somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ছোটগল্প : ঘর

২৮ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

--বাবা আমাকেও কি চলে যেতে হবে?
--বড়দি, মেজদি তাদের কথা মনে পড়ে তোমার?
--আমি যখন অনেক ছোট তখনই ভালো ছিলাম। বড়দি মাটি দিয়ে ঘর বানাত, আর আমি ভেঙে দিতাম। অমনি মেজদির থাপ্পড়, পিঠে পাঁচাঙ্গুলের দাগ বসে যেত।
--তোমার মনে আছে বাবা, গত বর্ষায় আমার জ্বর হলো, আর অমনি তুমি ডাক্তার-কবিরাজ কত-কি করলে। অবশেষে ডাক্তার কী বলল? ‘আপনার মেয়ের তেমন কিছু হয়নি, এই একটু-আধটু জ্বর। বৃষ্টিতে ভিজলে এমন তো হবেই।’ সেই থেকে তুমি বৃষ্টিতে ভিজতে দাও না। তুমি ভাবো--ভিজলেই বুঝি জ্বর আসে? আচ্ছা, তবে তোমার কেন জ্বর হয়? তুমি তো আর বৃষ্টিতে ভেজ না। নাকি তুমিও চুপিচুপি আমার মতো ভিজ?
--তোমার সে কথা মনে আছে, তুমি তখন সিটি কর্পোরেশনের ট্যাক্স আদায় বিভাগে কাজ করতে। মাঝে মধ্যেই তুমি রাতে ফিরতে না। মা তখন বেঁচে আছে। আমার বয়স কত আরÑতিন কি চার।
--একবার তুমি অনেক রাত করে ফিরলে। মা-র পাশে আমি ঘুমিয়ে আছি। তোমার আর মা-র ফিসফিস কথাবার্তায় জেগে উঠলাম। তুমি অনেক আদর করে দিলে আর পিঠে হাত দিতেই টের পেলে মেজদির স্পর্শাঘাত। অত রাতে মেজদিকে ঘুম থেকে ডেকে তুলে কি মারটাই না মারলে। জানো, এরপর আর কোনোদিন মেজদি আমার গায়ে হাত তোলেনি, মেজদিকে তুমিও না। সে রাতে তুমি শরিষার তেল গরম করে আমার পিঠে মালিশ করে দিয়েছিল। আমার বেশ মনে আছে।
--আচ্ছা, মা-র মারা যাওয়ার কত বছর হবে?
--আট-দশ বছর, না--না অত কেন হবে? মনে হয় এই তো সেদিন।
--মা বেগুন ভাজি করে প্লেটের উপর সাজিয়ে রাখত, পাশে ইলিশের আলুপাতা ভত্তা, আর কালাইয়ের ডাল। তোমার খুব প্রিয়। আর মধ্যবিত্তের এর চেয়ে খুব বেশি-কি জোটে প্রতিদিন?
--মা রান্না পর গোসল করে এলো। তুমি মা-র আঁচলের তল দিয়ে হাত পেঁচিয়ে ধরলে, যখন সিঁড়ি দিয়ে উঠতে গিয়ে মা পা-পিছলে পড়ে যাচ্ছিল। তোমার এই হিরোচিত স্বভাবে আমি, বড়দি বেশ হেসেছিলাম।
--এরপর আমরা খাচ্ছিলাম সবাই, শুধু মেজদি ছিল না। ওর সেদিন বৃত্তি পরীক্ষার ফল দেবে। তুমিও গিয়েছিলে, কিন্তু দেরি দেখে ওকে রেখে আসতে চাইলে, আমাদের পাড়ার ফুফাত ভাই হাসান এগিয়ে এসেছিল বড় ভাইয়ের চরিত্রে। তুমি বেশ স্বস্তিতেই ফিরেছিলে হাসান ভাইকে রেখে।
--মেজদি রেজাল্ট নিয়ে ফিরল সন্ধ্যার পর। তুমি প্রতি দিনকার মতো বাজারে গিয়ে বন্ধুদের সঙ্গে তাসের আসরে বসেছ। মা, আমি, বড়দি বসে বসে টিভি দেখছিলাম। মেজদি ফাইভের পর এইটেও বৃত্তি পেল, এই আনন্দে মেজদি দরজা আটকিয়ে গলা ছেড়ে হাছন রাজার গান গাইছিল।
--হঠাৎ করে সংবাদ এলো বড়দির বান্ধবী এষাকে তুমি নাকি বিয়ে করতে যাচ্ছ। আমরা কেউ বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কিন্তু সংবাদ নিয়ে এসেছিল হাসান ভাই। অবিশ্বাসের কিছু ছিল না।
--বড়দি, মেজদি হাসান ভাইকে সঙ্গে করে বের হলো, যাতে কোনোভাবেই সংবাদটি সত্য না-হয়। আমি ছোট বলে আমাকে নেয়া হলো না।
--এষা আর বড়দি এ-বছর একসঙ্গেই এসএসসি দিয়েছিল, রেজাল্ট হয়নি।
--আমি তখন ছুটে গিয়ে আমাদের পুকুরের পুব পাশে যেখানে শিমুল গাছের সঙ্গে বেড়ে উঠেছিল বাঁশঝাড়, সেখানে দাঁড়ালাম। ওখান থেকে কোনো বাড়ি-ঘর দেখা যেত না। সুবিস্তৃত মাঠ। ধানের জমি, একটু দূরে নিচু--ওখানে পানি। আমার দেখা ওঠাই প্রথম নদী আর সাগর।
--একটু দূরে গির্জাঘরে ন’টার ঘণ্টা বাজল। মাকে একা রেখে এসে দাঁড়িয়ে আছি, মনে হতেই দৌঁড়ে গেলাম।
--না, এষা আসেনি। বড়দি, মেজদি এসেছে। হাসান ভাইকে দেখা গেল না। বাবা এসেছে কি-না জানতে ঘরে যেতেই মেঝেতে মাকে পড়ে থাকতে দেখলাম। বড়দি, মেজদি জড়সড় হয়ে বসে আছে সিঁড়িতে। আমাদের বাড়ির আশেপাশে যে দু-তিনটা বাড়ি ছিল, সেখান থেকেও কোনো আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল না, যেন সবকিছু নীরব-নিস্তব্ধ। বাড়ির পাশ দিয়ে সরু পথে কেউ যেন আজ আর যাবে না।
--বাবা আসল, সঙ্গে বড় মামা। সেই না-কি বাবাকে উস্কে দিয়েছিল।
--পরে বড়দিকে বলেছিলাম, আমাদের ভাই নাই তো কি হয়েছে? বড় মামার মতো ভাই দরকার নাই।
--বড়দির ভাইপ্রীতি সেই থেকে হারিয়ে গেল।
--মেজদি এসএসসি দেবার দু’মাস পরেই হাসান ভাইয়ের সঙ্গে পালাল। বাবা সামাজিক সম্মান রা করতে গিয়ে শেষাব্দি রাজি হলো বিয়েতে। হাসান ভাইয়ের ফ্যামিলি আগে থেকেই সম্মত ছিল।
--বড়দি নাওয়া-খাওয়া ছেড়ে দিল। দিন দিন শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাচ্ছিল। এষার বাবা মজিদ ভাইয়ের সঙ্গে এষাকে বিয়ে দিল। মজিদ ভাই বড়দিকে পছন্দ করত, বড়দিও। কিন্তু হাসান ভাইয়ের বড় মজিদ ভাই, সে কারণে বড়দি মুখ বুজে পিছু হটল। মজিদ ভাই বিয়ের একদিন আগেও আসল, কিন্তু বড়দির না আর হ্যাঁ হলো না। মজিদ ভাইও রেগে-মেগে এষাকেই বিয়ে করল।
--একা-বাড়িতে এষা এবং মেজদি। তারপর কি জেনেছিল মেজদি? সে কারণে কাছে থেকেও পর হয়ে গেল। আমি গেলে মেজদি কিছু বলেনি, এষাকে দিয়ে বলিয়েছিল আমরা যেন আর না যাই ও বাড়িতে।
--বড়দি বিএ পাশ করে একরকম বসে, বেকারই। প্রাইমারি স্কুলের শিক পদে পরীা দিলে ভাইভা কার্ডও আসে। কিন্তু চাকরি হয় না।
--এর মাস-ছয়েক পর বড়দি একটা এনজিওতে জয়েন্ট করে। সেখানকার নতুন ম্যানেজার একরকম পারিবারিকভাবে বিয়ে করেই দূর শহরে নিয়ে যায় বড়দিকে।
--আমরা শহরটাকে চিনতাম না।
--আমি তখন কাস সেভেনে।
--বাবা ধীরে ধীরে একা হয়ে যেত লাগল, আমিও।
--গার্লস স্কুলে পড়ার কারণে আমার কোনো ছেলে বন্ধু নেই, দু-একজন মেয়ে বন্ধু থাকলেও তারা অন্যদৃষ্টিতে তাকাত আমার দিকে।
--পুরো বাড়িতে আমরা দু’জন। বাবার রিটায়ের্ডমেন্টের পর প্রাপ্ত টাকা তাসের ঘরেই পুরোটা চলে যায়। সামান্য জায়গা-জমিন যা-ছিল তাও শীঘ্রই বেঁচে-খেয়ে-খেলে সাফ। বাবা পুরো বেকার হয়ে গেল। আমারো এইচএসসি ভর্তি হওয়ার পর আর পড়া হলো না। তখন বাড়িটাই শেষসম্বল হিসাবে ঝুঁকিতে আছে।
--বাবা এখন আর তাস খেলতে যায় না, বাজারেও না। তার খেলার সঙ্গী এখন শুধু আমি।
--সমাজে যারা একঘরে হয়ে যায়, তাদের রান্নার পাতিল বুঝি ফুটো হয়ে যায়? আর পেটে খাবার না-থাকলে ধর্ম-কর্মও থাকে না। ষাটোর্ধ্ব বাবাই এখন ধর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। পাড়ার দু-একজন ছেলেরা আসে যারা জোর-জবরদস্তি করে বাড়িটা লিখে নিতে চায়। তাদের সাথে পুতুলজীবনের ঘর ঘর খেলি, দরজা-জানালা খুলি-আটকাই--শেষাশ্রয়টুকু হারাবার ভয়ে; ঘরটা মাটির নয়--মাংসল, তাই আর ভাঙতে পারি না।
--বয়সী পিতার ঘরও কি ভাঙা যায়?
সর্বশেষ এডিট : ১৫ ই জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৫৮
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×