somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

আসুন, লিমনের পাশে দাঁড়াই

০৬ ই মে, ২০১১ ভোর ৪:১৬
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

র্যাবের গুলিতে পা হারানো ঝালকাঠির কিশোর লিমনকে জামিন দেওয়ার জন্য বাংলাদেশ সুপ্রিম কোর্টের হাইকোর্ট বিভাগকে ধন্যবাদ। ধন্যবাদ মানবাধিকার কর্মীদের, যাঁরা বিষয়টি গতকাল হাইকোর্টে নিয়ে গেছেন। এর আগে ঝালকাঠির জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাহান ‘র্যাবকে হুমকি’ ও ‘সরকারি কর্তব্যে বাধাদানের’ একটি সাজানো মামলার আসামি লিমনকে জামিন দেন। কিন্তু তার দুর্ভাগ্য, একইভাবে র্যাবের দায়ের করা অবৈধ অস্ত্র মামলায় তার জামিন মিলছিল না।
লিমনের দুর্দশা নিয়ে গণমাধ্যমের ভূমিকা এবং সে বিষয়ে সরকারি কর্তৃপক্ষসমূহের সার্বিক তৎপরতা আমাদের এক বিরাট প্রশ্নের মুখে দাঁড় করিয়ে দিয়েছে।
সেই সব প্রশ্নের মধ্যে সবচেয়ে জ্বলন্ত হলো, এই সমাজব্যবস্থা, এই সমাজের মানবিকতাবোধ, এই সমাজের স্পর্শকাতরতা আজ কোন তলানিতে গিয়ে ঠেকেছে?
দেশে সংবিধান সংশোধন চলছে। যুদ্ধাপরাধের বিচার চলছে। বিএনপির নেতৃত্বাধীন জোট সরকারের দুঃশাসনের সঙ্গে আওয়ামী লীগের চলমান ‘সুশাসনের’ তুলনা চলছে। এসব ঘটনার মধ্যে এক কিশোর লিমনের প্রতি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিষ্ঠুরতা কি বিরল ও বিচ্ছিন্ন দুর্ঘটনা? নাকি, নিষ্ঠুরতা আমাদের গা-সওয়া হয়ে গেছে। আমরা কি সব লিমনের খবর রাখি? আমরা কি সব লিমনের ছবি তুলতে পারি? ১৬ কোটি মানুষের দেশে সংবাদমাধ্যম কি এখন এতটাই শক্তিশালী হয়ে পড়েছে যে অনাচার হওয়ামাত্রই তা জনসমক্ষে প্রকাশ করা সম্ভব হচ্ছে? যদি তা না-ই হবে, তাহলে এই সমাজ কোথায় চলেছে? যেসব ঘটনা নিভৃতে থাকছে, সেটার কী পরিণতি হচ্ছে, তা সহজে বোধগম্য।
‘চরম নিষ্ঠুরতা’ শিরোনামে প্রথম আলোয় প্রথম খবরটি ছাপা হয় ৬ এপ্রিল। গত ২৩ মার্চ লাল জামা গায়ের কিশোর লিমনকে র্যাব গুলি করেছিল। ১১ এপ্রিল র্যাব সদর দপ্তরে সংবাদ সম্মেলনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে বাহিনীর মহাপরিচালক মোখলেছুর রহমান বলেছিলেন, ‘আমরা তো আর লিমনকে ধরতে যাইনি। তার অপরাধ খুঁজতেও যাইনি। র্যাবের গুলিতে পা হারানো লিমন হোসেন সন্ত্রাসী নয়। সে ঘটনার শিকার।’ এই সংবাদ সম্মেলনে তিনি কিন্তু দুঃখ প্রকাশ করেননি। এমনকি ঘটনা জানাজানি হওয়ার পরও এক মাস কেটে গেল। অথচ প্রশাসন থেকে আমরা কোনো সাড়া পাইনি। এ দেশ তো বিচার বিভাগ চালাবে না, জনপ্রশাসনকেই চালাতে হবে। তাহলে কি প্রশাসন নিজের জালে আটকা পড়ে গেছে। এর আর কোনো মানবিক দিক নেই।
কলেজপড়ুয়া লিমনকে ‘সন্ত্রাসী’ বলে গুলি করার ১৯ দিন পর র্যাবের মহাপরিচালক নিজেই তো বললেন, লিমন একটি ছোট ছেলে। আমরা তো বলছি না যে, সে খারাপ বা সন্ত্রাসী। এ রকম কিছু দেখছিও না। তাঁর এ বক্তব্যের আগে পুলিশ সদর দপ্তরে পুলিশের মহাপরিদর্শক হাসান মাহমুদ খন্দকার সংবাদ সম্মেলন করে জানান, ‘র্যাবই এ ঘটনাটি তদন্ত করবে।’
র্যাবের মহাপরিচালকের সংবাদ সম্মেলনের পরও তাদের আগের বক্তব্য প্রত্যাহার করেনি এখনো। ২৩ মার্চ ঝালকাঠির ওই ঘটনার পর র্যাব-৮-এর কার্যালয় থেকে ঘটনা নিয়ে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, জনগণের উপস্থিতিতে ঘটনাস্থলে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় সন্ত্রাসী মো. লিমনকে এক রাউন্ড গুলিভর্তি একটি বিদেশি পিস্তল ও পাঁচটি রামদাসহ আটক করা হয়। একইভাবে র্যাব সদর দপ্তর থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতেও লিমনকে মোর্শেদ জমাদ্দারের সহযোগী ও অস্ত্রধারী সন্ত্রাসী বলে দাবি করা হয়। প্রশ্ন উঠতেই পারে, লিমন সন্ত্রাসী না হলে যে অস্ত্র দেখিয়ে তাকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে, সে অস্ত্রটি কার ছিল? এই প্রশ্ন আমরা আগেই তুলেছিলাম। কিন্তু এ পর্যন্ত সদুত্তর মেলেনি।
এমনকি গতকাল লিমনের জামিন লাভের ঘটনায় আমাদের আপাতস্বস্তির কারণে এ প্রশ্ন যেন গৌণ হয়ে পড়েছে। কাটা পায়ের লিমনের পাশে যদি আমরা দাঁড়াতে পারি, তার অসহায় পিতা-মাতা, যাঁরা শত দারিদ্র্যের মধ্যেও ছেলেকে স্কুলের চৌকাঠ পার করে কলেজে পড়তে পাঠিয়েছিলেন, তাঁদের ধূলিসাৎ হওয়া স্বপ্ন যদি আমরা একটু জোড়া দিতে পারি, তাহলে আমরা নিশ্চয় আনন্দিত হব।
কিন্তু বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ডের দায়ে ইতিমধ্যেই অভিযুক্ত আমাদের নিরাপত্তা বাহিনীগুলো যে ধরনের কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে পড়ছে, তার প্রতিকার তো আমাদের হাতে নেই। বিশেষভাবে বলা যায়, বাহিনী হিসেবে আমরা জঙ্গি ও সন্ত্রাস দমনে র্যাবের সাফল্য দেখতে চেয়েছি। সফলতাও আছে। এখনো তাদের সাফল্যের খবর বেশি করে ছাপতে চাইব। কিন্তু বাস্তবতা আমাদের হতবাক করছে।
র্যাবের স্থানীয় সোর্স, যাদের মধ্যে দাগি আসামি আছে বলেও অভিযোগ, তারা খবর দিয়েছিল, ফেরারি ডাকাবুকো মোর্শেদ জমাদ্দারের গায়ে লাল জামা। পথে তারা দেখে লাল জামা গায়ে বাড়ির পাশে সেতুর ওপর দুই বন্ধুর সঙ্গে গল্পরত লিমনকে। তাকেই ধরে নিয়ে গুলি করা হলো!
লিমনের জামিনের খবরে লিমন-পরিবার খুব যে নিরুদ্বিগ্ন থাকতে পারবে, তা কিন্তু বলা যাবে না। কারণ হাইকোর্ট ছয় মাসের অন্তর্বর্তীকালীন জামিন মঞ্জুর করেছেন। এর মানে কি এই যে লিমনের বিরুদ্ধে সাজানো মামলা আরও অন্তত ছয় মাস ঝুলে থাকবে। র্যাবের দায়ের করা মামলার সত্যাসত্য নিরূপণের দায়িত্ব আদালতের। এবং তা চলবে আইনের আপন গতিতে। তার চিকিৎসা শেষ না হতেই হাসপাতাল থেকে টেনেহিঁচড়ে ঝালকাঠিতে নিয়ে যাওয়ার কোনো যুক্তি ছিল না। লিমন ঢাকায় পঙ্গু হাসপাতালেও পুলিশি প্রহরায় চিকিৎসা নিচ্ছিল। এক আহত কিশোরকে হাসপাতাল থেকে জেলে পাঠানো হলো কোন আইনে—মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানের এ প্রশ্ন যথার্থ। আমরা এর জবাব পাইনি। অবশ্য পরদিন জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিমের সাহসী সিদ্ধান্তে ঝালকাঠি কারাগার থেকে তাকে বরিশালের শেরেবাংলা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য পাঠানো হয়েছে।
দুই মামলার আট আসামির মধ্যে কনিষ্ঠতম হলো লিমন। বাদবাকি অনেকের অতীত কালিমালিপ্ত বলেই জানা যায়। আমাদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যরা তাদের কারও টিকিটি পর্যন্ত স্পর্শ করতে পারেনি। তারা সবাই পলাতক। কিন্তু আটক রয়েছে লিমন, যে নির্দোষ।
লিমন যাতে জামিন না পায়, সে জন্য ঝালকাঠির পিপি বিরোধিতা করেন। এটা কি অভ্যাসবশত, নাকি ওপর থেকে নির্দেশ গিয়েছিল? সংশ্লিষ্ট র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে লিমনের মায়ের দায়ের করা মামলার অগ্রগতি নেই। এমনকি মামলা নথিভুক্ত করতেও চায়নি থানা। জ্যেষ্ঠ বিচারিক হাকিম নুসরাত জাহানের কঠোর নির্দেশের পরও মামলা নেয়নি সংশ্লিষ্ট থানা। পরে জেলা জজ এই নির্দেশের বিরুদ্ধে করা আপিল খারিজ করে ২৪ ঘণ্টার মধ্যে মামলা নেওয়ার আদেশ দেন। শেষমেশ ১২ দিন পর মামলা নেয় থানা। লিমনের ঘটনার তদন্তে মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যানসহ অন্যরা যে কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছেন, তার সঙ্গে আমরা একমত।
রাষ্ট্রকে লিমনের সর্বোৎকৃষ্ট চিকিৎসাই নয়, তার পুনর্বাসন নিশ্চিত করতে হবে। এই নিষ্ঠুরতায় অভিযুক্ত ব্যক্তির বিরুদ্ধে কী ব্যবস্থা নেওয়া হলো এবং লিমনের পরিবারকে কী ক্ষতিপূরণ দেওয়া হলো, সবাইকে তা অনতিবিলম্বে জানাতে হবে। তবে আমরা বিশেষভাবে দৃষ্টি আকর্ষণ করব সরকারের সেই কমিটিকে, যারা আইনের শাসনের দোহাই দিয়ে হাজার হাজার ফৌজদারি মামলা ‘হয়রানিমূলক’ বিবেচনায় প্রত্যাহার করার সুপারিশ করে। লিমনের বিরুদ্ধে করা মামলা অবিলম্বে প্রত্যাহার করা হোক। এক নির্দোষ কিশোরকে সারা জীবনের জন্য পঙ্গু করার পরও তাকে ‘অন্তর্বর্তীকালীন জামিনে’ রাখাটা আমাদের বিবেচনায় আইনের শাসনের জন্য লজ্জার।
এই লজ্জা নিবারণের দায় আমাদের সবার। আসুন, আমরা সবাই লিমনের পাশে দাঁড়াই।
মতিউর রহমান: সম্পাদক, প্রথম আলো।
৭টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। রোড জ্যাম ইন ভিয়েতনাম

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৫ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:৩৭



আমার ধারনা ছিল জটিল জ্যাম শুধু বাংলাদেশেই লাগে । কিন্তু আমার ধারনা ভুল ছিল । ভিয়েতনামে এরকম জটিলতর জ্যাম নিত্য দিনের ঘটনা । ছবিটি খেয়াল করলে দেখবেন... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমার অন্যরকম আমি এবং কিছু মুক্তকথা

লিখেছেন জানা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:০৬



২০১৯, ডিসেম্বরের একটি লেখা যা ড্রাফটে ছিল এতদিন। নানা কারণে যা পোস্ট করা হয়নি। আজ হঠাৎ চোখে পড়ায় প্রকাশ করতে ইচ্ছে হলো। আমার এই ভিডিওটাও ঐ বছরের মাঝামাঝি সময়ের।... ...বাকিটুকু পড়ুন

যেভাবে শরণার্থীরা একটি দেশের মালিক হয়ে গেলো!

লিখেছেন মাঈনউদ্দিন মইনুল, ১৫ ই মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৭:২৬



এবার একটি সেমিনারে প্রথমবারের মতো একজন জর্ডানির সাথে পরিচয় হয়। রাসেম আল-গুল। ঘনকালো মাথার চুল, বলিষ্ট দেহ, উজ্জ্বল বর্ণ, দাড়ি-গোঁফ সবই আছে। না খাটো, না লম্বা। বন্ধুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্ব। প্রতিটি সেশন... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিউ ইয়র্কের পথে.... ২

লিখেছেন খায়রুল আহসান, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২


Almost at half distance, on flight CX830.

পূর্বের পর্ব এখানেঃ নিউ ইয়র্কের পথে.... ১

হংকং আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে প্লেন থেকে বোর্ডিং ব্রীজে নেমেই কানেক্টিং ফ্লাইট ধরার জন্য যাত্রীদের মাঝে নাভিশ্বাস উঠে গেল।... ...বাকিটুকু পড়ুন

সামুতে আপনার হিট কত?

লিখেছেন অপু তানভীর, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০৩



প্রথমে মনে হল বর্তমান ব্লগাদের হিটের সংখ্যা নিয়ে একটা পোস্ট করা যাক । তারপর মনে পড়ল আমাদের ব্লগের পরিসংখ্যানবিদ ব্লগার আমি তুমি আমরা এমন পোস্ট আগেই দিয়ে দিয়েছেন ।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×