somewhere in... blog
x
ফোনেটিক ইউনিজয় বিজয়

ভয়ংকর ঠগী (তৃতীয় পর্ব)

৩১ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ১২:৪২
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
প্রথম পর্ব

দ্বীতিয় পর্ব



ঠগীদের ছিল নিজস্ব ভাষা

বিভিন্ন এলাকায় ঠগিদের ছিল বিভিন্ন নাম। যেমন, জলের ঠগিদের নাম পাঙ্গু, নদী-নালার ঠগিদের নাম আবার ভাগিনা। কোথাও কোথাও এদের নাম ছিল,‘আরিতুলুকর’, কোথাও ‘তন্তাকালেরু’ কোথাও ‘ফাঁসুড়ে’ ইত্যাদি। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন নাম থাকলেও এদের হত্যা করার পদ্বতি ছিল অভিন্ন। এদের মধ্যে কড়া নিয়ম ছিল কোথাও রক্তপাত করা চলবে না। ঠগিদের এলাকাও ভাগ করা থাকত। নেহায়েত দরকারে না পড়লে কেউ কারও সীমানা অতিক্রম করতো না। দরকার মতো এরা দলে সদস্যসংখ্যা কমাত কিংবা বাড়াত। শিকার ধরার সময় দরকার পড়লে পায়ে হেঁটে পাড়ি দিত শত-শত মাইল। তিন চারটি দলে ভাগ হয়ে এরা শিকার ধরতে ঝাঁপিয়ে পড়ত। যে কোনও সংগঠিত অপরাধী সমাজের মতো নিজস্ব সাংকেতিক ভাষাও ছিল ঠগীদের। তাদের ভাষার নাম ছিল ‘রামসি’। নানারকম সংকেতও ব্যবহার করতো তারা। ঠগীদের গোষ্ঠীভুক্ত না হলে এই ভাষা বা সংকেতের পাঠোদ্ধার ছিল অসম্ভব।

ঠগিদের দলের আগে আগে চলত ‘সোথা’রা। সম্ভাব্য শিকার চিহ্নিত করে প্রাথমিক পর্যায়ে ভাব জমানো ছিল তাদের কাজ। ইতিমধ্যে দলের খানিকটা পিছনে চলতে শুরু করবে ‘তিলহাই’রা। গুপ্তচর ও পুলিশের গতিবিধি নজরে রাখত তারা। ‘নিসার’ বা নিরাপদ জায়গা দেখে তাবু গাড়া হত। খাবার পর বাসন মাজার অতি স্বাভাবিক নির্দেশ। কিন্তু, ‘বিয়াল’ বা কবর তৈরি করার দায়িত্ব যার, সে জানত সময় এগিয়ে আসছে। এবার ‘ঝিরনী’ উঠবে অর্থাৎ হত্যার আদেশ আসবে। সে আদেশ হল ‘তামাকু লাও’। এক লহমায় ফাঁস জড়াবে শিকারের গলায়। ‘চামোচি’ ধরে থাকবে শিকারকে। ‘চুমোসিয়া’ তার হাত আটকে রাখবে, যাতে সে বাধা দিতে না পারে। ‘চুমিয়া’ তার পায়ে ধাক্কা দিয়ে মাটিতে ফেলে দেবে।

তারপর ‘ভোজারা’ দেহগুলোকে নিয়ে যাবে কবরে। ‘কুথাওয়া’র দায়িত্ব হল দেহগুলোর হাঁটু ভেঙে থুতনির সঙ্গে লাগিয়ে ভাঁজ করে কবরে দেওয়া। মৃতদেহ যাতে ফুলে উঠে কবর থেকে বেরিয়ে না পড়ে। সাদা কাপড়ের ফালি নিয়ে পাহারায় থাকবে ‘ফুরকদেনা’। বিপদের গন্ধ পেলে জানান দেবে এরাই। এরপর অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় জায়গাটা সাফসুতরো কওে ফেলবে ‘ফুরজানা’। এইরকম আরও কিছু ভাষার নমুনা হল, খৌর (ঠগির সাম্ভাব্য শিকার), বাজিত খান (কাজ শেষ), সোথাই (ভিনদেশী অচেনা পথিকদের বশ করা যার কাজ), তাইওয়া (পথিক দল) ইত্যাদি।

সংস্কার-কুসংস্কারের বেড়াজালে ঠগিরা

সদ্য মৃত মানুষদের কবরের ওপর বসবে ঠগীদের অমৃতের ভোজ। আসলে ভোজ আর কিছুই নয়, গুড়ের ভোজ। কিন্তু তাদের সংস্কার ছিল, ‘এ গুড় মন্ত্রপূত প্রসাদ। যে একবার খাবে, সে ঠগী হয়ে যাবে।’

ঠগীদের খুনের অস্ত্রটা ছিল অদ্ভুত। অতি সাধারণ, কিন্তু কী সাংঘাতিক কার্যকর। এক ফালি হলদে কাপড়ের টুকরো। দুই ভাঁজে ভাঁজ করলে মাত্র ৩০ ইঞ্চি। ১৮ ইঞ্চির মাথায় একটা গিট। তাতে একটা রুপোর টাকা বা তামার ডবল পয়সা বাধা। নিপুণ ঘাতকের হাতে সেটাই হয়ে উঠবে অব্যর্থ মরণ ফাঁস। আর ফাঁসের আগে সেই ফাঁদ পাতার গল্প।

বিভিন্ন ভূমিকা আর দক্ষতার ভিত্তিতে পেশাদারি শ্রম বিভাজনের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। দলের প্রত্যেক সদস্যের নির্দিষ্ট দায়িত্ব ছিল। ঠগীদের মধ্যে হিন্দু-মুসলমান-শিখ সব ধর্মের লোকই ছিল, কিন্তু সবাই তারা কালীর নামে শিকারে রেরুত। তারা বিশ্বাস করত শিকার তারা বেছে নেয় না, শিকারকে নির্দিষ্ট করে তাদের কাছে উৎসর্গ করে পাঠিয়ে দিতেন কালী মা। তারা নিজেদের ঠগী ধর্ম পালন করত শুধু। তারা নিমিত্ত মাত্র। তাই হত্যা করার পরও তাদেও মনে কোনও পাপবোধ বা অনুসোচনা হত না। এই বিশ্বাস থেকেই শিকার ঘিরে এক বিশাল সংস্কারের কাঠামো তৈরি করেছিল ঠগীরা। কবর খোড়ার কোদাল, মৃতদেহকে কেটে ভাঁজ করার ছুরি, হলদে রুমাল সব কিছুকেই সুদীর্ঘ পদ্ধতি আর উপচারের মধ্য দিয়ে শুদ্ধ, মন্ত্রপূত করে নেওয়া হত।

শিকারও চিনিয়ে দিতেন মা। ঠগীদের শুধু সেই ইঙ্গিতগুলো জানতে হত। হঠাৎ কা কা করে কোনও কাক যদি ডাল বদল করে, বুঝতে হবে মা অনুমতি দিয়েছেন। ডাইনের ডালে ঘুঘু থাকলে বা ডাহুক চোখে পড়লে শিকার সামনেই মিলবে। দিনে শিয়াল ডাকলে সে অঞ্চল ছেড়ে দেওয়াই ভাল! আর, রাতে ঘুঘু ডাকলে তো সমূহ বিপদ। সামনে দিয়ে খরগোশ পার হলেও অযাত্রা।
সর্বশেষ এডিট : ৩১ শে মার্চ, ২০১১ দুপুর ২:১৭
৭টি মন্তব্য ৬টি উত্তর

আপনার মন্তব্য লিখুন

ছবি সংযুক্ত করতে এখানে ড্রাগ করে আনুন অথবা কম্পিউটারের নির্ধারিত স্থান থেকে সংযুক্ত করুন (সর্বোচ্চ ইমেজ সাইজঃ ১০ মেগাবাইট)
Shore O Shore A Hrosho I Dirgho I Hrosho U Dirgho U Ri E OI O OU Ka Kha Ga Gha Uma Cha Chha Ja Jha Yon To TTho Do Dho MurdhonNo TTo Tho DDo DDho No Po Fo Bo Vo Mo Ontoshto Zo Ro Lo Talobyo Sho Murdhonyo So Dontyo So Ho Zukto Kho Doye Bindu Ro Dhoye Bindu Ro Ontosthyo Yo Khondo Tto Uniswor Bisworgo Chondro Bindu A Kar E Kar O Kar Hrosho I Kar Dirgho I Kar Hrosho U Kar Dirgho U Kar Ou Kar Oi Kar Joiner Ro Fola Zo Fola Ref Ri Kar Hoshonto Doi Bo Dari SpaceBar
এই পোস্টটি শেয়ার করতে চাইলে :
আলোচিত ব্লগ

কাঁচা আম পাড়ার অভিযান

লিখেছেন মরুভূমির জলদস্যু, ১৩ ই মে, ২০২৪ রাত ১০:৩২



গাজীপুর জেলার জয়দেবপুরের বাড়ীয়া ইউনিয়নের দেউলিয়া গ্রামে আমার প্রায় ৫২ শতাংশ জমি কেনা আছে। সেখানে ছোট একটি ডোবা পুকুর, অল্প কিছু ধানের জমি আর বাকিটা উঁচু ভিটা জমি। বেশ... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমরা কেন এমন হলাম না!

লিখেছেন সায়েমুজজ্জামান, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ৯:৪১


জাপানের আইচি প্রদেশের নাগোইয়া শহর থেকে ফিরছি৷ গন্তব্য হোক্কাইদো প্রদেশের সাপ্পোরো৷ সাপ্পোরো থেকেই নাগোইয়া এসেছিলাম৷ দুইটা কারণে নাগোইয়া ভালো লেগেছিল৷ সাপ্পোরোতে তখন বিশ ফুটের বেশি পুরু বরফের ম্তুপ৷ পৃথিবীর... ...বাকিটুকু পড়ুন

অভিমানের দেয়াল

লিখেছেন মোঃ মাইদুল সরকার, ১৪ ই মে, ২০২৪ সকাল ১১:২৪




অভিমানের পাহাড় জমেছে তোমার বুকে, বলোনিতো আগে
হাসিমুখ দিয়ে যতনে লুকিয়ে রেখেছো সব বিষাদ, বুঝিনি তা
একবার যদি জানতাম তোমার অন্তরটাকে ভুল দূর হতো চোখের পলকে
দিলেনা সুযোগ, জ্বলে পুড়ে বুক, জড়িয়ে ধরেছে... ...বাকিটুকু পড়ুন

আমাদের গ্রামে মুক্তিযুদ্ধের প্রস্তুতি

লিখেছেন প্রামানিক, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ১:৩১



২৬শে মার্চের পরে গাইবান্ধা কলেজ মাঠে মুক্তিযুদ্ধের উপর ট্রেনিং শুরু হয়। আমার বড় ভাই তখন ওই কলেজের বিএসসি সেকেন্ড ইয়ারের ছাত্র ছিলেন। কলেজে থাকা অবস্থায় তিনি রোভার স্কাউটে নাম... ...বাকিটুকু পড়ুন

বিকেল বেলা লাস ভেগাস – ছবি ব্লগ ১

লিখেছেন শোভন শামস, ১৪ ই মে, ২০২৪ দুপুর ২:৪৫


তিনটার সময় হোটেল সার্কাস সার্কাসের রিসিপশনে আসলাম, ১৬ তালায় আমাদের হোটেল রুম। বিকেলে গাড়িতে করে শহর দেখতে রওয়ানা হলাম, এম জি এম হোটেলের পার্কিং এ গাড়ি রেখে হেঁটে শহরটা ঘুরে... ...বাকিটুকু পড়ুন

×