somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মনে রবে কিনা রবে আমারে

০৩ রা জুন, ২০১১ সকাল ৭:২৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

যতটা সম্ভব, যে কোন 'বিদায়' অনুষ্ঠানকে 'না' বলার চেষ্টা করি। যেতে চাইনা। ভালো লাগে না। কাউকে বিদায় বলতে ভালো লাগে না। বিদায় দিতেও না। এমনকি নিজে বিদায় নিতেও আমার সহজ বোধ হয় না। জীবনে যতগুলো বিদায় অনুষ্ঠান হয়েছে 'আমাকে নিয়ে' প্রায় সবগুলো থেকে রক্ষা পেয়েছি কিছুদিন আগ পর্যন্তও। গত বছরই প্রথম 'ধরা' খেলাম। প্রশাসন জানালো আমার অনুরোধ ক্রমেই কোন বিদায় অনুষ্ঠান হবে না এবং আমাকে না জানিয়েই সারপ্রাইজ দেয়া হল। ১৯ বছরের চাকরী বলে কথা! হাসি হাসি মুখে, আবেগ ঘন কথা বলতে ভালো লাগেনি।

মিতুল (সাকিবা রহমান) আপার বিদায় অনুষ্ঠান! ই-মেইল পেলাম। যাব না। রওশন, বাচ্চাদের কিছুই বললাম না। ২৯শে মে, রোববার সকালে জিল্লুর চাচা ফোনে বললেন 'মানিক তুমি বাচ্চাদের নিয়ে আড়াইটার মধ্যেই চলে এসো'। হায় হায় বলে কি? আমিতো যাবই না। এখন কি করি?! অনেক চিন্তা করলাম। অপশন খুঁজলাম। কোনটাই মনের মতো হল না। ঠিক করলাম যাবো। বাচ্চাদের বললাম রেডি হতে।

মিতুল আপা ক্যানবেরায় ২০ বছরের বেশি সময়। আপার সাথে আমার পরিচয় ১০ বছরের বেশি হবে না। নিখাত শিল্পী মনের এই মানুষটিকে আমি যতটুকু চিনি, সংগীত তার ধ্যান, সংগীত তার জ্ঞান। সংগীত সবকিছু তার। হাজার ব্যস্ততায়ও 'না' নেই গানের জন্যে। কি নিজে গাইবেন, কি শেখাবেন। তা যেখানেই হোক, যখনই হোক। আমাদের সবগুলো অনুষ্ঠানেই উনাকে পেয়েছি আমরা সবার আগে। শেষ মুহূর্তে বলেও নিরাশ হইনি কখনো। ক্যানবেরায় এমন কোন সফল সংগীত অনুষ্ঠান ছিল না, যে খানে মিতুল আপা গান গাননি। অন্তত আমি আসার প্রথম ৫/৬ বছর।

প্রিয়অষ্ট্রেলিয়া পুরো পরিবারের সবার পক্ষ থেকে মিতুল আপাকে জানাই বিদায় শুভেচ্ছা। প্রার্থনা করছি, আবার আপনাকে আমাদের মাঝে পাবো, ক্যানবেরায় পাবো, কয়েক বছরের মধ্যেই। ভালো থাকবেন সব সময়। আমাদের সবার দোয়া রইলো, আপনার সাথে, আপনার জন্যে।

হঠাৎ শুনলাম মিতুল আপা 'স্পন্দন' নামের একটা গানের দল করেছেন। শুনে খুবই উৎসাহিত হলাম। 'স্পন্দন'এর ডেবু অনুষ্ঠানে যাবার সৌভাগ্য হল আমার। সত্যি বলতে কি - আমি, আমরা যারা সে দিন উপস্থিত ছিলাম সবাই 'স্পন্দন'কে এ প্লাস দিয়ে দিলাম। বাংলাদেশের যে কোন উঁচু মানের সঙ্গীত দলের সংগে তুলনা দেয়ার মতো যোগ্যতা আছে এ দলের। হিংসা হচ্ছিলো - ইস কোন ভাবে যদি এ দলের সাথে সংযুক্ত হবে পারতাম! তবে আমার যা গানের গলা!! আমি এ দলে যোগ দিলে - এ দলে আর অন্য কাউকে খোজে পাওয়া যেত কিনা সন্দেহ!!! সন্দেহ না, নিশ্চিত। সে যাই হোক।

দু:খ পেলাম, যখন শুনলাম, আপা আর 'স্পন্দন' এ নেই। হাসি হাসি মুখটি, হাসি হাসি ভরাই থাকলো। তার উপর, ভালো লাগলো 'স্পন্দন' এর ব্যাপারে উনার পজিটিভ ধ্যান ধারনায়। আসা করছি, মিতুল আপাকে 'স্পন্দন' থেকে ফেয়ার ওয়েল দেয়া হবে। সুন্দর একটা বিদায় অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। প্রার্থনা এবং অপেক্ষায় থাকলাম।

এবার আসি বাংলা স্কুল থেকে দেয়া 'ফেয়ার ওয়েল' মুল প্রসঙ্গে। খুব একটা যে আশা নিয়ে বসেছি, তা বলা ঠিক হবে না। নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে আরম্ভ হল অনুষ্ঠান (যা কিনা ক্যানবেরার জন্যে নিয়মিত ব্যাপার এখন এবং কোন বাঙ্গালী আয়োজকই অংশগ্রহণ কারীদের 'দেরিতে' না আসার কৌশল এখনো আয়ত্ত করতে পারেননি) ভাবছিলাম, রবিবার বিকেল (কালকে অফিস) যত তাড়াতাড়ি শেষ হয় ততই ভালো।

বাংলা স্কুলের শিক্ষিকা হাবিবা আহমেদ স্বপ্না এই বিদায় অনুষ্ঠানের পরিচালনায় থাকলেন। সুন্দর সাবলীল ভূমিকার মাধ্যমে আরম্ভ হল অনুষ্ঠান। বক্তব্য রাখলেন বাংলা স্কুলের প্রধান শিক্ষক জিল্লুর রহমান। শিক্ষকদের পক্ষ থেকে কথা বললেন শিরিন আহমেদ, অভিভাবকদের পক্ষ থেকে এহসান উল্লাহ। সামি, সেঁজুতি, ফারাহ এবং আদিবা বাংলা স্কুলে মিতুল আপাকে নিয়ে তাদের স্মৃতি'র কথা বলল। বাংলা স্কুল, বাংলার প্রতি শিক্ষক, অভিভাবক এবং ছাত্রদের আগ্রহ, সন্দেহ নেই, অন্য ধরনের এক বিশেষ মাত্রা এনে দিল এই 'ফেয়ার ওয়েল' অনুষ্ঠানের।

এবার মিতুল আপার ছাত্র/ছাত্রীদের গানের পালা। ষ্টেজে সামি এলো প্রথম, দু'টি গান গেল। কি বলবো? মন ভালো হয়ে গেল। খোলা, উদার, মেজাজি গলা। গানের সব কথার অর্থ সামি'র জানা আছে কিনা জানি না। ভেতর থেকে উঠে আসা গান বোধ হল। সেঁজুতি'র ভাওয়াইয়া গান ছিল - অনবদ্য। আমার পছন্দের প্রিয় গানগুলোর একটি। মনে হল বাংলাদেশে বসে 'ক্লোজআপ ওয়ানের' টপ ২০ প্রতিযোগিতা দেখছি। মাহিন এলো, গেয়ে গেল, জয় করে নিলো সবাইকে। খুবই বোল্ড তার গাওয়া। সবাই আরও কিছুক্ষণ গাইলে খারাপ লাগতো না। এদের সবার ব্যাপারে একটি কথা না বললেই নয়। এরা সবাই ভালো বাংলায় কথা বলতে পারে এ দাবি করবো না কিন্তু সব কটা গানের বাংলা উচ্চারণ ছিল নিতান্তই অসাধারণ! জানি না কি ভাবে সম্ভব করেছে তারা। কঠিন চর্চা, একাগ্রতা ছাড়া এ সম্ভব নয় কিছুতেই। এই গানের পাখিদের জন্যে রইলো দোয়া, রইলো একটা বাড়তি ধন্যবাদ। অভিভাবকদের সময়, ত্যাগের কথা নাইবা তুললাম এখন।

এবার লুনা (ভাবীর) গাইবার পালা। কখনো ওনার সলো গান গুনছি, মনে পড়ে না। পর পর চারটি গান গাইলেন। ছিল রবীন্দ্র, নজরুল আর অতুল প্রসাদ। কি আর বলবো, মনে হল 'এ শুধু গানের দিন'। ঘড়ির দিকে তাকাতে মন চাইলো না আর। চমৎকার গান গাইলেন লুনা।

অনুরোধে ঢেঁকি গিললেন (সামসুল) হুদা ভাই; ষ্টেজে উঠে দরাজ গলায়, গাইলেন উনার ট্রেডমার্ক গান 'স্কুল খুইলাছেরে মওলা, স্কুল খুইলাছে'। গুরুকে মনে পড়ে গেল। ঢাকার হাসপাতালে, লাইফ সাপোর্টে আছেন এখন। গুরু আজম খানের জন্যে দোয়া রইলো। সুস্থ হয়ে ফিরে আসুন, আবার সবার মাঝে, এ কামনায় থাকলাম।

সবার শেষে এলেন মিতুল আপা। বাংলা স্কুলে তার দীর্ঘ দিনের অনেক স্মৃতির কথা বললেন। অনেক ভালোবাসার কথা বললেন। কথা বলতে গিয়ে সংগত কারণেই আবেগে আপ্লুত হলেন। চারটি গান গাইবেন বললেন, চারটি গানই গাইলেন। এমন মানসিক অবস্থায় গাওয়া, খুব একটা সহজ নয়। তবুও গাইলেন, চমৎকার গাইলেন। শেষে গাইলেন 'এই কথাটি মনে রেখ - আমি যে গান গেয়েছিলাম' গাইতে গিয়ে বার বার আবেগে গলা ভিজে আসছিল উনার। পছন্দের কাউকে বিদায় দেয়া - সহজ কাজ নয়। যেমন সহজ নয়, বিদায় নেয়া। কান্না ধরে রাখতে হয়ত আমার মতো অনেকেরই কষ্ট হচ্ছিল তখন।

নারাবান্ডা কলেজে বাংলা অন্তর্ভুক্তির প্রয়োজনীয়তা এবং বাংলা স্কুলের পরবর্তী পরিকল্পনার কথা জানালেন শিক্ষিকা হাবিবা আহমেদ স্বপ্না তার সমাপ্তি বক্তব্যে।

অনুষ্ঠান পরবর্তী চা সহ হালকা খাবারের ব্যবস্হা ছিল। নানান ধরনের। বিশেষ করে ঝাল মুড়ির কথা না বললেই নয়। বলতে গেলে আমার স্কুল জীবনের ঝাল মুড়ির স্বাদ পেয়েছি।

প্রথমেই বলেছি, খুব একটা আশা নিয়ে অনুষ্ঠান দেখতে বসিনি। স্বীকার করতে দ্বিধা নেই, অনুষ্ঠান শেষে, অনেক সুন্দর ভবিষ্যতের বুক ভরা আশা নিয়েই বাসায় ফিরেছি এখন। অন্তত এই ক্যানবেরায়, দু,তিন প্রজন্মে, বাংলা পুরোপুরি মিলিয়ে যাবার কোন সম্ভাবনা নেই। আমি নিশ্চিত।

মায়ের ভাষা বাংলাকে এই প্রবাসে, বর্তমান প্রজন্মের কাছে আকর্ষণীয় করে তুলে ধরবার জন্যে, ধন্যবাদ বাংলা স্কুলকে। ধন্যবাদ, প্রধান শিক্ষক সহ সকল শিক্ষক শিক্ষিকা, এতে জড়িত সবাইকে, বাংলা স্কুলের পরিচালক মন্ডলিকে। ক্যানবেরায়, আমরা সত্যিই ভাগ্যবান বাংলা স্কুলের মত একটি নিবেদিত প্রাণ প্রতিষ্ঠানকে পেয়ে।

মূল লেখাটি এখানে ছবি সহ: Click This Link
১টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

সভ্য জাপানীদের তিমি শিকার!!

লিখেছেন শেরজা তপন, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৫

~ স্পার্ম হোয়েল
প্রথমে আমরা এই নীল গ্রহের অন্যতম বৃহৎ স্তন্যপায়ী প্রাণীটির এই ভিডিওটা একটু দেখে আসি;
হাম্পব্যাক হোয়েল'স
ধারনা করা হয় যে, বিগত শতাব্দীতে সারা পৃথিবীতে মানুষ প্রায় ৩ মিলিয়ন... ...বাকিটুকু পড়ুন

রূপকথা নয়, জীবনের গল্প বলো

লিখেছেন রূপক বিধৌত সাধু, ১৭ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২


রূপকথার কাহিনী শুনেছি অনেক,
সেসবে এখন আর কৌতূহল নাই;
জীবন কণ্টকশয্যা- কেড়েছে আবেগ;
ভাই শত্রু, শত্রু এখন আপন ভাই।
ফুলবন জ্বলেপুড়ে হয়ে গেছে ছাই,
সুনীল আকাশে সহসা জমেছে মেঘ-
বৃষ্টি হয়ে নামবে সে; এও টের... ...বাকিটুকু পড়ুন

যে ভ্রমণটি ইতিহাস হয়ে আছে

লিখেছেন কাছের-মানুষ, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১:০৮

ঘটনাটি বেশ পুরনো। কোরিয়া থেকে পড়াশুনা শেষ করে দেশে ফিরেছি খুব বেশী দিন হয়নি! আমি অবিবাহিত থেকে উজ্জীবিত (বিবাহিত) হয়েছি সবে, দেশে থিতু হবার চেষ্টা করছি। হঠাৎ মুঠোফোনটা বেশ কিছুক্ষণ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।

লিখেছেন মঞ্জুর চৌধুরী, ১৮ ই মে, ২০২৪ ভোর ৬:২৬

আবারও রাফসান দা ছোট ভাই প্রসঙ্গ।
প্রথমত বলে দেই, না আমি তার ভক্ত, না ফলোয়ার, না মুরিদ, না হেটার। দেশি ফুড রিভিউয়ারদের ঘোড়ার আন্ডা রিভিউ দেখতে ভাল লাগেনা। তারপরে যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

মসজিদ না কী মার্কেট!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৯

চলুন প্রথমেই মেশকাত শরীফের একটা হাদীস শুনি৷

আবু উমামাহ্ (রাঃ) হতে বর্ণিত। তিনি বলেন, ইহুদীদের একজন বুদ্ধিজীবী রাসুল দ. -কে জিজ্ঞেস করলেন, কোন জায়গা সবচেয়ে উত্তম? রাসুল দ. নীরব রইলেন। বললেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

×