somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

মোহনগঞ্জের হাটে

২৯ শে এপ্রিল, ২০১১ রাত ১:১৩
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :



ইবাদুল আর আমি পরস্পর কাজিন হলেও আমাদের সম্পর্কটা অনেকটাই বন্ধুত্বের।
কোরবানী ঈদে ইবাদুল এবার গুরু কোরবানী দেবেনা।সে ছাগল দেবে। ছাগল কিনতে সে যাবে মোহনগঞ্জের হাটে। হাটটি তার গ্রামের বাড়ির কাছেই। আমার গরু-ছাগল কেনার তাড়া নেই। বরাবরের মত এবারও দায়িত্বটি বাবা নিয়েছেন।
ইবাদুল যখন আমাকে মোহনগঞ্জ হাটে যাবার প্রস্তাব করল তখন আমি রাজি হয়ে গেলাম। কারণ শহরের কর্মব্যস্ততায় অনেকদিন কোথাও যাওয়া হয়নি। তাছাড়া ‘গঞ্জ’ নামটির মধ্যে আমার এক ধরনের দুর্বলতা আছে, বড় মোকাম, চাল-ডালের আড়ৎ, মানুষের ভিড়-ভাট্টা, কর্মব্যস্ততা দেখতে খারাপ লাগে না।
মোহনগঞ্জ যেতে চাওয়ার আরও কারণ আছে। মোহনগঞ্জের কাছে আমার কলিগ থাকেন; আমার সহকর্মী মাজেদা আপা। কিছুদিন আগে আপার হাজবেন্ডের প্রেসার খুব হাই হয়ে গিয়েছিল, সে কারণে তাকে হাসপাতালেও থাকতে হয়েছিল। এখন নাকি কিছুটা সুস্থ, তাকে একবার দেখতে যাওয়া।
পেশাগত জীবনে আপার সঙ্গে আমার একটা সখ্যতা আছে। তিনি আমাকে বিশেষ স্নেহ করেন। বিশ-পঁচিশ বছর আগে তিনি আমার বড় ভাইয়ের সঙ্গে কলেজে পড়েছেন। তার কাছে আমার বড় ভাইয়ের অনেক গল্প শুনেছি। তারা একসাথে বাংলার অধ্যাপক মাজেদ স্যারের কাছে প্রাইভেট পড়তে যেতেন। স্যারকে নিয়েও আপার অনেক গল্প। মাজেদ স্যার আমার ফুপা এবং ইবাদুল তারই ছেলে।
মাজেদা আপার সঙ্গে আমার সখ্যতা থাকলেও কর্মক্ষেত্রে আমরা পরস্পর প্রতিদ্বন্দ্বী। তিনি একটি দল করেন আমি অন্যটি। দু’দলেরই শক্ত অবস্থান। কখনো আমার দল ক্ষমতায় থাকে কখনো তার দল। ক্ষমতায় থাকলে প্রতিষ্ঠানের নীতি নির্ধারণে অংশগ্রহণ, হালুয়া রুটিতে ভাগ বসানো থেকে শুরু করে প্রতিষ্ঠান প্রধানের নিয়ন্ত্রণ ক্ষমতা পর্যন্ত হাতে থাকে।
আমি অনেকবারই নির্বাচন করেছি কিন্তু আমার ধারণা আপা কখনোই আমাকে ভোট দেননি। আমি অবশ্য তার কাছে কখনো ভোট প্রার্থনাও করিনি। কিন্তু এবার আমার দলনেতা বললেন, যেভাবে হোক আপার ভোটটি নিতে হবে। এটা তার নির্দেশ। আমি দলনেতার নির্দেশ পালনের জন্যই মনোনয়ন পত্রটি আপার সামনে মেলে ধরি। তিনি আমাকে যারপরনাই বিস্মিত করে, সমর্থক হিসেবে মনোনয়ন পত্রে স্বাক্ষর করে বসেন এবং বলেন, শুধু স্বাক্ষরই নয় আমি তোমাকে ভোটও দেব, তবে তোমাকে একবার সপরিবারে আমার বাসায় বেড়াতে যেতে হবে। আমি আপাকে তথাস্তু বললেও শেষ পর্যন্ত বউ নিয়ে যেতে পারিনি। আমি আপার বাসায় গেছি ইবাদুলকে নিয়ে এবং মোহনগঞ্জ হাটে যাবার পথে।
আপার বাসা হয়ে মোহনগঞ্জ হাটের দিকে যখন আমরা রওনা দিয়েছি তখন আমার মোহনগঞ্জ হাটে যাবার তৃতীয় কারণটি মনে হল। কারণটি ছিল অবচেতনে ; আর কে নারায়ণের একটি ছোট গল্প পড়েছিলাম। গল্পে লেখক হাটে যায় ছাগল কিনতে কিন্তু সেখানে এক মুরগী বিক্রেতার পটানিতে পড়ে লেখক ছাগলের পরিবর্তে মুরগী কিনে বাড়ি ফেরে। ছাগলের হাটে এরকম বিভ্রান্ত হওয়ার ঘটনা পড়ে আমার ছাগলের হাট দেখার সখ হয়েছিল।
মোহনগঞ্জ হাটে যখন আমরা পৌঁছি তখন বিকেল চারটা, ফাল্গুনের রোদের তীব্রতা থাকলেও একটা গা জুড়ানো বাতাসও বইছিল।
মোহনগঞ্জ হাটটি অন্য সব হাটের চেয়েও সাধারণ ; একটা ইট বিছানো রাস্তার দু’পাশে কয়েকটি মামুলি দোকান। মাছ তরিতরকারিওয়ালারা বসেছে রাস্তার উপরই। গঞ্জটির আশেপাশে কোন নদী বা খাল নেই, ধান চালের আড়ত নেই, লোকজনের আনাগোনাও কম, আসলে এটা একটা গ্রাম্য বাজার ছাড়া কিছু নয়। ইটের রাস্তার শেষ দিকে একটা পরিবার-পরিকল্পনা অফিস, তার সামনে বসেছে ছাগলের হাট।
ইবাদুল আর আমি ছাগলের হাটে ঘুরে ঘুরে ছাগল দেখছি। হাটে অনেক ছাগল উঠেছে। ছাগলের ক্রেতাও কম নয়। ছাগলে মানুষে গিস্ গিস্ করছে বাজার।
ইবাদুল হঠাৎ করেই একটা হাওলা খয়েরি রঙের ছাগল পছন্দ করে বসে। ছাগলটির মত বিক্রেতাও তাগড়াই গোছের আর খর্বাকৃতির। তার চেহারায় বেশ কাঠিন্য। সে ইবাদুলের সঙ্গে কথা বলতে বলতে ছাগলকে কাঠালপাতা খাওয়ায়। ইবাদুল ছাগল বিক্রেতার বাড়ি কোথায় জিজ্ঞেস করে। বিক্রেতা জানায় তার বাড়ি মানিককাঠি। ইবাদুল মানিককাঠি নামটি শোনা মাত্রই উল্লসিত হয়ে উঠে। সে ছাগল বিক্রেতার পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে বলে, আরে মিয়া আমি তোমার পাশের গ্রাম ক্ষুদ্রকাঠির পোলা, আমার বাড়ি হাওলাদার বাড়ি, আমার চাচা মোতাহার চেয়ারম্যান, আমার বাপ মাজেদ প্রফেসার, বাদশা ভাইরে চেননা, উপজেলার চেয়ারম্যান আছিল, সর্বহারার গুলি খাইয়া মারা গেল, সেতো আমার চাচাত ভাই।
ছাগল বিক্রেতার এসব পরিচয় নিয়ে কোন আগ্রহ নেই। সে শুধু বলে ‘হ আপনাগো বাড়িতে আমি অনেক গেছি। ইবাদুল চায় তোমার বাপের নাম কি ? বিক্রেতা বলে, ‘ হাসন চৌকিদার’। ইবাদুলের উৎসাহ তখন দ্বিগুণ হয়ে ওঠে। সে বলে, ‘আরে তুমি হাসনের পোলা। তোমার বাপের লগে ছোটবেলায় কত খেলছি। তোমার বাপ্রে আমার কথা কইও।’
ইবাদুল এবার ছাগলটির দাম জিজ্ঞেস করে। বিক্রেতা স্পষ্ট জানিয়ে দেয় তার ছাগলের দাম পাঁচ হাজার টাকা। তার দাম চাওয়ার ভঙ্গিতে দেশী কিংবা বাপকে চেনা ক্রেতাটির প্রতি কোন মমত্ব নেই। ইবাদুল বলে, ‘তুমি আমার দেশী পোলা, এত দাম আমার থিকা নিবা। আমি তোমারে চাইর দিমু। ছাগলটা আমার পছন্দ হইছে তা না হইলে এত দাম বলতাম না।’ বিক্রেতা কোন কথা বলে না। ইবাদুল জিজ্ঞেস করে, ‘কি মিয়া রাজি না ?’ বিক্রেতা মাথা নেড়ে অস্বীকৃতি জানায়। ইবাদুল পকেট থেকে একতাড়া নোট বের করে বিক্রেতার সামনে ফড় ফড় করে গুণতে থাকে। গোনা শেষ করে টাকাটা মুঠোয় পুরে বিক্রেতার হাতের মধ্যে গুঁজে দিতে দিতে বলে, ‘ন্যাও, তোমারে বিয়াল্লিশই দিলাম। তুমি হাসনের পোলা সেজন্য দুশ বাড়তি।’ বিক্রেতা টাকা নেয় না। সে হাত সরিয়ে ফেলে এবং ইবাদুলের জোরাজুরিতে শেষ পর্যন্ত দুই হাত মাথার উপর উঠিয়ে রাখে। ইবাদুল পঁয়তাল্লিশশো টাকা বলেও ছাগলটি কিনতে পারে না। ইবাদুল ছাগল বিক্রেতার আচরণে আহত হয় অথবা তার জিদ চেপে যায়। সে তখন বলে ‘যাহ্ আমি ছাগলই কিনব না।’
ইবাদুল এবার আমাকে নিয়ে হাটের পশ্চিম প্রান্তে চলে আসে। সেখানে গরুর হাট বসেছে। মোহনগঞ্জ হাটে ভাল ভাল গরু উঠেছে। গরু বিক্রেতারা তাদের গরুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ। তারা বলে, তাদের গরুগুলো দক্ষিণের ঘাস খাওয়া গরু, সার খাওয়া গরু নয় এবং কোন বিক্রেতাই তার গরুগুলোকে বিদেশী বলতে নারাজ।
নারায়ণগঞ্জের লোকেরা কোরবানীর জন্য সাদা গরু পছন্দ করলেও ইবাদুল পছন্দ করে কালো
গরু। সে মনে করে, কালো শোক এবং উৎসর্গের প্রতীক। ইবাদুল অবশ্য কালো ছাগল কিনতে চায়নি। কারণ সে শুনেছে কালো ছাগলের দাম বেশি থাকে আর ছাগল বিক্রেতারা বেশী দাম পাবার লোভে অন্য রঙের ছাগলকেও কালো কলপ করে বাজারে আনে।
ইবাদুলের একটি কালো গরু পছন্দ হল। গরুটার মিশকালো গায়ে একটা চেকনাই আছে। অবশ্য ওর গায়ে যথেষ্ট পরিমাণ শর্ষের তেল মাখাও হতে পারে। ইবাদুলের সঙ্গে গরু বিক্রেতার দাম নিয়ে তেমন মতানৈক্য হয় না। যেন উৎসর্গের গরু এক দামে কিনতে হয় এরকম একটি ভাব নিয়ে ইবাদুল গরুটি কিনে ফেলে। তারপর সে গরুর হাটের পেছনে পাঁচইন হাতে দাঁড়ানো ঠিকা রাখালের মধ্য থেকে একজন তরুণকে গরুটি বাসায় নিয়ে যাবার জন্য ঠিকা করে, ঠিকা রাখাল গরুটির লেজ মুড়িয়ে পাঁচইনের গুঁতো মেরে হাঁট হাঁট বাঁয় বাঁয় শব্দ করে যখন সে গরুটিকে শহরের দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল তখন আমি ইবাদুলের কানে ফিস ফিস করে বললাম, ইবাদুল তোমার মনে হয় কোরবানী হবে না। কারণ কোরবানীর জন্য তুমি ঠিক করেছিলে ছাগল। কিন্তু ছাগল বিক্রেতাকে পটাতে না পেরে তুমি গরু কিনে নিয়ে যাচ্ছো। গরু কিন্তু তোমার প্রিয় নয়। ইবাদুল কথাটি শুনে অপ্রস্তুত হয়ে গেল, চোখেমুখে অপ্রস্তুতির চিহ্ন ফুটে উঠল, কিন্তু কয়েক মিনিট পরই তার চেহারায় স্বস্তি ফিরে এল। সে আমাকে হতবাক করে দিয়ে বলল, কোরবানী অবশ্যই হবে; কারণ আমাদের মুসলিম জাতির পিতা ইব্রাহিম তার প্রিয় পুত্র ইসমাইলকে শেষ পর্যন্ত কোরবানী দিতে পারেননি। যেভাবেই হোক তিনি একটা দুম্বা কোরবানী দিয়েছিলেন।


০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কোরআন কী পোড়ানো যায়!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১০:৩৮

আমি বেশ কয়েকজন আরবীভাষী সহপাঠি পেয়েছি । তাদের মধ্যে দু'এক জন আবার নাস্তিক। একজনের সাথে কোরআন নিয়ে কথা হয়েছিল। সে আমাকে জানালো, কোরআনে অনেক ভুল আছে। তাকে বললাম, দেখাও কোথায় কোথায় ভুল... ...বাকিটুকু পড়ুন

সেঞ্চুরী’তম

লিখেছেন আলমগীর সরকার লিটন, ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:১৪


লাকী দার ৫০তম জন্মদিনের লাল গোপালের শুভেচ্ছা

দক্ষিণা জানালাটা খুলে গেছে আজ
৫০তম বছর উকি ঝুকি, যাকে বলে
হাফ সেঞ্চুরি-হাফ সেঞ্চুরি;
রোজ বট ছায়া তলে বসে থাকতাম
আর ভিন্ন বাতাসের গন্ধ
নাকের এক স্বাদে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ইরানের প্রেসিডেন্ট কি ইসরায়েলি হামলার শিকার? নাকি এর পিছে অতৃপ্ত আত্মা?

লিখেছেন ...নিপুণ কথন..., ২০ শে মে, ২০২৪ সকাল ১১:৩৯


ইরানের প্রেসিডেন্ট হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়ে নিহত!?

বাঙালি মুমিনরা যেমন সারাদিন ইহুদিদের গালি দেয়, তাও আবার ইহুদির ফেসবুকে এসেই! ইসরায়েল আর।আমেরিকাকে হুমকি দেয়া ইরানের প্রেসিডেন্টও তেমন ৪৫+ বছরের পুরাতন আমেরিকান হেলিকপ্টারে... ...বাকিটুকু পড়ুন

ভণ্ড মুসলমান

লিখেছেন এম ডি মুসা, ২০ শে মে, ২০২৪ দুপুর ১:২৬

ওরে মুসলিম ধর্ম তোমার টুপি পাঞ্জাবী মাথার মুকুট,
মনের ভেতর শয়তানি এক নিজের স্বার্থে চলে খুটখাট।
সবই যখন খোদার হুকুম শয়তানি করে কে?
খোদার উপর চাপিয়ে দিতেই খোদা কি-বলছে?

মানুষ ঠকিয়ে খোদার হুকুম শয়তানি... ...বাকিটুকু পড়ুন

কোথাও ছিলো না কেউ ....

লিখেছেন আহমেদ জী এস, ২০ শে মে, ২০২৪ রাত ১০:১৯




কখনো কোথাও ছিলো না কেউ
না ছিলো উত্তরে, না দক্ষিনে
শুধু তুমি নক্ষত্র হয়ে ছিলে উর্দ্ধাকাশে।

আকাশে আর কোন নক্ষত্র ছিলো না
খাল-বিল-পুকুরে আকাশের ছবি ছিলো না
বাতাসে কারো গন্ধ ছিলোনা
ছিলোনা... ...বাকিটুকু পড়ুন

×