somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মরীচিকা

০৫ ই মে, ২০১১ রাত ১১:১২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

দুপুরের দিক থেকেই বিক্ষিপ্ত মেঘ দেখা যাচ্ছে। কখনও সূর্য ঢেকে যাচ্ছে কখনও উঁকি দিচ্ছে । এখন দু’একবার গুড়ুম শব্দ শুনা গেলো। বাড়ি থেকে বের হবে কীনা বুঝতে পারেনা সাইকী। মাঝে মাঝে খুব রাগ হয় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের উপর। বিশেষ করে আজিজ স্যারের উপর। নতুন জয়েন করে ভাবটা এমন কীবা হলাম মুই। তাঁর আচরণে ক্ষুব্ধ অনেকেই। কিন্তু সাহস করে কেও কিছু বলতে পারেনা। রেজাল্টের ভয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বাহাদুরী ঐ এক জায়গাতেই। না হলে স্বৈরাচারী আচরণ মানে কে কার।

বেলা তিনটায় টিউটোরিয়াল ক্লাস। ইচ্ছে করুক আর নাই করুক যেতে হবে। কোন কৈফিয়ত তিনি শুনবেন না। পরে মায়া কান্না কাঁদলেও নাকি টিউটোরিয়ালে কোন মার্কস দিবেন না- সাফ তিনি জানিয়ে দিয়েছেন। এ আদেশ নির্দেশ হয়তো সবার জন্য প্রযোজ্য নাও হতে পারে, ভাবে সাইকী। সুন্দরী যে ছাত্রীরা স্যারের সাথে লেপ্টে থাকতে পারে তারা হয়তো এ নিষেধাজ্ঞার বাইরে। সাইকী নিজে যে অসুন্দরী তা নয়। শুধু ডিপার্টমেন্ট বললে ভুল হবে, গোটা ক্যাম্পাসের সুন্দরীদের মধ্যে একজন। উচ্চতা প্রায় পাঁচ ফুট তিন ইঞ্চি। গায়ের রঙ দুধে আলতায় মেশানো ফর্সা, দেহ সৈষ্ঠব ফুটে উঠার জন্য যেখানে যতটুকু মাংশ প্রয়োজন তা বিধাতা নিপূণ হাতেই দিয়েছেন। মাথার চুল কোমর পর্যন্ত লম্বা| একেবারে স্ট্রেট। এমন সুন্দরী আজিজ স্যারের চোখে পড়বেনা তা হতে পারে না। অতো বোকা নয় সে।অতো বোকা শব্দটি আসলে তাঁর ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়। তিনি খুব চালাক। তিনি যতনা মেধাবী ততো বেশি চালাক, তা না হলে তাঁর চেয়ে প্রতিভাবান ভালো রেজাল্টধারীদের ডিগবাজি দিয়ে তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকতা চাকুরীটি পেতেন না। বিষয়টি ডিপার্টমেন্টের কারো অজানা নয়। তার পরেও তিনি বেশি বেশি ভাব দেখান। সাইকী ওসবের ধার ধারেনা। ছোট থেকেই সে একটু ঘাড় তেড়া মেয়ে। প্রাইমারী স্কুলে পড়ার সময় এক দিন পড়া না পরার জন্য এক স্যার তাকে তিরস্কার করলে পরে এক সময় স্যারকে ঠিকই সমুচিত জবাব দিয়েছিল । সে সময় পিচ্চি মেয়ের কথা শুনে শিক্ষক রীতিমত অবাক হয়ে গিয়েছিলেন। সেই শিক্ষক সাইকীর বাবাকে বলেছিলেন বড়হলে আপনার মেয়ে খুব প্রতিভাবান হবে, তার মধ্যে আলো দেখতে পাচ্ছি।এর পর ক্লাস নাইনে পড়তে এক বকাটে ছেলের গালে স্যান্ডেল মেরেছিল সে। এসব নিয়ে বাবা মা খুব চিন্তিত থাকতেন । না জানি কোন বিপদেই না পড়ে মেয়েটি। আল্লাহর রহমতে আজ পর্যন্ত সে বড় কোন বিপদে পড়েনি। আজিজ স্যারের বিপদেও হয়তো পড়বেনা। সাইকীর মাঝেমাঝে তার সহপাঠী মেয়েদের উপর খুব রাগ হয়। স্যারের কাছে একটু বেশি নম্বর নেওয়ার জন্য কেন এতো বেহেল্লেপনা! চেম্বারে বসে স্যারের সামনে হাসিহাসি মুখে কথা বলা, ওড়নাটা একটু এদিক সেদিক করে দেওয়া, খাতায় সহি নিতে গিয়ে টেবিলে কুনুইয়ে ভর দিয়ে উপুড় হয়ে অন্তর্বাস পর্যন্ত দৃষ্টি চালান দিতে সহায়তা করা - এসব কী? যত্তসব নোংরামী! সাইকী এসব পারেনা বলে আজিজ স্যার তাকে পছন্দ করেন না। পছন্দ করুক আর নাই করুক তাতে কিস্‌সু যায় আসেনা তার। অন্তত পক্ষে নিজের চরিত্র, ব্যক্তিত্ব বিলিয়ে তিনি কিছু পেতে চায় না।

আকাশের অবস্থা দেখে ক্লাসে যেতে ইচ্ছে না হলেও এক প্রকার বাধ্য হয়েই বাড়ি থেকে বের হলো সাইকী। না হলে অযথা স্যারকে তোষামোদ করতে হবে । যা তার পক্ষে সম্ভব নয়। বের হয়ে মোড়ের দোকান গুলোর কাছে আসতেই হঠাৎ জোরে বাতাস শুরু হয়। রাস্তার টুকরো কাগজ, পলিথিন ব্যাগ তুলার মতো উড়তে শুরু করে। পথের ধুলোয় চার পাশ ধোঁয়াশাচ্ছন্ন হয়ে যায়। মুখটা বিকৃত করে লোকজন ধুলাবালির আঘাত হজম করার চেষ্টা করে। কেউবা দু হাতে ঢেকে রাখে নাখমুখ। উজ্জ্বলের ঢোপের দোকানে দাঁড়িয়ে থাকা ছোঁড়াটা রাক্ষসের মতো তাকিয়ে থাকে সাইকীর দিকে। বাতাসের বিপরীতে হাঁটার জন্য সালোয়ার কামিজ ওড়না গায়ের সাথে একেবারে লেপ্টে ধরেছে। দেহের প্রতিটি সমতল, অসমতল ভূমি ফুটে উঠেছে স্পষ্ট। এক হাত দিয়ে জামা ওড়না ঠিকঠাক করার চেষ্টা করে ব্যর্থ হয় সে। ছোঁড়াটার রাক্ষুসী ভাব দেখে রাগ হয় তার। কান্নাও আসে। কিন্তু কিছু বলতে পারেনা। বলা সম্ভবও নয়। কিছু বলতে গেলে হৈ-চৈ হবে, আরো লোকজন জড়ো হবে, গন্ডগোলের কারণ জানতে চাইবে, জানবে এবং তারাও কেউ কেউ সরাসরি কেউবা চোরাগুপ্তা তার দেহের দিকে নজর দিয়ে কতকী ঠাহর করার চেষ্টা করবে। পুরুষদের সে ভালো করেই জানে, শালা সব বজ্জাতের জাত।
একটি রিক্সা এলে সে রেহাই পায় লজ্জা থেকে। খালি দেখে দাঁড়াতে বলেই উঠে পড়ে। কোথায় যাবে ভাড়া কত নিবে এতো কিছু বলার সময় তার নেই। লজ্জা তার গায়ে চাবুকের মতো আঘাত করছিল। মনে হচ্ছিল কেটে যাচ্ছে তার গা। উৎভ্রান্ত হরিনীর মতো নিজেকে আড়াল করতে চাইছিল সে। কিন্তু কতটুকু আড়াল করতে পারবে জানেনা। মাঝে মাঝে ভয় হয়। এটা সেটা ভেবে শরীর ঘেন্নায় রি-রি করে। রিক্সার হুড থেকে মাথা বের করে দলা পাকানো থুথু ফেলে হ্যাঁক-থু করে।
ততক্ষণে বৃষ্টি নেমেছে। বৃষ্টির ছাঁটে ভিজে যাচ্ছে পা,উরু,বুক। আবার মনে পড়ে বৃষ্টি ভেজা শরীরে কাপড় লেপ্টে থাকার কথা। নিজের শরীর নিয়ে নিজেরই ঘেন্না আসে। নিজেকে নিজেই ধিক্কার দেয় মেয়ে হয়ে জন্মাবার জন্য। রাস্তার কত ছেলেইতো ভিজতে ভিজতে হেঁটে যাচ্ছে কিন্তু কৈ কেওতো কোন বাজে কমেন্ট করেনা। তাহলে তার বা তাদের বেলায় কেন ওমনটি হয়? হয়তো বিধাতারই লিলাখেলা।
রিক্সা প্যারিস রোড থেকে বামে শহীদুল্লাহ্ কলা ভবনের দিকে ঘুরতেই দূর থেকে দেখতে পেলো তার সহপাঠীদের। কলাপসেব্ল গেটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে আভা, মনি, নীলু, স্মৃতি । রনিও আছে তাদের সাথে। দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে আড্ডা দিচ্ছে। স্যার হয়তো খারাপ আবহাওয়া দেখে আসেননি। রিক্সা কাছে আসতেই ওরা সাইকীকে দেখে হেসে ওঠে। নামার পর ডিপার্টমেন্টের জুনিয়র কয়েকজন মেয়ে আহ্‌লাদী কন্ঠে বলে- হায় আল্লা, সাইকী আপু আপনিতো এক্কেবারে ভিজে গেছেন। কিন্তু রনি ব্যস্ত হয়ে যায়। অভিভাবক্ত অস্থিরতা পেয়ে যায় তার। মাথা মুছো, মুখ মুছো, রুমে ফ্যানের নিচে কাপড় শুকাও, জ্বর হবে, মাথা ধরবে কত্ত কথা বলে গেলো এক নাগাড়ে।
রনি ছেলেটি যে তাকে পছন্দ করে সাইকী তা ভালো করেই বুঝতে পারে। এক ধরনের দ্বিধা, সংকোচ, ভয়ের কারণে যে সে তার মনের কথা বলতে পারেনা সেটাও সে বুঝে। আসলে সে বিষয়টিকে পাত্তা দিতে চায়না। রনি ছেলেটা মন্দ নয়। দেখতে শুনতে খুব ভালো না হলেও খারাপ নয়। স্বভাব, চরিত্র বাইরে থেকেতো ভালোই মনে হয়। যতটুকু বুঝা যায় বাপের আর্থিক অবস্থাও ভালো। চাঁপাইয়াদের আর্থিক অবস্থা বোধ হয় আনুপাতিক হারে অন্যান্য জেলার চেয়ে ভালো। আমবাগানই বোধহয় ঐ এলাকার লোকজনের অর্থনৈতিক উন্নয়নের মূল শক্তি। সায়েমদেরও তো নাকি অনেক বড় বড় আমবাগান ছিলো। দেখাতে নিয়ে যেতে চেয়েছিল সাইকীকে। প্রতি বছর আমের মৌসুমে খুব পীড়াপীড়ি করতো নিয়ে যাবার জন্য। এইতো সেবার কতইনা অভিমান করলো রাজী না হবার জন্য। ছেলেটি বড্ড অভিমানী ছিলো, একটুতেই ছোট বাচ্চার মতো অভিমান করতো, মুখ গোমড়া করে বসে থাকতো, কথা বলতনা, দেখিয়ে দেখিয়ে বেশি বেশি সিগারেট খেতো। নাহ্ সেসব কথা আর মনে করতে চায়না সাইকী। মনে করে দুঃখ বাড়িয়ে কী লাভ? কিন্তু লাভ ক্ষতির হিসাব যে মিলাতে পারেনা তার মন।
বিশ্ববিদ্যালয়ে ১ম বর্ষে ভর্তি হওয়ার পর প্রথম বন্ধুত্ব হয় সায়েমের সাথে। ছেলেটি বেশ স্মার্ট এবং ব্যক্তিত্বপূর্ণ ছিলো। সেই সম্পর্কটি কখন যে প্রেমের পোকা হয়ে তার বুকের ভিতর ঢুকেছিল তা সে নিজেও বোধহয় বুঝতে পারেনি। সায়েমও তাকে প্রচন্ড ভালবাসতো। দুজন দুজনাকে বিয়ে করারও সিদ্ধান্ত নেয়। মাস্টার্স পরীক্ষার পরই বিয়ে। কিন্তু কীভাবে যেন সব উলটপালট হয়ে গেলো। আসলে ওর জেদটাই যত সর্বনাশের গোড়া। কতবার পঁই পঁই করে নিষেধ করেছিল চুয়াডাঙ্গা আসতে, কিন্তু কে শুনে কার কথা।

অনার্স পরীক্ষা দিয়ে সাইকী গেলো গ্রামের বাড়ি। পরীক্ষার পর প্রায় ৩/৪ মাসের অবসর। এ সময়টা পুরো মা বোনদের সঙ্গে থাকার সিদ্ধান্ত নেয় সে। কিন্তু মাস পার হতে না হতেই সায়েম সাইকীকে দেখার জন্য পাগলামী শুরু করে। তার একটিই কথা - হয় আসতে হবে না হয় আমাকে তোমার সাথে দেখা করার অনুমতি দিতে হবে। তার এ দুটো প্রস্তাবের কোনটিই মানা সম্ভব হচ্ছিলনা। মা কী ভাববে না ভাববে এসব চিন্তা করে সাইকী কোন সিদ্ধান্তই দিতে পারছিলনা। এ নিয়ে ফোনে কত রাগারাগি করতো সে। মাঝে মাঝে রাগ করে দুচারদিন কথা বলা বন্ধ করে দিত। সাইকীকেই ভাঙ্গাতে হতো সে রাগ। সাইকী খুব ভালো করেই বুঝতো সায়েম তাকে কতটা ভালবাসে। মাঝে মাঝে তার ভয়ও হতো। এতো ভালবাসা এত সুখ কী সইবে কপালে?

একদিন গাড়ীতে উঠে সায়েম ফোন করে জানালো - কয়েক ঘন্টা পরেই তোমার সাথে দেখা হচ্ছে। সে মুহুর্তে তাকে নিষেধ করতে পারেনি সাইকী। বাড়ির লোকেশনটা ভালো করে বুঝিয়ে দিয়েছিল, যাতে খুঁজে পেতে অসুবিধা না হয়। তার পর মাকে বলে ভালোমন্দ খাবার তৈরী করিয়েছিল, নিজের হাতে তৈরী করেছিল ডিমের পুডিং। মনের অজান্তেই এক প্রকার সুখের হাওয়া তার গায়ে ঝাপটা দিয়ে যাচ্ছিল। দুপুর হতে না হতেই বারবার ঘড়ির দিকে তাকিয়ে সময়টা দেখে নিচ্ছিল সাইকী। চারটার মধ্যেই এসে যাবার কথা। কিন্তু ঘড়ির কাটায় চারটা পার হয়ে বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যা নামতে থাকলে সাইকী অস্থির হয়ে যায়। বারবার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করেও পাওয়া যাচ্ছিলনা। শুধুই দুঃখিত এই মুহূর্তে মোবাইল সংযোগ দেওয়া সম্ভব হচ্ছেনা।একই টোন শুনতে শুনতে সাইকী বিরক্ত হয়ে যায়। না জানা কত আশংকা মনের মধ্যে ভীড় করতে থাকে। কিন্তু কোনটিকেই পাত্তা দিতে চায়না সাইকী। রাত আটটার দিকে সাইকীর মোবাইলটি বেজে উঠলো। বুকের ভিতরটি ধড়াস্ করে উঠলো তার। তারপর যা শুনলো তা তার জীবন নাটকের মঞ্চে পর্দা টেনে দিয়ে যায়। সেদিন রাতের ফোনটি রনিই করেছিল। সায়েমের সাথে সেও যাচ্ছিল সাইকীদের বাড়ি। রনি সায়েমের খুব কাছের বন্ধু। ওদের দুজনেরই বাড়ি রহনপুর। প্রাইমারী স্কুল থেকে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত এক সাথেই পড়ছে তারা। সে জন্য তাদের বন্ধুত্বের সম্পর্কটি খুব গাঢ়। তাই বন্ধুকে সাথে নিয়েই সায়েম যাচ্ছিল সাইকীদের বাড়ি। সে দিনের ঘটনা পরে বিস্তারিত রনির কাছে শুনেছিল। তাদের গাড়ীটি চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে ছেড়ে চুয়াডাঙ্গা - দামুড়হুদার মাঝামাঝি জায়গাতে পৌঁছতেই ঘটে দুর্ঘটনা। গাড়ীটি উল্টে যাবার মুহুর্তে সায়েম গাড়ীর জানালা দিয়ে লাফ দিয়েছিল, আর সাথে সাথেই সে চাপা পড়েছিল নিচে। পুরো বাসের ভারে তার দেহের প্রতিটি লোমকূপ দিয়ে রক্ত বেরিয়ে এসেছিল। সে কী এক বিভৎস পরিস্থিতি। সাইকী আর কিছু শুনতে পারেনি। চিৎকার দিয়ে ডুকরে কেঁদে উঠেছিল।

দুই.

বৃষ্টি থামলে ডিপার্টমেন্ট থেকে বের হয়ে রাস্তায় নামে সাইকী। সন্ধ্যা নামতে এখনও প্রায় চল্লিশ মিনিট দেরি, তবু কেমন যেন সন্ধ্যার আমেজ। রিক্সা পাবার সম্ভাবনা নাই। বাধ্য হয়ে প্যারিস রোড ধরে পশ্চিম মুখো হয়ে হাঁটা শুরু করে সাইকী। ইউক্যালিপটাশ গাছ গুলো মনে হচ্ছে রাস্তার পাশে দৈত্যের মতো দাঁড়িয়ে আছে। আম গাছ গুলোর নিচে এখনও দাঁড়িয়ে আছে কয়েকটি জুটি। বৃষ্টি ভেজা মাটির জন্য বসতে পারেনা তারা। তবু আলাদাও হতে পারেনা। পারলে রাতটাও বোধহয় কাটাতো এক সাথে। কত দিন প্রক্টরের তাড়া খায় তারা। পরের দিন যেইকার অবস্থা সেই। আসলে আপনজনকে ছেড়ে থাকতে কেইবা চায়? তার পরেও থাকতে হয়। একটা বড় শ্বাস ছাড়ে সাইকী। নিজের কানে যেন বেশ জোরেই বাধে শ্বাস ছাড়ার শব্দটি। ইদানিং ঘনঘন বড় বড় নি:শ্বাস ছাড়ে সে। বুকটা কেমন যেন ভারি ভারি লাগে। একবার ডাক্তারের কাছে যাবার কথা ভেবেছিল কিন্তু ঠিক সময় হয়ে উঠেনি। আসলে যেতে তেমন ইচ্ছেই করেনা। খুব জোর হার্ট এ্যাটাক করে মারা যাবে এইতো? তাতে কী? কেনইবা বেঁচে থাকা? ভালো লাগেনা কিছুই।

সাইকী... বলে কে ডাকলে মুখ ফেরায় সে। আকমল সাহেব। হাঁসি হাঁসি মুখে রিক্সার সিটে আকমল সাহেব। সালাম দিলো সাইকী। বৃষ্টি বাদলার দিনে ক্যাম্পাসে কী করছো ? - জিজ্ঞেস করলো আকমল সাহেব।
টিউটোরিয়াল ক্লাসে এসেছিলাম।
বাসায় ফিরছো নিশ্চয়?
জ্বি হ্যাঁ।
আপত্তি না থাকলে আমার রিক্সায় আসতে পারো, তোমাদের বাসার রাস্তা দিয়েই বাজার যাবো।
না, ঠিক আছে। সামনে কাজলা গেটেই রিক্সা পাবো।
রিক্সা ছেড়ে দিয়ে কাজলা গেট পর্যন্ত একসাথে হেঁটে যেতে চাইলেও সাইকীর আপত্তিতে আকমল সাহেব তা পারলেন না। হয়তো ব্যথিত মনে চলে গেলেন সাহেব বাজারের দিকে।
মাঝে মাঝে খুব বিরক্ত লাগে আকমল সাহেবকে। কেউ কারো প্রতি বেশি বেশি আগ্রহ দেখালে ন্যাকামি মনে হয়। দেখা হলেই আইকা আঠার মতো লেগে থাকতে চায়। সুকৌশলে আঠা ছাড়িয়ে দূরে সরে হাঁফ ছেড়ে বাঁচে সাইকী। বিশ্ববিদ্যালয়ের এক জন শিক্ষক হয়েও তিনি এমন হ্যাংলামি করেন যে সাইকীর তা মোটেও পছন্দ নয়। আকমল হোসাইন মার্কেটিং বিভাগের এক জন নতুন শিক্ষক। গত বছর তার আগের বছর জয়েন করেছেন। পড়াশুনা করেছেন ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে। সাইকীর বড় বোনের ডিপার্টমেন্টের সিনিয়র ভাই। ক্যাম্পাসে বোনের সাথে দেখা করতে গিয়ে পরিচয় তাঁর সাথে। তাছাড়া বাড়িও একই এলাকায়, আলমডাঙ্গায়। বাবা কেরু ডিস্‌টিলারীতে চাকুরী করতেন। যাই হোক, এই আকমল হোসাইন ই এখন সাইকীকে বিয়ে করতে চায়। বাসায় প্রস্তাব দিয়েছেন। কিন্তু বাসা থেকে জানানো হয়েছে সাইকীর সিদ্ধান্তই তাদের সিদ্ধান্ত। সে রাজী থাকলে তাদের কোন আপত্তি নাই। এ কথা জানার পর থেকে সাইকীর মন পাবার জন্য উঠেপড়ে লাগে আকমল সাহেব। কিন্তু বিরক্ত বোধ করে সাইকী। লোকটিকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি পরিপাটি মনে হয়। কেমন যেন লেডিস মার্কা মনে করে সাইকী। পুরুষ হবে ঢেউয়ের মতো উত্তাল, ঝরনার মতো চঞ্চল তবেই না পুরুষ।

তিন মাস পর -
আকমল সাহেব এমন ভাবে পিছু লাগলো যে, শেষ পর্যন্ত সাইকী বিয়েতে অমত করতে পারলনা। আত্মীয় স্বজনদের চাপ ছিল খুব। তাছাড়া সাইকী ভাবলো - আমাদের সমাজে একটি মেয়ে একা চলতে পারেনা। চলতে গেলে পথে পথে হোঁচট খেতে হয়। সামাজিক নিরাপত্তা বলে কথা। এখনই কত প্রতিকূলতার মধ্যে প্রতিদিন চলতে হয় তাকে। সব দিক ভেবে চিন্তে অবশেষে রাজী হলো বিয়েতে। বিয়েও হলো বেশ জাক জমক ভাবে। আকমল খুব ভালোবাসে সাইকীকে। বিয়ের এ মাস ছয়েকের মধ্যে মনে হয়নি আকমলের ভালোবাসার মধ্যে কোন খাদ আছে। সাইকী যেতে না চাইলেও জোর করে শপিং এ যাওয়া, পদ্মা পাড়ে বেড়াতে যাওয়া কত কী পাগলামি ই না করে লোকটা। ভালই লাগে সাইকীর। মায়ের বাড়ি যেতেও কোন বাধানিষেধ নাই যখন তখন। যতদিন ইচ্ছে থাকে মায়ের কাছে। আসার জন্য জোরাজোরি নাই তার। ব্যাপার গুলো এক দিক দিয়ে ভালো লাগলেও আবার মাঝে মাঝে খারাপ লাগে। কেন সে জোর করে ডাকেনা, আমাকে ছেড়ে থাকতে কী তার কোন খারাপ লাগেনা, কেমন যেন উত্তাপ হীন ভালোবাসা মনে হয় সাইকীর কাছে। সেতো চায় ভালোবাসার উত্তাপে আকমল তাকে পুড়িয়ে ফেলুক।
পনের দিনের জন্যে মায়ের বাড়ি যায় সাইকী। দিন দশেক থাকার পর ভালো লাগলোনা থাকতে। লোকটার জন্য মাঝে মাঝে মন পুড়ে। কোথায় কী খেয়ে না খেয়ে কত কষ্ট করেই না আছে। সকালে ডিপার্টমেন্টে যাবার আগে শার্ট, প্যান্ট, টাই তাকেই পছন্দ করে এগিয়ে দিতে হয়। নিজের পছন্দে কিছুই করতে চায়না। না জানি এক শার্ট, প্যান্টে হয়তো দশ দিন পার করে দিয়েছে। এ সব ভেবে সাইকী কপোতাক্ষ এক্সপ্রেস ট্রেনে রওনা দিলো রাজশাহীর পথে। ঈশ্বরদী স্টেশনে ট্রেন গেলো আটকিয়ে। সামনে কোথায় যেন মালবাহী বগি লাইনচ্যুত হয়েছে, সেটা তুলবে তার পর গাড়ী ছাড়বে। পাক্কা দেড় ঘন্টা দেরীতে ছাড়লো ট্রেন। লক্কর ঝক্কর করতে করতে বেলা তিনটার সময় পৌঁছল রাজশাহী। ট্রেন থেকে নেমে রিক্সা নিয়ে ভার্সিটির পশ্চিম পাড়া পৌঁছতে বেলা সাড়ে তিনটা। লোকটি নিশ্চয় এতক্ষণে অঘোরে ঘুমাচ্ছে ভাবে সাইকী। দরজায় টক্ টক্ করে কয়েকবার । কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকে। কাঁচা ঘুমে লোকটিকে উঠাতে ইচ্ছা হয়না। তার পরেও বাধ্য হয়ে একবার ডোর বেলে চাপ দেয়, তার কিছুক্ষণ পর আরো একবার। খট্ করে দরজা খুলে দাঁড়ায় আকমল সাহেব।মরার মতো ঘুমাচ্ছিলে নাকী?- জিজ্ঞেস করে সাইকী। কিন্তু কথার কোন উত্তর না দিয়ে ভ্যাবাচেকা খেয়ে তার দিকে তাকিয়ে থাকে সে। ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকে দরজা আগলিয়ে। সরো বলে পাশ কাটিয়ে বাড়িতে ঢুকে সাইকী। ঢুকেই বেডরুমের দরজায় একজোড়া হাইহিল লেডিস স্যান্ডেল চোখে পড়ে তার। কপালটা কুঁচকে আসে। আগন্তুক দেখার জন্য এগিয়ে যায় রুমের দিকে। রুমে ঢুকতেই অ্যাট্যাচ্ট বাথরুম থেকে বের হলো একটি মেয়ে। মেয়েটিকে চিনে সাইকী। তাপসী রাবেয়া হলে থাকে। আকমলের ডিপার্টমেন্টেই বোধ হয় পড়ে। নাম সিমকী।
ঠান্ডা গলায় সাইকী বলল- সিমকী তুমি!
হ্যাঁ আপু, স্যারের কাছে একটা অ্যাসাইনমেন্ট নিয়ে আলোচনা করতে এসেছিলাম। এসে দেখি আপনি নেই।
তোমার লিপস্টিক লেপে আছে কেন? চুল, শাড়ীই বা কেন এলোমেলো?
সাইকীর কোন প্রশ্নের দিতে পারলনা সিমকী। মাথা নীচু করে চুপ করে বেরিয়ে গেলো বাড়ি থেকে। সাইকীর মাথাটা ঘুরে উঠে। একটি চেয়ার টেনে বসে পড়ে সে। আকমল চেয়ারের হেলনাটাই হাত দিয়ে দাঁড়ায় সাইকীর পাশে। কিছুক্ষণ চুপচাপ দুজনেই। তারপর আকমল নীরবতা ভেঙ্গে বলে- মনে কিছু করোনা। আমার ভুল হয়ে গেছে। Please forgive me.
ভুল! তুমি ভুল করবে কেন? ভুলতো করেছি আমি।
প্লিজ সাইকী, মাফ করে দেওয়া যায়না।
সাইকী কথার কোন উত্তর দিল না। আকমলের কথা গুলো সে শুনলো কী না বুঝাও গেল না। ব্যাগটি হাতে নিয়ে বেরিয়ে গেলো । পিছনে পিছনে নীচতলা পর্যন্ত নেমে গেল আকমল। কোন অনুরোধ ই শুনল না সাইকী। হাঁটতে হাঁটতে ভাবে, কোথায় যাবে সে? কিছুই মাথায় আসেনা। একবার ভাবে সায়েমের কাছে গেলেই ভালো হয়। অস্ফুট স্বরে বলে - সায়েম আমি আসছি।
সর্বশেষ এডিট : ০৫ ই মে, ২০১১ রাত ১১:২৬
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। ভারতে পচা রুটি ভাত ও কাঠের গুঁড়ায় তৈরি হচ্ছে মসলা

লিখেছেন শাহ আজিজ, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৩০

আমরা প্রচুর পরিমানে ভারতীয় রান্নার মশলা কিনি এবং নিত্য রান্নায় যোগ করে খাই । কিন্তু আমাদের জানা নেই কি অখাদ্য কুখাদ্য খাচ্ছি দিন কে দিন । এর কিছু বিবরন নিচে... ...বাকিটুকু পড়ুন

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ১৪ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:৪৩

মন যদি চায়, তবে হাতটি ধরো
অজানার পথে আজ হারিয়ে যাব
কতদিন চলে গেছে তুমি আসো নি
হয়ত-বা ভুলে ছিলে, ভালোবাসো নি
কীভাবে এমন করে থাকতে পারো
বলো আমাকে
আমাকে বলো

চলো আজ ফিরে যাই কিশোর বেলায়
আড়িয়াল... ...বাকিটুকু পড়ুন

One lost eye will open thousands of Muslims' blind eyes

লিখেছেন জ্যাক স্মিথ, ১৫ ই মে, ২০২৪ রাত ২:২৭



শিরোনাম'টি একজনের কমেন্ট থেকে ধার করা। Mar Mari Emmanuel যিনি অস্ট্রেলীয়ার নিউ সাউথ ওয়েলসের একটি চার্চের একজন যাজক; খুবই নিরীহ এবং গোবেচারা টাইপের বয়স্ক এই লোকটি যে... ...বাকিটুকু পড়ুন

চাকরি বয়সসীমা ৩৫ বৃদ্ধি কেনো নয়?

লিখেছেন এম ডি মুসা, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪২



চাকরির বয়সসীমা বৃদ্ধি এটা ছাত্র ছাত্রীদের/ চাকরি প্রার্থীদের অধিকার তবুও দেওয়া হচ্ছে না। সরকার ভোটের সময় ঠিকই এই ছাত্র ছাত্রীদের থেকে ভোটের অধিকার নিয়ে সরকার গঠন করে। ছাত্র ছাত্রীদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাঁচতে হয় নিজের কাছে!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৫ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৮

চলুন নৈতিকতা বিষয়ক দুইটি সমস্যা তুলে ধরি। দুটিই গল্প। প্রথম গল্পটি দি প্যারবল অব দ্যা সাধু।  লিখেছেন বোয়েন ম্যাককয়। এটি প্রথম প্রকাশিত হয় হার্ভার্ড বিজনেস রিভিউ জার্নালের ১৯৮৩ সালের সেপ্টেম্বর-অক্টোবর সংখ্যায়। গল্পটা সংক্ষেপে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×