somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

প্রভু নষ্ট হয়ে যাই

২৮ শে জুলাই, ২০১৩ দুপুর ১২:০২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

প্রভু নষ্ট হয়ে যাই
খাকি চত্বরের খোয়ারি- শাহাদুজ্জামান। বেঙ্গল পাবলিকেশনস, ২০১৩। প্রচ্ছদ : শিবুকুমার শীল। দাম ২২০ টাকা
মুবিনুর রহমান

একটি ঘূর্ণায়মান গল্পের লাট্টু ঘুরতে ঘুরতে গিয়ে শেষ হয় আবারও সূচনায়। ‘খাকি চত্বরের খোয়ারি’ স্বাধীনতা-পরবর্তী সময়ের কাহিনী। কাহিনীতে চকিতে সমসাময়িক ঘটনা পরম্পরার বুদ বুদ উঠলেও মুহূর্তেই মিশে যায় চত্বরের গুমট আবহে। একটি সুন্দর, সুনিশ্চিত, অভিজাত জীবনের প্রত্যাশায় স্বেচ্ছায় কিংবা পরেচ্ছায় কিশোরেরা যে অদ্ভুত পাকচক্রে ঢুকে পড়ে এক সময় চক্রবর্তী পাকেরই অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে ওঠে এবং চক্রভাঙার বৈপ্লবিক অভিলাষ তাদের কাছে তাই অপ্রয়োজনীয়, অদ্ভুদ মনে হয়, তার দৃশ্যচিত্র খাকি চত্বরের খোয়ারি।

উপন্যাসের নামটি যথাযথ। প্রচ্ছদ নান্দনিক, বিষয় সংশ্লিষ্ট, কাগজ বাঁধাই মন্দ বলা যাবে না। শাহাদুজ্জামান বাংলাদেশের মননশীল কথা সাহিত্যের বিশিষ্ট নাম। গল্প এবং উপন্যাস তার কাজের প্রধান ক্ষেত্র হলেও প্রবন্ধ, গবেষণা, ভ্রমণ এবং অনুবাদ সাহিত্যেও রয়েছে তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থ। লেখক বরাবরই পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেছেন, ভেঙেছেন আবার নতুন করে গড়েছেন তার শিল্প, সৌন্দর্য ও ভাবনার সৌধ।

উপন্যাসের মূল চরিত্র নামহীন, গোত্রহীন। কোথাও তার পরিচয় সুস্পষ্ট নয়। তিনি একজন কথক। মনে হয় একজন কিশোর তার জীবনের একটি গুরুত্বপূর্ণ সময়ের বিবরণী বাধাহীন স্বচ্ছন্দে বলে যাচ্ছে। লেখকই কথক, কথকই লেখক। বছর বছর স্কুল বদলের ঝামেলা থেকে মুক্ত হতে গিয়ে চার চোখা মফস্বলের কিশোর চারপাশে তাকাতে তাকাতে স্থিরচিত্রের আরেকটি অনুষঙ্গ হয়ে ঢুকে পড়ে এক নিশ্চল অচলায়তনে। অচলায়তনের ঝা চকচকে দালান, ছিমছাম রাস্তা, বিশাল সবুজ মাঠ, লাল সাদা রঙে সাজানো গাছ, জ্যামিতিক ছক কাটা লম্বা লম্বা ঘর আর হাসপাতালের মতো বিছানা ধীরে ধীরে হয়ে ওঠে অতি চেনা। এই চত্বরই তাদের পৃথিবী। বড় গ্রহের ভেতর ছোট গ্রহ। বড় দেশের ভেতর ছোট দেশ।

দেয়াল আর কাঁটাতার ঘেরা এক আধাসামরিক প্রতিষ্ঠান। সেখানে চকচকে বুট আর খাকি পরা কতিপয় কিশোর। কঠোর শৃঙ্খলা আর কড়া নজরদারির ভেতর তারা প্যারেড করে, ক্লাসরুমে বসে খোলে অঙ্কের খাতা। বিকেল গড়ালে ছুটে যায় মাঠে। বিউগল বাজিয়ে সূর্যকে বিদায় জানায় তারা। রাতে গলায় টাই বেঁধে কাঁটা চামচে খায় ইংলিশ ডিনার। ঘড়ির কাঁটা রাত ১০টা স্পর্শ করলে লাইটস অফ। চারদিকে অন্ধকার, সুনসান। দূর গ্রামের কিশোর এই চত্বরে এসে হয়ে পড়ে স্কটিশ ব্যাগপাইপ বাজিয়ে। নিজেকে খাকি পরা মেঘ ঘোষণা করে কেউ কেউ বুকে বয়ে বেড়ায় জীবনানন্দ। কেউ গিটারে তুমুল ঝঙ্কার তুলে গায় ‘হানড্রেড মাইলস, হানড্রেড মাইলস অ্যাওয়ে’। কারো কিশোর চোখ খোঁজে কিশোরীর মুখ। সব নজরদারি এড়িয়ে কেউ কেউ অন্ধকারে পেরিয়ে যায় কাঁটাতারের ঘেরাটোপ। কৈশোরের নিয়ম আর নিয়ম ভাঙার এইসব মত্ততার গল্প খাকি চত্বরের খোয়ারি।

ব্রিটেনের লর্ড, ব্যারন, নাইট, ডিউক প্রভৃতি অভিজাত পরিবারের ছেলেদের সুসভ্য, দক্ষ ও চৌকস মানুষ করার জন্য যে বোর্ডিং স্কুল ছিল তার আদলে এইসব খাকি চত্বর। যাকে আমরা ক্যাডেট কলেজ নামে চিনি। ক্যাডেট কলেজ নিয়ে আমাদের মধ্যে যে ধরনের ফেনোমেনা কাজ করে, শাহাদুজ্জামান সেই ফেনোমেনা ভাঙতে চেষ্টা করেননি, আবার অনুসরণও করেননি সেই সূত্র, তিনি মনন বিছিয়ে এক একটি শব্দ দিয়ে এ ফোঁড় ও ফোঁড় করে সেলাই করেছেন পুরো গদ্যের নকশিকাঁথা। আধা সামরিক, আধা বেসামরিক, খানিকটা ইসলাম, খানিকটা ব্রিটিশ, কিছুটা বাঙালি এমনসব বিচিত্র কায়দার মিশ্রণে এসব চত্বরে তৈরি করা হচ্ছে ‘ক্রিম অব দ্য সোসাইটি’। যারা ভবিষ্যতে নেতৃত্ব দেবে পুরো দেশকে। যারা দক্ষ, চটপটে, চৌকস কিন্তু দেশ-কাল-মানুষের সম্পর্কবিহীন অন্তঃসারশূন্য চকচকে নাট বল্টু। সত্য, সুন্দর ও কল্যাণময় পথে সমাজের চাকাটাকে চালিয়ে নিতে যে জিজ্ঞাসু, বিশ্লেষণী, মানবিক ও দূরদৃষ্টিসম্পন্ন মানুষ হতে হয়, তা এখানে হয়ে ওঠে বিভ্রান্তিকর, অলীক। বরং মস্তিষ্কজাত ডাক্তারি, ইঞ্জিনিয়ারিং, সামরিক কর্মকর্তা কিংবা আমেরিকার দাসত্ব গ্রহণের উপরিতলের স্বপ্নই এই চত্বরের খুদে খাকিদের কাছে বেশি সতেজ, ঝকঝকে, করকরে, চকচকে।

স্তরে স্তরে, শ্রেণিতে শ্রেণিতে বিভক্ত সমাজের নানা কোঠর থেকে উঠে আসা সব বিবিধ বালকেরা এসেছে অজানা স্বপ্ন পূরণের বিক্ষিপ্ত কল্পনা মাথায় নিয়ে। কিন্তু বাটিছাঁটা চুলের মতো মরে পড়ে থাকে সব কল্পনা, মায়ের গন্ধ ভরা আটপৌরে বাড়িঘর, গ্রামের পথ, ঘাট, মাঠ, খোলা আকাশ। প্রতিদিনের নিয়মমাফিক ক্লাস, প্রেপটাইম, ডিনার, সেলফ স্টাডি এসবের বাইরেও ছেলেরা সাপ্তাহিক মুভি দেখে, খেলাধুলার চলে মেতে ওঠে প্রতিযোগিতায়, সাংস্কৃতিক সন্ধ্যায় কেউ কেউ গিটার হাতে গেয়ে ওঠে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত ‘ওরে সালেকা, ওরে মালেকা, ওরে ফুলবানু পারলি না বাঁচাতে’, কবিতার প্রয়োজন ফুরিয়েছে কি ফুরায়নি সে নিয়ে চলে তুমুল বিতর্ক। এইসব প্রতিযোগিতা কখনও কখনও হয়ে রূপান্তরিত হয় ক্ষমতার রাজনীতিতে। চত্বরের নেতৃত্ব পেতে নেমে যায় যুদ্ধের ময়দানে।

‘যেখানে ক্ষমতার চর্চা থাকে সেখানে ক্ষমতাকে উপেক্ষা করার একটা চর্চাও থাকে সব সময়। নিয়মের যাঁতাকলে পড়ে দুর্বলরা যখন বোঝে নিয়ম পাল্টানোর কোনো ক্ষমতা তাদের নাই, তখন তারা নিয়ম ভেঙে এক ধরনের প্রতিবাদ করে।’ তখন ভাবনায় থাকে না শাস্তির যন্ত্রণা। চত্বরে লঘু শাস্তির তালিকায় সবার উপরে ফ্রন্টরোল, পরে ফ্রগজাম্প, ক্রলিং। আর গুরু শাস্তি একটাই এক্সট্রা ড্রিল সংক্ষেপে ইডি। চত্বরে নিয়মভাঙার খেলা চলে দলেবেঁধে। দলবেঁধে নিয়মভাঙা, দলবেঁধেই ইডি। নাকের জল, চোখের জল, রক্ত, বমি মিশে একাকার তবু বালকেরা কাঁদে না। কারণ তারা শিখেছে ‘হোয়াট আই অ্যাম ট্রাইয়িং টু ডু ইজ টু ট্রেইন ইউ অ্যাজ আ টাফ হিউম্যান বিয়িং। অ্যান্ড রিমেমবার হোয়েন গোয়িং গেটস টাফ, দ্য টাফ গেটস গোয়িং’।

তবুও কারো কারো মনে ঠিকই উঁকি দেয় বিপুলা পৃথিবী দেখার উদগ্র কামনা। খাকি পরা মেঘ, মায়োভস্কির ‘ট্রাউজার পরা মেঘ’-এর মতো মিলন চত্বরে থেকেও নেই, মেঘের মতো দূর-দূরান্তে উড়ে বেড়ায় তার মন। জীবনানন্দ, আবুল হাসানের কবিতায় ডুব দিয়ে আরও রহস্যময় হয়ে ওঠে মিলন। ‘জীবন কি শুধুই জয়ের জন্য, একটা কোনো জীবিকার জন্য? এর বাইরে আর কিছু নাই, আর কোনো অর্থ নাই’। এই ভাবনা মিলনকে তাড়িয়ে তাড়িয়ে নিয়ে যায় অসীম ভ্রমণে। হঠাৎ একদিন বাংলা শিক্ষক রফিক স্যার এসে এক বিস্ফোরণ ঘটালেন, খুলে দিলেন জাদুর প্যান্ডোরা, বিস্ময়ের বিবিধ কীটপতঙ্গ ছড়িয়ে দিলেন খাকি চত্বরের অবরুদ্ধ আকাশে। জীবনের মানে বুঝুক আর নাই বুঝুক যৌনতা, যৌবনের উন্মত্ততা বুঝতে সময় লাগে না খুদে খাকিদের। টেস্টোস্টেরন হরমোনের প্রাবল্যে ভেসে যায় সবাই। নারীবর্জিত চত্বরে স্বমেহন, হোমোসেক্সুয়ালিটি কিংবা সডোমিও দুর্লভ থাকে না, যেমন থাকে না মিলিটারি ব্যারাক, জেলখানা, মাদরাসায়।

আঘাতকারীর সঙ্গে আঘাতপ্রাপ্তের মানসিক সখ্যের যে স্টকহোক সিনড্রোম তাতে সংক্রমিত কথক। মধুর শৈশব অপহরণকারীর জন্যই জেগে ওঠে অনিবার্য দরদ, বুকের গভীরে ছ্যাঁত করে ওঠা নস্টালজিয়া। খাকি চত্বরের খোয়ার ক্রিম অব দ্য সোসাইটি বানানোর কারখানা হয়ে ওঠে পুতুলনাচের মঞ্চ। ছাচে পড়া বালকেরা হয়ে ওঠে অর্থ, যশ, খ্যাতি প্রাপ্তির দানবীয় যন্ত্রের কলকব্জা, নাট বল্টু। জীবন, মানুষ আর প্রকৃতি হারিয়ে যায় অজান্তে। কারো কারো জীবনের স্বাদ পাওয়ার আশা নিঃশেষ হয় রেললাইনে কাটা পড়ে, উপন্যাস পাঠ শেষে শক্তি চট্টোপাধ্যায়ের কবিতার একটি লাইন জলের মতো ঘুরে ঘুরে কেন্দ্রীভূত হয় ‘প্রভু নষ্ট হয়ে যাই’।
০টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

অপরাধের সেকাল ও একাল

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:১০

সেকাল
--------------------------------------------------------
স্কটল্যান্ডের বাসিন্দা হেনরি বেভারিজ ছিলেন বৃটিশ-ভারতীয় সিভিল সার্ভিসের একজন সদস্য৷বেভারিজ ১৮৭০ সালের মার্চ হতে ১৮৭১ সালের মার্চ এবং ১৮৭১ সালের জুন থেকে ১৮৭৫ সাল পর্যন্ত বৃহত্তর বরিশালের জেলা ম্যাজিস্ট্রেট ও... ...বাকিটুকু পড়ুন

মুক্তির কোরাস দল

লিখেছেন সেলিনা জাহান প্রিয়া, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:২৫



ঘুমিয়ে যেও না !
দরজা বন্ধ করো না -
বিশ্বাস রাখো বিপ্লবীরা ফিরে আসবেই
বন্যা ঝড় তুফান , বজ্র কণ্ঠে কোরাস করে
একদিন তারা ঠিক ফিরবে তোমার শহরে।
-
হয়তো... ...বাকিটুকু পড়ুন

বাইডেন ইহুদী চক্তান্ত থেকে বের হয়েছে, মনে হয়!

লিখেছেন সোনাগাজী, ০৮ ই মে, ২০২৪ সকাল ১০:৪৮



নেতানিয়াহু ও তার ওয়ার-ক্যাবিনেট বাইডেনকে ইরান আক্রমণের দিকে নিয়ে যাচ্ছিলো; বাইডেন সেই চক্রান্ত থেকে বের হয়েছে; ইহুদীরা ষড়যন্ত্রকারী, কিন্তু আমেরিকানরা বুদ্ধিমান। নেতানিয়াহু রাফাতে বোমা ফেলাতে, আজকে সকাল থেকে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আজ ২৫শে বৈশাখ। ১৬৩তম রবীন্দ্র জন্মজয়ন্তী উপলক্ষে আমার গাওয়া কয়েকটি রবীন্দ্রসঙ্গীত শেয়ার করলাম। খুব সাধারণ মানের গায়কী

লিখেছেন সোনাবীজ; অথবা ধুলোবালিছাই, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:০৫

আপনারা জানেন, আমি কোনো প্রফেশনাল সিঙ্গার না, গলাও ভালো না, কিন্তু গান আমি খুব ভালোবাসি। গান বা সুরই পৃথিবীতে একমাত্র হিরন্ময় প্রেম। এই সুরের মধ্যে ডুবতে ডুবতে একসময় নিজেই সুর... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিশ্ব কবি

লিখেছেন সাইদুর রহমান, ০৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৩:২৭

বৈশাখেরি পঁচিশ তারিখ
কবি তোমার জনম
দিন,
বহু বছর পার হয়েছে
আজও হৃদে, হও নি
লীন।

কবিতা আর গল্প ছড়া
পড়ি সবাই, জুড়ায়
প্রাণ,
খ্যাতি পেলে বিশ্ব জুড়ে
পেলে নভেল, পেলে
মান।

সবার ঘরেই গীতাঞ্জলী
পড়ে সবাই তৃপ্তি
পাই,
আজকে তুমি নেই জগতে
তোমার লেখায় খুঁজি
তাই।

যখন... ...বাকিটুকু পড়ুন

×