্টেশনে দাঁড়িয়ে শীতের মাঝে ট্রেনের জন্য যখন অপেক্ষা করছিলাম শুভ ভাইয়া আপন মনে সিগারেটের ধোঁয়া টানছিলো, আমি কৌতুহলী হয়ে শুভ ভাইয়াকে বলেছিলাম,

-ভাইয়া, সিগারেট কি মিষ্টি মিষ্টি লাগে?

ভাই, রাগী চোখে তাকালেও উত্তর দিয়েছিলো স্বাভাবিকভাবেই। এমনিতেই ছোটবেলায় ভাইয়াকে খুব ভয় পেতাম। তবুও কিভাবে যে হুট করে বলেছিলাম, সেটা মাথায় তখনো আসেনি, এখনো না। ভাইয়া বলেছিলো,

-না লাগে না। তোমার এসব জানার দরকার নেই।

আমি বাধ্য ছেলের মতো আর কিছু বলিনি, এদিকে ট্রেন চলে আসছে বলে প্লাটফর্মে জানিয়ে দিল। ভাইয়া, ব্যাগ কাঁধে নিতে নিতে বলছিল,

-সাদী, আগে কখনো একা একা জার্নি করেছো?

-না।

-তাহলে আজকে করবে। কেমন?

শুভ ভাইয়ার কথায় ভয় পেয়েছিলাম কিছুটা। একা একা যাবো কিভাবে? তবুও মুখ শক্ত করে জবাব দিয়েছিলাম,

-আচ্ছা।

-আমাদের টিকিট দুইটা কাটা। একটা বগির এক মাথায়, আরেকটা আরেক মাথায়। আমি একটায়, তুমি আরেকটায় বসবে।

-জ্বি আচ্ছা।

-বাথরুমে গেলে একা একাই যাবে।

-জ্বি আচ্ছা।

-কিছু খেতে চাইলে আমার কাছে আসবে।

-জ্বি আচ্ছা।

শীতের কুয়াশাভেজা বিকেলে দূর থেকে ট্রেনের হেডলাইট দেখা যাচ্ছিল। মনের মধ্যে একটা অন্যরকম ভয় কাজ করছিলো। মাতব্বরি মেরে যে সব কথায় জ্বি জ্বি বলছিলাম, তখন বুঝতে পারছিলাম কতটা ভুল হয়েছে, এরই মধ্যে টেনশনে বাথরুমও চেপে ধরলো, ভাইয়াকে বলেছিলাম,

-ভাইয়া হাগু করবো।

-এখানেই করে ফেলো। করতে করতে ট্রেনে উঠবা।

লজ্জায় আমি এতটুকু হয়ে গিয়েছিলাম। টেনশনে যেমন বাথরুম চেপেছিলো, লজ্জাতেও বাথরুম নিমিষেই চলে গেল।

ট্রেন প্লাটফর্মে ঢুকলো, সেদিন ট্রেনটা বেশ ফাঁকা ছিল। তবুও ট্রেন আসতেই হুড়োহুড়ি লেগে গেল। আমরা ট্রেনে উঠলাম। ভাইয়া আমাকে আমার সিটে বসিয়ে দিয়ে তাঁর সিটে যাওয়ার সময় বলছিলেন,

-এখন তো অন্ধকার। তাও জানালা খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকবা। দেখবা বাতাসেই মন ভালো লাগবে। আর ট্রেন চলার শব্দ শুনতে থাকবা, সময় তাড়াতাড়ি কাটবে।

আমার ভেতর অস্থিরতা কাজ করছিলো, কেউ যদি আমাকে ধরে নিয়ে যায়! মনে মনে দোয়া দরুদ পড়া শুরু করছিলাম। সামনের সিটের একজন আঙ্কেল বসেছিলেন, তিনি আমাকে দেখে বলছিলেন,

-গাড়িতে চড়ার সময় আল্লাহ খোদার নাম নেওন ভালো।

মনে মনে ভাবছিলাম এই লোক আবার ছেলেধরা না তো। তার কথার আর জবাব দেইনি। ওয়্যাকম্যানের হেডফোন কানে লাগিয়ে গান শুনছিলাম। গান শুনতে শুনতেই কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিলাম টের পাইনি। ঘুম ভাঙ্গার পর পিছনে ফিরে ভাইয়ার সিটের দিকে তাকালাম, দেখি ভাইয়া নেই। বুকের ভেতর আত্মা ছ্যাঁৎ করে উঠলো। আশেপাশের লোকদের বললাম, ভাইয়াকে দেখেছিলেন কি না। কেউ কোন জবাব দিতে পারেনি। মাতব্বরি মেরে দরজার কাছে গেলাম, গিয়ে দেখি ভাইয়া, দুই বগির জয়েন্টের মাঝে দাঁড়িয়ে সিগারেট টানছে। সিগারেট খাওয়াটা ভাইয়াকে দেখে শেখা না হলেও দুই বগির মাঝে দাঁড়িয়ে সিগারেট খাওয়ার অভ্যাসটা ভাইয়ার থেকেই শেখা। ভাইয়া আমাকে দেখে বলেছিল,

-ঘুম ভাঙলো?

-জ্বি।

-বাথরুমে যাবে?

-হুমম।

বাথরুম শেষে দেখি ভাইয়া দরজার কাছে দাঁড়িয়ে আছে, আমাকে বলেছিল,

-কি ভয় লাগছে নাকি?

-না।

-ভালো লাগছে?

-হুমম।

-সিটে যাওয়ার পর এখন আবার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাবা। দেখবা খুব সুন্দর চাঁদ উঠেছে।

-জ্বি আচ্ছা।

সিটে যাওয়ার পর জানালায় তাকিয়ে দেখি সত্যিই চাঁদ উঠেছে। ট্রেনে চড়ে চাঁদ দেখে যত না অবাক হয়েছিলাম তার থেকে বেশি অবাক হয়েছিলাম বাইরে অনেকগুলো জোনাকী পোকা দেখে। হাত বাড়িয়ে দুই একটা ধরেওছিলাম।

এভাবে ঘন্টা পাঁচেক জার্নির পর আমরা ট্রেন থেকে নামলাম। শীতের খোলা আকাশের চাঁদনী রাতে আমরা হেঁটে চলেছি। রিকশাও পাইনি। আমার ছোটবেলার স্মৃতি জড়ানো প্রিয় ফুল হাস্নাহেনার ঘ্রাণও তখন পাচ্ছিলাম। আনুমানিক রাত পৌনে বারোটার দিকে আমরা ফুফু বাড়ি গিয়ে পৌঁছালাম। আমার জীবনের প্রথম বাসার কারোর সাথে ছাড়া ট্রেন জার্নি।

মূলত এই জার্নির পরই ক্লাস এইটে ওঠার পর আমি বহুবার জয়দেবপুর থেকে ময়মনসিংহ একা একাই গিয়েছিলাম। ক্লাস নাইনে ওঠার পর প্রথম ট্রেন জার্নির সময় প্রথম সিগারেট খেতে খেতে গিয়েছিলাম।

কাল আবারো যাচ্ছি ময়মনসিংহে। বরাবরের মতো এবারও প্রিয় যমুনা এক্সপ্রেসেই যাচ্ছি। এই ট্রেন ছাড়া শেষ বিকেলের ট্রেন ছাড়া অন্য কোন ট্রেনে চড়ে আমি আনন্দ বোধ করি না। First impression is the last impression বলে ইংরেজীতে একটা প্রবাদ আছে। সেকারণেই হয়তো এখনো ট্রেনে জার্নি করলেই আমার সেইদিনের স্মৃতি মনে পড়ে। এখনো আমি বিকেলের যমুনা এক্সপ্রেসে খুঁজে বেড়াই গোধুলীর আবিরমাখা আকাশের ছোয়া, কিংবা চাঁদনী রাতে হাস্নাহেনার ঘ্রাণ। গফরগাঁও স্টেশন পার করার পর জানালার বাইরে এখনো হাত বাড়াই জোনাকী ধরার জন্য। কিংবা দুই বগির মাঝখানে দাঁড়িয়ে চেইন স্মোকারের মতো সিগারেট খাওয়া। ভীড়বাট্টা-হৈ-হুল্লার মাঝে ঝালমুড়ি-চানাচুরওয়ালার মাখনোর শব্দ। কিংবা রাতের ট্রেনের অজানা কোন গন্ধ। অথবা ট্রেনের হুইসেল ইঞ্জিনের গর্জনে শরীরে শিহরন জাগানিয়া অনুভূতি। শেষ বিকেলের ট্রেন ছাড়া আর কোন ট্রেন পারে এরকম অনুভূতি দিতে?

সর্বশেষ এডিট : ২৫ শে জুলাই, ২০১৩ সকাল ১০:৫৫
১১টি মন্তব্য ১১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×