somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

সাহেব ধরা বাঙালি !

০৮ ই মার্চ, ২০১৩ ভোর ৪:১০
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :

[আগেই বলে রাখি লেখাটা আমার না। ভাল লাগল তাই আপনাদের সাথে শেয়ার করলাম]

বাঙালির পশ্চিমপ্রীতি বা বিদেশপ্রীতি আজকের নয়। এর শুরু সেই নবাবি আমল-পরবর্তী ইংরেজ রাজত্বের সূচনালগ্নে। সাহেবদের জন্য বাড়ি খোঁজা, দাস-দাসী জোগাড় করা থেকে শুরু করে পালকি, বেহারা, ঘোড়া, সহিস মায় বুবু (দেশীয় রক্ষিতা) পর্যন্ত জুটিয়ে দেওয়া ছিল এদের কাজ।

নবাবি আমল যাই যাই করছে। উনিশ শতক অস্ফুট এখনো। ফুটবে কিছু পরে। কাজ-চালানো গোছের ইংরেজি জানা একশ্রেণীর বাঙালি তখন ভিড় করে দাঁড়িয়ে থাকে জাহাজঘাটে। কখন পালতোলা জাহাজ থেকে নামবেন সাহেবেরা—এ দেশের নতুন নবাবেরা। এই নবাগতদের সেবা দিয়ে, তুষ্ট করে তাঁদের অনুগ্রহভাজন হওয়াই এই উদ্যোগী বাঙালিদের প্রধান লক্ষ্য।
ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির এই সাহেবদের জন্য বাড়ি খোঁজা, দাস-দাসী জোগাড় করা থেকে শুরু করে পালকি, বেহারা, ঘোড়া, সহিস মায় বুবু (দেশীয় রক্ষিতা) পর্যন্ত জুটিয়ে দেওয়া ছিল এদের কাজ। সব সময় হাতজোড় বিনীত এই বাঙালিদের ছাড়া সাহেবদের দৈনন্দিন জীবন চালানো হতো দুষ্কর। তবে প্রতিটি সেবাই তাঁদের পেতে হতো টাকার বিনিময়ে। সাহেব-ধরা তখন একশ্রেণীর বাঙালির পেশা, নেশাও বটে।
সাহেব-আনুকূল্যে সামান্য অবস্থা থেকে এরা প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়ে সেদিনের সমাজে নামীদামি বড় মানুষ হয়েছিল। যেমন, সে আমলের ধনী রতন সরকার। তিনি প্রথমে ছিলেন ধোপা। পরে ইংরেজের দোভাষী হয়ে প্রচুর বিত্তের অধিকারী হয়েছিলেন। ফ্রান্সিস সাইরুস ও পরে ওয়ারেন হেস্টিংসের দেওয়ান কান্তবাবু ছিলেন নিম্নবর্ণের হিন্দু মুদি। কাশিমবাজারের মহারাজ কৃষ্ণকান্ত নন্দী, বিখ্যাত ধনী রামদুলাল সরকার নকুধর—এঁদের সবার কপাল ফেরার মূলে রয়েছেন কোম্পানির সাহেবেরা। এঁরাই ধীরে ধীরে নবাবি আমলের অভিজাত ধনীদের (যেমন নারায়ণ রাজবল্লভ, মহারাজ নন্দকুমার—যাঁরা নবাবদের দেওয়ান ছিলেন) স্থলাভিষিক্ত হয়েছিলেন। কোনো কোনো আধুনিক গবেষক এঁদেরই নাম দিয়েছেন সাহেব-ধরা বাঙালি।
কালীপ্রসন্ন সিংহ এই ছোট থেকে বড় হওয়ার পর্বটি তাঁর হুতোম প্যাঁচার নক্সায় অননুকরণীয় ভঙ্গিতে লিখেছেন, ‘নবাবী আমল শঠতকালের সূর্যের মতো অন্ত গ্যালো মেঘান্তের রৌদ্রের মতো ইংরাজদের প্রভাব বেড়ে উঠলো। বড় বড় বাঁশঝাড় সমূলে উচ্ছেদ হলো। কঞ্চিতে বংশলোচন জন্মাতে লাগলো। নবোমুন্সী, চিরে বেনে, পুটেতেলি রাজা হলো।’ চিরে বেনের অর্থ উঠতি বাঙালি আর পুটেতেলি হলো ছোটখাটো তেলের ব্যবসায়ী।
সাহেব-ধরাদের ধ্যান-জ্ঞান ছিল বিদেশিদের মুৎসুদ্দি বা এজেন্ট হওয়া। দেওয়ানি ও বেনিয়ানগিরিও ছিল পছন্দের পেশা। দেওয়ানি হলো এই সাহেবদের চাকরি করা। সাহেব মনিবের টাকা দিয়ে মনিবের ব্যবসা চালাত এরা। কী ধরনের ব্যবসা? প্রধানত লবণ ও আফিমের ব্যবসা। আবার দেওয়ান, মুনশি, গোমস্তা সরকার বা সাহেবেরা জমিদারি ও তদারক্করণে বিদেশি বণিকেরা এ দেশের বাজার, রীতি-নীতি, লেনদেন ভাষা কিছুই বুঝত না। অনেক সময় এদের মূলধনেরও অভাব দেখা দিত। বাঙালি বেনিয়ানরাই তাদের টাকা ধার দিত চড়া সুদে বন্ড লিখিয়ে নিয়ে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে এই ধার দেওয়া টাকার অঙ্ক সুদে-আসলে এমন ফুলেফেঁপে উঠত যে অল্প সময়েই এরা ধনী হয়ে দাঁড়াত। নিমক মহলের দেওয়ানি নিয়ে লোকে দুই দিনেই টাকার কুমির হয়ে উঠত। এ কারণেই প্রথম জীবনে প্রচুর বিত্ত থাকা সত্ত্বেও দ্বারকানাথ ঠাকুরও কোম্পানির নিমকের দেওয়ান হয়েছিলেন। সেই সময়ে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি এ দেশে ইউরোপিয়ানদের অবাধ প্রবেশ ও বসবাস পছন্দের চোখে দেখত না। তখন বাঙালি ছাড়া কোনো ভারতীয়কে কোম্পানির কর্মচারী হিসেবে নিয়োগের অনুমতি দেওয়া হতো না। ফলে কোম্পানির তখনকার সেই নীতি সাহেব-ধরাদের সামনে নতুন নতুন সুযোগ এনে দেয়। আবার নিজেদের স্বার্থের তাগিদেই এ দেশের উঠতি ব্যবসায়ী, নতুন জমিদারদের আনুগত্য কোম্পানির জন্য একান্ত প্রয়োজন ছিল। ফলে বাঙালিদের শুধু বেনিয়ান মুৎসুদ্দিই নয়, এমনকি ব্যবসায়ের অংশীদার পর্যন্ত তাদের করতে হয়েছিল। অন্যদিকে সরকারি অনুগ্রহ ছাড়া এ দেশের ব্যবসায়ীদের প্রাথমিক মূলধন জোগাড় করার কোনো সুযোগ ছিল না। অতএব, ইংরেজতোষণ করেই বাংলার তৎকালীন সাহেব-ধরারা ভাগ্যের চাকা ঘোরাতে পেরেছিল। অনায়াসে অল্প সময়েই গড়ে তুলেছিল সম্পদের পাহাড়। বিনয় ঘোষ লিখেছেন, ‘ইংরেজ যুগের প্রথম পর্বে নতুন বাঙালি ধনী সমাজ গড়ে ওঠে প্রধানত এই দেওয়ানি বেনিয়ানি মুৎসুদ্দিগিরি ও চলনসই ইংরেজি বিদ্যার ওপর নির্ভর করে।’ সেই থেকেই বাঙালির ইংরেজ প্রভুকে তুষ্ট করে জাগতিক উন্নতির সিঁড়ি বেয়ে ওঠার শুরু।
ধনবান বাঙালিরা সাহেব-ভজনার একটি চমকপ্রদ পন্থা সেই সময় বের করেছিল। সেটি হলো ধর্মীয় ও সামাজিক অনুষ্ঠানে নাচ-গানসহ ভোজেরি আসরে সাহেব-মেমদের আমন্ত্রণ করে বাড়িতে নিয়ে আসা, বিশেষ করে দুর্গাপূজায়। গোড়ার দিকে দুর্গোৎসবে পূজাবাড়িতে সাহেবদের প্রবেশ নিষিদ্ধ ছিল। ১৭৬৬ সালে হলওয়েলের লেখায় দেখা যায়, ইংরেজ সাহেবদের পূজাবাড়িতে নিমন্ত্রণ করে নিয়ে আসা শুরু হয়েছে। ইতিহাস বলে, রাজা নবকৃষ্ণদেবই প্রথম সাহেবদের অনুগ্রহ লাভের জন্য পূজাবাড়িতে নিমন্ত্রণ করে তাদের নাচ-গান ও পান-ভোজনে আপ্যায়িত করেছিলেন। ১৮২৯ সালে নবকৃষ্ণ মহারাজার কলকাতার বাড়িতে গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিংক আর প্রধান সেনাপতি লর্ড কাম্বারমির ও অন্যান্য উচ্চপদস্থ সাহেবেরা নিমন্ত্রণ রক্ষা করেছিলেন। নবকৃষ্ণের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে অন্যান্য ধনী বাঙালি সাহেবদের পূজায় নিমন্ত্রণ করে নাচ-গান ও পান-ভোজনে আপ্যায়িত করতেন। বলাবাহুল্য, এহেন উদার আতিথেয়তা অবশ্যই উদ্দেশ্যহীন ছিল না। সাহেবদের মনোরঞ্জন করে কিছু জাগতিক সুবিধা আদায় করাই ছিল এর প্রধান লক্ষ্য।
এসব আনন্দে সে আমলের বিখ্যাত বাইজিদের নিয়ে আসা হতো। যিনি সবচেয়ে দামি নৃত্য-নর্তকীকে ভোজসভায় আনবেন, সাহেবদের চোখে তাঁরই সামাজিক মর্যাদা সবচেয়ে বেশি হবে—এমন ধারণা ছিল বাবুসমাজের চাঁইদের। বিখ্যাত নর্তকী নিকি রাজা রামমোহন রায়ের মানিকতলার বাগানবাড়িতে অতিথিদের মনোরঞ্জনের জন্য নেচেছিলেন বলে শোনা যায়। মাদাম বেলনোস নামের একজন ইউরোপীয় মহিলা শিল্পী (১৮৪০) কলকাতার বাঙালিবাড়িতে নিমন্ত্রিত সাহেব-মেমদের নৃত্য-গীত উপভোগ করার বেশ কয়েকটি জীবন্ত ছবি এঁকে গিয়েছেন। এহেন আমোদ-প্রমোদের স্রোতে সাহেব-মেমদের গা ভাসিয়ে দেওয়ায় শঙ্কিত হয়ে ওঠেন কোম্পানি বাহাদুর। বাঙালির সাহেব-ভজনার এই চমকপ্রদ রেওয়াজটি একসময় উঠিয়ে দিলেন তাঁরা।
১৮৪০ সালের এক আইনের বলে দেশীয়দের পূজা-পার্বণে সাহেব-মেমদের হাজির হওয়া বন্ধ হয়ে যায়।
সাহেব-ভজনা কি উঠে গিয়েছিল? না, মোটেই নয়। এবার নতুনরূপে, নতুন বেশে, আরও পরিশীলিত ভঙ্গিতে শুরু হলো ইংরেজি শিক্ষিত, পাশ্চাত্যের আলোকে বিবশ এবং মুগ্ধ বাঙালির সাহেব-তোষণের নতুন পালা। এ সময়ই ইংরেজদের উচ্চারণের সুবিধা ও বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী নিজেদের নাম-পদবি ও স্থানের নাম বিকৃত করে ইংরেজের বশংবদতা অর্জনের চেষ্টার সূচনা। সাহেবেরা বাংলা নাম সহজেই বিনা শ্রমে উচ্চারণ করতে পারবেন বলে ঠাকুর হলো টেগোর, মিত্র মিটার, বসু বোস বা ভোস, চক্রবর্তী চেকোবারটি, বসাক বাইসেক। ইংরেজি শেখায় পিছিয়ে পড়া মুসলমান কিন্তু এই নামবদলের নামাবলি গায়ে চড়ায়নি। মতিন মার্টিন হয়নি, খানও কান বা কাওন হয়নি, হারিস হ্যারিছ বা কাদেরকে ক্যাডার হতে হয়নি।
বাঙালিরা তত দিনে বুঝে গেছে যে ইংরেজরা এ দেশের ভবিষ্যৎ, এ দেশের নতুন নবাব। সুতরাং ইংরেজের সহচর হিসেবে আত্মপ্রকাশ লাভের প্রচেষ্টা শিক্ষিত বাঙালির শ্রেয় বলে মনে হলো। ইংরেজি ভাষা এই নতুন প্রভুর বোধনের নতুন মন্ত্র। মন্ত্রটি আয়ত্ত করে ইংরেজের সহায়ক হলে অচিরেই হাতে আসবে জাগতিক উন্নতির চাবি। ইংরেজি শিক্ষিত এই নতুন সম্প্রদায় ইতিমধ্যেই যারা খেমটা-খেওড় আর বাইজিবিন্যাস থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে, পূর্বপ্রজন্মের অনুসারিত ‘পাশা-পায়রা-পর-দার পোষাকের’ আকর্ষণ থেকেও মুক্ত তারা। ইংরেজি ভাষা-সাহিত্য ও পাশ্চাত্যের আলোকে তারা তখন আবিষ্ট। আপ্লুত (তারা এই নতুন আলোকের স্রোতে) ইংরেজির হাত ধরে পাশ্চাত্যের সঙ্গে পরিচয়ের ছাপ সুস্পষ্ট তাদের চলনেবলনে, পোশাকে এবং ধ্যান-ধারণায়। আচার-আচরণে অনেকেরই তখন সাহেব সাজার প্রাণান্তকর চেষ্টা। দেশীয় ভাষা, দেশীয় কৃষ্টি—সবকিছুর প্রতি এই নব্যশিক্ষিতদের প্রবল বিতৃষ্ণা। এমনি এক টালমাটাল সময়ই শোনা গিয়েছিল অ্যালবিয়নস ডিসটেন্স শোর-এর জন্য মাইকেল মধুসূদনের দীর্ঘশ্বাস।
তখনকার ইংরেজি জানা সাহেব-ভজা বাবু বাংলা বই ছুঁয়েও দেখে না, কারণ তার চোখে ‘বাংলা বই অশ্লীল। সাহেবের কাছে এসবের দর নেই।’ শিক্ষিত বাবুর মহামূল্য মন্তব্য ‘বাঙ্গলা-ফাঙ্গলা ওসব বাজে লোকে লেখে আর ছোটলোকে পড়ে’ (বাঙ্গলা সাহিত্যের আদব, বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)। সাহেবের কাছে যার দর নেই, শিক্ষিত বাঙালির কাছে তার কদরও নেই।
বাঙালির সাহেব-ভজনার প্রকৃত উদ্দেশ্য নিয়ে বঙ্কিমের পরিহাসের শেষ নেই। তাঁর শাণিত বিদ্রূপের লক্ষ্য সেই সব বাঙালি, যাদের সব সংস্কারমূলক উদ্যোগ, সব জনহিতকর কাজের উদ্দেশ্য ইংরেজের হাত থেকে খেলাত, টাইটেল, সামাজিক প্রতিপত্তি ও জাগতিক সুবিধাদি হাতিয়ে নেওয়া। বঙ্কিম তাঁর ‘ইংরেজ স্তোত্র’-এ শিক্ষিত বাঙালির এই মনোবৃত্তিকে ফুটিয়ে তুলেছেন ব্যঙ্গের তীব্র কশাঘাতে। ইংরেজ প্রভুর চরণে নিবেদিত এই মজার স্তোত্রটিতে বঙ্কিম শিক্ষিত বাঙালির ইংরেজভক্তির দৃষ্টান্ত বাবুর মুখ দিয়ে কবুল করিয়েছেন এমনি ভাষায়, ‘আমি যাহা কিছু করি তোমাকে ভুলাইবার জন্য। তুমি দাতা বলিবে বলিয়া দান করি। তুমি বিদ্বান বলিবে বলিয়া লেখাপড়া করি। আমি তোমাকে প্রণাম করি।’ ইংরেজ প্রভুকে খুশি করার জন্য তাঁর প্রতিশ্রুতির বন্যা বিশেষ লক্ষণীয়। ‘আমি তোমার ইচ্ছামতো ডিসপেনসারি করিব। তোমার প্রীতার্থে স্কুল করিব। তোমার আজ্ঞামত চাঁদা দিব। আমার প্রতি প্রসন্ন হও।’ স্তুতির মধ্যে মিশে রয়েছে আরও। অঙ্গীকার, আরও আনুগত্য। ‘যাহা তোমার অভিমত তাহাই করিব। বাবু নাম ঘুচাইয়া মিস্টার লিখিব...মাতৃভাষা ভুলিব, তোমার ভাষায় কথা কহিব। আমাকে চরণে রাখিও।’
বিনিময়ে বাবু কী কী চেয়েছিল তার ফিরিস্তি শোনা যাক। ‘আমাকে বড় চাকরি দাও, রাজা কর, রায়বাহাদুর কর, কৌন্সিলের মেম্বার কর। যদি তাহা না দাও, তবে ডিনার এই হোম-এ নিমন্ত্রণ কর। সেনেটর মেম্বার কর, জুরিস্ট কর, অনারারী ম্যাজিস্ট্রেট কর। আমার স্পিচ শুন, আমায় বাহবা দাও—আমি তাহা হইলে সমগ্র হিন্দু সমাজের নিন্দা গ্রাহ্য করিব না। আমাকে মনে রাখিও।’
ইংরেজ খেতাব, টাইটেল ইত্যাদি বিলিয়ে এসব প্রভুভক্ত বাঙালিকে ঠিকই মনে রেখেছিল—অবশ্যই নিজের স্বার্থে।
সময়ে শিক্ষিত বাঙালির আরও একটি বোধোদয় হয়েছিল। ধন ও বিত্তের মধ্যে ইংরেজি জ্ঞানও একটি মূলধন, যার প্রয়োগে সাহেবদের তুষ্টি ও নিজের জাগতিক লাভ দুটিই সম্ভব। তবে এই মূলধনটির প্রয়োগে মাঝেমধ্যেই লজ্জাকর বাড়াবাড়ি হয়ে যেত, বিশেষ করে, অফিস-আদালতে বা জেলা জজদের এজলাসে। ইংরেজি দক্ষতা দেখাতে গিয়ে অনেক সহজ কথাকে অতিসহজেই দুর্বোধ্য করে তুলত। একবার এক ইংরেজি পাস করা উকিল একটি রইট অব ওয়ের মামলা হাতে নিয়েছেন। ইংরেজ জজকে তিনি বলতে চাইলেন, যে পথ নিয়ে বিবাদ হচ্ছে, সে পথে সর্বদাই সবার বিনা বাধায় যাতায়াত ছিল। এই মোদ্দাকথাটি বোঝাতে গিয়ে তিনি বারবার বলে চললেন, ‘ইট ইজ এ কেস অব প্রমিসিয়াস ওয়াটার কোর্স, মাই লর্ড।’ জজ সাহেব নাকি উকিলের দিকে তাকিয়ে বলেছিলেন, ‘ইউ আর এ বর্ন ইডিয়ট, বাবু।’
বঙ্কিমসহ অনেকেই এদের নিয়ে রসিকতার চূড়ান্ত করেছেন। আবার আধুনিক গবেষকদের অনেকে এদের ইংল্যান্ডের মানসসন্তান বলেছেন, যারা শেষ পর্যন্ত জনবিচ্ছিন্ন হয়ে হারিয়ে গেছে। তবে সবচেয়ে যথার্থ আখ্যা রেখেছেন অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। তিনি এদের বলেছেন ‘ইংরেজমুখো’। শব্দটি তিনি রামমোহনকে মূল্যায়ন করার প্রসঙ্গে ব্যবহার করেন। বিলেতে পার্লামেন্টারি সিলেক্ট কমিটিতে নমস্য রামমোহন দেশীয় রায়তদের দুর্দশার কথা বলেছেন ঠিকই, কিন্তু একই নিঃশ্বাসে ইংরেজ পুঁজি কেন আরও বেশি করে আসছে না এ দেশে এবং এই পুঁজির হাত ধরে ইংরেজ স্বয়ং কেন এ দেশে বসবাস করছে না—এই নিয়ে আক্ষেপ করেছিলেন। তাঁর এই মনোভাব সে সময় কলোনাইজেশন থিওরি নামে অপযশ কুড়িয়েছিল। অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী এ প্রসঙ্গে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন, ‘রামমোহন বরাবরই ইংরেজমুখো।’ সবাই জানেন, রামমোহন ও দ্বারকানাথ ঠাকুর উভয়ই নীল চাষ ও লবণ আমদানির পক্ষে ছিলেন।
শুধু রামমোহন-দ্বারকানাথ ঠাকুরই নন, পরবর্তীকালের অনেক উচ্চশিক্ষিত বাঙালিও যাদের ‘ইংল্যান্ডের মানসসন্তান’ বলা হয়েছে, তারা বিলেতের কাছে তাদের ঋণ শোধ করার চেষ্টায় কখনো দ্বিধান্বিত হয়নি। উনিশ শতকের প্রায় গোটা সময় ধরেই তাদের এই প্রবণতা লক্ষ করা গেছে। অনেক দৃষ্টান্তই এখানে হাজির করা যেতে পারে। কালিপ্রসন্ন সিংহ তাঁর মহাভারতখানা মহারানি ভিক্টোরিয়ার পাদপদ্মে উৎসর্গ করেছিলেন। দীনবন্ধু মিত্র নীলদর্পণ-এ নীলকর সাহেবদের অত্যাচারের ভয়াবহ চিত্র এঁকেছিলেন ঠিকই, কিন্তু এই বইয়ের ভূমিকায় ভিক্টোরিয়া এবং কয়েকজন ইংরেজ সিভিলিয়ানের ন্যায়নিষ্ঠার ওপর আস্থা করে ব্রিটিশ সুশাসন সম্পর্কে নিশ্চিত হতে চেয়েছেন, কেশবচন্দ্র সেন ভিক্টোরিয়াকে ‘মা’ বলে সম্বোধন করে আত্মপ্রসাদ লাভ করেছেন। একজন দেশপ্রেমিকের কর্তব্য কী হওয়া উচিত, তা বলতে গিয়ে রমেশচন্দ্র দত্ত লিখেছেন, দেশপ্রেমিককে ‘সংগ্রাম’ করতে হবে দেশের স্বার্থরক্ষার জন্য, কিন্তু পাশাপাশি তাঁকে ব্রিটিশ শাসনের স্থায়িত্বের জন্য সচেষ্ট হতে হবে। এ ধরনের ‘উৎকেন্দ্রিক’ মনোভাবের জন্য তাঁরা সমসময়েই কঠোর সমালোচনার মুখে পড়েছিলেন। ‘ইংরেজমুখো’ এসব কৃতী ব্যক্তি বিলেতের সমাজেও আদৃত হননি, দেশীয় সমাজেও পুরোপুরি মিশে যেতে পারেননি। ইংরেজদের কাছ থেকেও জীবনভর তাঁদের শুনতে হয়েছিল ‘ব্লাকি’, ‘নেটিভ’—এহেন ঘৃণাসূচক সম্বোধন। সে সময়ের অনেক ছোটখাটো জমিদারকেও দেখা গেছে ইংরেজ সিভিলিয়ানদের স্মৃতিরক্ষার জন্য মর্মরমূর্তি স্থাপনে প্রবল আগ্রহী, অথচ বিদ্যাসাগরের মতো মহাপুরুষের স্মৃতিরক্ষায় নির্বিকার, নিষ্ক্রিয়।
সে সময় বাঙালি সমাজে এই স্রোতের বিপরীতে কেউ কি ছিলেন না? অবশ্যই অনেকে ছিলেন। তবে বিদ্যাসাগরের নামই প্রথম মনে পড়ে, যিনি ছিলেন হিমালয়ের মতো অটল, যিনি কখনো ইংরেজ তোষণে লিপ্ত হননি। সে সময়ের আরেক ব্যতিক্রম স্বামী বিবেকানন্দ। ১৮৯৯ সালে মেরি হেলকে লেখা এক চিঠিতে বিবেকানন্দ ভারতে ব্রিটিশ শাসনের নগ্ন ছবি তুলে ধরেছেন। সেখানে দেশীয়রা অর্থনৈতিকভাবে শোষিত, নিরস্ত্রীকৃত, শিক্ষা বিস্তারের চেষ্টা নেই, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা অপহূত, যেটুকু স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হয়েছিল তা কেড়ে নেওয়া হয়েছে। সামান্য সমালোচনার জন্যও দেওয়া হয় দ্বীপান্তর বা কারাবাস। বিবেকানন্দের মতে, ইংরেজ শাসন তিনটি ‘ব’-এর সমাহার, ‘বাইবেল, বেয়নেট ও ব্র্যান্ডি...’।
অনেক গবেষকের ধারণা, সে সময়ের বাঙালি শিক্ষিত সমাজ সম্ভবত একটা দোটানায় ভুগত। শিক্ষিত বাঙালি সমগ্র ভারতের মধ্যে প্রথম জাতীয়তাবাদ, মানবতাবাদ, ব্যক্তিস্বাতন্ত্র্য দেশভক্তি—এককথায় আধুনিকতা যা ইংরেজ শাসনের অবদান—বিশ্লেষণ ও প্রচার করতে এগিয়ে এসেছিলেন, আবার ইংরেজের শ্রেষ্ঠত্ব, তার শক্তি ও জ্ঞানের প্রতি মুগ্ধতারও অন্ত ছিল না। ইংরেজ শাসন বিধাতার আশীর্বাদ—এহেন বিশ্বাসে আকণ্ঠ ডুবে ছিলেন অধিকাংশ শিক্ষিত বাঙালি। অবশ্য এই টানাপোড়েনের মধ্যেই আগামী দিনের জন্য প্রস্তুত হয়েছিল বাঙালি মধ্যবিত্ত শ্রেণী।
ঠাকুর পরিবারে দুই শাখা—পাথুরিয়া ঘাটা এবং জোড়াসাঁকো—দৃষ্টান্তের মধ্যে বাঙালি ভদ্রলোকের দ্বিধাবিভক্ত মনোভাব ধরা পড়েছে। পাথুরিয়া ঘাটার ঠাকুর পরিবারের প্রধান রাজা সৌরীন্দ্রমোহন ঠাকুর ভিক্টোরিয়ার ভারতসম্রাজ্ঞী উপাধি গ্রহণের উৎসব উপলক্ষে তাঁর নিজের বাড়িতে মহারানির জয়ধ্বনি করেছিলেন:
‘জয় জয় জয় রাজ-রাজেশ্বরীর জয়
আজি রে এ বঙ্গরাজ্যে অতুল আনন্দময়।’
ঠিক এক মাস পর এই উৎসবের রেশ ধরে জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে তাঁর এক তরুণ আত্মীয় গাইলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন সুর, ভিন্ন তাল বা সৌরীন্দ্রমোহনের সুরেরই যেন প্রতিবাদ। সেই তরুণ গেয়েছিলেন:
‘আর যে গায় গান আমরা গাব না
আমরা গাব না হর্ষ গান,
এসো গো আমরা যে কজন আছি
আমরা ধরিব আরেক তান।’
এই তরুণই ভাবী বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
ইংরেজের প্রতি বাঙালির আস্থা ও ভক্তি ১৮৫৭ সালেও চিড় খায়নি। কিন্তু বঙ্গভঙ্গ ও স্বদেশি আন্দোলনের অভিঘাতে সেই আস্থা ও ভক্তিতে ধরে বিশাল ফাটল। ইংরেজভক্ত সাহেব-ভজা বাঙালি এবার হাতে অস্ত্র তুলে নেয় তার প্রভুর অত্যাচারের বিরুদ্ধে।

২টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

আজ রমনায় ঘুড়ির 'কৃষ্ণচূড়া আড্ডা'

লিখেছেন নীলসাধু, ১৮ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১২:২৬




আজ বিকাল ৪টার পর হতে আমরা ঘুড়ি রা আছি রমনায়, ঢাকা ক্লাবের পর যে রমনার গেট সেটা দিয়ে প্রবেশ করলেই আমাদের পাওয়া যাবে।
নিমন্ত্রণ রইলো সবার।
এলে দেখা... ...বাকিটুকু পড়ুন

আকুতি

লিখেছেন অধীতি, ১৮ ই মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৩০

দেবোলীনা!
হাত রাখো হাতে।
আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে বিষাদ নেমে আসুক।
ঝড়াপাতার গন্ধে বসন্ত পাখি ডেকে উঠুক।
বিকেলের কমলা রঙের রোদ তুলে নাও আঁচল জুড়ে।
সন্ধেবেলা শুকতারার সাথে কথা বলো,
অকৃত্রিম আলোয় মেশাও দেহ,
উষ্ণতা ছড়াও কোমল শরীরে,
বহুদিন... ...বাকিটুকু পড়ুন

ক- এর নুডুলস

লিখেছেন করুণাধারা, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৮:৫২



অনেকেই জানেন, তবু ক এর গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম, কারণ আমার আজকের পোস্ট পুরোটাই ক বিষয়ক।


একজন পরীক্ষক এসএসসি পরীক্ষার অংক খাতা দেখতে গিয়ে একটা মোটাসোটা খাতা পেলেন । খুলে দেখলেন,... ...বাকিটুকু পড়ুন

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???

লিখেছেন স্বপ্নের শঙ্খচিল, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ৯:০২

কারবারটা যেমন তেমন : ব্যাপারটা হইলো কি ???



আপনারা যারা আখাউড়ার কাছাকাছি বসবাস করে থাকেন
তবে এই কথাটা শুনেও থাকতে পারেন ।
আজকে তেমন একটি বাস্তব ঘটনা বলব !
আমরা সবাই... ...বাকিটুকু পড়ুন

স্প্রিং মোল্লার কোরআন পাঠ : সূরা নং - ২ : আল-বাকারা : আয়াত নং - ১

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৮ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:১৬

বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম
আল্লাহর নামের সাথে যিনি একমাত্র দাতা একমাত্র দয়ালু

২-১ : আলিফ-লাম-মীম


আল-বাকারা (গাভী) সূরাটি কোরআনের দ্বিতীয় এবং বৃহত্তম সূরা। সূরাটি শুরু হয়েছে আলিফ, লাম, মীম হরফ তিনটি দিয়ে।
... ...বাকিটুকু পড়ুন

×