somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রং পেন্সিল ৫

২০ শে মে, ২০১১ বিকাল ৫:৩০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

রং পেন্সিল
রেলগাড়ি ঝমাঝম
হুমায়ূন আহমেদ

আমার শিশুবেলার প্রধান খেলা ছিল 'রেলগাড়ি খেলা'। বাসার কাঠের চেয়ারগুলোকে একটির পেছনে আরেকটি সাজাতাম। প্রথম চেয়ারটায় আমি গম্ভীর মুখে বসে ট্রেনের চাকার শব্দের অনুকরণে 'ঝিকঝিক ঝিকঝিক' করতাম।
শৈশবের অতি আনন্দময় সময় আলাদা করতে বললে আমি সঙ্গে সঙ্গে বলব_ট্রেনে করে দাদার বাড়ি, নানার বাড়ি যাওয়া। তখনকার ট্রেনের ইঞ্জিন ছিল কয়লার। জানালার পাশে বসে মাথা বের করলে অবধারিতভাবে চোখে পড়ত ইঞ্জিনের ধোঁয়ার সঙ্গে উড়ে আসা কয়লার টুকরা। কাজেই বড়দের প্রধান চেষ্টা ছিল শিশুদের জানালা দিয়ে মাথা বের করতে না দেওয়া। বড়দের সব নিষেধ অগ্রাহ্য করে আমি শুধু যে মাথাই বের করতাম তা না, শরীরের অর্ধেকটা জানালা দিয়ে বের করে রাখতাম। বড় মামার দায়িত্ব ছিল শক্ত করে আমার পা চেপে ধরে রাখা। চিরকুমারের মতো চিরবেকার বড় মামা আমাদের সঙ্গেই থাকতেন। আমাদের সঙ্গেই ঘুরে বেড়াতেন। অবসরে কবিতা ও জারিগান লিখতেন। কবিতাগুলোতে সুর বসিয়ে গান বানিয়ে শিশুমহলে দারুণ চাঞ্চল্য তৈরি করতেন।
ট্রেন ভ্রমণে ফিরে যাই। শিশুবেলা কাটিয়ে আমি বালকবেলায় পড়লাম, রেলগাড়ির প্রতি আকর্ষণ মোটেই কমল না। বরং বাড়ল। আমার দুষ্টুমি নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য ট্রেন-ভ্রমণে সব সময় আমাকে বসতে হতো বাবার পাশে। বাবা ছিলেন নীরব শিক্ষক। তিনি খুব কায়দা করে নানান তথ্য তাঁর বালকপুত্রের মাথায় ঢোকাতেন। যেমন_টেলিগ্রাফের তারে বসে থাকা কোন পাখির কী নাম। কেন রাস্তায় ট্রেন চলতে পারে না, ট্রেনের চলার জন্য রেললাইন লাগে।
এক ট্রেন-ভ্রমণে অদ্ভুত তথ্য দিয়ে তিনি তাঁর বালকপুত্রকে চমকে দিলেন। তিনি বললেন, ট্রেন কত মাইল স্পিডে যাচ্ছে বলতে পারবি?
আমি বললাম, না।
বাবা বললেন, খুব সোজা। ট্রেলিগ্রাফের ২৭টা (সংখ্যায় ভুল হতে পারে, এখন মনে পড়ছে না) খাম্বার দূরত্ব হলো এক মাইল। তুই ঘড়ি হাতে নিয়ে দেখবি ২৭টা খাম্বা পার হয়ে যেতে কত সময় লাগে। সেখান থেকে বের করবি ট্রেন ঘণ্টায় কত মাইল বেগে যাচ্ছে।
এর পর থেকে আমার প্রধান কাজ হলো ঘড়ি হাতে বসে টেলিগ্রাফের খাম্বা গুনে ট্রেন কত মাইল স্পিডে যাচ্ছে তা বের করা। বালক বয়সে তিনি বিশাল এক বিস্ময় আমার ভেতর তৈরি করে আমাকে অভিভূত করলেন। আমি চেষ্টা করতে থাকলাম এই জাতীয় কোনো বিস্ময় আমার পুত্র নিষাদের ভেতর তৈরি করতে পারি কি না। সমস্যা হচ্ছে, নিষাদের বয়স চার। এ বয়সের শিশুরা সব সময় বিস্ময়ের ভেতর থাকে। তাদের আলাদা করে বিস্মিত করা যায় না। হঠাৎ সুযোগ হয়ে গেল। আমি শ্রীলঙ্কায় ট্রেনে করে কলম্বোর দিকে যাচ্ছি। পুত্র নিষাদকে মনে হচ্ছে আমার শৈশবের ফটোকপি। ট্রেন ভ্রমণের আনন্দে আমার মতোই উদ্বেলিত। আমি তাকে বললাম, বাবা, মন দিয়ে শোনো ট্রেনের চাকা কী বলছে?
সে কিছুক্ষণ চাকার শব্দ শুনে বলল, জানি না তো কী বলছে?
আমি বললাম, ট্রেনের চাকা তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম বলছে। চাকা বলছে_নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত। নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত।
নিষাদ আবারও কিছুক্ষণ কান পেতে থেকে অবাক হয়ে বলল, হ্যাঁ বলছে তো!
পাঠকদের ব্যাখ্যা করার প্রয়োজন নেই, তাঁরা জানেন যেকোনো ছন্দময় শব্দ ট্রেনের চাকার সঙ্গে মিলবে। পুত্র নিষাদ ব্যাপারটা জানে না। সে বিস্ময়ে এবং আনন্দে অভিভূত হয়ে গেল। সে বলল, বাবা, শ্রীলঙ্কার ট্রেন আমার নাম কিভাবে জানল?
আমি বললাম, সব ট্রেন তোমাদের দুই ভাইয়ের নাম জানে। বাংলাদেশের ট্রেনও জানে।
বাংলাদেশে ফিরে সে আবার ট্রেনে চাপল। কিছুক্ষণের মধ্যেই তার আনন্দধ্বনি। সে অবাক হয়ে বলল, ট্রেন বলছে নিষাদ-নিনিত, নিষাদ-নিনিত।
আচ্ছা, আমি কি ছোট একটি বাচ্চার সঙ্গে প্রতারণা করলাম না? এই শিশুটি একদিন বড় হয়ে জানবে ট্রেন তার নামে গান করে না। সে কি তখন নিজেকে প্রতারিত মনে করবে না? পৃথিবীর সব দেশেই নানান ভাবে শিশুরা প্রতারিত হয়। পড়ে যাওয়া দাঁত ইঁদুরের গর্তে রাখলে ইঁদুর সুন্দর দাঁত উপহার দেয়। তারা বিশ্বাস করে, সান্তাক্লজ এসে তাদের উপহার দিয়ে যায়। শিশুদের কাছে একসময় প্রতারণা ধরা পড়ে, তারা তখন (আমার ধারণা) বড়দের ক্ষমা করে দেয়।
আমরা বড়রাও প্রতারিত হই। প্রতারণা করেন রাজনীতিবিদরা। ইলেকশনের আগে কত সুন্দর সুন্দর কথা বলেন। বৈতরণী পার হওয়ার পর সব কিছুই ভুলে যান। বিস্মৃতি ব্যাধি হয়। এ ব্যাধি পাঁচ বছর থাকে। পাঁচ বছর পর রোগ সারে। আবার পূর্ণোদ্যমে পুরনো কথা বলতে থাকেন, আমরা আবারও প্রতারিত হওয়ার জন্য প্রস্তুতি গ্রহণ করি। ন্যাড়া একবারই বেলতলায় যায়। আমরা প্রতি পাঁচ বছর অন্তর বেলতলায় যাই। বেলতলায় যেতে আমাদের বড় ভালো লাগে।
আচ্ছা এ রকম হলে কেমন হয়_বাংলাদেশের সব মানুষ যদি ঠিক করে ভোট দিয়ে লাভ তো কিছু নেই, কাজেই এই নির্বাচনে আমরা কেউ ভোট দেব না। ইলেকশন হয়ে গেল, একটি ভোটও পড়ল না। তখন কী হবে? বাংলাদেশ কি সরকারবিহীন হয়ে পড়বে? আইন কী বলে?

পাদটীকা
'শহীদ স্মৃতি বিদ্যাপীঠ' নামে আমি একটি স্কুল দিয়েছি। আমি কল্পনায় যে সুন্দর স্কুল দেখি এই স্কুলটি সে রকম। চার বছর ধরে স্কুলটি চলছে। পাসের হার শতভাগ। ড্রপ আউট শূন্য। স্কুল দেখতে দূর-দূরান্ত থেকে মানুষজন আসে, কিন্তু আমার এলাকার নির্বাচিত এমপি এবং মহিলা এমপি কেউই দুই মিনিটের জন্যও স্কুলে আসেননি। আমি কিছুদিন আগে একদল লেখক, কবি, অধ্যাপক, বুদ্ধিজীবীকে স্কুলে নিয়ে গেলাম। আমার এলাকার এমপিদের অনুরোধ করে চিঠি পাঠালাম তাঁরাও যেন আসেন। দুজনের কেউই এলেন না। এমপিদের নানান কর্মকাণ্ডে ব্যস্ত থাকতে হয়। বললেই তো তারা সময় বের করতে পারেন না। টার্ম শেষ হয়ে যাচ্ছে, এখনো শুল্কমুক্ত গাড়ির ব্যবস্থা হলো না_এটা নিয়েও হয়তো ব্যস্ততা আছে।

'আমাদের সন্তানেরা থাকুক দুধে-ভাতে
আমাদের এমপিরা থাকুক ট্যাঙ্ ফ্রি গাড়িতে।'
সূত্র...
৪টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন আর আদর্শ কতটুকু বাস্তবায়ন হচ্ছে

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৭

তার বিশেষ কিছু উক্তিঃ

১)বঙ্গবন্ধু বলেছেন, সোনার মানুষ যদি পয়দা করতে পারি আমি দেখে না যেতে পারি, আমার এ দেশ সোনার বাংলা হবেই একদিন ইনশাল্লাহ।
২) স্বাধীনতা বৃথা হয়ে যাবে যদি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×