somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

কেওক্রাডংয়ের পথে (উচ্চতা ৩১৭২ ফুট)

১৮ ই মে, ২০১১ দুপুর ১২:৩৭
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মিষ্টি হেসে চায়ের কাপটা হাতে তুলে দিল মেয়েটি। বেলা দুইটার চড়চড়ে রোদেও সেই চায়ের স্বাদ শরবতের চেয়ে বেশি। দীর্ঘ খাড়া ঢাল বেয়ে উঠে আসার পরিশ্রম যেন সার্থক। সামনে দুর্গম গিরি, কান্তার মরু...মানে কেওক্রাডং পৌঁছানোর পাহাড়ি পথ। কিন্তু আমাদের উদ্যমের কমতি নেই। হিমালয় না-ই বা হলো, কেওক্রাডং তো জয় করতে যাচ্ছি।
আমরা আছি দার্জিলিংপাড়া নামের জায়গায়। পেছনে ফেলে এসেছি বগালেক, চিম্বুক, নিলগিরি। এখানে বমদের একটি পাড়ায় বসে চা পানের পর্ব চলছে। বম তরুণী দোকানদার।

ছবি: নুরুল আজম

বের হয়ে আবার হাঁটা। ঘণ্টা খানেক পর দূর থেকে দেখতে পেলাম কেওক্রাডংয়ের চূড়া। ততক্ষণে আকাশে একটু একটু মেঘও জমতে শুরু করেছে। রোদের তেজও পড়ে গেছে অনেকখানি। কয়েক ফোঁটা বৃষ্টিও পড়ল গায়ে। কেওক্রাডংকে হাতের নাগালে দেখে হঠাৎ শরীরের সব ক্লান্তি উবে গেল। ভূমি থেকে তিন হাজার ১৭২ ফুট উঁচুতে আমরা। আমাদের দলের সাতজনেরই প্রথম এত দূর আসা। হইচই করলাম। গলা ছেড়ে চিৎকার করলাম। টের পেলাম খিদে পেয়েছে। খেতে হবে। খাওয়ার জন্য যেতে হবে সামনের পাশিংপাড়ায়। পাড়াপ্রধান পাশিং কারবারিকে সকালেই ফোন করে জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। হাসিমুখে অভ্যর্থনা জানালেন তিনি। মেন্যু পাহাড়ি ঢেঁকিছাঁটা লাল চালের ভাত আর ঝাল করে রান্না পাহাড়ি মোরগ। খাওয়া শেষে আবার কেওক্রাডংয়ের চূড়ায়। কাটালাম আরও ঘণ্টা খানেক। বিকেল সাড়ে পাঁচটার দিকে ফিরতি পথে রওনা দিলাম। উদ্দেশ্য, চাঁদের আলোয় পাহাড়ি ঢাল বেয়ে হেঁটে নামব। রাতে হাঁটা দিনের চেয়ে অনেক সহজ; কারণ, গরম নেই একটুও। দার্জিলিংপাড়ার বম সুন্দরীর দোকানে আবারও চা-বিরতি। একই রকম অভ্যর্থনা। চা পান শেষে বিদায় নিয়ে আবার রওনা দিলাম। মনটা যেন কেমন করে উঠল। কেওক্রাডং না অন্য কারও জন্য, জানি না। চাঁদের আলোয় পাহাড়ি ট্রেইলটা দেখতে একটা আঁকাবাঁকা দড়ির মতো। সেই দড়ির ওপর হেঁটে চলেছি আটটি ছায়ামূর্তি। এখন আর তেমন ক্লান্তিটান্তি নেই। কেমন যেন একটা নেশায় পাওয়ার মতো বিরতিহীন হেঁটে চলেছি আমরা। রাত বেশি হওয়ার আগে রেস্টহাউসে পৌঁছাতে হবে। বিকেলে আকাশে মেঘ ছিল। বৃষ্টি নামলে ভয়ংকর হয়ে যাবে আমাদের ফেরা।
সাড়ে আটটায় নিরাপদেই পৌঁছে গেলাম রেস্ট হাউসে। ঘেমে সবার গোসল হয়ে গেছে। রেস্টহাউসের মাঠে বসলাম গোল হয়ে। উঠতে ইচ্ছে করছিল না—পা জমে গেছে। মনে হলো, বিশ্বজয় করে এসেছি। চলে গেলাম সোজা বগালেক। লেকের ঠান্ডা পানিতে গোসল করলাম অনেকক্ষণ সময় নিয়ে। লেকের ঠান্ডা পানিতে যেন ধুয়ে গেল পাহাড় বেয়ে ওঠার সব ক্লান্তি।
অথচ সকালেও ভাবিনি আজকের দিনটা এমন হবে। হঠাৎ সিদ্ধান্তেই বগালেক থেকে কেওক্রাডং চলে যাওয়া। ফ্ল্যাশব্যাকে টুকরো বর্ণনা। বগালেক থেকে মিনিট খানেকের হাঁটাপথ লারাম রেস্টুরেন্ট। ১০-১২টি ঘর আর তার চেয়ে বেশি কিছু পরিবারবেষ্টিত একটি জায়গা, লেকের পাড়েই। প্রায় প্রতিটি ঘরের সঙ্গেই দোকান। এখানে সাকুল্যে ৪০ জন গাইড আছেন। তাঁদের সরদার হলেন লারাম। লারামই আমাদের গাইড। কে তুলল প্রস্তাবটা মনে নেই। তবে মিনিট খানেকের মধ্যেই হইহই শুরু হলো—কেওক্রাডং যাব।
১১টা ৩৮ মিনিটে যাত্রা শুরু। সঙ্গে কিছু কলা, পানির বোতল, কেক। পাহাড়ি বন-ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে একটি সরু পথ—পায়ে হাঁটার ট্রেইল। সেই ট্রেইল ধরেই আমরা আটজন হেঁটে চলি। কোথাও খাড়া উঁচু আবার খাড়া নিচু। মাঝেমধ্যে ঝোপঝাড়ের একটু ছায়া পেলে শান্তি লাগে। প্রথম মিনিট বিশেক হাঁটার পর মনে হলো, এই কাজ আমার পক্ষে সম্ভব নয়। বেশ খানিকটা পথ হাঁটার পর প্রথম একটা ছোট্ট ঝরনার মতো জায়গায় এসে থামলাম। জায়গাটা নিরিবিলি। পানি অনেক ঠান্ডা। মুখ-হাত ধুয়ে, মাথায় পানি ঢেলে আবার রওনা হলাম। আরও বেশ খানিকটা পথ মোটামুটি নিজেকে টেনেহিঁচড়ে নিয়ে যাওয়ার পর পৌঁছে গেলাম একটা ছোট ঝরনার কাছে। স্থানীয় বাসিন্দারা এটাকে ডাকে ‘চিংড়ি ঝরনা’ বলে। এতক্ষণ হাঁটার ক্লান্তির অনেকটুকু শুষে নিল ঝরনার শীতল পানি। আবার শুরু। একসময় হঠাৎ খেয়াল করলাম, পা সয়ে গেছে। লারাম জানালেন, পথ এখনো অনেক বাকি। একটার পর একটা পাহাড় পেরিয়ে যাচ্ছি। পাহাড় যেন আর শেষ হয় না। অসংখ্য পাহাড় দিয়ে গাঁথা মালা যেন। কিছুদূর যাওয়ার পর একটা যাত্রীছাউনি পড়ল; ওখানে থামলাম। না থেমে অবশ্য উপায়ও নেই। এ পর্যন্ত আসতে সবচেয়ে দীর্ঘ ঢাল বেয়ে উঠতে হয়েছে, ফলে সবাই কমবেশি হাঁপিয়ে গেছি। পৌঁছে গেছি দার্জিলিংপাড়া।
চোখের সামনে শুধু ভাসছে বম মেয়েটির মুখ। ফেরার পর বগালেকের পানিও তার স্মৃতি ধুয়ে দিতে পারল না।
কুটিরের মেঝেতে রাত কাটালাম। সকালে ভালো করে আরও কিছুক্ষণ বগালেক দেখে হেঁটেই রওনা দিলাম। নিচে আমাদের জন্য চান্দের গাড়ি অপেক্ষা করছে। গতকাল কেওক্রাডং গিয়ে সাহস অনেক বেড়ে গেছে। মিনিট বিশেক ঘোরাপথে হেঁটে গাড়ির কাছে চলে এলাম। আবার গিরিখাতের মতো ঢালু পথে চান্দের গাড়িতে করে চাঁদ থেকে ধরণিতে। রুমায় যখন পৌঁছাই, তখন সূর্য সোজা মাথার ওপর। সাঙ্গুতে নেমে এবার গা ভাসিয়ে দিলাম। পাহাড়ের ক্লান্তি পাহাড়ি নদী সাঙ্গুতে ভাসিয়ে দিয়ে ফিরে এলাম চিম্বুকে।
এরপর আর কী? চোখ বুঝলেই চোখের সামনে ফাস্ট ফরওয়ার্ড মুভির মতো দ্রুত ভেসে চলল চিম্বুকের সকাল, রুমা থেকে বগালেকের সেই ভয়ংকর ঢাল, রাতের বগালেক, কেওক্রাডং যাওয়ার পথের অসংখ্য পাহাড়, কেওক্রাডংয়ের চূড়া, পাশিং কার্বারির পাহাড়ি মোরগের ঝোল, সাঙ্গুর হাঁটুপানি। গোটা স্বপ্নের কোথাও এতটুকু ক্লান্তি নেই। আমার দেশের এই সৌন্দর্য না দেখে মরে গেল একটা আফসোস থেকে যেত। স্বপ্নেই বেজে উঠল, ‘এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি...’।

যেভাবে যাবেন
প্রথমে চট্টগ্রাম থেকে বাসে বান্দরবান। ওখান থেকে চান্দের গাড়িতে সোজা রুমা। এসব ক্ষেত্রে দরদামটা আগেই করে রাখা ভালো। নৌকায় সাঙ্গু পার হয়ে রুমা বাজার। আবারও চান্দের গাড়ি। ওই গাড়িতেই বগালেক। লেকের পাড়েই লারাম রেস্টহাউস। রাতে থাকার পরিকল্পনা থাকলে রুম ভাড়া করতে পারেন। ওখানেই পাবেন গাইড। বাকিটুকু হাঁটাপথ; গাইডই নিয়ে যাবেন। সঙ্গে সানগ্লাস, হ্যাট, ব্যাক ব্যাগ, পানির বোতল, হালকা কেক/বিস্কুটও রাখতে পারেন। হাঁটার জন্য শর্টস কিংবা ট্রাউজারই ভালো। সাক্ষী-প্রমাণ রাখতে চাইলে একটা ক্যামেরা অবশ্যই। পথে কোথাও এটিএম বুথ নেই; টাকা-পয়সা পর্যাপ্ত নিয়েই বের হওয়া উচিত।

প্রকৃত লেখক:  তাওহিদ মিলটন
৭টি মন্তব্য ১টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×