somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ইসলামে পারিবারিক বিকাশ

১৩ ই মে, ২০১১ দুপুর ১:১১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

মানবজাতির প্রাথমিক ভিত্তি হলো তার পরিবার। পরিবার থেকেই পর্যায়ক্রমে মানুষ বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। ধীরে ধীরে গড়ে ওঠে সমাজ, অতঃপর অর্থনৈতিক লেনদেন, সেখান থেকে রাজনৈতিক কর্মকা-ের সূত্রপাত। এভাবে মানবজাতির বিকাশ, সমাজ সভ্যতার সৃষ্টি, সংস্কৃতিবোধের উন্মেষ। যে জাতির পারিবারিক বন্ধন যত দৃঢ় সে সমাজ ততই উন্নত ও শক্তিশালী। পারিবারিক বন্ধনকে সুদৃঢ় করার জন্য যা কিছু প্রয়োজন মুসলিম সমাজে তার সব কিছুই বিদ্যমান রয়েছে। মুসলিম দেশগুলোর এই পারিবারিক সুদৃঢ় বন্ধনের ওপর ঈর্ষান্বিত হয়ে পাশ্চাত্য সমাজ মুসলিম পারিবারিক বন্ধনে বিশৃঙ্খলা সৃষ্টির নানা রকম অপচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি ছড়ানোর চেষ্টা করছে। এর পেছনে অন্যতম কারণ হলো আজকের পাশ্চাত্য সমাজে পারিবারিক বিকাশের পরিবর্তে তাদের পরিবার প্রথা ভেঙে পারিবারিক অশান্তি বিরাজ করছে। পরিবারের বিভিন্ন সদস্যদের নিয়ে নানামুখী সমস্যায় জর্জরিত পাশ্চাত্য। তাদের পরিবারে ছোট-ছোট শিশুদের লালনপালন নিয়ে সমস্যা, বয়স্ক লোকদের ভরণ-পোষণ নিয়ে সমস্যা, কর্মহীন লোকদের নিয়ে সমস্যা। কারণ পাশ্চাত্য দর্শনে গঠিত সমাজে বয়স্ক লোকদের প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে যায় যখন সে কর্মহীন হয়ে পড়ে, তখন তার ঠিকানা হয় বৃদ্ধাশ্রম, আর শিশুদের লালনপালনে সমস্যা, কারণ স্বামী-স্ত্রী ভিন্ন ভিন্ন স্থানে বসবাস করে প্রয়োজনে একত্রে মিলিত হয়। প্রত্যেকেই নিজ চাকরি নিয়ে ব্যস্ত। এ কারণে কে দায়িত্ব নেবে সন্তানের, অবশেষে সন্তানের ঠিকানা হয় বেবি হোমে। এভাবে বৃদ্ধরা যেমন জীবন সায়াহ্নে এসে বিড়ম্বনার শিকার হন, তেমনি শিশুরা মা-বাবার সানি্নধ্য না পাওয়ায়, তাদের আদর-সোহাগ না পাওয়ায়, তাদের মধ্যে এক ধরনের দয়া-মায়াহীনতা, মা-বাবার প্রতি অনাগ্রহ সৃষ্টি হয়। এই শিশুরা বড় হয়ে তাদের মা-বাবার খোঁজ নেয় না। তারা যে কোনো মূল্যে সম্পদ অর্জন কর এবং ভোগ কর নীতিতে বিশ্বাসী হয়ে ওঠে।
ইসলামী সমাজে পরিবার গঠনে স্বামী-স্ত্রীর দায়িত্ব, তাদের পারস্পরিক আচার-আচরণ, সন্তানের প্রতি তাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য অত্যন্ত সুন্দরভাবে বিধৃত হয়েছে। কারো দায়িত্ব এড়িয়ে যাওয়ার সুযোগ নেই। ইসলামে স্ত্রীর প্রতি স্বামীর দায়িত্ব, স্বামীর প্রতি স্ত্রীর দায়িত্ব ও কর্তব্য, শিশু জন্ম হলে তার প্রতি পিতা-মাতার করণীয়_ সব কিছু নিখুঁতভাবে বর্ণনা করা হয়েছে। সন্তান লালনপালনে কষ্টের কারণে ইসলামে তাদের মর্যাদা এত বেশি দেয়া হয়েছে, ইসলামে আল্লাহতায়ালার ইবাদতের পরে পিতা-মাতার প্রতি কর্তব্য পালনকে আবশ্যক করে দিয়েছে। মায়ের পদতলে সন্তানের বেহেশত ঘোষণা করা হয়েছে। পিতা-মাতার প্রতি সুন্দর আচরণ করা, তাদের কোনো ধরনের কষ্ট না দেয়া, তাদের সামনে নিজেকে তুচ্ছ করার চাদর বিছিয়ে দেয়া, কোনো কারণে তারা উহ-আহ্ করতে পারে এ ধরনের আচরণকে সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে। এমনকি তারা যখন বৃদ্ধ হয় তখন তাদের সেবার মাধ্যমে জান্নাত লাভ করতে না পারাকে চরম ব্যর্থতা বলা হয়েছে। রাসুল (সা.) বলেছেন- 'যে ব্যক্তি পিতা-মাতার যেকোনো একজনকে অথবা উভয়কে বৃদ্ধ অবস্থায় পেল, অথচ সে জান্নাত লাভ করতে পারল না তাদের নাক ধুলিময় হোক।' সন্তানের প্রতি পিতা-মাতার হক সম্পর্কে রাসুল (সা.) যে আদর্শ শিক্ষা দিয়ে গিয়েছেন তার কোনো তুলনা হয় না। হজরত আবু হুরায়রা (রা.) বলেন-জনৈক সাহাবী রাসুল (সা.)-কে জিজ্ঞাসা করেন- 'ইয়া রাসুলুল্লাহ আমার নিকট সুন্দর ব্যবহার পাওয়ার কে বেশি হকদার?' তিনি বললেন- 'তোমার মা, অতঃপর তিন তিনবার একই উত্তর দিলেন, চতুর্থবার বললেন_ তোমার বাবা।' মুহাদ্দিসিনে কেরাম লিখেন মা-বাবার মধ্যে সন্তানের কাছ থেকে সেবা পাওয়ার ক্ষেত্রে মা বাবার চেয়ে তিনগুণ বেশি অধিকার রাখেন। কারণ মা-ই সন্তানকে লালনপালন, ভরণপোষণ করার যাবতীয় কাজ আঞ্জাম দিয়েছেন। এখন সন্তান যদি বেবি হোমে বড় হয় তাহলে সেক্ষেত্রে মা সন্তানের কাছ থেকে কতটুকু সেবা দাবি করতে পারেন। যেই মা সন্তানের জন্য তার সামান্য সুযোগ-সুবিধা ত্যাগ করতে পারল না, যে মা আদর্শ সন্তান গঠনের চেয়ে নিজের সাময়িক চাহিদা পূরণকেই অগ্রাধিকার দিল, সেই সন্তানের প্রতি কতটুকু অধিকার দাবি করতে পারে? একজন আদর্শ মা-ই তো পারেন আদর্শ জাতি গঠন করতে, আদর্শ সমাজ গঠন করতে।
বর্তমান সমাজে একক পরিবার সংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় মুসলিম দেশগুলোতেও মায়া-মহব্বত হ্রাস পাচ্ছে। পারিবারিক বন্ধন দুর্বল হচ্ছে। বিশ্বায়ন ও শহরায়নের ফলে মানুষের মধ্যে ছোট পরিবার গঠন আমাদের কিছুটা স্বার্থপর জাতিতে পরিণত করছে। আমাদের মা-বাবারা এখনই বৃদ্ধাশ্রমে যাওয়া শুরু করেছে। এটা মুসলিম জাতির জন্য চরম অধঃপতন। একবার একটি বৃদ্ধাশ্রমে গিয়ে দেখেছি মুরুবি্বদের আহাজারি আর বেদনার চিত্র, তাদের কষ্টের কথা, তাদের অবহেলার কথা। অথচ একদিন তারাই ছিলেন পরিবারের মধ্যমণি। তাদের আয়-রোজগার দিয়েই ছেলেমেয়েরা ফুর্তি-আমোদ করে দিন কাটাতো। পাশ্চাত্যের প্রভাবে আমাদের মুসলিম সমাজের মেয়েরা স্বামীর পিতা-মাতাকে, তাদের ছোট ছোট ভাইবোনদের নিয়ে একসঙ্গে থাকার ব্যাপারে কঠিনভাবে বিরূপ মানসিকতায় গড়ে উঠছে। ফলে পারিবারিক অশান্তি বেড়ে যাচ্ছে। ইসলামী আদর্শকে অবহেলা করার পরিণাম ফল শুভ হয় না। হচ্ছেও তাই। হজরত আনাস (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসুল (সা.) বলেন, তোমাদের মধ্যে কেউ যদি রিজিকের প্রসন্নতা কামনা করে এবং দীর্ঘায়ু ও প্রাচুর্য কামনা করে সে যেন আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষা করে।' রাসুল (সা.) বলেন- 'সেই ব্যক্তি প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী নয় যে ভালো ব্যবহারকারী আত্মীয়ের খোঁজ-খবর নেয়, বরং প্রকৃত আত্মীয়তার সম্পর্ক রক্ষাকারী ওই ব্যক্তি যে সম্পর্ক ছিন্নকারী আত্মীয়ের সঙ্গে সুসম্পর্ক গড়ে তোলে।' ইসলাম আত্মীয়ের হক আদায়ের ব্যাপারে যে নির্দেশনা দেয় সে ক্ষেত্রে মা-বাবার সঙ্গে কিরূপ সম্পর্ক থাকা উচিত? সবার সঙ্গে সুসম্পর্ক রাখতে হবে। এভাবে পরিবার বিকাশ লাভ করে, সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হয়, পারস্পরিক হৃদ্যতা বৃদ্ধি পায়। সুখে-দুঃখে মানুষ একে অপরকে সহযোগিতা করে, সহমর্মিতা দেখায়। আমাদের পরিবার প্রথার অন্যতম আকর্ষণীয় দিক ছিল পরিবারে দাদা-দাদি আর নানা-নানি এবং ছোট নাতি-পুতি নিয়ে এক প্রকার আনন্দময় সংসার। যৌথ পরিবারে কিছু অসুবিধা পরিলক্ষিত হলেও সুবিধাই ছিল বেশি। যৌথ পরিবারে ছেলেমেয়েদের লালনপালনে দাদা-দাদিরা খুব গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। শিশুরা তাদের কাছ থেকে গল্পের ছলে অনেক শিক্ষা গ্রহণ করে থাকে। অথচ আজকের একক পরিবারে একটি সন্তান পালন করাও কষ্টকর হয়ে যাচ্ছে।
পরিবার গঠনের প্রাথমিক উদ্দেশ্য প্রবৃত্তির চাহিদা নিবারণ হলেও এর অন্যতম উদ্দেশ্য হলো বংশধারা সংরক্ষণ, স্থিতিশীল সমাজ গঠন, মানবজাতির বিকাশ এবং পূর্ণ শান্তিময় সমাজ প্রতিষ্ঠা। অন্যায়-অশ্লীলতা পরিহার করা। ইসলামী সমাজ রক্ষায় আমাদের পারিবারিক বিকাশকে সঠিক আদর্শের ওপর গঠনে সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে। শিশুকাল থেকে সন্তানদের সঠিক শিক্ষা নিয়ে গড়ে তুলতে হবে। নিজেদের যেমন বেঁচে থাকতে হবে, তেমনি আমাদের বৃদ্ধদের, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে রক্ষা করার সুন্দর পথ বেছে নিতে হবে। পাশ্চাত্য যে ভুলের খেসারত দিচ্ছে আমাদের ইচ্ছে করে সে ভুলের পুনরাবৃত্তি রোধ করতে হবে। তাহলেই প্রকৃত সুন্দর পরিবার গঠন সম্ভব। স্বার্থপরতা আমাদের কারো জন্যই সুখকর নয়। সাময়িক সুখ লাভের আশায় দীর্ঘদিনের অশান্তি টেনে আনা বুদ্ধিমানের কাজ নয়।
২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ডেল্টা ফ্লাইট - নিউ ইয়র্ক টু ডেট্রয়ট

লিখেছেন ঢাকার লোক, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:২৬

আজই শ্রদ্ধেয় খাইরুল আহসান ভাইয়ের "নিউ ইয়র্কের পথে" পড়তে পড়তে তেমনি এক বিমান যাত্রার কথা মনে পড়লো। সে প্রায় বছর দশ বার আগের ঘটনা। নিউ ইয়র্ক থেকে ডেট্রিয়ট যাবো,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ল অব অ্যাট্রাকশন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ৮:৪৫

জ্যাক ক্যান ফিল্ডের ঘটনা দিয়ে লেখাটা শুরু করছি। জ্যাক ক্যানফিল্ড একজন আমেরিকান লেখক ও মোটিভেশনাল স্পিকার। জীবনের প্রথম দিকে তিনি হতাশ হয়ে পড়েছিলেন। আয় রোজগার ছিলনা। ব্যাংক অ্যাকাউন্টে অর্থ ছিলনা।... ...বাকিটুকু পড়ুন

চরফ্যাশন

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৬ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৫৯



নয়নে তোমারি কিছু দেখিবার চায়,
চলে আসো ভাই এই ঠিকানায়।
ফুলে ফুলে মাঠ সবুজ শ্যামলে বন
চারদিকে নদী আর চরের জীবন।

প্রকৃতির খেলা ফসলের মেলা ভারে
মুগ্ধ হয়েই তুমি ভুলিবে না তারে,
নীল আকাশের প্রজাতি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কর কাজ নাহি লাজ

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ১৬ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৪


রাফসান দা ছোট ভাই
ছোট সে আর নাই
গাড়ি বাড়ি কিনে সে হয়ে গেছে ধন্য
অনন্য, সে এখন অনন্য।

হিংসেয় পুড়ে কার?
পুড়েপুড়ে ছারখার
কেন পুড়ে গা জুড়ে
পুড়ে কী জন্য?

নেমে পড় সাধনায়
মিছে মর... ...বাকিটুকু পড়ুন

নতুন গঙ্গা পানি চুক্তি- কখন হবে, গ্যারান্টি ক্লজহীন চুক্তি নবায়ন হবে কিংবা তিস্তার মোট ঝুলে যাবে?

লিখেছেন এক নিরুদ্দেশ পথিক, ১৬ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৫:২৬


১৬ মে ঐতিহাসিক ফারাক্কা দিবস। ফারাক্কা বাঁধ শুষ্ক মৌসুমে বাংলাদেশে খরা ও মরুকরণ তীব্র করে, বর্ষায় হঠাৎ বন্যা তৈরি করে কৃষক ও পরিবেশের মরণফাঁদ হয়ে উঠেছে। পানি বঞ্চনা এবং... ...বাকিটুকু পড়ুন

×