somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভোরের আজানের ধ্বনি আমাকে সেই ভরসাই দিয়ে গেল

০২ রা এপ্রিল, ২০১১ রাত ২:৫১
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :


মা হ মু দু র র হ মা ন
পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতন এখন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম চেষ্টায় রিমান্ডে নিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার ব্যর্থ হলেও দ্বিতীয় বার যে তারা ব্যর্থ হবে না, সে ব্যাপারে আমি এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি। কতখানি নির্যাতন সইতে পারব, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য.....
(গতকালের পর)
আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যান অসংখ্য মানুষের ভিড় ঠেলে এগোতে চেষ্টা করছে। ভেতর থেকেই শুনতে পাচ্ছি অনেকের কণ্ঠে ‘মাহমুদ ভাই’ ডাক এবং পুলিশের মুহুর্মুহু হুইসেলের আওয়াজ। সিএমএম আদালতের সামনের রাস্তায় অপেক্ষমাণ আইনজীবী, সাংবাদিক, প্রকৌশলী এবং সাধারণ জনগণের প্রতিবাদের মুখে আমাকে কোর্টে নেয়া সম্ভব হলো না।

অবস্থা বেগতিক হয়ে ওঠায় শেষ পর্যন্ত শত শত পুলিশের প্রহরায় প্রিজন ভ্যান ঢুকে গেল কোর্ট গারদ চত্বরে। প্রায় আধঘণ্টা ধরে জ্যৈষ্ঠের প্রচণ্ড গরমে ভ্যানের মধ্যেই সেদ্ধ হচ্ছি। আশপাশের বিল্ডিং-এ ক্যামেরা হাতে সাংবাদিকরা ততক্ষণে অবস্থান নিয়েছেন। আইও আহাদ ভ্যানের তালা খুলে একজন কনস্টেবলসহ প্রবেশ করল। দু’জনার হাতে বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট এবং হেলমেট। যুগপত্ বিরক্ত এবং বিস্মিত হয়ে তার দিকে তাকাতেই পুলিশের গত্বাঁধা বুলি আউড়ে জানাল, আমার নিরাপত্তার জন্যই নাকি এই চরম অবমাননাকর আয়োজন।

যেন আমি ভয়ঙ্কর কোনো সন্ত্রাসী। হয় আমাকে মেরে ফেলা কিংবা ছিনিয়ে নেয়ার জন্যে প্রিজন ভ্যান থেকে বাইরে পা দিলেই অস্ত্র হাতে হাজার হাজার সন্ত্রাসী ঝাঁপিয়ে পড়বে! এক-এগারোর সময়ে মরহুম রাষ্ট্রপতি জিয়ার জ্যেষ্ঠ পুত্র তারেক রহমানকে এই আদালতেই হেলমেট, জ্যাকেট পরিয়ে আনার দৃশ্য মনে পড়ে গেল। জেএমবি এবং হুজির লোকজনকেও একইভাবে আদালতে হাজির করা হচ্ছে দীর্ঘদিন থেকেই।

বুঝতে অসুবিধে হলো না, মিডিয়া-সার্কাসের মাধ্যমে চরিত্রহননের চেনা কৌশল আমার ক্ষেত্রেও প্রয়োগ হতে যাচ্ছে। আমাকে পুরোপুরি চিনতে বর্তমান প্রশাসনের তখনও বাকি ছিল।
আমি বেঁকে বসলাম। আমার সাফ কথা, হেলমেট ও বুলেটপ্রুফ জ্যাকেট পরানোর আগে প্রিজন ভ্যানের ভেতরেই আমাকে গুলি করে মেরে ফেলতে হবে। আইও আবদুল আহাদ আমাকে বোঝানোর প্রাণপণ চেষ্টা করলেন। তার কাছ থেকে শুনলাম, আমার নাকি অনেক শত্রু, জ্যাকেট আর হেলমেট কেবল আমার অমূল্য প্রাণ রক্ষার জন্যই ‘সদাশয় সরকার’ বিশেষভাবে ব্যবস্থা করেছে।

আমি অটল রইলাম। দল বেঁধে আসা ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের নানারকম হুমকিতেও কাজ হলো না। আমার অনমনীয়তার কাছে শেষ পর্যন্ত গণতন্ত্রের লেবাসধারী মহাজোট সরকারের লাঠিয়াল বাহিনী পিছু হটতে বাধ্য হলো। তখনও বাইরে পুলিশের সঙ্গে আইনজীবী, সাংবাদিক, পেশাজীবীসহ প্রতিবাদী জনতার ধাক্কাধাক্কি চলছে। আরও ঘণ্টাখানিক অপেক্ষার পর অনেক কসরত

করে প্রিজন ভ্যান কোর্টের একেবারে দোরগোড়ায় নেয়া হলো। চারদিকে স্লোগান এবং শত শত পুলিশের বেষ্টনীর মধ্যে হেলমেট, জ্যাকেট ছাড়াই মাটিতে পা দিলাম। এর মধ্যেই অ্যাডভোকেট মাসুদ তালুকদার দুটো ওকালতনামায় আমার সই নিয়ে গেছেন। তখনই প্রথম বুঝেছি, সরকার নতুন একটি মামলা অন্তত দায়ের করেছে। তবে কী প্রকৃতির মামলা, সেটি আদালতের কাঠগড়ায় দাঁড়ানোর আগে টের পাইনি। অসংখ্য পুলিশ এবং জনতার ভিড় ঠেলে দুর্বল শরীরে সিঁড়ি ভাঙতে কষ্ট হলেও পিঠ সোজা রেখেই আদালতে পৌঁছে সোজা কাঠগড়ায় উঠলাম। সানাউল্লাহ মিঞা, মাসুদ তালুকদার,

খোরশেদ আলমসহ অনেক আইনজীবী আমার জন্যে দাঁড়ালেন। সরকারও তার পিপিবাহিনী প্রস্তুত করে রেখেছে। এজলাসে তিল ধারণের ঠাঁই নেই। যুক্তি-তর্ক শুরু হলো। হাসমত আলীর দায়ের করা জামিনযোগ্য, বানোয়াট মামলায় সহজেই জামিন পেয়ে গেলাম। তারপর শুরু হলো দ্বিতীয় মামলা। এই মামলায় বাদী তেজগাঁও থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা। পূর্বরাতে আমার দেশ কার্যালয় থেকে আমাকে গ্রেফতারের সময় পুলিশকে নাকি আমারই নির্দেশে কর্তব্য-কর্মে বাধা দেয়া হয়েছে। কেবল মামলা দায়ের নয়,

পুলিশ সাত দিনের রিমান্ডও প্রার্থনা করল। এবার সত্যিই ধাক্কা খেলাম। মইন ও তার মার্কিন এবং ভারতীয় প্রভুর বিরুদ্ধে কলম ধরার দিন থেকেই জেলখানায় আসার মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছি। কিন্তু বিনিয়োগ বোর্ডের সাবেক নির্বাহী চেয়ারম্যান, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের সাবেক উপদেষ্টা ও জাতীয় দৈনিকের একজন সম্পাদককে কোনো সরকার নির্যাতন করার অভিপ্রায়ে বানোয়াট মামলায় রিমান্ডে নিতে পারে—এমন চিন্তা কখনও মাথায় আসেনি। মনে পড়লো, পত্রিকার দায়িত্ব নেয়ার প্রথম দিনেই আমার দেশ-

এর সাংবাদিকদের মানবাধিকার প্রশ্নে আমার অনমনীয় অবস্থানের কথা পরিষ্কারভাবে বুঝিয়ে দিয়েছিলাম। সেই থেকে ক্রসফায়ার, রিমান্ডে নির্যাতন, গুম-খুন ইত্যাদির বিরুদ্ধে আমরা জনমত গঠনের অব্যাহত চেষ্টা চালিয়ে গেছি। গণতান্ত্রিক সরকার পদ্ধতিতে রাষ্ট্রযন্ত্র নির্যাতনের হাতিয়ারে পরিণত হবে, এটা মানতে পারিনি কোনোদিন। আজ আমিই রিমান্ডের শিকার হওয়ার দ্বারপ্রান্তে।

উপস্থিত সবাইকে কিছুটা অবাক করেই তরুণ ম্যাজিস্ট্রেট সরকারপক্ষের রিমান্ডের আবেদন খারিজ করে তিন দিনের মধ্যে জেলগেটে জিজ্ঞাসাবাদের রায় শোনানো মাত্র প্রসিকিউশনের এক আইনজীবীকে উচ্চস্বরে ম্যাজিস্ট্রেটকে রাজাকার বলে গাল দিতে শুনলাম। উভয়পক্ষের যুক্তি-তর্কের পুরোটা সময় ধরে একই ব্যক্তি আমাকে লক্ষ্য করে বিভিন্ন ধরনের খিস্তি-খেউড় ও অঙ্গভঙ্গি করে যাচ্ছিল। অনেক গালাগালের মধ্যে টাউট শব্দটা বেশ পরিষ্কার শুনতে পেয়েছিলাম। দ্বিতীয় মামলায় জামিন অবশ্য হলো না।

এক-এগারোর অবৈধ সরকারের বিরুদ্ধে কলম ধরার দিন থেকে জেলে যাওয়ার যে মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে রেখেছিলাম, আজ সেটাই ঘটতে চলেছে। থানার হাজত ইতোমধ্যে দেখা হয়েছে, এবার প্রকৃত জেল দেখতে চলেছি। রিমান্ড আটকাতে পেরে আমার পক্ষের আইনজীবী ও আদালতে উপস্থিত পেশাজীবী নেতারা এক ধরনের স্বস্তিসহ আমাকে বিদায় জানালেন। তাদের অভিব্যক্তিতে মনে হলো,

স্বল্প সময়ের জন্য আমি যেন কোথাও বেড়াতে চলেছি। এদিকে আমার মন তখন বলছে, এক দীর্ঘ এবং অনিশ্চিত ভবিষ্যতের দিকে এই যাত্রা। রিমান্ড চাওয়ার মাধ্যমে সরকারের হীন চক্রান্ত প্রকাশিত হয়েছে। পুলিশ হেফাজতে আমার নির্যাতন এখন অবশ্যম্ভাবী। প্রথম চেষ্টায় রিমান্ডে নিতে প্রতিহিংসাপরায়ণ সরকার বিফল হলেও দ্বিতীয়বার যে তারা ব্যর্থ হবে না, সে ব্যাপারে আমি এর মধ্যেই নিশ্চিত হয়ে গেছি। কতখানি নির্যাতন সইতে পারব, সেটাই একমাত্র বিবেচ্য।

হাসিমুখেই সবার কাছ থেকে বিদায় নিয়ে প্রিজন ভ্যানে উঠলাম। আজ অন্তত গত রাতের মতো গন্তব্য নিয়ে কোনো অনিশ্চয়তায় ভুগছি না। প্রকৌশল বিদ্যা অধ্যয়নকালে পুরনো ঢাকা থেকে বহুদিন নাজিমউদ্দীন রোডের জেলখানার উঁচু প্রাচীরের পাশ দিয়ে রিকশা করে বুয়েটে গেছি। সেই উঁচু প্রাচীরের ভেতরের পৃথিবীর বাসিন্দা হব আজ থেকে। ম্যাজিস্ট্রেট আমাকে তার প্রয়োজনীয় ভিসা দিয়েছেন।
জুন মাসের ২ তারিখ সন্ধ্যা সাড়ে ৭টায় আমাকে বহনকারী প্রিজন ভ্যানটি থামল কারাগারের প্রধান ফটকের গা ঘেঁষে। ব্যাগ হাতে নেমে বিশাল প্রধান ফটক পেরিয়ে ভেতরে ঢুকলাম। পেছনে পড়ে রইল আমার ৫৭ বছরের মুক্ত জীবন। ভেতরে আলো-আঁধারি।

পার হয়ে আসা দীর্ঘ সময়ের চিহ্ন কারা অফিসের চারদিকে। কোন দিকে যাব বুঝতে না পেরে থমকে দাঁড়ালাম। একজন কারারক্ষী ইশারা করল ডান দিকের গলিপথের দিকে। বেশ খানিকটা অস্বস্তি নিয়েই সেখানে একজন জেল কর্মকর্তার সামনে দাঁড়াতেই মনে হলো, তিনি আমার পরিচয় জানেন। সামনের চেয়ারে বসতে বলে সেই ডেপুটি জেলার নিজের কাজে মন দিলেন।

আধঘণ্টাখানিক পর মাথা তুলে জানালেন, আমার ডিভিশন প্রাপ্তির কোনো আদেশ নাকি তারা পাননি। কিছুটা উদ্বেগের সঙ্গেই মনে করিয়ে দিলেন পরের দু’দিন সাপ্তাহিক ছুটির দিন হওয়ায় রোববারের আগে আদালতের সেই আদেশ জেল কর্তৃপক্ষের কাছে পৌঁছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থাত্ অন্তত তিন দিন আমাকে আম-কয়েদিদের সঙ্গে কাটাতে হবে। জেল কোড অনুযায়ী সচিব পর্যায় পর্যন্ত সাবেক ও বর্তমান কর্মকর্তা এবং জাতীয় পত্রিকার সম্পাদকের ক্ষেত্রে ডিভিশন

পাওয়ার জন্যে আদালতের নির্দেশের প্রয়োজন পড়ে না। এটা প্রটোকল অনুযায়ী তাদের প্রাপ্যের মধ্যেই পড়ে। জেল কোডের প্রশ্ন তুলতেই ভদ্রলোক অসহায়ত্ব প্রকাশ করে জানালেন, কোর্টের আদেশ ছাড়া আমাকে ডিভিশন দেয়া হলে তার বিপদে পড়ার সমূহ আশঙ্কা। চাকরি তো যাবেই, তার সঙ্গে উপরি হিসেবে আনুষঙ্গিক বিপদ। তাকে আশ্বস্ত করে জানালাম, সাধারণ কয়েদিদের সঙ্গে থাকতে আমার কোনো অসুবিধা হবে না। এবার একটু বিব্রত হয়েই তিনি জানতে চাইলেন, আমি শুকনো খাবার,

বোতলের পানি ইত্যাদি সঙ্গে এনেছি কিনা। নেতিবাচক জবাব শুনে খানিকটা বিরক্ত হয়েই বললেন, মুশকিলে ফেললেন; এত রাতে খাবেন কী? এক রাত উপোস করতে কিংবা পিপাসার্ত থাকতে আপত্তি নেই শুনে আমার মস্তিষ্কের সুস্থতা সম্পর্কে তার বোধহয় কিছুটা সন্দেহ হলো। খানিকটা চুপ থেকে আড়ষ্টভাবে জিজ্ঞাসা করলেন, তিনি যদি আমাকে এক প্যাকেট বিস্কুট এবং এক বোতল পানি দেন, আমি গ্রহণ করব কিনা। কোনো কথা না বলে কৃতজ্ঞচিত্তে কেবল ঘাড় নাড়িয়ে সম্মতি জানাতে

পেরেছিলাম। আমাদের আলাপচারিতার মাঝখানেই হৃষ্টপুষ্ট ও অতিশয় উদ্ধত এক কারারক্ষী উপস্থিত হয়ে প্রচণ্ড রুক্ষভাবে সঙ্গের ব্যাগে কী আছে জানতে চাইলে বৃথা বাক্যব্যয় না করে ব্যাগটি তার দিকে এগিয়ে দিলাম। ব্যাগের সব বস্তু মাটিতে নিক্ষেপ করা হলো। আপত্তিকর কিছু না পেয়ে লোকটির বিরক্তির পারদ কয়েকগুণ চড়ে গেল। এরপর আমার পরিধেয় বস্ত্র এবং আবৃত শরীর

তার মনোযোগের বস্তুতে পরিণত হলো। অন্তর্বাসের ভেতরে লুকিয়ে মোবাইল ফোন এনেছি কিনা, জিজ্ঞাসা করেই অশালীনভাবে আমার ওপর-নিচ পরীক্ষা করা হলো। আল্লাহর কাছে তখন শুধু সবর করার শক্তি চাচ্ছি। ব্যাগের দ্রব্যাদি অবহেলায় মাটিতে ফেলে রেখেই কারারক্ষী চলে গেলে নিজেই সবকিছু কুড়িয়ে আবার ব্যাগে ভরলাম। জেল কর্মকর্তাটি লজ্জিত মুখে কেবল বলতে পারলেন, আপনার জায়গায় অন্য কেউ থাকলে আজ হয়তো এখানে একটা চরম অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটে যেত।

আমি যথাসম্ভব নির্বিকারভাবে বললাম, যতদূর জানি ডিভিশনপ্রাপ্ত আসামির শরীর স্পর্শ করতে পারেন কেবল জেলার নিজে। একজন কারারক্ষী আপনার সামনে এই আচরণের স্পর্ধা কেমন করে পেল? এই প্রসঙ্গে আর কথা না বাড়িয়ে ভদ্রলোক অপর একজন রক্ষীকে ডেকে আমাকে আমদানিতে নিয়ে যেতে বললেন। ব্যাগ হাতে যন্ত্রচালিতের মতো উঠে দাঁড়ালাম। দ্বিতীয় একটি বিশাল দরজা পেরিয়ে এবার কারাগারের মূল অংশে প্রবেশ করলাম। রাত তখন ৯টার কাছাকাছি।

দু’দিনের ধকল এবং খানিক আগের অপমানে জেলের চারপাশ দেখার উত্সাহ তখন শূন্যে। কোনো কথা না বলে রোবটের মতো সঙ্গের রক্ষীটিকে অনুসরণ করে আমদানিতে পৌঁছানোর আগেই মুষলধারে বৃষ্টি নামল। মনে করলাম সৃষ্টিকর্তা বোধহয় সব গ্লানি ধুয়ে দেয়ার জন্যই তার রহমতের দ্বার আমার জন্য খুলে দিলেন। আল্লাহ্র কাছে শোকর জানিয়ে বৃষ্টিতে ভিজতে লাগলাম। আমদানিতে পৌঁছে দেখলাম, বেশ দীর্ঘ টানা একটি একতলা বিল্ডিং।

সেখানকার প্রথম ঘরটি সুবেদারদের অফিস কক্ষ। বড় জেলগুলোয় দু’জন সুবেদার সচরাচর দায়িত্বে থাকেন। সুবেদার ফয়েজ এবং সুবেদার ফজলু দু’জনই উপস্থিত ছিলেন। জেলের প্রধান অফিসে যে ব্যবহার জেলে প্রবেশের পর পেয়ে এসেছি, তার তুলনায় এখানকার ব্যবহার যথেষ্ট ভদ্রজনোচিত। রাতে আমাকে যে অনাহারে থাকতে হবে, সেই সংবাদ দেখলাম এরই মধ্যে আমদানিতে পৌঁছে গেছে।

সুবেদার ফয়েজ একটি ত্রিকোণাকৃতির বড় পাউরুটি দেখিয়ে জানালেন, সেটিই জেলখানার বেকারিতে তৈরি বিখ্যাত পেজগি রুটি। সেই রুটি এবং জেলেরই কোনো এক ভাণ্ডার থেকে জোগাড় করা দুই বোতল পানি দিয়ে রাতের আহারের ব্যবস্থা হলো। বৃষ্টি একটু ধরে এলে বিশাল দুই ছাতা সঙ্গে সুবেদার ফয়েজ আমাকে নিয়ে এগোলেন ঢাকা জেলে আমার বাসস্থানের দিকে। তখনও জানি না জেল কর্তৃপক্ষ আমার জন্য কী ধরনের জায়গা বরাদ্দ দিয়েছে।

গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে কাদাপানি পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতেই শুনলাম, আমরা সাত নম্বর সেলে যাচ্ছি। এর আগে শুনেছিলাম আমার মতো হাজতিদের ডিভিশন না দেয়া হলে হাসপাতালে রাখা হয়। আমি সম্ভবত জেল কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় সেই পর্যায়ভুক্তও নই। সুবেদার ফয়েজ জানালেন, সাত নম্বর সেলের দুই নম্বর কুঠুরি হবে আমার আবাসস্থল।

সেখানে তিনজন আসামি ছিল যাদের এক ঘণ্টার নোটিশে পাশের তিন এবং চার নম্বর কুঠুরিতে স্থানান্তর করা হয়েছে আমাকে জায়গা করে দেয়ার জন্য। তাদের ব্যক্তিগত জিনিসপত্র আজ রাতের মতো আগের স্থলেই থাকবে। সুবেদার ফয়েজ আমাকে আপাতত মানিয়ে নেয়ার অনুরোধ জানালে নিঃশব্দে হাসা ছাড়া আর জবাব খুঁজে পাইনি।
সেলে পৌঁছে তালা খোলা হলে অপর্যাপ্ত আলোর মধ্যেই ভেতরে ঢুকে হাতের ব্যাগটি রাখলাম। সুবেদারকে আগেই গোসলের ব্যবস্থার অনুরোধ করেছিলাম। সেলের বারান্দার ঠিক নিচেই ড্রামে পানি তোলা ছিল। সেখানে দাঁড়িয়ে ঠাণ্ডা পানিতে গোসল সেরে রাতের মতো নিজের সেলে ঢুকলাম।

বাইরে থেকে প্রহরী তালা লাগিয়ে দিল। অর্থাত্ জেলের পরিভাষায় আমার লক-আপ সম্পন্ন হলো। পেজগি রুটির একাংশ ছিঁড়ে রাতের আহারের পাট সাঙ্গ করলাম। অন্য আসামির ব্যবহার করা মাটিতে বালিশ ছাড়া কম্বলের বিছানায় পরিশ্রান্ত শরীর এলিয়ে দিতেই অনুভব করলাম, জেলজীবন সত্যিই শুরু হলো। স্ত্রীকে কতদিন রসিকতা করে বলেছি, অনেক কিছু দেখা হলেও জেলখানাটা এখনও দেখা হয়নি।

প্রতিবারই রাগতকণ্ঠে পারভীন (স্ত্রীর ডাক নাম) বলতো, বাজে কথা বলো না তো, আল্লাহ কখন কোন কথা কবুল করেন, কে জানে! শুয়ে তো পড়লাম, কিন্তু নিদ্রাদেবী অধরা। সেই শৈশব থেকে ফেলে আসা জীবনের কত কথা মনে হতে লাগল। কোথায় যেন পড়েছিলাম, স্মৃতি সততই দুঃখের।

দুঃখ তো দুঃখই। কিন্তু সুখের কথা মনে হলেও যে চোখ ভিজে আসে, সেই নতুন অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করলাম অন্ধকার সেলের নোংরা মেঝেতে শুয়ে। কখন ঘুমিয়েছি জানি না। তবে ঘুম ভাঙল আজানের সুমধুর আওয়াজে। বিগত প্রায় কুড়ি বছর ধরে গুলশানে থাকি। সেখানে কষ্ট করে, কান পেতে আজানের শব্দ শুনতে হয়।
পুরনো ঢাকার চিত্র একেবারে আলাদা।

চকবাজারের চারপাশের মসজিদগুলো থেকে আজানের সুরেলা ধ্বনি ভেসে আসছে। হঠাত্ মনে হলো যেন শৈশবে ফিরে গেছি। গেণ্ডারিয়ায় ধূপখোলা মাঠের পাশে থাকতাম।

ওখানকার এক মসজিদের মুয়াজ্জিনের অসাধারণ সুরেলা কণ্ঠ ছিল। মাঝে মাঝে আমার নানা ভোরবেলায় ঘুম ভাঙিয়ে দিতেন সেই আজান শোনার জন্য। ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে প্রথম রাত কাটানোর পর মনে হলো, আমি যে এখনও আল্লাহর রহমতবঞ্চিত হইনি, ভোরের আজানের ধ্বনি আমাকে সেই ভরসাই দিয়ে গেল।
৩টি মন্তব্য ০টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কথাটা খুব দরকারী

লিখেছেন বাকপ্রবাস, ৩১ শে মে, ২০২৪ সকাল ৯:৩৪

কথাটা খুব দরকারী
কিনতে গিয়ে তরকারি
লোকটা ছিল সরকারি
বলল থাক দর ভারী।

টাকায় কিনে ডলার
ধরলে চেপে কলার
থাকে কিছু বলার?
স্বর থাকেনা গলার।

ধলা কালা দু'ভাই
ছিল তারা দুবাই
বলল চল ঘানা যাই
চাইলে মন, মানা নাই।

যে কথাটা... ...বাকিটুকু পড়ুন

অতিরিক্ত বা অতি কম দুটোই সন্দেহের কারণ

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৩:৩০

অনেক দিন গল্প করা হয়না। চলুন আজকে হালকা মেজাজের গল্প করি। সিরিয়াসলি নেয়ার কিছু নেই৷ জোসেফ স্টালিনের গল্প দিয়ে শুরু করা যাক। তিনি দীর্ঘ ২৯ বছর সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রধান নেতা ছিলেন। বলা... ...বাকিটুকু পড়ুন

শাহ সাহেবের ডায়রি ।। সীমানা পিলার

লিখেছেন শাহ আজিজ, ৩১ শে মে, ২০২৪ বিকাল ৪:৫৮



বৃটিশ কর্তৃক এদেশে ম্যাগনেটিক পিলার স্থাপনের রহস্য।
ম্যাগনেটিক পিলার নিয়ে অনেক গুজব ও জনশ্রুতি আছে, এই প্রাচীন ‘ম্যাগনেটিক পিলার' স্থাপন নিয়ে। কেউ কেউ এটিকে প্রাচীন মূল্যবান ‘ম্যাগনেটিক’ পিলার... ...বাকিটুকু পড়ুন

মাথায় চাপা ভূত ভূত ভূতং এর দিনগুলি

লিখেছেন শায়মা, ৩১ শে মে, ২০২৪ সন্ধ্যা ৬:৫৫


এই যে চারিদিকে এত শত কাজ কর্ম, ঝামেলা ঝক্কি, ক্লান্তি শ্রান্তি সব টপকে আমার মাথায় আজও চাপে নানান রকম ভূত। এক ভূত না নামতেই আরেক ভূত। ভূতেদের... ...বাকিটুকু পড়ুন

নিজের পাসওয়ার্ড অন্যকে দিবেন না ;)

লিখেছেন অপু তানভীর, ৩১ শে মে, ২০২৪ রাত ৮:৫৭



কথায় আছে যে পাসওয়ার্ড এবং জাঙ্গিয়া অন্যকে দিতে নেই । মানুষ হিসাবে, বন্ধু হিসাবে প্রেমিক/প্রেমিকা হিসাবে অথবা আজ্ঞাবহ হওয়ার সুবাদে আমরা অন্যকে ব্যবহার করতে দিই বা দিতে বাধ্য হই।... ...বাকিটুকু পড়ুন

×