ভালো থাক আমার দেখা সেই মেয়েটি যে আমাকে সারা জীবন এগিয়ে যাবার প্রেরণা দিয়েছে,শিখিয়েছে অবরুদ্ধ দুয়ারে বন্ধী থেকেও মুক্তির আঘ্রাণ নিতে।গল্প সিনেমায় কত সংগ্রামী মেয়ে দেখেছি কিন্তু আমার বাস্তব ছুয়ে দেখা সে ছিলো একমাত্র সংগ্রামী মেয়ে।যে নিয়তির কাছে কখনই হার মানতে শেখেনি।
মেয়েটির নাম নদী(মেয়েটির প্রকৃত নামও একটি নদীর নাম)।আমার দেখা প্রথম আত্মসংগ্রামী এক মেয়ে।নদী নদীর মতই কেবল ধাবিত হতে চেয়েছে, নিজের গতিতে সকল বাধা উপেক্ষা করে।
ছোটবেলায় ফাইনাল পরীক্ষা হয়ে গেলেই আমরা ছুট লাগাতাম গ্রামের বাড়ীর দিকে।আমি তখন ক্লাশ টূ বা থ্রীতে পড়ি।তখনই প্রথম দেখেছিলাম তাকে।বড়সর ঢ্যাঙ্গা একটা মেয়ে হাতে কয়েক খানা বই নিয়ে এসেছে আমার এক খালার কাছে পড়তে।আকর্ষণ করার মত কিছুই ছিলনা তার মধ্যে।তারপরও অবাক হয়ে দেখেছিলাম তাকে পড়ন্ত বিকেলে খেলা বাদ দিয়ে তাকে বই নিয়ে পড়তে দেখে।সেদিনই শুনেছিলাম মা বাবা স্কুলে যেতে দিতে চায়না তাকে অভাবের কারণে।অথচ পড়বে বলে সেই মেয়ে নাকি হাস মুরগী পালে,ছাগল পালে।আর সেগুলো বিক্রির টাকা দিয়েই পড়ালেখার খরচ চালায়।আমার অতটুকু মাথা সংসারের হিসাব নিকাশ সেদিন কিছুই বুঝতে পারেনাই।তবে এতটুকু ঠিক বুঝেছিলাম মেয়েটির পড়ার শখ আছে।নইলে যেখানে আমাদেরকে জোড় করেও বই নিয়ে বসাতে পারেনা,সেখানে সে একা একা পড়তে বসে।শুনেছিলাম এভাবে নাকি সে ক্লাশ এইট পর্যন্ত পড়েছিল।
এরপর মাঝেমধ্যে গ্রামের বাড়ি গেলে ওকে কখনও দেখতাম ক্ষেতের ভিতর দিয়ে খাবার নিয়ে যাচ্ছে,কখনওবা ছাগলের রশি হাতে হেটে যাচ্ছে।পাড়ার মুরুব্বীরা তাকে কখনই সহ্য করতে পারেনাই।আর উঠতি বয়সী ছেলেছোকড়ারা নির্বিঘ্নে রসালো কথার বুলি আওড়াত ওকে দেখলেই।কিন্তু আমি দেখতাম মোটা জোড়া ভুরুর নীচে ফুসে ওঠা একজোড়া অগ্নি ফুলকি।
ঢাকায় বসেই শুনলাম নদীর বিয়ে হয়ে গেছে।পড়ালেখা না জানলেও ছেলেদের অবস্থা নাকি মোটামুটি ভালো।তবে ছেলেটা নাকি একটু বোকা ধরনের।কিন্তু সমস্যা তৈরী করে তার শ্বশুর শাশুড়ী।দুঃসময়ের কষাঘাতে জর্জরিত নদী একদিন ফিরে আসে বাবার বাড়ি।খবরদাতার কাছ থেকে নিজ থেকেই এবার জানতে চাইলাম,অতগুলো ভাইবোন তার উপর ওদের অবস্থাওতো ভালোনা তাহলে ওর জীবন এখন কাটছে কিভাবে?ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদেরকে পড়িয়ে পড়িয়ে।আমি জানতাম,ঠিক এমন কিছুই আশা করছিলাম।কারণ এতদিনে আমি ওকে চিনে নিয়েছি,হয়ত মনের একটা আলাদা কুঠুরীতে ওর জন্যে একটু জায়গাও করে নিয়েছি।
আবারও তার সাথে আমার দেখা হয়েছিলো যখন আমি অনার্সে পড়ি । কিন্তু সে দেখা না হলেই বুঝি ভালো হত,যাকে দেখে আমি নিজেকে একটু একটু করে চিন্তে শিখেছি,অন্যায়ের বিরুদ্ধে মাথা উচু করতে শিখেছি।আমার সেই পথপ্রদর্শককে সেদিন দেখেছিলাম একটি গাছের নীচে পায়ে শিকল,যেন দুরন্ত বয়ে চলা নদী নীরব স্থবির হয়ে থমকে আছে সেই গাছটির নীচে।যেখানে সমাজের চলমান ভাষা আর বিবেকেরা রাবারের ঘষায় মুছে গেছে। মাঝের দিনগুলির কথা অন্যের মুখে শুনেছি।এলাকার বিখ্যাত এক লোকের ছেলের(আমারই এক আত্মীয়) সাথে তার সম্পর্ক হয়।তাকে প্রলোভিত করে বিয়ে করবে বলে। ফসকে যায় নদী তার চলার পথ থেকে,ভুলে যায় বাস্তব আর কল্পনার মাঝের বিভেদকে।
বিচার বসে দোষীকে শাস্তি দেবার জন্যে।চার পাচ গ্রামের লোক জমায়েত হয় বিচার দেখবে বলে।পনের হাজার টাকার বাণ্ডিলে নিজেদেরকে শুদ্ধ করে নিতে চায় সমাজখ্যাত সেই বাবা মা।সমাজ মেনে নেয় সে বিচার,কিন্তু মানতে পারেনা কেবল একজন সে হল নদী।সে সবার অগোচরে তিন মাইল পথ পাড়ি দিয়ে দারস্থ হয় থানার।সুষ্ঠূ বিচারের আশায়।হায়রে অভাগা নদী।সে জানেনা এ সমাজ এ প্রশাসন সবার জন্যে না।উপর মহল থেকে থানায় ফোন আসে।নদীর নামে একটা মস্তিষ্ক বিকৃতির সার্টিফিকেট জমা পাপ ধুয়ে মুছে ঘরে ফেরে মাবাবার সোনার ছেলে।আর নদী সমাজকেই এবার জয়ী করার জন্যে উঠেপড়ে লাগে,তার ভাগ্য বাধা পড়ে এই শিকলে।
নদীর এই পরিনতি প্রথম প্রথম আমার মানতে খুব কষ্ট হত ঘুমের মধ্যে নিজের অজান্তেই চমকে উঠতাম কয়দিন।তারপর কাজের ব্যস্ততার ভীড়ে চাপা পড়ে গেল নদী নামের মেয়েটি।
প্রায় ছয় বছর পর আমার মোবাইলে কল আসে নিজেকে পরিচয় নদী নামে।আমি সাইকোলোজিতে পড়াশুনা করেছি বলে আমার কাছে জানতে চায় তার কিছু মানসিক সমস্যার সমাধান।জানালো আমাদের গ্রামের বাড়ির কারও কাছ থেকে আমার ফোন নাম্বার জোগাড় করেছে। আমি চমকে উঠি তার পরিচয়ে।একথা সেকথায় জানলাম তার নতুন জীবন যুদ্ধের গল্প।মাঝে মাঝে মাথার সমস্যাটা বাড়ে।তাছাড়া বেশ ভালোই আছে।সেলাইএর কাজ শিখেছে।তিনটা সেলাই মেশিনও কিনেছে,দু একজন কর্মচারীও কাজ করে তার সাথে।তার স্বপ্নের সাথে স্বপ্ন জোড়া লাগিয়ে পাড়ার মেয়েদের পোশাক সেলাই করে।দুর দুরান্ত থেকে মেয়েরা আসে তার স্বপ্নের ভাগীদার হতে। সে জানালো ,ভালো আছিরে বড্ড বেশি ভালো আছি।যাক না সে সুর ভেজা বাতাস হয়ে আমার কান ছুয়ে।ভালো লাগে তার আবার উঠে দাড়ানোর সাহস দেখে।
সর্বশেষ এডিট : ১৬ ই এপ্রিল, ২০১১ বিকাল ৫:২৬