somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

২০০১-এর কৌশলেই ভরসা ‘ন‌্যাড়া’ আনন্দবাজারের

০৭ ই মে, ২০১১ বিকাল ৪:৩৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


অজয় দাশগুপ্ত
কলকাতা, ৪ঠা মে

সুকুমার রায় সেই কবে প্রশ্ন তুলেছিলেন, ‘ন্যাড়া বেলতলায় ক’বার যায়?’ এটা সুকুমার রায়ের কাছেও স্বস্তি ও সৌভাগ্যের বিষয় যে তিনি বামফ্রন্ট সরকারের সময়ে আনন্দবাজার পত্রিকাকে দেখে যেতে পারেননি। তাহলে তাঁর পক্ষেও হিসাব রাখা মুশকিল হয়ে যেত।

কারণ ‘বেলতলা’ এবং ‘ন্যাড়া’, দুইই আনন্দবাজারের কাছে খুবই পছন্দের বিষয়। ‘বেলতলা’-য় তাঁদের প্রিয় বাসিন্দা অতি সম্প্রতি গত হয়েছেন। অতএব ‘ন্যাড়া’-তেই তাঁরা এখন পুরোদস্তুর মনোনিবেশ করেছেন। কিছুদিন আগেই তাঁরা “স্বভাষায় আন্তর্জাতিক ‘ন্যাড়া’কে বৈশাখী সন্ধ্যায় আনন্দ-কুর্নিশ” জানিয়েছেন। বৈশাখ মাস এখনো চলছে। আনন্দবাজার পত্রিকা বুধবার সকালের সংস্করণে অবশ্যই ‘স্বভাষায়’ আবার ‘ন্যাড়া’কে ‘আনন্দ-কুর্নিশ’ জানিয়েছে। তবে তিনি ‘আন্তর্জাতিক’ নন, তাঁর অনেক আন্তজার্তিক পৃষ্ঠপোষক থাকলেও।

আনন্দবাজার পত্রিকার কথাতেই ‘দু’দফা ভোট এখনও বাকি। ফল বেরোতে বাকি দশ দিন।’ তবু এদিনের প্রথম পাতাজোড়া খবর তৃণমূলের ‘মন্ত্রিসভা’ গঠনের। ‘জয় সুনিশ্চিত ধরে নিয়ে এখন থেকেই মন্ত্রিসভা গঠন নিয়ে’ মমতা ব্যাননার্জির হয়ে ‘ভাবনাচিন্তা’ করে দিয়েছে আনন্দবাজার পত্রিকা। শপথগ্রহণের স্থানও তাঁরাই বেছে দিয়েছে। আর এই কাজ করতে গিয়ে আনন্দবাজার তাঁদের সহোদর চ্যারনেলকেও টপকে গিয়েছে। দীর্ঘদিনের অভ্যাস যে! পশ্চিমবঙ্গে কমিউনিস্টবিরোধীদের স্বঘোষিত অভিভাবকের ভূমিকা পালন করতে করতে আনন্দবাজার এমনকি তাঁদের অতীত ‘কীর্তি’-কেও ভুলে গেছে! ‘বাহবা! সময় তোর সার্কাসের খেলা’।

গত ৩৪ বছরে হাতে গোণা একটি-দুটি নির্বাচন বাদ দিলে আনন্দবাজার পত্রিকার নির্বাচনী সংবাদ পরিবেশন, তথ্য বিশ্লেষণের আঙ্গিক পর্যালোচনা করলে যে কেউই এটা বুঝবেন যে মৌলিকভাবেই তা হয়েছে সি পি আই (এম) বিরোধিতার ওপর নির্ভর করে। অন্যান্য ক্ষেত্রেও সংবাদ পরিবেশনে সি পি আই (এম) বিরোধিতাই আনন্দবাজারী ঘরানা, সেটাই এই গোষ্ঠীর সাংবাদিককূলের কাছে ধ্রুব। প্রয়াত জননেতা জ্যোতি বসু তাই এই পত্রিকাগোষ্ঠীর পরিবেশিত সংবাদে নিয়মিত মিথ্যা চার সম্পর্কে প্রতিটি সভা-সমাবেশে মানুষকে সতর্ক করতেন, বলতেন, ‘এতদিন আমরা জানতাম তিল থেকে তাল হয়। কিন্তু এই কাগজগুলো ‘তিল’ ছাড়াই যেভাবে প্রতিদিন ‘তাল’ বানাচ্ছে, তা দেখলে অবাক হয়ে যেতে হয়।’

বেশি অতীতে যেতে হবে না। ২০০১ সালে নির্বাচনের আগেও যথারীতি আনন্দবাজারী প্রচারের দৌলতে তৃণমূলনেত্রী মমতা ব্যানার্জির হাতের ‘মুঠোয় মহাকরণ’ চলে এসেছিল। এদিনের প্রতিবেদনেও তার ইঙ্গিত আছে: ‘উল্লেখ্য, ২০০১ সালে, যখন ক্ষমতায় আসার বিষয়ে খুবই আশাবাদী ছিলেন, তখনও ব্রিগেডেই শপথ নেওয়ার পরিকল্পনা করেছিলেন মমতা।’ সেবার আনন্দবাজারের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছিল: ‘দূরদর্শনের জন্য ডেভেলপমেন্ট অ্যাণ্ড রিসার্চ সার্ভিসেস (ডি আর এস) যে-এগজিট পোল করেছে, তার ফলাফল জানার পরেই তৃণমূল-কংগ্রেস শিবিরে যেমন উল্লাস, তেমনই বাম শিবিরে থমথমে ভাব। দলের সমর্থকদের নির্ভয়ে ভোট দেওয়ার সাহস জোগাতে সারা দিন মেদিনীপুরে কাটিয়ে রাতে শহরে ফেরার পথে এগজিট পোলের ফল জেনে মমতা বন্দ্যোপাধ্যায়ের তাৎক্ষণিক মন্তব্য, ‘‘তা হলে আমরাই সরকার গড়ছি।’’ আনন্দবাজারী উৎসাহে উৎসাহিত মমতা ব্যাথনার্জি সেদিন মেদিনীপুর শহরের শিরোমণি গেস্ট হাউসে সাংবাদিকদের বিজয় চিহ্নের সূচক ‘ভি’ দেখিয়ে বলেছিলেন, এর পরের সাংবাদিক সম্মেলন হবে মহাকরণে।

২০০১ সালে ভোটগ্রহণের পরদিন, ১১ই মে আনন্দবাজারে এই প্রতিবেদনের পাশাপাশি ‘উদ্বেগ ঢেকে মুখে জয়ের কথা বুদ্ধের’ শিরোনামে প্রথম পাতায় বড় খবর। সঙ্গে ভোট দিতে আসা বুদ্ধদেব ভট্টাচার্যের ছবির ক্যাহপশন ‘পাঠভবন স্কুলে ভোট দিতে এলেন বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য। মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে এই কি শেষ ভোট?’ প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে: ‘...এগজিট পোল নিয়ে জিজ্ঞাসা করলে বুদ্ধবাবু প্রথমে বললেন, ‘‘আমরাই সরকার গড়ছি।’’ কিন্তু এগজিট পোল তো মাত্র তিনটি আসন বেশি দেখিয়েছে। বুদ্ধবাবুর জবাব, ‘‘দুর! ও-সব ঠিক নয়, আমরা ১৫০-এর থেকে অনেক বেশি আসন পাব।’’ আজ পর্যন্ত তো ডি আর এসের এগজিট পোল মোটামুটি ঠিক হয়েছে...। এ বার মুখ্যমন্ত্রীর গলায় যেন একটু উষ্মা: ‘‘কই, আমি তো কোনও দিন দেখিনি!’’ ফলাফল কি হয়েছিল পশ্চিমবাংলার মানুষ জানেন। রাজ্যের মানুষকে বিভ্রান্ত করতে তখন আনন্দবাজারের অবলম্বন ছিল ‘ডি আর এসের এগজিট পোল’। এবারের অবলম্বন আনন্দবাজার গোষ্ঠীর নিজস্ব উৎপাদন, এ সি নিয়েলসন-এর সঙ্গে যৌথ সমীক্ষার নামে একটি ‘হ য ব র ল’ !

২০০১ সালের ১৩ই মে সেবার বিধানসভা নির্বাচনের ফল প্রকাশিত হয়েছিল। সেদিনই সকালের সংস্করণে আনন্দবাজার তাঁদের ঈপ্সিত ভাবী মুখ্যমন্ত্রীর ‘প্রোফাইল..’ প্রকাশ করে রাজ্যের মানুষকে বলেছিল: ‘আসুন, আলাপ করিয়ে দিই’। আনন্দবাজারের খোয়াব দেখা সেই মুখ্যমন্ত্রী ছিলেন :‘ ‘মানুষটি মনেপ্রাণে পুঁজিবাদী। মার্গারেট থ্যাচারের বাঙালি সংস্করণ। চব্বিশ বছরের কমিউনিস্ট ভূত ঝেড়ে ফেলে বিশ্বায়িত বিশ্বের প্রতিযোগিতার জগতে পশ্চিমবঙ্গকে জেতাতে বদ্ধপরিকর। তার জন্য যা যা করা দরকার তা পাঁচ বছরেই করে ছাড়বেন পশ্চিমবঙ্গের নয়া কর্ণধার।’ তাঁর নেতৃত্বে সরকারের নীতি সম্পর্কে আনন্দবাজারের মূল্যাবয়ণ ছিল: ‘মৃত কলকারখানার সৎকার, রাষ্ট্রায়ত্ত শিল্পের দ্রুত বেসরকারিকরণের বিরুদ্ধে অবোধ বাধাদান আর নয়। বরং বেসরকারি বিনিয়োগের বন্যা বইয়ে দেওয়ার রণনীতি। পুরনো জঙ্গি ট্রেড ইউনিয়ন চোখ রাঙালে উল্টে তাকে ভস্ম করে দেওয়ার প্রত্যয়।’ পাঠক কি এই ব্যক্তিটির অবয়ব মেলাতে পারছেন?

২০০১ সালে আবার রাজ্যে বামফ্রন্ট সরকার গঠিত হয়েছিল। শপথগ্রহণ অনুষ্ঠান হয় ১৮ই মে। ১৯শে মে-র সংস্করণে আনন্দবাজার পত্রিকার ‘ক্রোধ’ প্রতিবেদনে মূর্ত হয়ে উঠেছিল: “ষষ্ঠ বামফ্রন্ট সরকার শপথ নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সরকারের পতন ঘটানোর হুমকি দিয়েছেন মমতা। এ দিন তিনি বলেন, ‘‘পাঁচ বছর তো দূরের কথা, এই সরকার ক’দিন চলতে পারে, সেটাই এ বার দেখব। তার জন্য যেখানে যা করার, করব।’’

তার পরের পাঁচ বছরই নয়, আরো দশ বছর মানুষের রায়ে চলেছে বামফ্রন্ট সরকার। রাজ্যের মানুষ শিক্ষা বারবার দিয়েছেন, কিন্তু আনন্দবাজারের শিক্ষা হয়নি। ‘বেলতলা’-র প্রতি তাঁদের আসক্তি, ‘ন্যাড়া’-র প্রতি তাঁদের অনুরাগ এখনো কমেনি। আর সে কারণে তাঁরা কখন নিজেরাই ‘ন্যাড়া’-তে পরিণত হয়েছেন, সেই বোধও হারিয়ে ফেলেছে আনন্দবাজার পত্রিকা। এদিনের প্রতিবেদনই তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।



সর্বশেষ এডিট : ২১ শে জুন, ২০১১ সন্ধ্যা ৭:১৭
১টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

কুরসি নাশিন

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৯ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৫


সুলতানি বা মোগল আমলে এদেশে মানুষকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়েছিল৷ আশরাফ ও আতরাফ৷ একমাত্র আশরাফরাই সুলতান বা মোগলদের সাথে উঠতে বসতে পারতেন৷ এই আশরাফ নির্ধারণ করা হতো উপাধি... ...বাকিটুকু পড়ুন

বসন্ত বিলাসিতা! ফুল বিলাসিতা! ঘ্রাণ বিলাসিতা!

লিখেছেন নাজনীন১, ১৯ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:০৯


যদিও আমাদের দেশে বসন্ত এর বর্ণ হলুদ! হলুদ গাঁদা দেখেই পহেলা ফাল্গুন পালন করা হয়।

কিন্তু প্রকৃতিতে বসন্ত আসে আরো পরে! রাধাচূড়া, কৃষ্ণচূড়া এদের হাত ধরে রক্তিম বসন্ত এই বাংলার!

ঠান্ডার দেশগুলো... ...বাকিটুকু পড়ুন

×