আজ রোদেলার বিবাহিত জীবনের ২৫ বছর পূর্ণ হল।এই ২৫ বছরের মধ্যে শুধুমাত্র প্রথম বছরটা ছাড়া কোন বিবাহবার্ষিকীতেই রোদেলা প্রান্তকে কাছে পায়নি।আজও যে পাবেনা এটা সে ভালো করেই জানে।জানলেও মেনে নিতে কেন যেন খুব কষ্ট হয় রোদেলার।
বিয়ের আগে কত রকমের স্বপ্নই না দেখেছিলো রোদেলা।যত ব্যস্তই থাকুক না কেন প্রতি শুক্রবার সারা বিকাল তারা এক সাথে ঘুরে বেড়াবে।সময় পেলেই দুজনে মিলে শপিং করবে।লং ড্রাইভে যাবে।একসাথে জ্যোস্না দেখবে,বৃষ্টিতে ভিজবে।আরোও কত কি!!!কিন্তু বিয়ের পর রোদেলা বুঝতে পারে তার এই স্বপ্নগুলো যে স্বপ্নই থেকে যাবে।কখনই পূরণ হবেনা।
রোদেলা যখন ইন্টার ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে তখন প্রান্তর মা বাবা রোদেলার জন্য প্রস্তাব নিয়ে আসে।একেতো ছেলেরা বিরাট ধনী তার উপর ছেলের খুব বড় বড় বিজনেস আছে শুনে রোদেলার মা বাবা এই বিয়েতে আর অমত করেননি।খুব ধুমধাম করেই প্রান্তর সাথে তার বিয়ে সম্পন্ন হয়।
বিয়ের পর প্রথম বছরটা যেন স্বপ্নের মতই কেটেছিল।যখন যা যেভাবে চেয়েছিল ঠিক সেভাবেই পেয়েছিল।প্রান্তর মা বাবা রোদেলা কে পরম মমতায় খুব আপন করে নেয়।একমাত্র ছেলের বউ বলে কথা।আর প্রান্তও রোদেলার সব চাওয়া পাওয়ার দিকে খেয়াল রাখত।কোন কিছুর প্রয়োজন অনুভব করার আগেই সব পেয়ে যেত।প্রান্ত কোন একভাবে জেনেছিল রোদেলা রজনীগন্ধ্যা ফুল খুব পছন্দ করে।তাই তো সে প্রতি সপ্তাহেই রোদেলার জন্য তার প্রিয় ফুলটি নিয়ে আসতো।একদিন রোদেলা কলেজ থেকে বাসায় ফেরার পথে একটা গাড়ির ধাক্কায় রিকশা থেকে পড়ে যায়।এতে তার হাত পা সামান্য ছিলে যায়।আর হাতের দুটা আঙ্গুল ভেঙ্গে যায়।রোদেলার এই অবস্থা দেখে প্রান্ত এমন অস্থির হয়ে গিয়েছিল মনে হচ্ছিল প্রান্তরই কিছু একটা হয়েছে।তার এই অস্থিরতা দেখে রোদেলার হৃদয়ে প্রান্তর প্রতি ভালোবাসায় পূর্ণ হয়ে যায়।সে ভাবে এই জীবনে আর কিছুই লাগবেনা শুধু প্রান্ত তার পাশে থাকলেই তার দিনগুলো খুব আনন্দে কেটে যাবে।রোদেলা হয়তো ভাবতেও পারেনি তার জীবনে সুখটা যে খুব ক্ষনস্থায়ী।
প্রতি বছরে বিবাহ বার্ষিকীর দিনে ডায়রী নিয়ে বসাটা যেন একটা নিয়ম হয়ে গেছে।তাই তো সে এ বছরও তার প্রিয় ডায়রীটা নিয়ে বসেছে।এই ডায়রীটাই যেন এখন তার সবচেয়ে কাছের হয়ে গেছে।রোদেলার আজো মনে পড়ে বিয়ের প্রথম বছর ঠিক এই দিনেই প্রান্ত তাকে কিভাবে চমকে দিয়েছিলো।ঐ দিনটি যেন আজো সে স্পষ্ট দেখতে পায়।রোদেলা তার সব কাজ গুছিয়ে রুমে প্রবেশ করা মাত্রই যখন দেখল যে আধো আলোমাখা রুমের বিছানার পাশের টেবিলটায় শোভা পাচ্ছে বিশাল এক ফুলের তোড়া।কত রকমের মোম দিয়ে পুরা রুমটাকে প্রান্ত কত অদ্ভুত ভাবেই না সাজিয়েছে।আর মোমের আলোতে রুমটা যে কি অসম্ভব সুন্দর লাগছে।রোদেলা ভাবতেও পারেনি প্রান্ত এমন কিছু করবে।বিস্ময়ে আর আনন্দে সে আত্মহারা হয়ে গিয়েছিল।এরপর প্রান্ত যখন তার ব্যাগ থেকে একের পর এক প্রথম বিবাহবার্ষিকী উপলক্ষে আনা গিফটগুলো বের করে রোদেলার হাতে দিচ্ছিল মনটা এত ভরে গিয়েছিলো যে খুশীতে সে আর চখের পানি আড়াল করে রাখতে পারেনি।এরপর থেকে প্রতি বছরই সে প্রান্তর দেয়া উপহারগুলো দেখে আর চখের পানি ফেলে।কিন্তু কেন যেন তা আর প্রথমবারের মত আনন্দ অশ্রু হয়ে ঝরেনা।
বিয়ের দু তিন বছর পর থেকেই প্রান্তর মাঝে কেমন যেন একটা পরিবর্তন চলে আসে।বিজনেস নিয়ে এত ব্যস্ত হয়ে যায় যে তাকে বেশীরভাগ সময়ই দেশের বাইরে থাকতে হত।কিন্তু এই ব্যাপারে রোদেলার কোন আপত্তি ছিলনা।কারন রোদেলা সবসময়ই চেয়েছিল প্রান্ত যেখানেই থাকুক না কেন যেন সে খুব ভাল থাকে।কিন্তু প্রান্তর ঘন ঘন বিদেশ ভ্রমন আর বিদেশেই বেশীরভাগ সময় থাকাটা রোদেলাকে ভাবিয়ে তোলে।প্রথম প্রথম ৩/৪ মাসে ১০/১২ দিনের জন্য রোদেলা প্রান্তকে কাছে পেত। এরপর আস্তে আস্তে রোদেলার কাছাকাছি থাকার দিনগুলো যেন আরো কমে যেতে থাকে।এভাবে সময় যত যেতে থাকে প্রান্তও যেন ধীরে ধীরে রোদেলার থেকে অনেক দূরে সরে যায়।
বিয়ের চার বছরের মাথায় রোদেলা ফুটফুটে একটি ছেলে সন্তানের জন্ম দেয়।রোদেলা ভাবতেই পারেনি যে এই সময় সে প্রান্তকে কাছে পাবে।প্রান্ত যখন তার মায়ের সাথে কথা বলছিল এক পর্যায়ে উনি তার নাতির কান্নার শব্দটা প্রান্তকে শোনায়।ছেলের কান্নার শব্দ শোনে পরদিনই সে সিঙ্গাপুর থেকে ছেলেকে দেখতে চলে আসে।প্রায় ৫/৬ মাস পর প্রান্তকে দেখে রোদেলা যেন তার সমস্ত দুঃখ কষ্ট ভুলে যায়।রোদেলা ভাবে প্রান্ত অনেক দিন পর পর দেশে আসলেও বা কি তবুও তো কিছুদিনের জন্য হলেও প্রান্তকে কাছে পাচ্ছে।এটাই বা কম কিসের???
সময়ের ব্যবধানে সবার জীবনে কত রকমেরই না পরিবর্তন আসে।কত রকমের ঘটনাই না ঘটে যায়।এখন রোদেলা বুঝতে পারছে তাই মাঝেও যে বিরাট পরিবর্তন এসেছে।কিছু কষ্ট যেন মানুষের মনকে পাথর করে দেয়।রোদেলার ক্ষেত্রেও ঠিক তাই হয়েছে।ইংল্যান্ড থেকে আসা একটা চিঠি যেন রোদেলার জীবনকে অনেক পরিবর্তন করে দেয়।চিঠিটায় প্রান্ত কত স্বাভাবিকভাবেই না লিখেছিল তার দ্বিতীয় বিয়ের কথা।সে যে আর কখনই দেশে ফিরবেনা এটা জানিয়ে দিতেও প্রান্ত যেন বিন্দুমাত্র সঙ্কোচবোধ করেনি।মানুষ বদলায় কিন্তু প্রান্ত যে এত তাড়াতাড়ি বদলে যাবে রোদেলা তা কল্পনাও করেনি।
এই ২৫ তম বিবাহবার্ষিকীর দিনে রোদেলা তার পাওয়া না পাওয়া দুঃখ-কষ্ট আনন্দ-বেদনায় মিশে থাকা দিনগুলোর কথা ভাবছে।বুঝ হওয়ার পর থেকে ছেলে সৌম্যই প্রতি বছর এই দিনটায় মাকে খুশী রাখার জন্য কত কিছুরই না আয়োজন করত।এই দিনে মা যেন চোখের পানি ফেলার সুযোগ না পায় এজন্য সে মাকে নিয়ে সারা দিন ঘোরাঘুরি করে রাতে ডিনার সেরে বাসায় ফিরত।কিন্তু এবার সৌম্য কাছে না থাকায় অতীতের কষ্টগুলো যেন রোদেলাকে আরোও পেয়ে বসেছে।রাজশাহী মেডিকেলে পড়ার কারনে সৌম্যকে ওখানেই থাকতে হচ্ছে।দুদিন পর তার ফাইনাল পরীক্ষা।পড়ার চাপে হয়তো এই দিনটির কথা ভুলেই গেছে,ভাবছিলো রোদেলা।ঠিক এই মুহূর্তেই রোদেলার ফোন বেজে উঠে।রিসিভ করা মাত্রই সৌম্য অস্থির হয়ে বলে-"মা অনেক্ষন ধরে বেল বাজাচ্ছি,দরজাটা কি একটু খুলবে?"
দরজা খুলেই রোদেলা দেখে সৌম্য বিশাল একটা ফুলের তোড়া নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে।ছেলেকে দেখেই যেন রোদেলার মনের গহীনে জমাট বেধে থাকা বোবা কষ্টগুলো এক নিমিষেই দূর হয়ে যায়।ছেলেকে কপালে গালে চুমু দিতে থাকে।এরপর জড়িয়ে ধরে বলে-"আমাকে কখনও একা করে দিস না বাবা।"সৌম্য বুঝতে পারে তার মা যে অঝোরে কাঁদছে।কিন্তু এ কান্না কি সুখের নাকি দুঃখের তা আর বুঝে উঠতে পারেনা......