somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

রাতের তারা ভোরের তারা মাকে জানিয়ে দিস...

০৮ ই মে, ২০১১ দুপুর ২:৫২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :




ঐ দূর আকাশের তারা রে
বলে দেনা কোনটা আমার মা
মা কি আমায় দেখতে পায়না...

এখন অনেক রাত । আমার ছোট্ট বেলকুনিটায় দাঁড়ালে আকাশ দেখা যায় । চাইলে গ্রীলের ভেতর দিয়ে হাত বাড়ানো যায়। আলো আর বাতাস অনুভব করা যায়। তারা থাকলে আলো ছায়ার খেলা দেখা যায়।
কোনো কোনোদিন আমার মাকে ভীষন মনে পড়ে। সবদিন নয়। দিনে আকাশে কোনো তারা থাকেনা। সব রাতে তারারাও কাছে নেমে আসেনা। আমি তারা দেখি আমার ভাবতে ভাল লাগে কোনো একটা তারা আমার মা।
শূন্যে হাত বাড়িয়ে দি, একা থাকলে এসব পাগলামীকে প্রশ্রয় দিতে আমার ভাল লাগে। আলো আমায় ছুঁতে পারে,তারার আলো। আমার মায়ের স্নেহ মনে হয়,তাপহীন উত্তাপটাকে।
এসব বড় বেশী কল্পনার,বলা যায় আবেগের বিলাসীতা। বাস্তবটা অন্যরকম।
আমি জানি মা নেই। নেই। নেই। এখানে নেই। ওখানে নেই। কোথাও কোনোভাবেই নেই।
এ না থাকাটাই সত্য।
তারা,আলো,রাত্রি কোথাও আমার মা নেই। তবু আমার ভাবতে ভাল লাগে,মিথ্যে করে হলেও আমি তাই ভাবি আছে। আছে শব্দটাই সান্তনার !

আমাদের দুভাই বোন কে রেখে মা চলে গিয়েছিলেন। রিমেটিক ফিভারে মানুষ মরে যায় কেউ বিশ্বাস করতে না চাইলেও আমার মা কঠিন বাতজ্বরেই মরে গেছে।
ভাইয়া আমার থেকে বছর চারেকের বড়। নিষ্ঠুরে মত চলে গেল মা। কিংবা হয়ত চলে যাওয়াই ছিল আমাদের নিয়তি। পৃথিবীর নির্মমতার স্বাদ তো সবাই পায়না। এমন তো বহু কিছু রোজ ঘটে। ইশ্বরের অশেষ কৃপায় আমরা সেই স্বাদ ভাল মত আস্বাদন করেছি।
মা মারা যাবার বছর খানেক পরেই দাদা বিয়ে দিয়ে আনলেন বাবার। আমাদের বাড়িটা উচ্ছন্নে যাচ্ছিল, এটা দাদার কথা। রান্নাবান্না খাওয়া দাওয়া অথবা আরো অনেক কিছুর কথা ভাবলেন দাদা। আমরা মা পাবো, তাঁর স্নেহের ছায়াতলে বড় হব এতটা নিশ্চয় দাদাও আশা করেন নি!
ভাইয়াকে নানুবাড়ি পাঠিয়ে দেয়া হল। বাবা বিয়ে করে আনলেন, ট্রেন থেকে খুব সাধারন একটা শাড়ি পরে আমাদের নতুন মা নামলেন। আমি ছোটচাচীর সাথে স্টেশনে গিয়েছিলাম। খুব অবাক হলাম কেন জানি। হয়ত আমি মা হিসেবে আমার মায়ের মতই কাউকে ভেবেছিলাম,যেহেতু সবাই বলছিল আমার মাকে আনতে গেছে বাবা।

আমার তখন সাত কি আট বড়জোর! কদিনের মধ্যেই আমি অনেক কিছু বুঝে গেলাম। অথবা আমি বয়সের থেকেও বড় হয়ে গিয়েছিলাম। মানুষের চোখে করুনা দেখতাম।
- আহারে মেয়েটির মা নেই!
- কত অল্প বয়সেই মেয়েটি মা হারা হল!
এমন করুনার কথা শুনতে যে আমার খুব একটা খারাপ লাগতো তা নয়। বরং আমি তাকে ভালবাসায় মনে করতাম। বিশেষত আমি ছিলাম আদরের কাঙাল।
নতুন মহিলাকে আমার কোনোদিনও আপন মনে হয়নি।
আমার মায়ের মুখটা তখনও আমার চোখে আঁকা ছিল। আমরা তখন দাদাবাড়িতে থাকতাম। মার কবরটা ছিল একটু দূরে মাঠের মধ্যে। আমি কবরের পাশে গিয়ে বসে থাকতাম এমন নয়, আমার লজ্জা করতো। কিন্তু আমি জানতাম এখানেই মা আছে।
মা মরে যাবার দিন আমি উথাল পাথাল করে কেঁদেছি কিনা,সারাদিন কি করেছি না করেছি আমার কিছুই মনে নেই। যেন সেই দিনটিই বিশেষ করে কেউ ইরেজার দিয়ে নিপুন হাতে মুছে দিয়েছে।
খুব চাইলেও কিছু মনে করতে পারিনা। অথচ আমার ভাবতে ইচ্ছে করে সদ্য গোসল সেরে মাকে খাটে শুইয়ে রাখা আছে। আমি মায়ের মুখে মুখ লাগিয়ে বসে আছি। শেষ স্পর্শটাকে খুব আপন করে ভাবতে ইচ্ছে করে।
বরং আমি চোখ বন্ধ করলে মায়ের হাসি দেখি। মা হাসলেই বাম পাশের উপর পাটির একটা দাঁত আলগা হয়ে বেরিয়ে আসতো। কি সুন্দর সেই হাসি! একবার বাবার জুতো পরে থপথপ করে উঠোন পেরিয়ে আসছিলাম দেখে মা হেসে গড়িয়ে পড়ছিল। আমি মা ভাবলেই সেই হাসিটা দেখি।

কেউ আমার সামনে,বলা যায় আমাদের সামনে কখনো মায়ের কথা বলতোনা। কেন যেন সবাই ভাবতো আমরা কষ্ট পাবো বা এমন কিছু। ভাইয়ার কথা জানিনা, কিন্তু আমার ভীষন ইচ্ছে করতো মায়ের কথা শুনতে। কেউ বলুক,কেউ সারাক্ষন আমার মায়ের কথা বলুক। নিজে থেকে কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারতাম না,বলতে পারতাম না, অথচ ভেতর থেকেই চাইতাম মাকে ভুলে না যেতে। মার কোনো ছবি ছিলনা। মাঝে মাঝে মার প্রতি কি দূরন্ত অভিমানে ভেতর পূর্ণ হয়ে যেত !

অবলীলায় আমি ডুবে গেলাম বর্তমানে। একটা কাঁসার থালার মধ্যখানে ফুলের সাথে আমার মায়ের নাম লেখা ছিল। থালাটা খুব যত্নে আমার কাপড় রাখার গোলাপি প্লাস্টিকের ঝুড়িটার ভেতর কাপড়ের মধ্যে লুকিয়ে রেখেছিলাম।
স্কুল থেকে ফিরে আমার যখন প্রচন্ড ক্ষুধা পেত অথচ নতুন মাকে বলতে পারতাম না,তখন লুকিয়ে থালাটা নিয়ে ঘরের এক কোনায় চলে যেতাম। দেখতাম আর ভাবতাম আমার মা যেখানে আছে আমার জন্য অনেক খাবার তুলে রেখেছে। ছোটবেলায় সুজির হালুয়া ছিল আমার ভীষন পছন্দের। আমি থালার দিকে তাকিয়ে ভাবতাম হালুয়া খাচ্ছি। এভাবে আমার ক্ষুধা সহ্য করাটা অভ্যাস হয়ে গেল।
আমার অপরাধ গুলো আমি ধরতে পারতাম না। তবে আমার কোনো কাজ পছন্দ না হলে নতুন মা মুখ গোমড়া করে থাকতো। আমার তখন মনে হত,টুম্পা,রোজীদের মা তাদের কত মারে। কথায় কথায় বলে থাপড়ায়ে গাল নড়ায়ে দেব। আমাকেও মারুক,বকুক। আমাকেও বলুক পিটায়ে পিঠের ছাল তুলে দেব! তবু বলুক! এমন অসহ্য নিরবতা কে আমি ভীষন ভয় পেতাম।
অবশ্য এক দিক থেকে ভালই হয়েছিল। আমি একটা আলাদা জগৎ তৈরি করেছিলাম সে সময়েই। আমি চাইলেই সবার ভেতরে থেকেও আলাদা হয়ে যেতে পারতাম। চাইলেই আমার পৃথিবীতে মার সাথে , ভাইয়াকে নিয়ে বাবাকে দখলদারী থেকে মুক্ত করতে পারতাম।
নতুন মা যখন আমার আর ভাইয়ার কোনো কথা নিয়ে বাবার সাথে চাপা গলায় ঝগড়া করতো,আমি কান পেতে শুনতাম। বাবাকে কি অসহায় যে লাগতো! শুধু বাবার জন্যই আমার হঠাৎ করে মরে যেতে ইচ্ছে করতো। মনে মনে চাইতাম,খোদা তুমি এই ডাইনির হাত থেকে আমার বাবাকে রক্ষা করো।
একটা সময় সবকিছুই কেমন অভ্যাসে পরিনত হয়। আমাদের আরো দুটি ভাইবোন হল। নতুন মা পুরোনো হল। শুধু আমরা যেমন ছিলাম,খুব নিঃস্বঙ্গ তেমনটাই রয়ে গেলাম।

আজ রাতটা কেমন নরম! আজ রাতের কথা কিছু বলছিনা আমি। অথচ একেকটা রাত আমার কি যন্ত্রনায় কেটেছে! আমার কথাগুলো কাউকে বলতে পারতাম না। তাই রাত হলেই একটা আঁকটানা খাতায় সারাদিন কি ঘটেছে লিখতে বসতাম। বানিয়ে বানিয়ে কত কি লিখতাম। মাকে লিখতাম।
আসলে আমি মাকে কষ্ট দিতে চাইতামনা। কিন্তু সারাদিন আনন্দের কিছু ঘটছে এমনটা ছিল বিরল। আমার সাথে যেমনটা ঘটতো আর আমি ঠিক যেমনটি চাইতাম তার ভেতর প্রায়শই মিল ছিলনা।
একদিন সে খাতাটাই নতুন মার হাতে পড়ায় সেকি হৈচৈ বাসা জুড়ে। বাবা আমাকে গম্ভীর মুখে বললেন, কি দরকার এসব লেখার? দেখতেই তো পাচ্ছো বাড়িতে কি অশান্তি! বড় হচ্ছো তাও বোঝোনা? আমাকে কি একটু শান্তিও পেতে দেবেনা তোমরা?

আমি অপরাধীর মত মুখ নিচু করে থাকলাম। যদিও আমার চিৎকার করে বলতে ইচ্ছে করছিল,আমি সত্যিই বড় হতে চাই।এতটা বোঝার মত খুব দ্রুত বড় হতে চাই। তোমাদের কষ্ট দিতে চাইনা। আমার কষ্ট গুলোকে রাত ডাকা শেয়ালের গলায় ঠুঁসে দিতে চাই।

এখন আমি অনেক বড়। আমার কাছে রং বেরঙের কষ্ট আছে। কিছু বদলেছে,কিছু বেড়েছে। কিন্তু একটুও কমেনি। বোধ হয় আমি বড় হওয়ার মত বড় হতে পারিনি।
আমার একজন মা আছে। একদম না থাকার চেয়ে হয়ত এটাই ভাল। তাঁকে মা বলে ডাকিনা তাই অনেকের কাছে তাঁর আক্ষেপের কথা শুনেছি। আমি মা ডাকি। হাজার বার ডাকি। এমন করে যখন রাত নিশুতি হয়,চাঁদ ওঠে। বেলকুনিটায় দাঁড়িয়ে হাত বাড়িয়ে দিয়ে গুনগুন করে আমার গাইতে ভাল লাগে--
'' মধুর আমার মায়ের হাসি
চাঁদের মুখে ঝরে,
মাকে মনে পড়ে আমার, মাকে মনে পড়ে!''



অ:ট: বিশেষ দিনে বিশেষ লেখা দিতে আমার ইচ্ছে করেনা। অনেকেই বলে মায়ের জন্য আবার বিশেষ দিন কিসের? প্রতিটা দিনই তো মাকে ভালবাসার। আমিও সেই দলে। কিন্তু আমার আম্মা আবার উল্টো। আজ যদি ফোন না দিই,কথা না বলি, আব্বার কাছে অভিমান করে বলবে,দেখেছো তোমার ছেলেমেয়েরা মনেই রাখেনা আজ মা দিবস! পৃথিবীর সব মায়েদের জন্য ভালবাসা। ভাল থাকুক আমার মা, ভাল থাকুক সব মায়েরা.....
সর্বশেষ এডিট : ১০ ই নভেম্বর, ২০১১ দুপুর ১:১৯
৫৭টি মন্তব্য ৫৭টি উত্তর পূর্বের ৫০টি মন্তব্য দেখুন

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আমার মায়ের চৌহদ্দি

লিখেছেন শাওন আহমাদ, ১২ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩৫



আমার মা ভীষণ রকমের বকবকিয়ে ছিলেন। কারণে-অকারণে অনেক কথা বলতেন। যেন মন খুলে কথা বলতে পারলেই তিনি প্রাণে বাঁচতেন। অবশ্য কথা বলার জন্য যুতসই কারণও ছিল ঢের। কে খায়নি,... ...বাকিটুকু পড়ুন

ছেলেবেলার অকৃত্রিম বন্ধু

লিখেছেন ঢাবিয়ান, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৯

খুব ছোটবেলার এক বন্ধুর গল্প বলি আজ। শৈশবে তার সাথে আছে দুর্দান্ত সব স্মৃতি। বন্ধু খুবই ডানপিটে ধরনের ছিল। মফস্বল শহরে থাকতো। বাবার চাকুরির সুবাদে সেই শহরে ছিলাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণা!

লিখেছেন সোনাগাজী, ১২ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:১৭



নীচে, আমাদের দেশ ও জাতি সম্পর্কে আমাদের ১ জন ব্যুরোক্রেটের ধারণাকে ( পেশগত দক্ষতা ও আভিজ্ঞতার সারমর্ম ) আমি হুবহু তুলে দিচ্ছি। পড়ে ইহার উপর মন্তব্য... ...বাকিটুকু পড়ুন

মোজো ইদানীং কম পাওয়া যাচ্ছে কেন?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৩৭


শুনলাম বাজারে নাকি বয়কটিদের প্রিয় মোজোর সাপ্লাই কমে গেছে! কিন্তু কেন? যে হারে আল্লামা পিনাকী ভাট ভাঁওতাবাজিদেরকে টাকা দিয়ে 'কোকের বিকল্প'-এর নামে 'অখাদ্য' খাওয়ানো হচ্ছিলো, আর কোককেই বয়কটের ডাক... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১২ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৫৮

আজ (১০ মে ২০২৪) রাত দুইটা দশ মিনিটে নিউ ইয়র্কের পথে আমাদের যাত্রা শুরু হবার কথা। এর আগেও পশ্চিমের দেশ আমেরিকা ও কানাডায় গিয়েছি, কিন্তু সে দু’বারে গিয়েছিলাম যথারীতি পশ্চিমের... ...বাকিটুকু পড়ুন

×