somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

পোস্টটি যিনি লিখেছেন

সালেহ মতীন
ভাঙতে নয়, গড়তে চাই। গড়তে চাই সম্প্রীতি ও সৌহার্দ্যের একটি বিশ্ব সৌধ। আগামী প্রজন্মকে হানাহানিমুক্ত একটি শান্তিময় সুন্দর পৃথিবী উপহার দিতে চাই। সুন্দরকে আরো সুন্দর করে সাজানো এবং পরিশীলিত ব্লগিং চর্চার মাধ্যমে পরিশুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ জাতি গঠনই আমার সাধনা।

হাসপাতালের ধর্ম আসলে কী ?

১৫ ই মে, ২০১১ সকাল ১১:১৪
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

হাসপাতালের ধর্ম আসলে কী ?
-সালেহ মতীন

একটি দু:সংবাদ অনিচ্ছা সত্ত্বেও প্রায়ই আমাদের শুনতে হয়, উপযুক্ত চিকিৎসার অভাবে কিংবা চিকিৎসকের অবহেলার কারণে রোগীর করুণ মৃত্যু ঘটেছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এ অভিযোগ কিছুটা আবেগ তাড়িত হয়ে থাকে, তবে অধিকাংশ ক্ষেত্রে এর সত্যতা মিলে। অভিযোগটি বিশ্লেষণ করলে আমরা দু’টি বিষয় খুঁজে পাই। এক. অবহেলার জন্য হয় দায়িত্বপ্রাপ্ত কোন চিকিৎসক এককভাবে দায়ী অথবা দুই. এর জন্য সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠান তথা প্রতিষ্ঠানের নিয়ম-নীতি দায়ী। তবে দায়ী যিনিই হোক না কেন মজার ব্যাপার হলো, এর অন্তর্র্নিহিত কারণ অভিন্ন। সেটা হলো চিকিৎসক কিংবা প্রতিষ্ঠানের একমাত্র বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি। চিকিৎসা পেশা একটি মহত্তম সেবার প্রতিশ্রুতি হলেও আমরা অত্যন্ত মর্মাহত হই এবং জাতি হিসেবে লজ্জা পাই যখন শুনি চিকিৎসার অভাবে কেউ আমাদের মাঝ থেকে হারিয়ে গেল। মানবিক মূল্যবোধ যদি আমাদের মধ্য থেকে বিলুপ্ত হয়, তাহলে চিকিৎসা সেবার মতো মহান ব্রত পরিপালনও তার আপন মর্যাদা ধরে রাখতে পারে না। বর্তমান দুনিয়ায় উপযুক্ত মেডিসিনের অভাব আছে এ কথা বলার অবকাশ নেই। শুধুমাত্র আন্তরিকতার অভাবে মানুষের সুন্দরভাবে বেঁচে থাকার মায়াময় আবেদন পরাজিত হচ্ছে।

কিছুক্ষণ আগে আমি একটি টিভি সংবাদ দেখলাম যে, ছুরিকাহত এক ব্যক্তিকে রক্তাক্ত অবস্থায় রেল লাইনের পাশে পড়ে থাকতে দেখে এক সহৃদয় ভ্যান চালক তাকে তুলে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে আসে। ডাক্তারদের তিনি বলেন যে, আহত ব্যক্তি অচেতন অবস্থায় পড়ে ছিল, নিজের মানবিক দায়িত্ব বোধ থেকে তিনি তাকে চিকিৎসার জন্য নিয়ে এসেছেন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ জরুরী চিকিৎসা শুরু করার পরিবর্তে রোগীর অভিভাবকের খোঁজ জানতে চাইলেন। অভিভাবক খোঁজ করা দোষের নয়, কিন্তু কোথায় পাওয়া যাবে এখন তার অভিভাবক ? দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির অভিভাবকের খোঁজ পাওয়া তো সহজ নয়, সময়ের প্রয়োজন। হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের চিন্তা খুব পরিষ্কার, অভিভাবকের সন্ধান ও সম্মতি পাওয়া না গেলে চিকিৎসার ব্যায় বাবদ বিল কে পরিশোধ করবে ? ভ্যান চালকের অনুরোধে কাজ হলো না, এবং সত্যি সত্যি ছুরিকাহত ব্যক্তি কাতরাতে কাতরাতে এক সময় করুণ মৃত্যুর মুখে ঢলে পড়ল। চিকিৎসকরা একবারও এ মানবিক ভাবনাটুকু ভাবল না যে, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষই তো রাস্তায় দুর্ঘটনা কবলিত ব্যক্তির অভিভাবক ! শুধুমাত্র অর্থচিন্তায় চোখের সামনে যদি কোন রক্তমাখা আহত ব্যক্তিকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া হয় তাহলে চিকিৎসক হিসেবে তাদের উচ্চ মর্যাদা থাকে কী করে ? একজন ভ্যানচালক যার কিনা একদিন কাজ না করলে পরিবার পরিজন নিয়ে অনাহারে থাকতে হয় মুমূর্ষু ব্যক্তিকে বাঁচাতে সবকিছু ফেলে ছুটে এসেছেন হাসপাতালে। অথচ অনেক ডাক্তারই তার হাতের নাগালে সব সুবিধা থাকা সত্ত্বেও মানুষের জীবন বাঁচাতে এগিয়ে আসেন না। দু’ পেশার মানুষের মধ্যে মূল্যবোধের তফাৎ স্পষ্ট। অবশ্য এখানে বলা উচিত, অনেক ডাক্তারই আছেন যারা আন্তরিকভাবে রোগীর চিকিৎসা করতে অভ্যস্ত।

আমার নিজের জীবনের একটি ঘটনা, ২০০৬ সালের ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যায় আমি এক মারাত্মক সড়ক দুর্ঘটনায় গুরুতর আহত হয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফেলি। ঘটনাস্থল ঢাকার মহাখালী বাস টার্মিনাল সংলগ্ন মহাসড়ক। সজীব নামে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিবিএ পড়ুয়া এক ক্ষীণদেহী সুহৃদ আমাকে তুলে জরুরী চিকিৎসার জন্য স্থানীয় ঢাকা মেট্রোপলিটন হাসপাতালে নিয়ে যায়। তখন আমার মাথা দিয়ে দরদরিয়ে রক্ত ঝরছে এবং আমার একটি পা সম্পূর্ণ দ্বিখণ্ডিত। কিন্তু বিপত্তি দেখা দিল, হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ অভিভাবকের উপস্থিতি ছাড়া কোন অবস্থাতেই আমাকে চিকিৎসা দিতে রাজী নন। তাদের বক্তব্য একটাই, বিলের দায় দায়িত্ব কে নিবে ? একটি আহত মানুষের যেখানে বাঁচা-মরার প্রশ্ন সেখানে ডাক্তারদের মনে সে বিষয়ে বিন্দুমাত্র রেখাপাত করেনি। সজীবের অনেক অনুনয় বিনয় উপেক্ষা করে ডাক্তাররা যখন আমাকে ফেলে যে যার মতো চলে যান তখন অনেক চেষ্টার পর মোবাইলে আমার শ্যালক ইঞ্জিনিয়ার নাজমুল হাসানকে সংবাদ দিয়ে হাসপাতালে ডেকে আনা সম্ভব হয়। ততক্ষণে পেরিয়ে গেছে প্রায় ১ ঘণ্টা। নাজমুল হাসান এসে চিকিৎসার বিল পরিশোধের নিশ্চয়তা দিলে তবেই ডাক্তাররা আমাকে স্পর্শ করে। বলা বাহুল্য, তার আসতে আরো দেরি হলে আমার রক্তক্ষরণ জনিত সমস্যা জটিল আকার ধারণ করতে পারতো এবং আর কোন দিন হয়ত এ পৃথিবীর আলো দেখা আমার পক্ষে সম্ভব হতো না। কী মর্মান্তিক দু:সংবাদ! কী অনিরাপদ পথ চলা আমাদের ! ভাবতে অবাক লাগে আমরা কোন্ নিষ্ঠুর, নির্দয় সমাজে বসবাস করছি ! এখানে জীবনের চেয়ে অর্থবিত্তের মূল্য বোধ করি অনেক বেশি। মানবতার নির্মম পরাজয় এখানেই।

এটা অমানবিক যে, চিকিৎসকরা তথা হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ শুধুমাত্র বাণিজ্যিক চিন্তাই অন্তরে লালন করবেন। পথচারী কোন ব্যক্তির হঠাৎ অসুস্থতা কিংবা দুর্ঘটনায় পতিত হওয়া অস্বাভাবিক নয়। এমতাবস্থায় তার অভিভাবক তালাশ করার অজুহাতে চিকিৎসায় বিলম্ব করা কোন হাসপাতাল বা ক্লিনিকের ধর্ম হতে পারে না। চিকিৎসা সেবার মতো মহৎ পেশায় যারা নিয়োজিত তাদের কমিটমেন্ট দু:স্থ ও মুমূর্ষু রোগীর পাশে থাকার। ভেবে বিষ্মিত হই, শরীর থেকে রক্ত ঝরা গুরুতর আহত ব্যক্তিকে দেখেও একজন চিকিৎসকের মনে অর্থচিন্তা আসে কী করে ? আমি মনে করি, বাণিজ্যিক চিন্তা যদি চিকিৎসকরা মন থেকে অপসারণ করতে না পারেন তাহলে তাদের পেশায় পরিবর্তন আনা জরুরী। আল্লাহর দুনিয়াতে রিজিকের জন্য পেশার অভাব নেই। চিকিৎসা একটি পেশার নামই নয় শুধু, সেবার নামও বটে। একমাত্র অর্থলিপ্সায় যদি চিকিৎসা পেশা কলঙ্কিত হয় তাহলে এ লজ্জার দায়ভার জাতির উপর পতিত হবে। কারণ, একজন ডাক্তার জাতির কাছে ঋণী।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তর তথা স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে হাসপাতাল বা ক্লিনিকের জন্য কিছু বাধ্যবাধকতা থাকা উচিত। যেমন, পথচারী কোন ব্যক্তির দুর্ঘটনাজনিত ইমার্জেন্সি আহতাবস্থায়, দু:স্থ-অসহায়ের জীবন বাঁচানোর তাগিদে তার জরুরী চিকিৎসার ক্ষেত্রে হাসপাতাল বা ক্লিনিক কর্তৃপক্ষ নি:শর্ত দায়িত্ব পালন করবে। কোনরূপ অবহেলা অথবা অযাচিত অপরিচর্যায় রোগীর মৃত্যু হলে কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নেয়া হবে এবং হাসপাতাল বা ক্লিনিকের লাইসেন্স বাতিল করা হবে। ডাক্তারী পড়ুয়া একজন ছাত্রের পিছনে দেশের যেখানে লাখ লাখ টাকা ভর্তুকি দিতে হয় সেখানে পরবর্তীতে পেশাগত জীবনে তাদের কাছ থেকে জাতি তো কিছু আশা করতেই পারে। তদুপরি আমাদের মনে রাখতে হবে, চিকিৎসা সেবা পাওয়া একজন মানুষের অন্যতম মৌলিক অধিকার। তাদেরকে এ অধিকার বঞ্চিত করা ন্যায়সঙ্গত নয়। আপাত দৃষ্টিতে একরকম বেকায়দায় ফেলে কোন রোগীর কাছ থেকে উচ্চহারে বিল গ্রহণের ঘটনা ঘটলেও প্রকৃতপক্ষে এটা মানবাধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন।

চিকিৎসার অভাব এবং হাসপাতাল কর্তৃপক্ষের অযত্ন-অবহেলায় আহত পথচারীকে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া মৌলিক মানবাধিকার পরিপন্থী। একটি বিষয়ে আমাদের বিশ্বাস পরিষ্কার হওয়া প্রয়োজন, হাসপাতাল অথবা কোন চিকিৎসকের কাছে জরুরী চিকিৎসা দাবী করা কোন দয়া ভিক্ষ করা নয়, বরং অধিকারের প্রশ্ন এখানে। মানবিক মূল্যবোধ ও অধিকার সচেতন দৃষ্টিভঙ্গি উন্নত রাখতে পারলে চিকিৎসা বিপর্যয়ের মতো দু:খজনক দু:সংবাদ আমাদের কখনই শুনতে হতো না।

লেখক : পিএইচ.ডি গবেষক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
E-mail : [email protected]
সর্বশেষ এডিট : ২২ শে মে, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:৩৯
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

টুইস্টেড মাইন্ড অফ আ সিরিয়াল কিলারঃ কবি কালিদাস স্পেশাল

লিখেছেন এইচ তালুকদার, ২৭ শে মে, ২০২৪ রাত ১:১৩



সিরিয়াল কিলারদের নিয়ে আমার আগ্রহ শুরু হয় এই ব্লগেরই একজন অসাধারন ব্লগার ''ডক্টর এক্স'' এর লেখা পড়তে যেয়ে। বাংলা ভাষায় সাইকোলজির দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সেলফ হেল্প ধরনের অসাধারন কিছু... ...বাকিটুকু পড়ুন

ফিলিস্তিনে কী শান্তি সম্ভব!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২৭ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:২১

এক.
প্রতিদিন ঘুমানোর আগে আলজাজিরা দেখি৷ গাজার যুদ্ধ দেখি৷ রক্ত দেখি৷ লাল লাল৷ ছোপ ছোপ৷ সদ্য জন্মানো শিশুর৷ নারীর৷ কিশোর কিশোরীর৷ বৃদ্ধের৷ সারি সারি লাশ৷ সাদা কাফনে মোড়ানো৷ ভবনে চাপা পড়া৷... ...বাকিটুকু পড়ুন

প্রাকৃতিক দূর্যোগে আপনার অভিজ্ঞতা কেমন?

লিখেছেন অপু তানভীর, ২৭ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৫

আমার জীবনে আমি সরাসরি প্রাকৃতিক দূর্যোগের ভেতরে পড়েছি বলে আমার মনে পড়ে না । ২০১৯ সালের ঘটনা। ঘূর্ণিঝড়ের নাম সেবার ছিল সম্ভবত বুলবুল ! সেটা যখন আসছিল তখন আমি ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

উপকূলের ভাই-বোনদের প্রতি গভীর সমবেদনা

লিখেছেন বিষাদ সময়, ২৭ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:০৭




আমরা ঢাকার পাকা দালানে বসে যখন আয়েস করে চায়ে চুমুক দিয়ে বৃষ্টি বিলাসে বিভোর, ঠিক সেই সময় আমাদের উপকূেলের ভাই-বোনেরা হয়তো কেউ স্বজন, কেউ ঘর, কেউ ফসল, কেউবা গবাদী... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজকের ব্লগার ভাবনা: অশ্লীলতা কি পোশাক দিয়ে নির্ধারণ করা উচিৎ নাকি মানসিকতা ও চরিত্র দিয়ে?

লিখেছেন লেখার খাতা, ২৭ শে মে, ২০২৪ দুপুর ২:৫২


ছবিটি -ফেসবুক থেকে সংগৃহীত।

কহিনুরের, ফ্লোরা ওরিয়েন্টাল বিউটি সোপ।১৯৭৮ সালের বিজ্ঞাপন। ছবিটি ফেসবুকে পেয়েছি। ব্লগার সোনাগাজী, ব্লগার কামাল ১৮ সহ যারা মুরুব্বি ব্লগার রয়েছেন তারা হয়তো এই বিজ্ঞাপনটি... ...বাকিটুকু পড়ুন

×